দারিদ্রকে ছাপিয়ে শিক্ষা: যে স্কুলে পড়ার সুযোগ জীবনে একবারই আসে
ভারতের উত্তর প্রদেশের স্কুলশিক্ষার্থী মানু চৌহান সারাক্ষণ ভয়ে থাকত, এই বুঝি তার নোটবুকের পাতা কিংবা কলমের কালি ফুরিয়ে গেল। উত্তর প্রদেশের আক্রাবাদ গ্রামে স্কুলে পড়া অবৈতনিক হলেও, স্টেশনারি জিনিস বিনামূল্যে পাওয়া যেত না। তাই লেখাপড়ার আনুষঙ্গিক কোনো জিনিস শেষ হয়ে গেলে মানুকে তার বাবার কাছেই টাকা চাইতে হতো; যদিও মানু জানত, ইনস্যুরেন্স বিক্রি করে তার বাবা মাসে মাত্র ৩০০০ রুপি আয় করেন।
সেই মানু চৌহানের বয়স এখন ১৮ বছর। আগামী সেপ্টেম্বরেই স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পড়তে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাবেন। এর আগে পড়ালেখা করেছেন ভারতের এমন একটি রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, যে রাজ্য থেকেই এসেছেন ভারত পেয়েছে আটজন প্রধানমন্ত্রী।
উত্তর প্রদেশভিত্তিক আইটি জায়ান্ট এইচসিএল টেকনোলজিসের প্রতিষ্ঠাতা শিব নাদার নিজ প্রদেশের গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে প্রতিষ্ঠা করেন 'বিদ্যাজ্ঞান লিডারশিপ একাডেমি'।
সাত বছর আগে এই একাডেমির কঠিন ভর্তি পদ্ধতিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন মানু। এরপরেই তিনি পেয়েছেন আমেরিকার মতো দেশে পড়াশোনার সুযোগ; যা তার অঞ্চলের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর ধরাছোঁয়ার বাইরে।
মানু বলেন, 'স্কুল না থাকলে এতদিনে আমি হয়তো মা-বাবাকে সাহায্য করার জন্য গ্রামে কাজ করতাম।'
নাদার এই লিডারশিপ একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন ২০০৯ সালে। অন্যান্য রাজ্যের ভালোমানের স্কুলগুলোতে শুধুই শহুরে, ধনী ছাত্রদের ভর্তি নিতে দেখে তার মাথায় একটা স্কুল গড়ার চিন্তা আসে। কিন্তু ভারতের ৬০ শতাংশ মানুষ যেখানে প্রত্যন্ত গ্রামে থাকে, সেখানকার মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খুব কম জায়গাই বরাদ্দ ছিল।
নাদারের মেয়ে রোশনি নাদার মালহোত্রা (৩৯) এই স্কুলের চেয়ারম্যান এবং এইচসিএল কোম্পানিরও প্রধান। তিনিই ভারতের প্রথম নারী, যার পরিচালনায় একটি শীর্ষ আইটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। রোশনি জানান, তাদের লক্ষ্য হলো নারী-পুরুষ উভয়ের উন্নয়নের লক্ষ্যেই কাজ করা, যাতে তারা সমাজ ও দেশের জন্য কাজ করতে পারে।
একাডেমির স্কাউটেরা ভারতের সবচেয়ে জনবহুল এই প্রদেশের ৭৫টি জেলা থেকে শিক্ষার্থী বাছাই করেন। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হতে চাইলে পরিবারের বার্ষিক আয় অবশ্যই এক লাখ রুপির কম হতে হবে। বলা বাহুল্য, এটি অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক এক প্রক্রিয়া। প্রতি বছর আড়াই লাখের মতো আবেদন জমা পড়ে এখানে, কিন্তু ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় মাত্র ২০০ জন।
মালহোত্রা বলেন, 'উত্তর প্রদেশের একজন কৃষকের কাছে তার সন্তানদের, বিশেষত মেয়েদেরকে আবাসিক স্কুলে পাঠাতে বলা মানেই বাড়ি থেকে বিদায় হয়ে যাওয়া। তবে এখানে যারা ভর্তি হয়, তাদের মা-বাবার চিন্তাধারাই তাদেরকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে।'
উল্লেখ্য, একাডেমির ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থীই মেয়ে।
শিক্ষার্থীদের জন্য একাডেমির শুরুর কয়েক বছর কঠিন মনে হতে পারে। এর কারণ হিসেবে মালহোত্রা জানালেন, প্রায়ই তাদের সামাজিক ও যোগাযোগ দক্ষতা দুর্বল হয়ে থাকে। অনেকেরই পারিবারিক অথবা স্বাস্থ্যজনিত নানা সমস্যা থাকে।
মালহোত্রা বলেন, 'আমাদেরকে অবশ্যই তাদের গতি ফিরিয়ে আনতে হবে, কিন্তু এর জন্য তাদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ দেওয়া যাবে না।'
একাডেমির বেশকিছু শিক্ষার্থী এরই মধ্যে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা করে নিয়েছে।
২১ বছর বয়সী অমরিশ নায়েক যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে বর্তমানে একজন বিজনেস অ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ করছেন। তার বাবা ছিলেন সিধাউলি গ্রামের এক কৃষক। নিজের ছেলেবেলায়ই অর্থাভাবে কষ্ট করার ব্যাপারটা বুঝে গিয়েছিলেন অমরিশ।
সুদূর নর্থ ক্যারোলিনা থেকে ফোনে তিনি জানালেন, 'আজ আমার যা কিছু আছে, সব এই স্কুলটার জন্যই। এ রকম স্কুলে পড়ার সুযোগ এক জীবনে একবারই আসে। স্কুলে পড়ার আগে আমি কখনো স্বপ্নই দেখিনি, একসময় নিজের গ্রামের গণ্ডি পার হতে পারব।'
তবে স্কুল থেকে বেরিয়ে গেলেও, নিজের এলাকার মানুষের জন্য কাজ করার একটি চেতনা এই স্কুলের শিক্ষার্থীদের মনে গেছে দেওয়া হয়। দারিদ্র্য বা রান্নাঘরের ধোঁয়ায় নারীদের যে ক্ষতি হয়- এ ধরনের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে শিক্ষার্থীরা। স্কুলের ছুটির দিনগুলোতে তারা গ্রামে গ্রামে শিক্ষা ক্যাম্প খোলে এবং উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।
মানু বলেন, 'কীভাবে আমাকে দেখে অন্য বাচ্চারা অনুপ্রাণিত হয়েছে- এমন অসংখ্য বার্তা আমি পেয়েছি। এই একাডেমিতে কাটানো সাত বছর আমার জীবন বদলে দিয়েছে। তাই অবশ্যই চাই অন্যদেরও সাহায্য করতে। তাদের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে আমার।'
তবে মালহোত্রা জানালেন, এটা শুধুই কেউ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে করতে চাইলে করবে; সব শিক্ষার্থীই নিজ গ্রামে ফিরে গিয়ে কাজ করবেই বা করতে হবে- এমনটা প্রত্যাশা করা ঠিক না।
'আমাদের শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা আছে। আমরা শুধু তাদের একটা কথাই মনে করাতে চাই, কোথেকে এসেছ সেটা ভুলে যেও না, আর নিজের অবস্থানের জন্য গর্বিত থাকো,' বললেন মালহোত্রা।
-
দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ: খুশনূর বাশার জয়া