জলবায়ু সংকট: ১২০০ বছর পর সময়ের আগেই ফুটলো চেরিফুল
বসন্ত যে শুধুমাত্র বাংলাদেশেই রঙিন ও বৈচিত্র্যময় ফুলের সমারোহ নিয়ে আসে, তা নয়। বসন্ত তার সুবাতাসে ও আপন গুণে রাঙিয়ে দেয় পৃথিবীর প্রায় সব দেশকেই। এই যেমন-জাপানের কথাই ধরুন না, বসন্তে জাপানের যে চিত্র সকলের মনে আসবে তা হলো- সাদা ও গোলাপিরঙা চেরিফুল, ফুটে আছে প্রতিটি শহরে এবং ফুলের পাপড়িতে ঢেকে গেছে জাপানের পাহাড় ও পথঘাট। এরকম শুভ্র কিংবা গোলাপির স্নিগ্ধতায় মুহূর্তেই মন ভালো হয়ে যেতে বাধ্য। দেশটিতে এই চেরিফুল 'সাকুরা' নামেও পরিচিত।
তবে চেরিফুলের এই উচ্ছ্বাসিত আত্মপ্রকাশ কিন্তু কয়েক দিনের বেশি থাকে না জাপানে এবং দেশটিতে এই প্রস্ফুটনকে রীতিমত পূজা করা হয়। চেরিফুল ফোটাকে উদযাপন করতে নানা পার্টি করে জাপানিরা কিংবা চেরিফুল আচ্ছাদিত সবচেয়ে সুন্দর স্থানগুলোতে ছুটে যায় ছবি তুলতে অথবা পিকনিক করতে।
কিন্তু এবছর জাপানে স্বাভাবিক সময়ের আগেই ফুটেছে চেরিফুল এবং তার স্থায়ীত্বকালও ছিল খুবই অল্প সময়। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, এটি বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটের ফলে বাস্তুসংস্থানে যে পরিবর্তন ঘটছে তার ফলাফল হিসেবে একটি নজির রেখে গেছে।
ওসাকা প্রিফেকচার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ইয়াসুয়ুকি অনো ৮১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে কিয়োটোতে চেরিফুল ফোটার তথ্যাদি সংগ্রহ করেছেন। অনো ই জানালেন, গত মার্চের ২৬ তারিখে জাপানের কিয়োটো শহরে চেরিফুল ফোটার ঘটনা বিগত ১২০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিকটতম সময়ে প্রস্ফুটন। দ্বিতীয় সবচেয়ে নিকটতম দিন হিসেবে ২২ মার্চ টোকিওতে চেরিফুল ফুটেছে।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভার্নমেন্টাল হেলথ সায়েন্স বিভাগের ড লুইস জিসকা বলেন, 'বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বসন্তের হিম এবার আগে আগেই পরেছে এবং ফুলও ফুটছে সম্ভাব্য সময়ে্র আগে।'
যদিও প্রতি বছরই আবহাওয়া ও বৃষ্টিপাতসহ নানা কারণে ফুল ফোটার তারিখ বদলে যায়, কিন্তু কয়েক বছর ধরে তা শুধু এগিয়েই আসছে। অনোর দেয়া ডেটা অনুযায়ী, কিয়োটোতে কয়েক শতক ধরে এপ্রিলের মাঝামাঝির আগে চেরিফুল ফুটতো না। তবে ১৮০০ সাল থেকে তা এপ্রিল মাসে চলে আসে।
অনোও জানালেন, সাকুরা ফুল ফোটা অনেকটাই তাপমাত্রার উপর নির্ভরশীল। ১৮২০ সালে একবার তাপমাত্রা অনেক কম ছিল, কিন্তু আজ তা ৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
কিয়োটোতে আগেই ফুটছে চেরি
ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ বায়োমেটেরোলজি'র গবেষণা অনুযায়ী, জাপানের কিয়োটোতে বিগত ১০০ বছরের তুলনায় সময়ের ১০ দিন আগেই ফুটেছে চেরি ফুল। সময়ের আগেই এই প্রস্ফুটনের কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা হচ্ছে। আরও বলা হচ্ছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ফুল জন্মানোর সময়কালও প্রভাবিত হচ্ছে। নিচের ধূসর ডটগুলো ৯০০ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত চেরিফুলের সর্বোচ্চ প্রস্ফুটন নির্দেশ করে। আর লাল দাগের লাইনগুলো গড়ে দশ বছরের পরিমাণ নির্দেশ করে।
তিনি আরো জানান, এ বছরের ঋতু বিশেষ করে ফুল ফোটাকে প্রভাবিত করেছে। শীতকাল ছিল বেশি শীতল এবং বসন্ত এসেছে তাড়াতাড়ি ও অস্বাভাবিক উষ্ণতা নিয়ে। তাই একটা পূর্ণ বিরতি পাবার পর ফুল ফুটেছে।
চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অফ হংকং এর আর্থ সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আমোস তাই বলেন, ফুলের এই শীঘ্র প্রস্ফুটন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের দেশগুলোর প্রাকৃতিক ব্যবস্থায় যে অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে তারই পূর্বাভাস।
