বিশ্বের অবিশ্বাস্য হাই-স্পিড রেল যোগাযোগের দেশ
একুশ শতকের শুরুর দিকে চীনে ছিল না কোনো হাই-স্পিড বা দ্রুত গতিসম্পন্ন রেলওয়ে। কম গতিসম্পন্ন পুরনো ধাঁচের ট্রেনে করে বিশাল দেশটির এক অংশ থেকে অন্য অংশে পাড়ি দেওয়া যেন ছিল চরম মাত্রার ভ্রমণ সহিষ্ণুতার পরিচয়।
কিন্তু আজ সেই চিত্র বদলে গেছে। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাষ্ট্রটিতে এখন চলছে অবিশ্বাস্য গতির হাই-স্পিড রেল যোগাযোগ।
২০০৮ সালের মধ্যেই পুরো দেশজুড়ে বড় বড় মেগা শহরগুলোকে যুক্ত করার জন্য প্রায় ৩৭,৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেল লাইন তৈরি করেছে দেশটি। এর অর্ধেকই তৈরি হয়েছে বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে। সেইসঙ্গে ২০২১ সালের মধ্যে আরও ৩,৭০০ কিলোমিটার রেল লাইন চালু করার কথা রয়েছে চীনের। ২০৩৫ সালের মধ্যে তারা এই রেল লাইন দ্বিগুণ করে ৭০,০০০ কিলোমিটারে রূপান্তরিত করার প্রত্যাশা করছে।
চীনের হাই-স্পিড রেল যোগাযোগে বহু লাইনেই সর্বোচ্চ গতি রয়েছে ৩৫০ কেপিএইচ (২১৭ এমপিএইচ)। বিমান ভ্রমণ বাদ দিয়ে এখন ট্রেনযোগে আন্তঃশহর ভ্রমণই অধিক জনপ্রিয়। ২০২০ সালের মধ্যে চীনের ৭৫ শতাংশ শহরের ৫ লাখ মানুষ হাই-স্পিড রেল যোগাযোগের সুবিধা পাচ্ছে।
দ্রুত গতির রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে চীনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ইউরোপের দেশ স্পেন। কিন্তু ২০০০ মাইলের বেশি রেললাইন এবং ২৫০ কেপিএইচ এর সামান্য বেশি গতির ট্রেন নিয়ে চীনের তুলনায় গতির দৌঁড়ে তারা বেশ পিছিয়ে আছে।
এদিকে মার্কিন মুলুকে হাই-স্পিড রেল যোগাযোগের জন্য আমট্রাকের নর্থ ইস্ট করিডর নামক একটিমাত্র রেল রুট রয়েছে, যেখানে অ্যাসিলা ট্রেনের বর্তমান গতি ২৪০ কেপিএইচ। যাত্রীবাহী ও মালবাহী সাধারণ ট্রেন লাইনের সঙ্গেই পুনঃনির্মাণ শাখা তৈরির মাধ্যমে অত্যন্ত ব্যয়বহুলভাবে এই হাই-স্পিড ট্রেন যোগাযোগ তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাজ্যের মাত্র ১০৭ কিলোমিটারের হাই-স্পিড রেললাইন রয়েছে।
অর্থনৈতিক শক্তির প্রতীক
হাই-স্পিড রেল যোগাযোগের দিকে এতটা গুরুত্ব দেয়ার উদ্দেশ্য ছিল আন্তঃদেশীয় দূরপাল্লার যোগাযোগের ক্ষেত্রে যেন নাগরিকরা ট্রেনকেই বেছে নেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসব নতুন রেলওয়ের গুরুত্ব আরও অনেক বেশি।
ষাটের দশকে জাপানের শিকানসেন-এর মতো হাই-স্পিড রেল যোগাযোগ এখন চীনের অর্থনৈতিক শক্তি, দ্রুত আধুনিকায়ন, প্রযুক্তিগত অগ্রসরতা ও ক্রমবর্ধমান উন্নয়নকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরছে।
চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা শি জিনপিং এর জন্যও হাই-স্পিড রেল যোগাযোগ এক ধরনের সামাজিক সংঘবদ্ধতা, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার এবং বিভিন্ন অঞ্চল ও তাদের সংস্কৃতির একত্রীকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ বিভাগের গবেষক ডা. অলিভিয়া চিউং এর মতে, 'নতুন রেলওয়ে তৈরি আসলে জিনপিং এর জাতীয় বাজার একীকরণ পরিকল্পনারই একটি অংশ এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে তার যে দর্শন, সেটির প্রতিফলন।'
