টাইটানিক থেকে বেঁচে ফেরা ‘নিখোঁজ’ চীনা যাত্রীরা কোথায়?
১৯১২ সালের এপ্রিলের যেদিন বিখ্যাত বিলাসবহুল জাহাজ টাইটানিক আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে গেল, সেদিন সাগরের হিমশীতল পানিতে জমে মৃত্যু ঘটেছিল হাজারো যাত্রীর।
জাহাজ থেকে আগেই সরে যাওয়া একটিমাত্র লাইফবোট শুধু ফিরে এসেছিল পানিতে পড়েও বেঁচে থাকা যাত্রীদের উদ্ধার করতে। আর সেই অন্ধকারের মধ্যে উদ্ধারকারী দল খুঁজে পেয়েছিল ভাঙা দরজা ধরে ভেসে থাকা ও শীতে কাঁপতে থাকা এক চীনা নাগরিককে।
আর সেই মানুষটি ছিলেন ফাং লাং। টাইটানিক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া ছয় চীনা নাগরিকের মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন, যার বেঁচে যাওয়ার দৃশ্য বিখ্যাত হলিউড ব্লকবাস্টার চলচ্চিত্র 'টাইটানিক'-এ দর্শকরা দেখেছেন।
কিন্তু, তাদের এই অলৌকিক বেঁচে যাওয়া দিয়েই ঘটনার যবনিকাপাত হয়নি।
আসলে উদ্ধারের পর নিউইয়র্কের এলিস দ্বীপের অভিবাসী তদন্ত স্টেশনে এসে পৌঁছাবার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই তাদের দেশ থেকে বের করে দেয়া হয় অবৈধ অভিবাসী হিসেবে। এর কারণ ছিল চীনের একটি বিতর্কিত আইন, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা নাগরিকদের প্রবেশে একটি বাধা তৈরি হয়েছিল।
সেই থেকে আজ অবধি সেই ৬ চীনা নাগরিকের নামই যেন মুছে গেছে ইতিহাসের পাতা থেকে। কিন্তু, অতি-সম্প্রতি একটি চীনা প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শনীতে টাইটানিক ট্র্যাজেডির ১০৯ বছর পর সেই ৬ নাগরিকের পরিচয় ও জীবনবৃত্তান্ত প্রকাশ পেয়েছে।
'দ্য সিক্স' নামের এই প্রামাণ্যচিত্র দ্বারাই বেরিয়ে এসেছে টাইটানিকে পেছনের এক অজানা গল্প, যে গল্প আগাগোড়াই জাতিগত বৈষম্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন-বিরোধী নীতি দিয়ে মোড়া; যা একইসঙ্গে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে এশিয়া বিরোধী মনোভাবেরও পরিচয় বহন করে।
কারা ছিলেন বেঁচে আসা সেই ছয় জন?
টাইটানিক থেকে বেঁচে যাওয়া সেই ছয় নাগরিকের নাম ছিল; লি বিং, ফাং লাং, চ্যাং চিপ, আহ লাম, চুং ফু এবং লিং হি। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের সকলেই ছিলেন ক্যারিবীয় অঞ্চলের দিকে কাজের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা নাবিক।
'দ্য সিক্স' এর পরিচালক, ব্রিটিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা আর্থার জোনস বলেন, "একসাথে একদল মানুষ থাকার পরেও এটি খুব অদ্ভুত যে তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।"
বেঁচে ফেরা চীনা নাগরিকদের নাম উদ্ধার করা হয়েছে জাহাজের যাত্রী তালিকা ও টাইটানিক সম্পর্কিত বিস্তারিত সংবাদ-আর্টিকেল থেকে।
কিন্তু, টাইটানিক থেকে বেঁচে ফেরা অন্যান্য যাত্রীরা গণমাধ্যমে ভূয়সী প্রশংসা পেলেও ২০ শতকের গোড়ার দিকে পশ্চিমে চীনাবিদ্বেষের কারণে এই চীনা নাগরিকদের সেখানে উহ্য রাখা হয় বলে মনে করছেন ঐতিহাসিক ও গবেষকরা।
জাহাজ ডুবে যাওয়ার ক'দিন পরেই লিখিত এক প্রতিবেদনে 'দ্য ব্রুকলিন ডেইলি এজ' সেই চীনা নাগরিকদের 'জীব' বলে উল্লেখ করে লেখে "তারা বিপদের আশঙ্কা দেখেই সবার আগে নৌকায় উঠে পড়েছিল এবং বসার সিটের নিচে গা ঢাকা দিয়ে লুকিয়েছিল।"
কিন্তু, সাম্প্রতিক প্রামাণ্যচিত্রের গবেষক দল দাবি করেন যে, এমন তথ্য একেবারেই ভিত্তিহীন।
তারা টাইটানিকের লাইফবোটের একটি রেপ্লিকা বানিয়ে দেখান যে। সেই নৌকার আসনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অসম্ভব, এবং তা কারো না কারো চোখে পড়বেই। জোনসের ভাষ্যে, "আমরা আজও বর্ণ বৈষম্যের যে চিত্র দেখি- তখনো তেমনই ছিল, অভিবাসীরাই সব সময় বলির পাঁঠা হয়।"
শুধু তাই নয়, সেসময়ের অন্যান্য গণমাধ্যম অভিযোগ করে, চীনা নাগরিকেরা নারীদের পোশাক পরে নৌকায় বসে ছিলেন।
টাইটানিক ঐতিহাসিক টিম মালটিন জানান, চীনারা নারীদের সাজে ছিল এমন কোনো প্রমাণ আজ অবধি পাওয়া যায়নি। এগুলো সবই গণমাধ্যমের বিদ্বেষী প্রচার ও জনসাধারণের বানানো বুলি।
এধরনের গুজব ওঠার পেছনের কারণ হতে পারে যে, তখনকার দিনে মানুষ ভাবতো নারী ও শিশুদের যেকোনো দুর্ঘটনায় আগে গুরুত্ব দেয়া উচিত। এর ফলে টাইটানিক থেকে বেঁচে ফেরা পুরুষদের নামের সঙ্গে কিছুটা উষ্মা জড়িয়েই ছিল।
ঐতিহাসিক টিম মালটিনের মতে, চীনা নাগরিকরা আগে অন্যদের সাহায্য করেছিলেন নিরাপদে লাইফবোটে উঠতে, বিশেষ করে ফাং লাং একাজে সক্রিয় ছিলেন।
কি ঘটেছিল সেই দুর্ঘটনার পর?
