কোভিড-১৯ যেভাবে মস্তিষ্কের ক্ষতি করে
কোভিড-১৯ মহামারির প্রথম মাসগুলোতে চিকিৎসকরা শ্বাসকষ্ট এবং ফুসফুসের ক্ষতি সারানোর কাজেই তাদের মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। তবে তখন থেকেও ভাইরাসের সংক্রমণে মস্তিষ্ক ও স্নায়বিক ক্ষতির আশঙ্কা করা হয়।
কোভিড-১৯ এর উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অনেক রোগীর মধ্যেই ডেলিরিয়ামের উপসর্গ দেখা যায়; তাদেরকে বিভ্রান্ত, দিশেহারা ও বিক্ষুব্ধ আচরণ করতে দেখা যায়।
জাপানের এক গবেষকদল গত এপ্রিলে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যাতে বলা হয়, কোভিড-১৯ আক্রান্ত এক রোগীর মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, আক্রান্ত এক ব্যক্তির স্নায়ুকোষের মায়োলিন আবরণী স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার নিউরো বিজ্ঞানী অ্যালিসন মুওত্রি জানান, "স্নায়বিক সমস্যার উপসর্গগুলো যতো দিন যাচ্ছে প্রকট হয়ে উঠছে।"
কোভিড-১৯ এর ফলে সৃষ্ট স্নায়বিক সমস্যার এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে স্ট্রোক, ব্রেন হেমোরেজ ও স্মৃতিশক্তি হ্রাস।
তবে এ ব্যাপারে গবেষকরা এখনো সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাননি। কতো সংখ্যক মানুষের এমন উপসর্গ দেখা গেছে, কারা বেশি ঝুঁকিতে আছেন এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। এই উপসর্গগুলো কেন দেখা যায় তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন গবেষকরা।
ভাইরাস মস্তিষ্কে আক্রমণ করে সংক্রান্ত ঘটাতে সক্ষম, তবে সার্স-কোভ-২ এর এই ক্ষমতা আছে কিনা তা এখনো স্পষ্ট নয়। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাসের লড়াইয়ে যুক্ত থাকায় প্রতিক্রিয়া হতে পারে এটি এই ধারণাও করা হচ্ছে। কারণ ভেদে ভিন্ন চিকিৎসার প্রয়োজন হওয়ায় আসল কারণ খুঁজে বের করাই জরুরি এখন।
মহামারির প্রকোপ বাড়তে শুরু করার পরই ইউনিভার্সিটি অব লিভারপুলের নিউরোলজিস্ট বেনেডিক্ট মাইকেল তার সহকর্মীদের নিয়ে কোভিড-১৯ এর ফলে সৃষ্ট স্নায়বিক জটিলতায় আক্রান্ত রোগীদের তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন। জুনে প্রকাশিত তাদের গবেষণায় তারা কোভিড-১৯ এর ফলে সৃষ্ট স্নায়বিক জটিলতায় আক্রান্ত ১২৫ জন রোগীর ক্লিনিক্যাল তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন। এদের মধ্যে ৬২ শতাংশ রোগী স্ট্রোক ও হেমোরেজের মতো মস্তিষ্কের রক্ত সরবরাহ প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ৩১ শতাংশ রোগীর মানসিক জটিলতা দেখা যায়। এরমধ্যে মানসিক জটিলতায় ভোগা ১০ জন রোগী পরবর্তীতে মানসিক রোগে আক্রান্ত হন।
স্নায়বিক জটিলতায় ভোগা সব রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল না বা তারা আইসিইউ-তেও ছিলেন না।
মাইকেল বলেন, "কোনো বড়সড় ঝুঁকির সম্ভাবনা ছাড়াও তরুণ রোগীদের স্ট্রোক হয়েছে এবং মানসিক অবস্থার পরিবর্তন দেখা গেছে যার অন্য কোনো কারণ নেই।"
কোভিড-১৯ এর ফলে সৃষ্ট স্নায়বিক জটিলতায় ভোগা ৪৩ জন রোগীর বিস্তারিত ক্লিনিক্যাল তথ্যের বিশ্লেষণী আরেকটি গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হয় জুলাইতে। গবেষণাটির সাথে যুক্ত ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের নিউরোলজিস্ট মাইকেল জান্দি জানান, সমস্যার ধরণগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রভাব গুলোর মধ্যে স্ট্রোক ও এনসেফালাইটিস অন্যতম। গুরুতর অবস্থায় এনসেফালাইটিস আক্রান্ত ব্যক্তির একিউট ডিসসেমিনেটেড এনসেফালোমায়েলিটিস নামক রোগেও আক্রান্ত হতে পারে; যার ফলে মস্তিষ্ক ও স্পাইনাল কর্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস রোগের লক্ষণও দেখা যেতে পারে। এ ধরণের গুরুতর উপসর্গের অনেক রোগীরই ফুসফুসের সমস্যার মৃদু উপসর্গ ছিল। সংক্রমণের ফলে তাদের মস্তিষ্কই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানান জান্দি। অনেক রোগীর গুলাইন-ব্যারে সিনড্রম, পেরিফেরাল নার্ভ ড্যামেজ ও পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার এর লক্ষণও দেখা যায়। পূর্বের সার্স ও মার্স প্রাদুর্ভাবেও এধরণের উপসর্গ দেখা যায়। তবে প্রাদুর্ভাব অল্প স্থানে সীমাবদ্ধ থাকায়, এব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য নেই।
ঠিক কতো সংখ্যক মানুষের এ ধরণের স্নায়বিক সমস্যার উপসর্গ দেখা যেতে পারে এ ব্যাপারে চিকিৎসকরা এখনো নিশ্চিত নন। পূর্বের করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের তথ্য বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য সংখ্যার ধারণা দেয়া হয়েছে আরেকটি গবেষণায়। সার্সের ফলে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর ০.০৪ শতাংশ ও মার্সের ফলে ০.০২ শতাংশ মানুষের মধ্যে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত হবার লক্ষণ দেখা যায়। বর্তমান বিশ্বব্যাপী ২৮.২ মিলিয়ন মানুষের কোভিড-১৯ আক্রান্ত হবার নিশ্চিত খবর পাওয়া গেছে। এ থেকে ধারণা করা হয়, অন্তত ১০ থেকে ৫০ হাজার মানুষ স্নায়বিক জটিলতায় ভুগতে পারেন।
তবে এই গবেষণার অনুমিত ফলাফলের সীমাবদ্ধতা হলো, বেশিরভাগ গবেষণাই কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের ওপর করা হয়েছে।
ব্রাজিলের ফেডারেল ইউনিভার্সিটি অব রিও ডি জেনেরিও এর নিউরো বায়োলজিস্ট ফার্নান্দে ডি ফেলিস বলেন, স্নায়বিক জটিলতায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এধরণের রোগী ৫০ শতাংশ। তবে, মৃদু উপসর্গের কিংবা শ্বসন যন্ত্রের জটিলতার উপসর্গহীন রোগীদের ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য নেই । তথ্যের ঘাটতির কারণেই স্নায়বিক জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার কারণ সম্পর্কে অনুসন্ধান ব্যাহত হচ্ছে। এই প্রভাব গুলো দীর্ঘস্থায়ী হবে কিনা এটিও এখনো নিশ্চিত নয়।