অর্থাৎ, চীন প্রকৃতপক্ষে অতীতের উত্তর আমেরিকা বা ইউরোপীয় রেল যোগাযোগের ইতিহাসকেই ফিরিয়ে নিয়ে আসছে। রাশিয়ার রেল যোগাযোগ কাঠামো, বিশেষত তাদের ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেল যোগাযোগও একইভাবে প্রুশিয়া, ফ্রান্স, ইতালি ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপর শক্তিশালী আর্থ-রাজনৈতিক প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু ১৯ শতকে যা তৈরি করতে কয়েক দশক লেগেছিল, চীন তা মাত্র কয়েক বছরে করে দেখিয়েছে।
ভ্রমণ বিশেষজ্ঞ মার্ক স্মিথ জানালেন, চীনের হাই-স্পিড রেলওয়ের ট্রেনগুলো প্রায়ই তাদের দেশীয় ফ্লাইটের চাইতেও দ্রুতগতিতে আপনাকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিতে সক্ষম। কিছু কিছু রেল স্টেশনের বিশাল আকার, বিপুল যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থাপনা ও সবাইকে রিজার্ভ সিট দেওয়ার মতো কার্যক্রম দেখে আপনি অবাক হতে বাধ্য। এমনকি তাদের কাগজের টিকিটও দেখাতে হয়না, স্রেফ আইডি কার্ড বা পাসপোর্ট স্ক্যান করেই ভ্রমণ করা সম্ভব।
যেভাবে নতুন রূপে ফিরে এলো ইউরোপের নাইট ট্রেন
চীন প্রাথমিকভাবে তাদের হাই-স্পিড নেটওয়ার্ক স্থাপন করার প্রযুক্তি ধার করেছে ইউরোপ ও জাপানের কাছ থেকে। চীনের বিশাল বাজার ও তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা দেখে স্বভাবতই বম্বারডিয়ার, আলস্টম ও মিতসুবিশির মত বৈশ্বিক ইঞ্জিনিয়ারিং জায়ান্টগুলো চীনের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী হয়।
তবে গত এক দশকের মধ্যে চীনের দেশীয় কোম্পানিগুলোই নিজেদের হাই-স্পিড রেল যোগাযোগ প্রযুক্তিকে বিস্ময়কর রূপ দিয়েছে।
উচ্চগতির ট্রেন ও রেললাইন বসানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা
চীনা ভূখন্ডের বিস্তৃতি এবং তাদের ভৌগলিক ও জলবায়ুজনিত বৈচিত্র্য নিঃসন্দেহে দেশটির রেলওয়ে প্রকৌশলীদের অসামান্য সব চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিল।
উত্তরের বরফ জমা শীত থেকে শুরু করে পার্ল নদীসংলগ্ন ব-দ্বীপ মহানগরীর উষ্ণ গ্রীষ্মমন্ডলীয় আবহাওয়াকে মোকাবিলা করতে হয়েছে তাদের। গোবি মরুভূমি পেরিয়ে ১,৭৭৬ কিলোমিটার লানঝু-উরুমকি লাইন তৈরির সময় ভূপৃষ্ঠের উপরে, নিচে বা সামনে যা-ই পড়েছে সেই ভূখন্ডের মধ্য দিয়েই রেল লাইন স্থাপন করতে গিয়ে চীনা প্রকৌশলীরা অত্যাধুনিক নানা প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটিয়েছেন।
