কুকুর অপসারণ: জ্যাকদের অপেক্ষায় দিন গুনছেন অসংখ্য অভি
"আমার বাবা বারবার তাদের বলেছিলেন জ্যাক আমাদের পোষা কুকুর, কিন্তু তারপরও রক্ষা হয়নি," বলছিলেন অভি।
জ্যাক, পুরান ঢাকার আইজি গেইট ব্যাংক কলোনীর বাসিন্দা অভি শঙ্করের পোষা কুকুর। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কুকুর অপসারণের অভিযান থেকে মুক্তি পায়নি এই পোষা কুকুরটিও। ইঞ্জেকশন দিয়ে অচেতন করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় জ্যাককে। হন্য হয়ে মাতুয়াইল থেকে খবর নিতে নগর ভবন- নিজের পোষ্য বন্ধুকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন অভি।
মালিকানাবিহীন বেওয়ারিশ কুকুরদের বেহাল দশা তো বলাই বাহুল্য। পুরান ঢাকা, শাহজাহানপুর, মালিবাগ, কাকরাইল, ঝিগাতলা, ওয়ারির অনেক বাসিন্দা অভিযোগ তুলেছেন এসব এলাকা থেকে বিগত সপ্তাহগুলোতে বেশ কিছু কুকুর অপসারণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের প্রাণীকল্যাণ গ্রুপগুলোতে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন তারা। জ্যাকের মতো এসব কুকুরকেও ইঞ্জেকশন দিয়ে অচেতন করে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ আসছে এসব এলাকা থেকে।
কুকুর অপাসারণের আদ্যোপান্ত
কুকুর অপসারণ শুরু হওয়ার আগে শহরে কুকুরের সংখ্যা কমাতে কী করতো সিটি করপোরেশন? সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে আমাদের এই শহরেই কুকুর পিটিয়ে মেরে ফেলার রেওয়াজ ছিল। জ্বি, ঠিকই শুনছেন!
২০১২ সালে হাইকোর্ট কুকুর নিধনকে অমানবিক উল্লেখ করে তা বন্ধের নির্দেশ দেন। সরকারের পক্ষ থেকে কুকুরকে বন্ধ্যাকরণ করে সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দেওয়া হয়।
২০১২ সালের ১ এপ্রিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বেসরকারি সংস্থা অভয়ারণ্যের সঙ্গে কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলাতঙ্ক প্রতিরোধ টিকা দেওয়ার জন্য চুক্তি সই করে। ২০১৪ সালে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু পরে সেই চুক্তির নবায়ন হয়নি।
ডিএসসিসির ভেটেরিনারি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত বিরতি দিয়ে ছয় মাস কুকুর বন্ধ্যাকরণের একটি প্রকল্প চালু ছিল। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ঠিক কতো সংখ্যক কুকুরকে বন্ধ্যাকরণ করা হয়েছে, কী পরিমাণ খরচ হয়েছে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্যই ভেটেরিনারি বিভাগের কাছে নেই। বিভাগটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের মার্চ মাসে পর থেকে বেওয়ারিশ কুকুর নিয়ন্ত্রণে রাখতে আর কোনো কার্যক্রম নেওয়া হয়নি।
রিট, রিট কার্যতালিকা থেকে বাদ- আবারও অপসারণ শুরু?
