দেশাত্মবোধক সিনেমা দেখুন, ঘরে বসেই

করোনা ভাইরাসের প্রভাবে সারা পৃথিবীর মতো আমাদের দেশেও জনজীবনে নেমে এসেছে এক ধরনের স্থবিরতা। অভ্যস্ত কর্মচাঞ্চল্য নেই। ঘরে বসেই সময় কাটানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত। জরুরি কিছু ক্ষেত্র ছাড়া সব কর্মস্থলই বন্ধ। অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসার বাইরে বের হওয়া বারণ। এমন স্থবির সময়েই এলো ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস।
ঘরে বসে থেকে অনেকেই হয়তো হাঁপিয়ে ওঠেছেন। তারা এমন দিনে দেখতে পারেন দেশাত্মবোধক সিনেমা। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমাগুলো থেকে এমনই ১০টির কথা জানানো হলো এখানে। ইউটিউবসহ অনলাইন স্ট্রিমিং চ্যানেলগুলোতে সহজেই খুঁজে পাবেন সিনেমাগুলো।

জীবন থেকে নেয়া
চলচ্চিত্রকার হিসেবে কতটা দেশপ্রেমিক ও দূরদর্শী ছিলেন জহির রায়হান, তার প্রমাণ ১৯৭০ সালের ১০ এপ্রিল মুক্তি পাওয়া এই সিনেমা। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনকে সেই উত্তপ্ত সময়ে চমৎকার রূপকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। বাংলার অতি সাধারণ এক পরিবারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এর কাহিনি। কিন্তু বিচক্ষণ দর্শকমাত্রই টের পাবেন, পরিবারের সদস্যদের কেউ কেউ যেমন একদিকে মুক্তিকামী বাঙালি, আবার কেউ-বা শোষক পাকিস্তানিদের প্রতিনিধিত্ব করছে।
ছবিটিতে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক, সুচন্দা, রওশন জামিল, আনোয়ার হোসেন, খান আতাউর রহমান, শওকত আকবর, রোজী সামাদ প্রমুখ।

ওরা ১১ জন
এটি স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তি পাওয়া প্রথম চলচ্চিত্র। চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত এটি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত, স্বাধীনতাত্তোর প্রথম চলচ্চিত্রও। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বাধীনতার ডাক দেন, এই ছবির গল্পে সেই ঐতিহাসিক ভাষণের কিছু অংশ দেখানো হয়েছে।
ছবিটিতে খসরু, মুরাদ, হেলাল ও নান্টুসহ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও অভিনয় করেছেন। আরও অভিনয় করেছেন রাজ্জাক, শাবানা, নূতন, সৈয়দ হাসান ইমাম, আলতাফ, খলিলউল্লাহ খান প্রমুখ।

অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী
মুক্তিযুদ্ধের এক ভিন্ন গল্প বলে সুভাষ দত্তের এই সিনেমা। দেশ স্বাধীন করতে জীবনবাজি রেখে যেখানে লড়াইয়ে নেমেছে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষকসহ নানা বয়স ও পেশার মানুষ, সেখানে এক খ্যাতিমান অভিনেতা পাশের দেশে আশ্রয় নিয়ে কাটাচ্ছে নিরাপদ জীবন। এই নিয়ে তার ভেতর এক সময় আত্মগ্লানী জেগে ওঠে। সেটির দাম সে অন্যভাবে দেয়, এক বীরাঙ্গনার সন্তানের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে।
১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবিতে অভিনয় করেছেন আনোয়ার হোসেন, ববিতা, সুভাষ দত্ত, উজ্জ্বল, আহমদ শরীফ প্রমুখ।

ধীরে বহে মেঘনা
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের প্রথম ফিচার ফিল্ম এটি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে ভারতীয় এক পাইলট শহীদ হন। তার বাগদত্তা নারীটি কিছুটা ক্রোধ নিয়েই সদ্য স্বাধীন এ দেশে দেখতে আসেন, কী এমন আছে- যার জন্য তার স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল। ঢাকায় আত্মীয়ের বাসায় এসে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ নিজ চোখে দেখে, এ দেশের প্রেমে পড়ে যান তিনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এক ভিন্ন ধারার চিত্র ফুটে উঠেছে এই চলচ্চিত্রে।
১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্রে ববিতা, গোলাম মুস্তাফা, বুলবুল আহমেদ, আনোয়ার হোসেন, খলিল উল্লাহ খান প্রমুখ অভিনয় করেছেন।

আবার তোরা মানুষ হ
কলেজ পড়ুয়া সাত তরুণ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা উপলব্ধি করেন, জীবন আর আগের মতো নেই। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তাদের কাছে অস্ত্র রয়ে যায় । তবে সেই অস্ত্রকে তারা নেতিবাচক কাজে নয়, বরং সমাজের অন্যায় প্রতিরোধে ব্যবহারের চেষ্টা করেন। তাদের এই নতুন যুদ্ধ ঘিরে খান আতাউর রহমান পরিচালিত এই সিনেমা মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালে।
অভিনয় করেছেন খান আতাউর রহমান, রাইসুল ইসলাম আসাদ, ববিতা, ফারুক প্রমুখ।

