দুই বছর পর ঝড়ে ভেসে এলো ভৌতিক জাহাজ
আটলান্টিক মহাসাগরের জলরাশি যুগ যুগ ধরে বুকে জমিয়ে রেখেছে হাজারও রহস্য। বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এমনই এক রহস্যের নাম। ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা অনুসন্ধানী অভিযাত্রায় সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে মানুষ যুগে যুগে এই রহস্যের পাল্লা ভারীই করে। এমনই এক ঘটনার সাক্ষী হলো আয়ারল্যান্ডের এক ছোট্ট জেলেপল্লী বেলিকটন।
সম্প্রতি সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় ডেনিসের প্রভাবে খারাপ আবহাওয়ার কবলে পড়েছে ইউরোপের কিছু দেশ। গত রোববার এটি ইউরোপে আঘাত হানলে প্রথম শিকার হয় আয়ারল্যান্ড। এই ঝড়ে সৃষ্ট সমুদ্রস্রোতের প্রকোপে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে দেশটির উপকূলে ভেসে এসেছে এক ‘ভৌতিক’ জাহাজ। খবর বিবিসির।
৮০ মিটার দৈর্ঘ্যের যাত্রীহীন এই জাহাজের নাম আলটা। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে শেষবার যাত্রীহীন আলটাকে সমুদ্রে ভেসে বেড়াতে দেখেছিল ব্রিটিশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস প্রটেক্টার। এই সময় জাহাজটির ক্যাপ্টেন এক টুইট বার্তায় বলেন, ‘পরিত্যক্ত জাহাজটিকে উদ্ধারের চেষ্টা করা যেতে পারে, তবে খুব সম্ভবত আমরা নয় বরং অন্য কোনো পক্ষ এটির ভাগ্য নির্ধারণ করবে।’
আসলে হলোও তাই। রুদ্র প্রকৃতির হস্তক্ষেপে নাবিকহীন জাহাজটি উদ্দেশ্যহীন পথচলা শেষে ঝড়ের টানে এসে ভিড়ল আয়ারল্যান্ড উপকূলে। আইরিশ এক্সামিনার পত্রিকাকে বেলিকটনের স্থানীয় উদ্ধারকারী নৌযান প্রধান জন টটান বলেন, ‘এই ধরনের ঘটনা প্রতি ১০ লাখে একবার দেখা যায়। নাবিকহীন জাহাজটির সমুদ্রে এতদিন ভেসে থাকাটা আসলেই বিস্ময়কর।’
নাবিকহীন জাহাজের রহস্য
আলটা নামের এই জাহাজ ১৯৭৬ সালে তৈরি করা হয়। এরপর বহুবার এর নাম ও মালিকানা বদল হয়েছে। সর্বশেষ এটি তাঞ্জিনিয়ার পতাকাবাহী বাণিজ্য তরী ছিল। কিন্তু যে কারণে জাহাজটি আজ আইরিশ উপকূলে, তার শুরুটা কিন্তু হয়েছিল প্রায় দুই বছর আগে, ২০১৮ সালে। সে সময় নাবিকেরাই জাহাজটি পরিচালনা করছিলেন।
সর্বশেষ যাত্রায় এটি গ্রিস থেকে হাইতি যাচ্ছিল। মার্কিন উপকূলরক্ষী বাহিনী জানায়, যাত্রাপথে যুক্তরাষ্ট্রের বারমুডা উপকূল থেকে ১৩০০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে আসার পর জাহাজটির ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। নাবিকেরা অনেক চেষ্টা করেও সমস্যা উদঘাটনে ব্যর্থ হন। এরপর তারা অসহায়ের মতো সমুদ্রেই ভেসে বেড়াচ্ছিলেন। ইউএস কোস্টগার্ড এ সময় তাদের দুরাবস্থা সম্পর্কে জানতে পারে।
বিকল জাহাজে তখন অবশিষ্ট ছিল মাত্র দুই দিনের খাবার। এই অবস্থায় মার্কিন উপকূলরক্ষীরা প্রথমে হেলিকপ্টারের সাহায্যে আলটার নাবিকদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করেন।
এরপরেই দেখা দিয়েছিল আরেক বিপদ। আলটার দিকে ধেয়ে আসছিল আরেক ঘূর্ণিঝড়। এই অবস্থায় উপকূলরক্ষী বাহিনী জাহাজটিতে থাকা ১০ জনের নাবিক দলটিকে উদ্ধার করেন এবং তাদের পুয়ের্তো রিকো পৌঁছে দেন।
ওই সময় বারমুডার সমুদ্রযান চলাচল কেন্দ্রের একজন মুখপাত্র জানান, এম/ভি আলটা এখন আমাদের উপকূল থেকে দক্ষিণ-পূর্বে সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে। জাহাজটির মালিকেরা একে উদ্ধারের উদ্যোগও নিচ্ছেন।
তারপরে যা হলো
নাবিকহীন জাহাজটিকে উদ্ধারে মালিকপক্ষ হাল ছেড়ে দেয়। এরপর থেকেই সাগরে ‘প্রেত্মাতার’ মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল আলটা। এ সময় অনেক দেশের সরকার ও নানা সংস্থা আলটার উদ্দেশ্যহীন ভ্রমণ লক্ষ্য করে। এমন অবস্থাতেই ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ প্রটেক্টার তাকে খুঁজে পেয়েছিল।
পরিত্যক্ত জাহাজের দায়ভার কার?
বিবিসি নিউজকে আয়ারল্যান্ড উপকূলে উদ্ধারকাজ পরিচালনায় জড়িত সংস্থা কমিশনারস অব আইরিশ লাইটস-এর পরিচালক রবার্ট ম্যাকক্যাবে বলেন, সাধারণত কোনো জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ডুবে গেলে পূর্ব মালিকানা অনুসারেই এর স্বত্ব নির্ধারিত হয়। তার মানে উদ্ধারের অধিকার ও দায় সেটির মালিকেরই থাকে। তবে এ ধরনের জাহাজ যদি স্থানীয় নৌচলাচল এবং জলজ বাস্তুসংস্থানের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে, তাহলে সেটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের থাকে।
আলটার শেষ পরিণতি
আলটার ভাগ্য নির্ধারণ করবে কর্ক কাউন্টি কাউন্সিল, আইরিশ উপকূলরক্ষী বাহিনী এবং পরিত্যক্ত বা ডুবে যাওয়া জাহাজ উদ্ধারকারী সংস্থা। কিন্তু এখানেও আছে আরেক রহস্য। কেউ জানে না সর্বশেষ যাত্রায় আলটা কোন ধরনের পণ্য বা মালামাল বহন করছিল। জাহাজটির ভাগ্য নিয়ে আইরিশ কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত ফয়সালার পরেই সেই রহস্য উন্মোচিত হতে পারে।