কুকুরের জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ২০২০ সালেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কুকুর অপসারণ শুরু করে।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাইকোর্টে রিট করা হয়। অভয়ারণ্যের সভাপতি রুবাইয়া আহমেদ, পিপলস ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ারের চেয়ারম্যান রাকিবুল হক এমিল ও অভিনেত্রী জয়া আহসানের পক্ষে ব্যারিস্টার সাকিব মাহবুব এই রিট দায়ের করেছিলেন।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এই রিট আবেদনে কুকুর স্থানান্তর ও ডাম্প করার বিষয়ে ডিএসসিসির কার্যক্রমের বৈধতা প্রশ্নে রুল জারির আরজি জানানো হয়েছিল। রিটে বিবাদী করা হয়েছিল ডিএসসিসিসহ সংশ্লিষ্টদের।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস তখন কুকুর অপসারণ নিয়ে আর নতুন কোনো পদক্ষেপ নেই জানিয়েছিলেন। কুকুর অপসারণ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে পদক্ষেপ নেওয়া হবে জানানো হয়েছিল। এর পর সেই কার্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
ভবিষ্যতে আবারও অপসারণ কার্যক্রম শুরু হলে আবার রিটটি উত্থাপন করা যাবে বলা হয়েছিল।
এ বিষয়ে কথা হয় পিপল ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ারের (প ফাউন্ডেশন) প্রতিষ্ঠাতা রাকিবুল হক এমিলের সঙ্গে। রিটকারী তিনজনের তিনি একজন। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রিটকারী তিনজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি বলে জানান তিনি।
"অভিযোগ আসার পর থেকে আমরা নিজেরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ শুরু করি। কিছু কুকুরকে তারা বন্ধ্যাকরণ করিয়ে আগের জায়গার চেয়ে কয়েক কি.মি দূরে ছেড়ে দিয়ে আসা হয়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কোনো বৈজ্ঞানিক নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে না। প্রাণীদের জীবন সংক্রান্ত বিষয়গুলোর বৈজ্ঞানিক দিক না মেনে শুধু প্রশাসনিকভাবে কাজ চলছে। যারা এসব কাজ করছে তারাও একেবারে অনভিজ্ঞ,"
বেশ কিছু এলাকা থেকে পোষা ও আগেই বন্ধ্যাকরণ করা কুকুর তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ তিনিও পেয়েছেন বলে জানালেন।
"সিটি করপোরেশন টেকসই পদ্ধতিতে কাজ করছে না। তাদের বক্তব্য এটি পাইলট প্রজেক্ট। সরকারি অর্থ খরচ করে সাময়িকভাবে এ কাজগুলো না করে সত্যিকার অর্থে তাদের এ সমস্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মাথায় রেখে কাজ করা উচিত",
রাকিবুল হক আরও জানালেন, তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে বিষয়টি আরও কিছুদিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে- তারপর পুনরায় রিট করবেন কিনা সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
কুকুর অপসারণ কেন অযৌক্তিক?
কুকুর অপসারণের সঙ্গে যে এলাকায় কুকুর অপসারণ করা হচ্ছে সেখানে খাবারের অভাব হবে কি না, কুকুর টেরিটোরিয়াল প্রাণী হওয়ায় ওই এলাকায় আগে থেকে থাকা কুকুরের সংখ্যা, কুকুরগুলো সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশ, এলাকায় গিয়ে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে কিনা- এসব বিভিন্ন বিষয় জড়িত। এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত অমানবিক বলে মত প্রাণী অধিকার কর্মীদের।
শুধু মাত্র জায়গা থেকে অপসারণ মানেই কেন সেই প্রাণীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হবে- এ নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে। খালি চোখে দেখা যায় না এ বিষয়টি বোঝার জন্য প্রয়োজন সেই প্রাণীটির খাদ্যাভ্যাস, আচরণ ও তার পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা।
কুকুরকে টেরিটোরিয়াল প্রাণী বলা হয়। আশেপাশে খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন কোনো এলাকার নির্দিষ্ট একটি পরিধি থাকে কিছু নির্দিষ্ট কুকুরের দখলে। অন্য এলাকার কুকুর সেখানে ঢুকে পড়লেই শুরু হয় লড়াই। বাস্তব জীবনে অনেকেই হয়তো সাক্ষী হয়েছেন এমন লড়াইয়ের। এর ফলে অত্র এলাকার মানুষও কিন্তু বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন।
