জীবন চলে মাথার চুলে
দিন মজুর স্বামীর আয় দিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হতো মাগুরার শালিখা উপজেলার কাতলি গ্রামের পলি খাতুনের। অভাব অনটনের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরাতো তাদের। বাধ্য হয়েই স্বামীর সঙ্গে সংসারের হাল ধরেন তিনি। শুরু করেন পরচুলা প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ। সেখানে কাজ করে আজ তিনি স্বাবলম্বী। স্বামীর পাশাপাশি তিনিও এখন পরিবার চালানোর খরচ জোগাচ্ছেন।
পলি বলেন, ‘‘সংসারের কাজ শেষ করে প্রতিদিন চার ঘণ্টা চুল বাছাই ও ধোঁয়ার কাজ করে মাসে দুই থেকে তিন হাজার টাকা আয় করি। এই টাকা দিয়ে সংসার চালাতে স্বামীকে সাহায্য করি। মেয়ের স্কুলের খরচ দেই।’’
পার্শ্ববর্তী বৈখালা গ্রামের গৃহবধূ আঞ্জুয়ারা এবং সারিকা বেগমও পলি খাতুনের মতো একই কাজ করেন। তারাও চুল প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ করে তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন। শুধু পলি, আঞ্জুয়ারা ও সারিকাই নয়, তাদের মতো ৪০০ নারী-পুরুষ এই কাজ করে তাদের জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করেছেন।
মাগুরার শালিখা উপজেলার ছয়টি গ্রামের ৪০০ হতদরিদ্র নারী-পুরুষ পরিত্যক্ত চুল প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তাদের জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন। দারিদ্র সীমার নীচে বসবাসকারী এ মানুষগুলো ফেলনা চুল সংগ্রহ করে সেগুলো বাছাই এবং প্রক্রিয়াজাত করে তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন।
গ্রামগুলো হলো- শতখালি ও আড়পাড়া ইউনিয়নের বৈখোলা, কাতলি, বরইচারা, দীঘি, গোপালগ্রাম এবং কুমারকুটা।
ওই অঞ্চলে প্রায় দশ বছর আগে এ ব্যবসা শুরু করেন বৈখালা গ্রামের হাসানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘‘পাবনার সাইফুর নামে আমার এক বন্ধু আছে। তার কাছ থেকে প্রথমে এই ব্যবসা সম্পর্কে জেনেছি। শুরুতে এলাকার মানুষ কাজটাকে ছোট করে দেখলেও এখন কম-বেশি সবাই কাজটি করছেন।’’
স্থানীয়রা জানায়, পরিত্যক্ত চুলের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এখানকার অনেক পুরুষ তাদের বেকারত্ব ঘুঁচিয়েছেন। পাশাপাশি অনেক নারী সংসারের কাজ সেরে বাড়তি উপার্জনের আশায় এখানে কাজ করেন। ফলে স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের আয়ে তাদের সংসার এখন আগের থেকে ভাল চলছে।
বৈখোলা, কুমারকুটা এবং কাতলি গ্রাম পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায় একজন চুল ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানে নারী পুরুষসহ ৩০/৪০ জন কাজ করছেন।
শতখালি গ্রামের আনিসুর রহমান জানান, আড়পাড়া ও শতখালি ইউনিয়নের ছয়টি গ্রামের শতকরা ৯০ ভাগ পুরুষ সারাদিন বিভিন্ন এলাকা ও গ্রাম থেকে চুল সংগ্রহ করেন। ওই চুল বাড়িতে আনার পর বাড়ির নারীরা সেগুলো বাছাইসহ প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ করেন।
বৈখোলা গ্রামের চুল ব্যবসায়ী ওমর আলী বললেন, “আমরা সাধারণত এক কেজি চুল সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকায় কিনে প্রক্রিয়াজাতরণ শেষে রাজধানীর উত্তরায় গিয়ে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করি। এসব চুল চীন ও কোরিয়ান ব্যবসায়ীরা কিনে তাদের দেশে নিয়ে কৃত্রিম চুল (উইগ) তৈরি করে।’’
চুল প্রক্রিয়াজাতকরণের পদ্ধতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংগৃহীত চুল বাছাই করে সেগুলো হুইল পাউডার ও শ্যাম্পু দিয়ে ধুঁয়ে শুকানোর পর তা বিক্রির উপযোগী করে তোলাই হচ্ছে প্রক্রিয়াজাতকরণ।
আরেক চুল ব্যবসায়ী আজিজুল জানান, তাদের এলাকার মানুষ এখন কৃষি কাজের পাশাপাশি চুল প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ করে ভাল অংকের বাড়তি উপার্জন করছে।
পরচুলার ব্যবসা ওই এলাকার দরিদ্র মানুষদের জীবনমান উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে জানিয়ে শালিখা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট কামাল হোসেন বলেন, ‘‘চুল প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ করে এই এলাকার লেখাপড়া না জানা অনেক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এ কাজের মাধ্যমে অনেকেই তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন। তারা এখন তাদের জীবনমাণের বিষয়েও যথেষ্ট সচেতন।’’