গারোহিলস টি আখ্যান
জামালপুরে পাশের জেলা শেরপুর। এখানে চা চাষ হচ্ছে এরকম একটা খবরে বেরিয়ে পড়ি ঝিনাইগাতির গারো পাহাড়ের উদ্দেশে।
জামালপুর শহর থেকে প্রায় ত্রিশ-পয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরে শেরপুর, সেখান থেকে শাল-গজারি বনের সরু রাস্তা ধরে পৌঁছলাম বনরাণী নামে একটি জায়গায়। যাওযার পর বোঝা গেল এটা আসলে একটি নির্মাণাধীন রিসোর্ট, দুই তলা উঠেছে, বাকি কাজ অসমাপ্ত। এই অসম্পূর্ণ দালানের এককোণে ছোট আয়তকার একটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা গারো হিলস টি কোং।
চা বাগানে পরিদর্শন করতে চাইলে এখানেই অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল। খানিক পরে একটি মোটরসাইকেল নিয়ে হাজির হলেন সাব্বির সাগর। তিনি এই বনরূপা রিসোর্ট ও টি কোম্পানির কেয়াটেকার গোছের একজন। গারোহিলস টি কোম্পানির উদ্যোক্তার নাম আগেই জেনেছি। তার নাম মো. আমজাদ হোসেন ফনিক্স। মূলত একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। ষোল-সতের বছর আগে তিনি এ অঞ্চলে আসেন পাহাড়ে জমি কেনার উদ্দেশে।
বনরাণী রিসোর্টের এক কোণে পরিবার নিয়ে থাকেন তসর আলী। তিনিও গল্পে গল্পে জানালেন: গারোহিলস টি কোং-এর সঙ্গে তিনি আছেন গোড়া থেকেই। তিনিই আমজাদ ফনিক্সকে এখানে পঞ্চাশ একর জমি কিনে দিয়েছেন। এখানে এক একরের উপর গড়ে উঠেছে বনরাণী রিসোর্ট।
আমজাদ ফনিক্সের বাড়ি হবিগঞ্চ, জানালেন সাব্বির সাগর। তার বাবা বাংলাদেশের ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। সাব্বির সাগরের বাড়িও হবিগঞ্জ।
'স্যার যখন জমি কেনেন, তখন জমির দাম সস্তা ছিল, তিন লাখ টাকা একর,' জানালেন তসর আলী।
'আমি দুই বছর হয় আসছি। আগে আমাজাদ স্যারের গার্মেন্টসে কাজ করতাম। এখন চা বাগানের কাজ করি,' পাশে বসা সাগর যোগ করলেন।
একটু পর এসে যোগ দিলেন রফিক বাঙালি। তিনি একজন চা চাষি। ৩ কাঠা জমিতে চায়ের বাগান করেছেন গারোহিলস টি কোংয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে।
গারোহিলস টি কোম্পানি এখানকার স্থানীয় বাঙালি ও কয়েক ঘর গারোর জমি নিয়ে ২০১৮ সালে চা বাগান শুরু করে। এখন গারো হিলস কোম্পানির তত্ত্বাবধানে সাকুল্যে এরকম ক্ষুদ্র চা বাগান হয়েছে ১৯টি। গত কয়েক বছরে চা চাষ নানাভাবে আরও জোরদার হয়েছে টি বোর্ডের উদ্যোগে। এখানে শেরপুর জেলা, বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং মুক্তাগাছায় ব্যাপক ভিত্তিক চা চাষ শুরু করার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে।
প্রকল্পের নাম হয়েছে 'বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ সম্প্রসারণ প্রকল্প'। এটি এখন অনুমোদনের অপেক্ষায়। এর আওতায় প্রায় ৭৪ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে।
প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে, কিন্তু কিছু পরিবর্তন ও যাচাই বাছাইয়ের কারণে সময় পিছিয়েছে। প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ সালে।
প্রকল্পের আওতায় শেরপুরে ২৩১ একর জমিতে চা চাষ হবে। চা বোর্ডের তরফ থেকে কয়েক দফা গারো হিলস টি কোম্পানির কার্যক্রম সশরীরের এসে দেখে গেছেন টি বোর্ডের উপ পরিচালক মোহাম্মাদ আলী, কৃষিতত্ত্ব বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ মাসুদ রানা, কীটতত্ত্ব বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নাঈম মোস্তফা আলী ও সহকারী উন্নয়ন কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান। তারা বাগানের মাটিও পরীক্ষা করেছেন। পরিদর্শক দল ঝিনাইগাতীর বনাঞ্চলঘেরা গজনী, বাকাকুড়া ও শ্রীবরদীর খাড়ামোড়া এলাকাকেচা বাগানের জন্য উপযুক্ত হিসেবেই শনাক্ত করেছেন। তসর আলী আর সাব্বির সাগর বিভিন্ন সময়ের তাদের আগমণের সচিত্র নথিসহ বর্ণনা করে গেলেন।