এ বিষয়ে কথা হয় দ্বীপান্বিতা হৃদির সঙ্গে। অসহায় প্রাণীদের আশ্রয় দিতে প্রতিষ্ঠিত আশ্রয়কেন্দ্র এএলবি অ্যানিমেল শেল্টারের প্রতিষ্ঠাতা দীপান্বিতা হৃদিও বলছিলেন, এভাবে কুকুর অপসারণ মূলত কুকুরগুলোকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া।
"এক এলাকায় জন্ম হওয়ার পর সেখানকার পরিবেশেই অভ্যস্ত হয়ে যায় কুকুর। একদম ভিন্ন নতুন পরিবেশে গিয়ে খাবার পানির অভাবে পড়ে যায়। কুকুর টেরিটোরিয়াল প্রাণী হওয়ায় এলাকার আগের কুকুরগুলোর সঙ্গে তাদের মারামারি হবেই। খাবার ও টেরিটোরির লড়াইয়ে ওই এলাকায় আগে থেকেই যে সব কুকুর ছিল, তাদের সঙ্গে নতুন কুকুরগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। এক সময় না খেতে পেয়ে, মার খেয়ে মারা যায়," বলেন তিনি।
কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে বৈজ্ঞানিক ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত পদ্ধতি না মেনে নেওয়া এ সিদ্ধান্তের ফলে মানুষ ও কুকুর কারোই লাভ হচ্ছে না, উল্টো বিপাকে পড়ছে সবাই।
দ্বীপান্বিতা বলেন, 'সিটি করপোরেশন এবার বলছে তারা কুকুরগুলোকে বন্ধ্যাকরণ করিয়ে আগের জায়গা থেকে কয়েক কি.মি দূরে ছেড়ে দিয়ে আসছে। কিন্তু তাদের কাছে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না, বন্ধ্যাকরণ করালে বিস্তারিত তথ্য থাকার কথা ছিল। কোথাইয় ছেড়ে দিয়ে আসা হচ্ছে এ বিষয়ে কোনো উত্তর দিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। পোষা কুকুর, আগেই বন্ধ্যাকরণ করা হয়েছে এমন কুকুরও তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে,"
"কুকুরগুলোকে যদি অন্য জায়গায়ও ছেড়ে দিয়ে আসা হয়, সেক্ষেত্রে নতুন এলাকাটিতে আবার কুকুরের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। নতুন কুকুর আসলে এলাকার আগের কুকুরগুলো আক্রমণাত্মক ব্যবহার শুরু করে। এ পরিস্থিতি অনেক মানুষের জন্যও ভীতিকর হতে পারে। অর্থাৎ বিষয়টি কুকুরের জন্য যেমন ক্ষতিকর, সেইসঙ্গে এই সিদ্ধান্তে মানুষেরও কোনো লাভ হচ্ছে না," বলছিলেন দ্বীপান্বিতা।
সাধারণত ছয় থেকে সাত মাস বয়সের মধ্যে কুকুর প্রজননক্ষম হয়। একটি কুকুর একবারে চার-ছয়টি বাচ্চা দিতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে আট বা এর অধিক বাচ্চাও জন্মাতে পারে। একটি কুকুর বছরে একবার বাচ্চা দিলেও, সেই বাচ্চা কুকুরগুলো আবার ছয় মাস পর থেকেই জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
মোদ্দাকথা, কোনো পরিকল্পনা ছাড়া কোনো একটি এলাকায় কুকুর ছেড়ে দিয়ে আসলে ওই এলাকায় নতুন কুকুরগুলোর খাদ্য সংকটও তৈরি হয়, নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। এসব কারণেই কুকুর অপসারণকে এক অর্থে কুকুরগুলোকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত বছর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল ট্রায়াল ভিত্তিতে বিভিন্ন এলাকার কুকুর মাতুয়াইলে ছেড়ে আসা হয়।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বরাবরই দাবি করে আসছে, কোনো এলাকার মানুষ অভিযোগ জানালেই তারা কুকুর অপসারণ করেন। কারো অভিযোগ, এলাকায় বেশি কুকুর হয়ে যাওয়ায় চলাফেরার সমস্যা হয়, কারো বা অভিযোগ হঠাত করেই আক্রমণাত্মক আচরণ করে কিছু কুকুর।
কুকুর কী আক্রমণাত্মক হতে পারে? কেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, সকালে ক্লাসে ঢোকার আগে টিএসসি, কলাভবন, এফবিএস এসব এলাকা শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকে। একটু খেয়াল করলেই অনেক সময় দেখা যায়, নিজেরা সকালের নাস্তাটা সেরে নেওয়ার সময় অনেক শিক্ষার্থীই নিজের খাবার থেকে ক্যাম্পাসের কুকুরগুলোকে খেতে দিচ্ছেন। কুকুরগুলো আবার লেজ নেড়ে তাদেরকে এগিয়ে দিচ্ছে গন্তব্য পর্যন্ত। এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দেখলেই কুকুর মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু এ কথাই মনে পড়ে যায়।
তাহলে এমন বন্ধুত্বপূর্ণ প্রাণীই কেন মাঝেমধ্যে আক্রমণ করে বসে? শোনা যায় নানা অভিযোগ?
এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। বলাই বাহুল্য, এর পেছনে অনেক সময় মানুষেরই অমানবিক কাজের দায়ভার থাকে।
প্রজননের সময়টাতে স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃতির অন্য সব প্রাণীর মতো মা কুকুর তার বাচ্চাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে। অনেক সময়ই মানুষের আক্রমণের শিকার হয় মা কুকুর। বাচ্চা কুকুর মেরে ফেলা, মা কুকুরের কাছ থেকে কেড়ে ফেলে দিয়ে আসা কিংবা দুর্ঘটনায় মায়ের সামনেই বাচ্চার গাড়িচাপা পড়ার ঘটনা অহরহ দেখা যায় আমাদের ইট-পাথরের এ নিষ্ঠুর শহরে। এসব কারণেই বছরের এ সময়টাতে মা কুকুরগুলো কিছুটা আক্রমণাত্মক হয়ে থাকে। বাচ্চার আশেপাশে মানুষের আনাগোনা হলেও হয়তো মানুষকে আক্রমণ করে বসে মাঝেমধ্যে।
এ নিয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এনিম্যাল ওয়েলফেয়ার ক্লাবের প্রেসিডেন্ট তাওহিদ তানজিমের সঙ্গে। লকডাউনের পুরো সময়জুড়ে তিনি ও তার কিছু বন্ধুরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থানরত কুকুরদের খাবার দিয়েছেন। তিনি জানালেন, কুকুরের গর্ভধারণের ও বাচ্চা জন্মানোর পরের সময়টাতে মা কুকুর চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারে।
"অনেকেই ছোট ছোট কুকুরের বাচ্চা তুলে নিয়ে যায়। কেউ ঢিল ছুড়ে, গরম পানি ছোড়ে। অনেক সময় আবার দুর্ঘটনায় বাচ্চাগুলো মারা যায়। এ সময় মা কুকুরের খাবারের দরকার হয় আরও বেশি। সব মিলিয়ে অপরিচিত মানুষ ছাড়া অন্য কেউ আশেপাশে ঘেষলেই কিছুটা আক্রমণাত্মক আচরণ করতে পারে,"
এছাড়া, মানুষের সরাসরি নির্যাতনের শিকার হওয়া কুকুরও অনেক সময় আত্মরক্ষার চিন্তা থেকে আক্রমণ করে বসতে পারে। অসুস্থ কুকুরও অনেক সময় আত্মরক্ষার্থে আক্রমণাত্মক আচরণ করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে কুকুরগুলোকে পাল্টা ঢিল না ছুড়ে ধীরে ধীরে হেঁটে চলে গেলেই আর ভয়ের কিছু নেই।
প্রতিবেশী দেশগুলো কী করছে?
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বেওয়ারিশ কুকুর নিধন ও অপসারণের বিষয়ে স্পষ্ট আইন রয়েছে। অ্যানিমাল বার্থ কন্ট্রোল (ডগস) রুলস, ২০১৯ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা সরকারি প্রতিষ্ঠান বা স্থানীয় প্রশাসন কোনো এলাকার কুকুর অপসারণ করতে পারবে না। কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন প্রাণীকল্যাণ সংগঠন কুকুরের বন্ধ্যাত্বকরণ করার কাজ করে থাকে। বন্ধ্যাত্বকরণের পর কুকুরগুলোকে আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে দিতে হয়।
ভূটানে চলতি বছরই পোষা কুকুরসহ বেওয়ারিশ সব কুকুরকে নিবন্ধনের আওতায় আনার কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। দেশটির বন ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের লাইভস্টক ডিপার্টমেন্ট 'ডগ পপুলেশন কন্ট্রোল ফ্লাগশিল প্রোগ্রাম' নামের এ কর্মসূচি শুরু করেছে। এর কর্মসূচির আওতায় পোষা কুকুরগুলো নিবন্ধিত আছে কিনা তা নিশ্চিত করা হবে। সেইসঙ্গে বেওয়ারিশ কুকুরদের নিবন্ধনের আওতায় এনে টিকা দিয়ে বন্ধ্যাত্বকরণ করার কাজ চলছে।
নেপাল ও শ্রীলঙ্কাতে প্রানীকল্যাণ সংগঠনগুলোর সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন কাজ করে, ভলান্টিয়ার নিয়োগ দেয়। এলাকাভিত্তিকভাবে টিকাদান ও বন্ধ্যাত্বকরণ করা হয়।
সমাধান কী?
