কেন ‘টক্সিক’ বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখি আমরা?
রজার এবং জিমের বন্ধুত্ব ৩০ বছরের। তরুণ বয়সে তাদের একটি ব্যান্ড ছিল। সংগীত ও বিয়ারের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তাদের বন্ধুত্বের সূত্রপাত। পারিবারিক দায়-দায়িত্বের জন্য আগের মতো মেলামেশা না হলেও এখনও দুই মাসে একবার অন্তত মিলিত হন দুজন।
"কিন্তু, এখনও আমার মাথা গরম করে দেয় সে," বলেন রজার।
কোথাও 'টক্সিক বন্ধু' কথাটা শুনলে জিমের কথাই মাথায় আসে রজারের। তার দাবি, প্রতি আড্ডায় একই বিষয় নিয়ে আলাপ হয় তাদের। কারণ, তিনি কী বলছেন সেটা কখনো কানে নেন না জিম।
নিজের এই বিতৃষ্ণার কথা জিমকে কখনো মুখ ফুটে বলেননি রজার। কিন্তু কেন?
পঞ্চাশোর্ধ রজার বলেন, "এখন আর বলে কী হবে? সে হয়তো বলবে, এই কথা এতদিন বলিনি কেন?
"এছাড়া, জিম আমার স্বল্প কয়জন পুরনো বন্ধুদের একজন। হালকা বিরক্তির জন্য দুজনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গেলে ব্যাপারটা দুঃখজনক হবে।"
কিন্তু যাদের উপস্থিতি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখি কেন আমরা? পরিবার বা সহকর্মীর মতো এটা এমন কোনো সম্পর্ক না যেটা ধরে রাখতে বাধ্য আমরা। কিন্তু এরপরও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের সবারই এমন কিছু বন্ধু আছে, যাদের ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে আমাদের।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাইগাম ইয়ং ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞান এবং স্নায়ুবিজ্ঞানের অধ্যাপক জুলিয়ান হল্ট-লুনস্টাড বলেন, "ঘটনা হচ্ছে, এমন কিছু লোকই আছে যারা অন্যদের চেয়ে বেশি পায়।"
দ্বিমুখী সম্পর্ক এবং আমাদের স্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন হল্ট-লুনস্টাড। ইতিবাচক সম্পর্কের অন্তর্নিহিত সুবিধা রয়েছে অনেক, নেতিবাচক সম্পর্কে রয়েছে ক্ষতি। এগুলো সবারই জানা, এবং গবেষণাতেও প্রমাণিত।
কিন্তু যেসব সম্পর্কে এই দুইয়ের মিশ্রণ রয়েছে, সেগুলো?
হল্ট জানান, তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, এরকম 'দ্বিমুখী' বন্ধুদের সঙ্গে যেকোনো রকমের যোগাযোগ অংশগ্রহণকারীদের স্ট্রেস ও হৃদযন্ত্রের কার্যকলাপ বাড়িয়ে দেয়। এরকম কোনো বন্ধুর চিন্তাই হৃৎস্পন্দন এবং রক্তচাপ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, যেসব মানুষকে আমরা পরিষ্কারভাবে ঘৃণা করি তাদের চেয়েও এই দ্বিমুখী বন্ধুদের উপস্থিতি রক্তচাপ বাড়ানোয় বেশি প্রভাব ফেলে।
"এটি আসলে ইতিবাচকতা এবং নেতিবাচকতার মিশ্রণ। সে ব্যক্তি কী করবে বা বলবে, সেটা হয়তো আপনি আন্দাজ করতে পারেন না। আবার এটাও হতে পারে, আপনি তাকে পছন্দ করেন। যে কারণে তার নেতিবাচক বাক্যগুলো আরও বেশি আঘাত করে," বলেন হল্ট।
২০ বছর বয়সী সোফি তার স্কুল জীবনের এমন এক বন্ধু সম্বন্ধে বলেন, "ওর সঙ্গে হ্যাং-আউট করার পরে আমি খুবই নিষ্প্রভ হয়ে যেতাম। কিছুই ভালো লাগত না। কেন এমন লাগত সেটা বের করতে অনেক সময় লেগেছে আমার। অনেক সময় আড্ডা দিয়ে বাসায় যাওয়ার পর দেখতাম সে ইঙ্গিতে আমাকে নিয়ে টুইট করেছে। যেমন, 'দিনের বেলা লাল লিপস্টিক আমি অনেক অপছন্দ করি'।
"কারণ, সেদিন আমি লাল লিপস্টিক পরে ছিলাম। কেন এরকম কটু কথা বলে এটা জিজ্ঞেস করলে সে বলত, আমি বেশি সেনসিটিভ হয়ে যাচ্ছি।"
রিলেশনশিপ কোচ স্যাম ওয়েন জানান, পিছন থেকে কটু কথা বলা একজন টক্সিক বা বিষাক্ত বন্ধুর বৈশিষ্ট্য হতে পারে। এছাড়া, মুখের কথার সঙ্গে বিরোধপূর্ণ অবাচনিক যোগাযোগও একটি বৈশিষ্ট্য হতে পারে। এগুলো একজনের বিশ্বাসে ফাটল ধরায়।
"আমাদের শরীরের ভেতরকার সংবেদনগুলো নিজেকে আশেপাশের লোকজনের কাছে নেয় বা দূরে যেতে নির্দেশ দেয়," বলেন ওয়েন।
বন্ধুর উপস্থিতি যদি আপনাকে প্রায়ই ভয় পাইয়ে দেয় বা হতাশাগ্রস্ত করে, তাহলে আপনি একসময় ভাবতে শুরু করবেন, "সে আসলে আমার পক্ষের কেউ না।"
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যাদের ব্যাপারে আমাদের মিশ্র অনুভূতি আছে এবং যারা আমাদের খারাপ বোধ করায়, তাদের সঙ্গে তবুও কেন সময় ব্যয় করি আমরা?