আলোর মিছিল
নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত এই চলচ্চিত্র মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে। সদ্য স্বাধীন দেশে একটি দেশদ্রোহী চক্রের বিরুদ্ধে এক মুক্তিযোদ্ধার সংগ্রামের অনবদ্য কাহিনি এটি। পারিবারিক গল্পের ভেতর অস্থির সামাজিক প্রেক্ষাপটে, সেই মুক্তিযোদ্ধা মামাকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হারাতে হয় ভাগনিকে। তার মৃতদেহ কোলে নিয়ে, অন্য আলোর পথে পা বাড়ান মামা। দেশ থেকে অন্ধকার তাড়ানোর জ্বালান মশাল।
রাজ্জাক, ববিতা, ফারুক, সুজাতা, খলিল উল্লাহ খান, রোজী আফসারী, আনোয়ার হোসেন প্রমুখ অভিনয় করেছেন এই চলচ্চিত্রে।

আগুনের পরশমণি
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ পরিচালিত এই চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট ১৯৭১ সালের মে মাস। অবরুদ্ধ ঢাকায় নিস্তব্ধ রাতের বুক চিরে ছুটে চলা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাঁজোয়া গাড়ির বহরে তীব্র ভয়ে কাঁপছে এ দেশের মানুষ। এরইমধ্যে একটি পরিবারে এক আহত মুক্তিযোদ্ধার আগমন। তাকে বাঁচানোর লড়াই প্রতীক অর্থে দেশ বাঁচানোর লড়াইয়ে রূপ নেয়।
১৯৯৪ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমায় অভিনয় করেছেন আসাদুজ্জামান নূর, বিপাশা হায়াত, আবুল হায়াত, ডলি জহুর, দিলারা জামান, মোজাম্মেল হোসেন, সালেহ আহমেদ প্রমুখ।

নদীর নাম মধুমতী
মধুমতী নদী তীরের এক গ্রামের প্রেক্ষাপটে এই চলচ্চিত্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় চির চেনা মানুষগুলোর অচেনা হয়ে যাওয়া, শত্রু ও মিত্র- দুইভাগ হয়ে যাওয়ার কাহিনি এটি।
তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত এই সিনেমা মুক্তি পায় ১৯৯৫ সালে। অভিনয় করেছেন আলী যাকের, তৌকীর আহমেদ, রাইসুল ইসলাম আসাদ, সারা যাকের, আফসানা মিমি, আয়েশা আখতার, আবুল খায়ের, মমতাজউদ্দীন আহমেদ, রামেন্দু মজুমদার, আমিরুল হক চৌধুরী প্রমুখ।

মাটির ময়না
মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগের সময়কার একটি পরিবারের যুদ্ধ ও ধর্মের কারণে ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ার গল্প এটি। ধর্মীয় উদারতা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র এবং ধর্মের দুর্বোধ্যতা- সব মিলিয়ে জাগতিক দ্বন্দ্বের একটি দৃশ্যমান প্রতিকৃতি এখানে ফুটে উঠেছে। তারেক মাসুদ পরিচালিত এই সিনেমা মুক্তি পায় ২০০২ সালে।
অভিনয় করেছেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, নুরুল ইসলাম বাবলু, রাসেল ফরাজী, রোকেয়া প্রাচী, শোয়েব ইসলাম প্রমুখ।

জয়যাত্রা
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে একদল মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, মৃত্যু ও বেঁচে থাকার সংগ্রামের গল্প এটি। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যুদ্ধের বিভীষিকা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাণভয়ে পলায়নয়ত একদল সাধারণ মানুষ আশ্রয় নেয় এক নৌকায়। তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম এবং রুখে দাঁড়ানোর স্পৃহা নিয়ে এর কাহিনি। ২০০৪ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমা নির্মাণ করেছেন তৌকীর আহমেদ।
অভিনয় করেছেন আবুল হায়াত, তারিক আনাম খান, হুমায়ুন ফরীদি, বিপাশা হায়াত, আজিজুল হাকিম, মাহফুজ আহমেদ, সালেহ আহমেদ, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, মোশাররফ করিম প্রমুখ।

গেরিলা
নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত এই সিনেমা মুক্তি পেয়েছে ২০১১ সালে। সৈয়দ শামসুল হকের 'নিষিদ্ধ লোবান' উপন্যাস এবং গেরিলা কমান্ডার হিসেবে পরিচালকের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে এর কাহিনি। পাকিস্তানি বর্বরতা, বাঙালির প্রতিরোধ আর স্বাধীনতার দাবির এক অনবদ্য আখ্যান হয়ে আছে এটি।
অভিনয় করেছেন জয়া আহসান, ফেরদৌস, এটিএম শামসুজ্জামান, রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, আহমেদ রুবেল, শতাব্দী ওয়াদুদ, শম্পা রেজা প্রমুখ।