কুকুরের প্রজননের বৈশিষ্ট্যের কারণে, বছর বছর অপসারণ করেও জনসংখ্যা কমানো কার্যকর পদ্ধতি না। কুকুরের জনসংখ্যা কমানোর বৈজ্ঞানিক ও সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো অত্র এলাকার কুকুরগুলোকে টিকাদানের আওতায় এনে স্পে/নিউটার (বন্ধ্যাকরণ) করিয়ে দেওয়া। এ কারণেই সংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যা সমাধানে প্রাণী অধিকার কর্মী ও বিশেষজ্ঞরা সবসময় বন্ধ্যাকরণ করানোর সুপারিশ করে থাকেন।
'সিএনভিআর বা 'ক্যাপচার (কুকুর ধরা)', 'নিউটার (বন্ধ্যাকরণ) ', 'ভ্যাকসিন (জলাতঙ্ক টিকা) ' এবং 'রিলিজ (মুক্তি) '- এ প্রক্রিয়া বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখার কার্যকর পদ্ধতি।
অভয়রাণ্য এর আগেও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে কুকুরের টিকাদান আর বন্ধ্যাকরণের কাজ করেছে।
প ফাউন্ডেশনের রাকিবুল হক এমিল জানালেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবসের জলাতঙ্ক নির্মূল ও বেওয়ারিশ প্রাণীদের বন্ধ্যাকরণের প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করবে আশা করি। আমরা যারা প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করি আমরাও যথাসাধ্য সাহায্য করবো এ কাজে,"
এএলবি এনিম্যাল শেল্টারের দ্বীপান্বিতা জানালেন, কুকুর অপসারণের পর থেকে বিভিন্ন এলাকার তরুণরা রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে যাতে তাদের আদরের কুকুরদের তুলে নিয়ে যাওয়া না হয়।
"সরকারিভাবে তারুণ্যের এ শক্তিকে কাজে লাগিয়েই বন্ধ্যাকরণ প্রকল্প অনেক দূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অবৈজ্ঞানিক ও অমানবিক পদ্ধতি বাদ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর পদ্ধতিতে এগুনো উচিত।"
কুকুরের আক্রমণ মূলত সমস্যা নয়, বরং সমস্যার ফলাফল। প্রাণীর ওপর অত্যাচার কমিয়ে সহানুভূতিশীল হলেই রাস্তার কুকুরও সেই এলাকার মানুষকে আক্রমণ করে না। শহরের বিভিন্ন এলাকাভেদে কুকুরের আচরণের পার্থক্য খেয়াল করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এ বিষয়ে প্রয়োজন সচেতনতা কর্মসূচি চালানো। টিকা দেওয়া আছে এমন কুকুর র্যাবিস আক্রান্ত হয় না। তাই র্যাবিস আক্রান্ত কুকুর যাতে আক্রমণ না করে তা নিশ্চিত করতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় সিটি করপোরেশনে উদ্যোগে কুকুরদের র্যাবিস টিকাদানের আওতায় আনার কোনো বিকল্প নেই। বন্ধ্যাত্বকরণ করা হলে সংখ্যা বৃদ্ধিও নিয়ন্ত্রণে থাকে। প্রাণিকল্যাণ আইনের যথাযথ ব্যবহার কমিয়ে আনতে পারে প্রাণী নির্যাতন।