কোভিড-১৯ টিকা কাজ করছে কি না, কীভাবে বুঝবেন?
প্রাণঘাতি সার্স কোভ-২ নামের করোনাগোত্রের নতুন জীবাণুটি প্রতিরোধে বিশ্বজুড়ে চলছে ফলদায়ক টিকা তৈরির গবেষণা। অনেক উন্নত দেশের সরকার এবং ফার্মাসিটিক্যাল জায়ান্টরা তাদের সর্বোচ্চ শক্তি ব্যয় করছে এ প্রচেষ্টায়। লক্ষ্য সবার আগে একটি টিকা বাজারে আনা- যা মানবদেহে স্থায়ীভাবে জীবাণুটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে।
এ ধরনের বড় কিছু প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ এখন তৃতীয় স্তরের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালাচ্ছে তাদের প্রার্থী ভ্যাকসিনের। ভাইরাসের বিরুদ্ধে নানা বয়সের সবল ব্যক্তির দেহে এটি কতটুকু ফলপ্রসূ হয়, তা জানতেই চলছে এ পরীক্ষা।
আগামী অক্টোবরের আগেই টিকা বাজারে আনা যাবে বলে ইতোমধ্যেই নিজ দেশের নাগরিকদের আশ্বাস দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ভ্যাকসিন গবেষণায় দ্রুতগতি আনতে তার সরকার নিয়েছে ওয়ার্প স্পিড কার্যক্রম। এর আওতায় আরোগ্যের সম্ভাবনা জাগিয়েছে- এমন কিছু প্রার্থী ভ্যাকসিনের গবেষণায় হাজার কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে তার প্রশাসন।
তবে প্রেসিডেন্টের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে, ওয়ার্প স্পিড কার্যক্রম প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মনসেফ স্লাওই জানিয়েছেন, এত তাড়াতাড়ি টিকা বাজারে আনার সম্ভাবনা খুবই কম। মার্কিন গণমাধ্যম এনপিআর'কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
''গবেষণা থেমেই নেই। অগ্রগতি অবশ্যই আসছে। কিন্তু, অক্টোবরের শেষ নাগাদ চলমান ট্রায়ালের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সফল ভ্যাকসিন তৈরি করা যাবে- এ আশা করা ঠিক হবে না। পরীক্ষার ফলাফল অনুসারে চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে ভ্যাকসিনের উন্নয়ন কাজেও অনেকটা সময় ব্যয় হতে পারে'' স্লাওই জানিয়েছিলেন।
এনপিআর- এর সঙ্গে স্লাউই আলাপ সূত্রে- এবার জেনে নেওয়া যাক বড় পরিসরের পরীক্ষায় সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা সম্পর্কে শীর্ষ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের মতামত ও বিষয়টি নিয়ে জনমনে প্রচলিত নানা প্রশ্নের ব্যাখ্যা।
ট্রায়ালগুলো কতটা বড় পরিসরে করা হচ্ছে?
মানবদেহে তৃতীয় স্তরের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ বা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রত্যেকটিতে কমপক্ষে ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবীকে গ্রহণ করা হচ্ছে। এদের কেউ কেউ পরীক্ষামূলক টিকাটির ইনজেকশন পাবেন। অন্যদের তার পরিবর্তে অন্য কোনো প্রতিষেধক বা আয়োডিন দেওয়া হবে। কে পরীক্ষাধীন ভ্যাকসিন পাচ্ছেন তা ইঞ্জেকশনদাতা স্বাস্থ্য কর্মী এবং গ্রহীতা স্বেচ্ছাসেবী- কেউই জানতে পারবেন না। তাই ফলাফল সম্পর্কেও তাদের অগ্রিম কোনো প্রত্যাশার সুযোগ নেই। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এধরনের প্রক্রিয়াকে বলা হয়-ডাবল ব্লাইন্ড বিকল্প ওষুধ নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা। গবেষণায় সম্পূর্ণ সঠিক ফলাফল নিশ্চিত করে এ পদক্ষেপ।
বাস্তবসম্মত কারণেই গবেষকরা পরীক্ষা চালানোর জন্য ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর জনসংখ্যাকে বেছে নিয়েছেন। বিপুল পরিমাণ ভ্যাকসিন দেওয়ার অন্যতম একটা উদ্দেশ্য হচ্ছে; মহামারি চলাকালে এসব স্বেচ্ছাসেবকদের অনেকেই প্রাকৃতিকভাবে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারেন। এমনটা হলে, প্রার্থী ভ্যাকসিন কেমন প্রতিরোধ গড়ে তোলে, সেটা জানতে চান তারা। অবশ্য, গবেষকদের জানা নেই, স্বেচ্ছাসেবীরা কিভাবে সংক্রমণের শিকার হবেন বা কোথা থেকে হতে পারেন। তবে বড় পরিসরে পরীক্ষার উদ্দেশ্যই হচ্ছে সেই সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলা।
''এটা অনেকটা বাজি ধরার মতোই। গবেষকরা আলোচ্য জনসংখ্যার উপর তাদের বাজিটি ধরেছেন'' বলে জানান সিয়াটল ভিত্তিক ফ্রেড হাচিসন ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারের জৈব-তথ্য পরিসংখ্যানবিদ হোলি জেনস।
পরীক্ষা সফল হলো কিনা তা কিভাবে নির্ধারণ করা হয়?