এটা বুঝতে হলে আমাদের রবিন ডানবারের কাছে যেতে হবে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, আমরা একসাথে মোট ১৫০ জনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারি। কিন্তু তাদের সবার সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা সমান হবে না। আমাদের সকল সামাজিক যোগাযোগের ৬০ শতাংশ হয় মাত্র ১৫ জনের সঙ্গে। ৪০ শতাংশ হয় মাত্র পাঁচ জনের সঙ্গে।
এই পাঁচ জন হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে কাছের পাঁচ জন। এদেরকে আপনি বলতে পারেন 'ইনার সার্কেল'।
ডানবার জানান, ঘনিষ্ঠতার উপর নির্ভর করে হওয়া এই গ্রুপগুলোয় সবসময়ই অদল-বদল হয়। কে ইনার সার্কেলে প্রবেশ করছে, কে ইনার সার্কেল থেকে বের হচ্ছে সেটা নির্ভর করে আপনি কার সঙ্গে কতটুকু ব্যক্তিগত সময় পার করছেন তার উপর।
"সিরিয়াস পর্যায়ে চলে গেলে আপনি একসময় থামবেন এবং চিন্তা করবেন একজনের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করবেন কি করবেন না," বলেন ডানবার।
এর মানে হচ্ছে, আমরা সাধারণত কারো সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার চেয়ে তাকে দূরে সরিয়ে দিতে বেশি পছন্দ করি।
সোফি এবং তার বন্ধু অবশ্য শেষ পর্যন্ত আলাদাই হয়ে যায়। সোফির পরামর্শেই।
"ওর সাথে কয়েক বছর ধরে কোনো দেখা-সাক্ষাত নেই আমার। সে মাঝে মাঝে ইনস্টাগ্রামে আমাকে টেক্সট পাঠায়, আমি উপেক্ষা করে যাই।"
কিন্তু যারা এরকম সম্পর্ক ধরে রাখি, তারা কেন রাখি?
এর কারণ অনুসন্ধান করার সময় হল্ট ভেবেছিলেন, কারণটা হয়তো বাহ্যিক। যেমন, আমরা কাছাকাছি থাকি, বা আমাদের মধ্যে অনেক মিউচুয়াল বন্ধু আছে।
কিন্তু তার গবেষণায় দেখা যায়, কারণটা মূলত অভ্যন্তরীণ। সবচেয়ে পরিচিত কারণ যেটা দর্শানো হয়, সেটি হচ্ছে, 'এই সম্পর্কে (রিলেশনশিপে) ইতোমধ্যে অনেক সময় ব্যয় করে ফেলেছি আমি।'
ডানবার বলেন, অনেকের ইনার সার্কেল গড়ে উঠে স্কুল জীবনেই। ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সের মধ্যে তৈরি হওয়া ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বগুলোয় বয়সের কারণে বন্ধনের তীব্রতা বেশি থাকে। এবং এ সম্পর্কগুলো সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয়।
"আপনি জানেন এই ব্যক্তির সঙ্গে একসাথে থাকার ও অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করার গভীর ইতিহাস রয়েছে আপনার। যে কারণে পুরনো সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে গিয়ে এক ধরনের বাধ্যবাধকতা অনুভব করবেন আপনি, যদিও দুজন আলাদা হয়ে গেছেন," বলেন ডানবার।
হল্টের গবেষণায় দেখা গেছে, অনেকেই বন্ধুর অভদ্রতা বা খারাপ আচরণকে মেনে নেন মহানুভবতা দেখিয়ে। তারা ভাবে, মেনে নেওয়াটা তাদেরকেই বড় ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতীয়মান করছে। 'বন্ধুত্ব ধরে রাখতে পারে না' এমন ব্যক্তি হিসেবে তাদের পরিচয় হোক, সেটা চায় না তারা।
আবার অনেকের ক্ষেত্রে বন্ধুত্বের ভালো সময়গুলো খারাপ সময়কে ঢেকে দেয়। বন্ধুর ভালো দিকগুলোকে বেশি পছন্দ করার জন্য তারা এই ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে।
ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট ড. মিরিয়াম কিরমায়ার বলেন, বন্ধুত্ব তখনই বিষাক্ত হয় যখন সম্পর্কের কোনো প্রত্যাশা বা মৌলিক মূল্যবোধ কেউ ভেঙে ফেলে। উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি- বিশ্বাসে ভাঙন, বা কে কতটুকু সময় ব্যয় করছে তাতে ভারসাম্যহীনতা।
কিন্তু এ অবস্থা থেকে সম্পর্ক উদ্ধার করা কি সম্ভব? সহজ কথায়, টক্সিক বন্ধুকে কি নন-টক্সিক বানানো সম্ভব?