ফুলের শীঘ্র প্রস্ফুটনের পেছনে যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে তার ২ টি কারণ থাকতে পারে। এর একটি হলো নগরায়ণ ও অন্যটি হলো জলবায়ু পরিবর্তন। নগরায়ণ বৃদ্ধির ফলে গ্রামাঞ্চলের চাইতে শহর এলাকায় তাপমাত্রা বাড়ছে। তবে তার চাইতেও বড় কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন যা সারা বিশ্বেরই তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে।
আর ফুলের শীঘ্র প্রস্ফুটনের সঙ্গে যে শুধুমাত্র পর্যটন জড়িত তা নয়, এটি প্রভাব ফেলতে পারে সম্পূর্ণ বাস্তুসংস্থানেও এবং ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে অনেক প্রাণীর জীবন।
প্রতিটি ক্রিয়ারই রয়েছে একটি প্রতিক্রিয়া
গাছপালা ও পোকামাকড়-একে অপরের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল এবং দুটিই তাদের জীবনচক্রের সময়সীমা নির্ধারণে পরিবেশগত সূত্র, বললেন তাই। উদাহরণস্বরূপ, গাছপালা যদি তাদের আশেপাশের পরিবেশে উষ্ণতা বাড়ছে বলে বুঝতে পারে, তারা ফুল ফোটাতে শুরু করে এবং তাদের পাতা বিকশিত হয়। একইভাবে প্রানীর ক্ষেত্রেও তাপমাত্রা বৃদ্ধি মানেই দ্রুত বৃদ্ধি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরবর্তনের ফলে এই নিয়ম অনেক বেশি বিঘ্নিত হচ্ছে।
বিভিন্ন তাপমাত্রার প্রভাবে এখন গাছ ও পোকামাকড় আলাদা আচরণ করতে পারে। অর্থাৎ আগে যেখানে তারা বসন্তে ফুল ফোটাতো, এখন পোকামাকড়েরা তৈরি হবার আগেই গাছে আগে ফুল ফুটছে অথবা তার বিপরীত চিত্র। অর্থাৎ এর ফলে পোকামাকড় আর খাদ্য হিসেবে গাছ থেকে কিছু পাচ্ছে না। আবার গাছও পর্যাপ্ত পরাগবহনকারী পাচ্ছে না।
জলবায়ু পরিবর্তন থেকে বাঁচতে কিছু গাছ ও প্রাণী প্রজাতি ইতিমধ্যেই নিজেদের 'উচ্চ মাত্রা ও উচ্চ অক্ষাংশ' তে নিয়ে গেছে বলে ২০০৯ সালের এক গবেষণায় পাওয়া যায়। কারণ তারা এই পরিবর্তিত বাস্তুসংস্থানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছিল না।
তাই আরো জানালেন যে বাস্তুসংস্থান এরকম বড় ধরনের ওঠানামার সঙ্গে অভ্যস্ত নয়। ভবিষ্যতে উৎপাদন আরো কমে যেতে পারে এবং বাস্তুসংস্থানও ভেঙ্গে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তাই।
শুধুমাত্র জাপানের চেরিফুলই যে আগে ফুটেছে তা নয়। এবছর ওয়াশিংটন ডিসির উপকূলীয় অববাহিকার ধারে যে চেরিফুল ফোটে, সেখানেও সময়ের আগেই ফুল ফুটেছে। ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিস জানিয়েছে, ৫ এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চের মধ্যে ফুল ফোটার তারিখ অন্তত এক সপ্তাহ এগিয়ে গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল শুধুই চেরি ফুলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। চেরিফুল দেখতে সুন্দর, তাই লোকে তা ভালোবাসে বটে, কিন্তু বাস্তুসংস্থানে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখে এমন অন্যান্য অনেক গাছপালার জীবনচক্রেও পরিবর্তন এনেছে জলবায়ু সংকট, জানালেন তাই।
তাই এর কাছ থেকেই জানা যায় যে একই রকম ঘটনা বিভিন্ন অর্থকরী ফসলের ক্ষেত্রেও ঘটছে যা কৃষকদের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে। খরা, ফসলহানি ও পঙ্গপালের আক্রমণের ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে এর ফলে খাদ্য সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
এমনকি কিছু অঞ্চলে কৃষকরা হয়ত নিজেদের ফসল আবাদের ধরন বদলে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের এখনকার ফসল উৎপাদনের পক্ষে জলবায়ু অনেক উষ্ণ হয়ে উঠতে পারে। আবার অন্যদিকে বন্যা, তুষারপাত, বাতাসে জলবায়ুর পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই এর মতে, কৃষিকাজ এখন অনেকটা জুয়া খেলার মত হয়ে উঠেছে কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন হুটহাট বাস্তুসংস্থান ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে।
- সূত্র: সিএনএন