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর ছয় চীনা নাগরিককে কিউবা পাঠানো হয়। সেখান থেকে শীঘ্রই তারা যুক্তরাজ্যে যাবার উপায় খুঁজে পান, কারণ তখন বহু ব্রিটিশ নাবিক প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেওয়ায় নাবিক সংকট চলছিল।
দুর্যোগময় সেই রাতের পর থেকেই চ্যাং চিপ ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন এবং অবশেষে তিনি ১৯১৪ সালে নিউমোনিয়ায় মারা যান। তাকে লন্ডনের এক সমাধিস্থলে কবর দেয়া হয়, তবে কবরে কোনো চিহ্নই রাখা হয়নি।
বাকি ৫ জন ১৯২০ সাল পর্যন্ত একসাথেই ব্রিটেনে কাজ করেন। যুদ্ধ পরবর্তী সমস্যা ও অভিবাসী বিরোধিতা তখন চরমে ছিল। খুব কম সংখ্যক চীনা পুরুষ তখন ব্রিটিশ নারীদের বিয়ে করেছিলেন, যদিও অভিবাসী বিরোধী আইন শীঘ্রই তাদের আলাদা করে দেয় এবং বিনা নোটিশে যুক্তরাজ্য ছাড়তে বাধ্য করে। সেই সাথে হারিয়ে যায় প্রিয়জনও।
জোনস বলেন, "এটা আসলে তাদের দোষ নয়। সময়টাই ছিল এমন যে সবাই রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল এবং নিজেদের জীবনের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল না।"
এরপর আহ লাম চলে আসেন হংকং-এ, অন্যদিকে লিং হি একটা স্টিমবোটে চড়ে ভারতের কলকাতায় রওনা দেন।
লি বিং কানাডায় অভিবাসিত হন, আর ফাং লাং কয়েক বছর ব্রিটেন-হংকং ঘুরে শেষপর্যন্ত নাগরিক হন সেই আমেরিকার, যারা তাকে একসময় তাড়িয়ে দিয়েছিল।
ইতিহাস ও বর্তমানের সমান্তরাল চিত্র:
টাইটানিক ডুবে যাওয়ার অর্ধশতক পরে ফাং লাং এর ছেলে টম ফং এর জন্ম হয় উইসকনসিনের মিলওয়াকিতে।
কয়েক দশক ধরে টম তার বাবার জীবনের সেই অভিজ্ঞতার কিছুই জানতেন না।
ফং বিবিসিকে বলেন, "বাবা কখনোই ওই ব্যাপারে আমার বা মার কাছে কিছুই বলতেন না।"
১৯৮৫ সালে ৯০ বছর বয়সে ফাং মারা যান। তার মৃত্যুরও ২০ বছর পর টম ফং প্রথম এক আত্মীয়ের কাছে জানতে পারেন, তার বাবা ছিলেন বহুল আলোচিত সেই টাইটানিক থেকে বেঁচে যাওয়া এক যাত্রী।
টম ফং এর ধারণা, তার বাবা সেদিনের বিভীষিকা থেকে পাওয়া মিশ্র অনুভূতির ফলেই কাউকে কিছু বলতে চাইতেন না।
'দ্য সিক্স' এর গবেষক দল যখন টাইটানিক থেকে বেঁচে ফেরাদের সম্পর্কে খোঁজখবর শুরু করে, অনেকের পরিবারই এক শতক আগে তাদের প্রিয়জনের বাজে অভিজ্ঞতাবশত সেদিনের গল্প বলতে অনাগ্রহ দেখান।
উইসকনসিনে বেড়ে ওঠা ফং তার বাবাকে বহুবার দেখেছেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। একদিন তাকে বিজাতীয় নামে ডাকায় এক ব্যক্তিকে ঘুষিও মেরেছিলেন তার বাবা।
"তিনি একজন ভদ্রলোকই ছিলেন বটে। কিন্তু বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন দেখলেই তিনি নিজের পরিচয়ের জন্য লড়াই করতে পিছপা হতেন না," বলেন টম ফং।
আজ থেকে একশো বছর আগে ছয় চীনা নাগরিক যেই জাতিগত বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন, আজ মহামারিকালে এশিয়া বিরোধী সেই আগুন আবারও প্রজ্জ্বলিত হতে দেখা যায়।
শুধুমাত্র আমেরিকাতেই সম্প্রতি কয়েক মাসে হাজার হাজার অভিবাসী নিপীড়নের অভিযোগ জমা পড়েছে।
ফং তার পরিবারের গল্প বলতে রাজি হয়েছেন এই আশায় যে দর্শকেরা একটি সত্যি গল্প জানবে বেঁচে যাওয়া সেই চীনা নাগরিকদের সম্পর্কে।
"কারণ আপনি যদি ইতিহাস না জানেন, ইতিহাস নিজেই ফিরে ফিরে আসবে," নিজের কথার ইতিটা এভাবেই টানেন ফং।
- সূত্র: বিবিসি