এই বনরাণীর রিসোর্টের সঙ্গেই গারোহিলস টি কোংয়ের চা প্রসেসিং ফ্যাক্টরি হবে বলে জানালেন সাব্বির।
পরবর্তীকালে আরও কিছু খোঁজখবর করে টিবোর্ডের পরিকল্পনা বিভাগ প্রধান মুনির আহমদের সঙ্গে কথা যা জেনেছি, তার সারমর্ম এরকম: বৃহত্তর ময়মনসিংহের পাঁচ জেলার ১৫ উপজেলায় ১৫ হাজার ৬৪৫ একর জমিতে ক্ষুদ্রায়তন চা আবাদের সম্ভাবনা আছে। ৭৪ কোটি টাকার যে প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে, সে অনুযায়ী ১৫ হাজার ৬৪৫ একর জমিতে চা চাষের আওতায় আনা গেলে এ অঞ্চল থেকে বছরে ১৬ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হবে।
গারোহিলস টি কোম্পানির হয়ে ৩ কাঠা জমিতে চাষ করছেন রফিক বাঙালি। তিনি বাঙালি ও গারোদের চা চাষে উদ্বুদ্ধকরণ কমিটিরও প্রধান। তিনি জানালেন, গারোদের মধ্যে চার ঘর চা চাষে এসেছে। সামনে আরও অনেকেই আসবেন।
রফিক বাঙালির পর কথা হলো আরেকজন চা চাষি মো. আজিজুল হকের সঙ্গে, পচাত্তর বছর বয়স। তিনি ২৪ শতক জমিতে চা চাষ করছেন।
'চা চাষ করছি, এখানে ফ্যাক্টরি হবে। আমাদের চা এখানেই বিক্রি করা যাবে,' পান চিবাতে চিবাতে বলেন আজিজুল হক।
গারোহিলস টি কোম্পানির তসরআলী কাছ থেকেই আরও জানা গেল: শেরপুরে বাঙালিদের জমির সঙ্গে যোগ হবে ১৩ হাজার হেক্টর চা চাষ উপযোগী জমি।
'এগুলো কালেক্টরেট ল্যান্ড। খাস জমি,' এসব জমির বেশিরভাগই উঁচু ও বনভূমির ভেতরে, যা বহু যুগ ধরে গারো-কুচরা জুম আবাদ করে আসছে।
টি বোর্ডের পরিচালক মুনির আহমেদকে টেলিফোনে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি বললেন কৃষকের জমিতে চা বাগান হবে, খাস জমির কথা তার জানা নেই!
'ফ্যাক্টরি হলে আমরা চা কিনে নেব। সবাই চা চাষে যোগ দেবে,' বলেন সাব্বির সাগর।'গারোদের চেয়ে বাঙালিদের মধ্যেই চা চাষে আগ্রহ বেশি।'
যে চারজন গারো চা বাগান করছেন, তাদের একজন কানু রাম। কুচ। তিনি ১৭ শতকের মতো জমিতে চা বাগান করেছেন। তার বাড়ির কয়েক মিটার দূরেই। এক সময় এখানে সিমলা আলুর চাষ করতেন তিনি।
কানু রাম ওয়ার্ল্ড ভিশনের শিক্ষা কার্যক্রমের অধীনে প্রাথমিক শিক্ষকের কাজ করেছেন। প্রকল্প শেষে আবার তিনি পুরোদস্তুর কৃষক এখন।
'তিন বছর হয় চা বাগান করেছি। এখন একটু হতাশ লাগছে। চা নিয়ে কী করব? বাগানের চা নিজেরা খেয়েছি। কিন্তু আমার তো কোনো আয় হচ্ছে না। এখানে চা প্রসেস করার উপায় নাই,' বললেন তিনি।
গারো হিলস টি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের পাহাড়ি জনপদে চা চাষের মূল উদ্যোক্তা আমজাদ হোসেন ফনিক্সের সঙ্গে আলাপে তার স্বপ্নের কথা বললেন, বাণিজ্যিকভাবে চা চাষের জন্য স্থানীয়ভাবে কৃষককে ২৭ হাজার উন্নত জাতের চা চারা বিতরণ করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ২৯ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে চা চারা রোপণ। ইতোমধ্যে শেরপুরের শ্রীবরদীতে ৬ জন, নালিতাবাড়ীতে ৩ জন, ঝিনাইগাতীতে ১৩ জন, নকলায় ৪ জন, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় একজন কৃষক ৫ দশমিক ৩১ একর জমিতে চা চাষ শুরু করেছেন। এ উদ্যোগ সফল হলে ময়মনসিংহ অঞ্চলে স্থাপন করা হবে চা বোর্ডের আঞ্চলিক অফিস।
কিন্তু সাব্বিরের কালেক্টরেট ল্যান্ড কথাটা মাথায় ঘুরতে থাকে। শত শত বছরের প্ল্যান্টেশনের ইতিহাস ঠিক এরকমই, সুগার, টি সব প্ল্যান্টেশনের শুরু এভাবেই সোনালী স্বপ্ন দিয়ে। তারপর দেখা যায় স্থানীয়দের জমি বেহাত হয়ে গেছে, নিজ ভূইয়ে তারা শ্রমিকে পরিণত হয়েছেন। গারো, হাজং, কুচরা বহু যুগ ধরে বনজীবী, জুম চাষী। চা বাগান তাদের কোথায় নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেবে? প্রশ্নটা মাথায় ঘুরতে থাকে।