তৃতীয় স্তরে বড় পরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা ভ্যাকসিনটি নিরাপদ এবং একইসঙ্গে জীবাণু প্রতিরোধে সফল কিনা- তা জানার চেষ্টা করেন। পাশাপাশি বড় পরিসরে প্রতিষেধকটির বিরল কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও ধরা পড়ে।
এটি ফলপ্রসূ হচ্ছে কিনা তা জানতেই যাদের প্রার্থী ভ্যাকসিন ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে, তাদের সঙ্গে যাদের দেওয়া হয়নি- সেই জনসংখ্যার মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ সংখ্যা তুলনা করেন বিজ্ঞানীরা।
মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) এরপর প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রার্থী টিকাটি কার্যকর এবং অনুমোদনযোগ্য কিনা সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশের ওষুধ প্রশাসন এই নিয়মেই অনুমোদন দিয়ে থাকে।
এফডিএ বলছে, প্রার্থী ভ্যাকসিন গ্রহণকারীদের মধ্যে সংক্রমণের হার কমপক্ষে ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনতে সক্ষম প্রমাণিত হলেই তারা সেটিকে অনুমোদন দেবে।
ভ্যাকসিন কাজ করছে কিনা তা আমরা কখন জানতে পারব?
বিষয়টি এখনও খুব একটা স্পষ্ট নয়। কারণ এসব পরীক্ষাকে বলা হয়, ইভেন্ট ড্রিভেন ট্রায়াল বা ঘটনাবলী নির্ভর পরীক্ষা। এমন পরীক্ষায় স্বচ্ছ ফলাফল তখনই পাওয়া যায়, যখন প্রত্যাশা অনুযায়ী অনেক (সংক্রমণের) ঘটনা ঘটে। 'কিন্তু, এজন্য ঠিক কতটা সময় লাগবে, তা আমরা জানিনা' বলছিলেন জেনস।
তিনি আরও জানান, চলমান পরীক্ষাগুলোর অংশ হিসেবে বিজ্ঞানীরা কমপক্ষে ১৫০ জন স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়াবে, এমন ঘটনা প্রত্যাশা করছেন।
এজন্যেই প্রার্থী ভ্যাকসিন কে পেয়েছেন, আর কে পাননি তা শুরুতেই গবেষকরা জানতে পারেন না। পরীক্ষা চলাকালে সংক্রমণের তথ্য বিশ্লেষণে এজন্য আলাদা একটি কর্তৃপক্ষ কাজ করে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সকল স্তরের বিশেষজ্ঞদের নিয়েই তথ্য নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত এ বোর্ড গঠন করা হয়।
অতিদ্রুত একটি টিকা বাজারে আনার নেতিবাচক দিক কী?
টিকা আনার পর, তা যদি প্রত্যাশা অনুসারে ঠিকঠাক কাজ না করে- তাহলে মানুষ অসুস্থ হতেই থাকবে, মৃত্যুর মিছিলও থামবে না। শুধুমাত্র ৫০% সফল কোনো ভ্যাকসিন বাজারে আনার অর্থ; তখনও অনেকে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হবেন। তবে এটাও ঠিক, আংশিক কার্যকর একটি টিকা কিছুটা হলেও মহামারি নিয়ন্ত্রণে সফলতা যোগ করবে।
আবার, কার্যকর কিন্তু তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যুক্ত টিকা বাজারে আনার অর্থ হলো; এটি নিলে সম্পূর্ণ সুস্থ ব্যক্তিদের জীবনও বিপন্ন হবে।
সরকার অনুমোদিত একটি টিকা ব্যর্থ প্রমাণিত হলে, তা প্রশাসনের উপর নাগরিকদের আস্থাও বহুগুণে হ্রাস করবে।
- সূত্র: এনপিআর