তবে চীনের এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির রেল যোগাযোগ সম্পন্ন করতে গিয়ে কোনো সমস্যার মুখোমুখি যে হতে হয়নি তা নয়। রেললাইন স্থাপনের ক্ষেত্রে আইনি জটিলতা ও বাধা এড়াতে চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ ও নানাবিধ পরিকল্পনা করতে হয়েছে। তবে মুদ্রার অপর দিক হলো, নতুন রেল রুট স্থাপনের ক্ষেত্রে সেসব অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সুবিধা-অসুবিধার নিয়ে চীন খুব বেশি মাথা ঘামায়নি বললেই চলে।
হাই-স্পিড ট্রেন প্রযুক্তির ফলে ২০১১ সালে মর্মস্পর্শী এক দুর্ঘটনার শিকারও হয়েছে চীন। ওয়েনঝু কলিশন নামে পরিচিত সেই দুর্ঘটনায় একটি রেল সেতুর উপর দুই ট্রেনের সংঘর্ষে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে ৪০ জন যাত্রী নিহত ও ২০০ জন আহত হন।
এই দুর্ঘটনার পর হাই-স্পিড ট্রেনের উপর জনগণের বিশ্বাস কমে যায়, ট্রেনের গতি কমাতে হয় তখন। এর ফলে নতুন লাইন তৈরির কাজও স্থগিত রাখতে হয়। কিন্তু পরবর্তী এক দশকে আর কোনো বড় দুর্ঘটনা না ঘটায় হাই-স্পিড রেল যোগাযোগ এখন চীনের অন্যতম জনপ্রিয় নাম।
নিজেদের উচ্চ গতির ট্রেন যোগাযোগ এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সর্বোচ্চ দক্ষতায়ও যেন সন্তুষ্ট থাকতে পারছিলো না চীন। আর তাই চীনই বিশ্বে সর্বপ্রথম চালকবিহীন ট্রেন যোগাযোগ, আধুনিক সিগন্যালিং ও নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি চালু করে।
বেইজিং ও নর্দার্ন হেবেই প্রদেশের ঝ্যাংজিয়াকুকে সংযুক্ত করা এই চালকবিহীন 'বুলেট ট্রেন' এর গতি ৩৫০ কেপিএইচ'রও বেশি যা বিশ্বের সর্বোচ্চ গতির চালকবিহীন ট্রেন।
বেইজিং অলিম্পিক ২০২২ ও প্যারাঅলিম্পিকের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ২০১৯ এর ডিসেম্বরে এই নতুন লাইনটি তৈরি করা হয় যা তিন ঘণ্টার যাত্রাকে কমিয়ে এক ঘণ্টারও কম সময়ে নিয়ে এসেছে।
চালকবিহীন ট্রেন স্টেশনগুলোতে শীতকালীন খেলাধুলা সামগ্রী সংরক্ষণ ব্যবস্থা, ফাইভ জি টাচস্ক্রিন কন্ট্রোল প্যানেলসহ আসন, হাজার হাজার নিরাপত্তা সেন্সর, ইন্টেলিজেন্ট লাইটিং ইত্যাদি সুবিধা রাখা হয়েছে। স্টেশনগুলোতে যাত্রীদের অবস্থান, মালামাল ও চেক-ইনের জন্য ব্যবহৃত হয় ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তি ও রোবট।
রেল যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীন যে এখানেই থেমে যাবে তা মোটেই নয়। বরং তারা দিন দিন এই খাতে নিজেদের বাজেট বৃদ্ধি করছে এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগেও হাই-স্পিড প্রযুক্তি ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছে। মাগলেভ (ম্যাগনেটিক লেভিয়েশন) নামক নতুন আরেক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পেছনেও তারা এই মুহূর্তে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে যা যাত্রীদের ৬২০ কেপিএইচ গতিতে ভ্রমণের সুযোগ করে দিবে। অর্থাৎ চীনের হাই-স্পিড ট্রেনে উঠলে আপনার জীবনের অন্যতম একটি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়!
- সূত্র: সিএনএন