ড. কিরমায়ার বলেন, "এর মূলে থাকবে হবে আত্ম-প্রতিফলন। আপনার প্রথমে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, 'তার কোন বিষয়টা আমাকে বিরক্ত করছে, সেটা কি আমি জানি?"
হতে পারে আপনার সম্পর্কের মৌলিক মূল্যবোধগুলোর একটি লঙ্ঘন করা হয়েছে। যেমন, সময় না মেনে দেরি করা, কিংবা মিথ্যা কথা বলা। এক্ষেত্রে অনেক সময়ই আমরা আমাদের হতাশাটুকু পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করতে পারি না।
"সম্পর্ক কেন বন্ধুর হয়ে আসছে, তার কারণগুলো শেয়ার করলে প্রায়শই মানুষ তা যত্নের সঙ্গে গ্রহণ করে। এবং এর মাধ্যমেই হয়তো আপনারা একটি সাধারণ ভিত্তি খুঁজে পাবেন," বলেন কিরমায়ার।
এতেও যদি আপনি কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন দেখতে না পান, তাহলে আপনি বন্ধুর ইতিবাচক অবদানগুলোর দিকে নজর দিতে পারেন। এর জন্য কিছু ক্ষেত্রে সীমানা নির্ধারণের প্রয়োজন হতে পারে। যেমন, আপনি ঠিক করে নিলেন আড্ডায় কিছু বিষয় এড়িয়ে যাবেন আপনারা। কিংবা, কোনো নির্দিষ্ট কাজে বন্ধুর সঙ্গ দিবেন না আপনি।
কিরমায়ার বলেন, "অন্য কারো আচরণ এবং তারা যা করেছে তা কেন আমাদের বিরক্ত করছে, সেটি চিহ্নিত করতে পারাটা খুবই সহজ। কিন্তু ভিতর থেকে দেখলে ব্যাপারটি অন্যরকম হতে পারে। কেউ নিজেকে দোষারোপ করুক সেটা চাই না আমি। তবে বন্ধুত্বসহ সব ধরনের সম্পর্কই ব্যক্তিগত বোঝাপড়া, এবং আপনার বন্ধুদের ব্যবহার কিন্তু এক অর্থে আপনার সত্ত্বার প্রতি তাদের জবাব।"
কিরমায়ারের এই বক্তব্য হল্ট-লুনস্টাডের গবেষণার একটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে দেয়। প্রশ্নটি ছিল এমন- যারা জানেন তাদের দ্বিমুখী বন্ধু আছে, তারা কি তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে বাস্তববাদী? না তারা সব ধরনের সুবিধাই পেতে চান, তেমন ঝামেলা ছাড়া?
হল্ট বলেন, তার এই গবেষণা তাকে নিজের সম্পর্কগুলো নিয়েও ভাবিয়েছে। তার মধ্যে আত্ম-প্রতিফলন ঘটিয়েছে।
তিনি বলেন, "আমি অন্য কারো দ্বিধাদ্বন্দ্বের উৎস হতে চাই না। গবেষণার কারণে আমি ভাবা শুরু করেছি, 'আমি নিজে আসলে কেমন বন্ধু? আমি কি বন্ধুদের ঠিকভাবে সমর্থন দিচ্ছি? আমি কি নির্ভরযোগ্য?' আমরা হয়তো অন্যদের বদলাতে পারব না, কিন্তু আমরা নিজেকে সবসময়ই পরিবর্তন করতে পারি। যে কারণে, প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত নিজের দিকে তাকানো।"
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান।
অনুবাদ: কিরো আদনান আহমেদ।