কর্ণফুলীর বুকে এখন ঢেউ তোলে না সাম্পান
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে ৩০ বছর ধরে সাম্পান চালান বাবুল মাঝি। যাত্রী আনা-নেওয়া করে প্রতিদিন আয় হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে বাবুলের টানাটানির সংসার। কর্ণফুলী থানার ইছানগরের এই মাঝি গত এক সপ্তাহ ধরে বেকার।
করোনা ভাইরাসের কারণে কর্ণফুলীর ১২টি ঘাটে যাত্রী আনা-নেওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাবুল মাঝির মতো প্রায় তিন হাজার মাঝি বেকার হয়ে পড়েছেন।
বাবুল মাঝি বলেন, 'তিন দশক ধরে নদীতে সাম্পান চালাই। এমন দুর্দিন আমাদের আগে কখনও আসেনি। বাপ-দাদার পেশা টিকিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে। তাছাড়া যাত্রীও কমে যাচ্ছে। তাই মাঝিদের সংসার চালাতে কষ্ট হয়।'
তিনি বলেন, এমনিতে দিন আনি দিন খাই। তারমধ্যে যাত্রী পরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছি। কারও কাছে ধার চেয়েও পাচ্ছি না। সব বন্ধ থাকায় কোথাও অন্য কাজও নেই। এ ছাড়া কোনো সমিতি বা সরকারিভাবে এখনো কোনো ত্রাণ পাইনি।
কর্ণফুলী সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ফেডারেশনের তথ্যমতে, বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর ১২টি ঘাট দিয়ে যাত্রী আসা-যাওয়া করে। এ সব ঘাটে ছোট-বড় মিলে চলাচল করে তিন হাজার সাম্পান। সাম্পান চালিয়ে জীবন চালায় তিন হাজার মাঝি।
বাংলাবাজার ঘাট মাঝি কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. লোকমান মাঝি বলেন, এই ঘাটে ৩০০টি সাম্পান চলাচল করে। প্রতিদিন চার হাজার যাত্রী এই ঘাট দিয়ে আসা-যাওয়া করে। করোনার কারণে যাত্রী পরিবহণ বন্ধ হয়ে সাম্পান চলাচল বন্ধ। মাঝিরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। অন্য সময় যাত্রী কমে গেলে মাঝিরা শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালাতেন। এখন সবকিছু বন্ধ থাকায় মাঝিদের কষ্টের দিন যাচ্ছে। অনেক মাঝির পরিবার দিনে দুই বেলা খাবার পাচ্ছে না।
কর্ণফুলী সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি পিয়ার আলী বলেন, যাত্রী পরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মাঝিরা বেকার হয়ে পড়েছেন।
সরকার এখনো মাঝিদের কোনো ধরনের সহায়তা দেয়নি। কোনো সামাজিক সংগঠনও আসেনি। প্রতিনিয়ত সমিতির লোকজন আমাকে ফোন করছে তাদের জন্য কিছু ব্যবস্থা করতে। তবে আমরা অসহায়। সরকারিভাবে সহায়তা না দিলে আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে।
চট্টগ্রামে প্রথম পর্যায়ে জেলা ও শহরে সাড়ে ১৭ হাজার মানুষকে সরকারিভাবে চাল-ডালসহ খাদ্য সামগ্রী সহায়তা দেওয়া হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সজীব কুমার চক্রবর্তী বলেন, উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসন ত্রাণ বিতরণ করছে; শহরে সিটি করপোরেশন করছে। আমরা তালিকা করে ত্রাণ বিতরণের নির্দেশ দিয়েছি। এ ছাড়া নতুনভাবে ত্রাণ বিতরণের জন্য আবারও তালিকা করতে চিঠি দিয়েছি।
আলাদাভাবে মাঝিদের ত্রাণ দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেই। তবে যে যেই এলাকায় থাকেন সেখানকার চেয়ারম্যান-কাউন্সিলরের সঙ্গে যোগাযোগ করে ত্রাণ সংগ্রহ করতে পারবেন। এ ছাড়া মাঝিদের সংগঠনের পক্ষ থেকে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ত্রাণ সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে। যোগ করেন সজীব কুমার।
যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি একসময় এই সাম্পানে করে চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক বাণিজ্য হতো। বন্দর থেকে মাল বহন করে সারাদেশে পরিবহন করতো সাম্পান। এরপর ইঞ্চিনচালিত নৌকা ও জাহাজ আসার কারণে বন্দরকেন্দ্রিক পণ্য আনা নেওয়ায় সাম্পানের চাহিদা কমে। এ ছাড়া দেশের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের ব্যবসা পুরোটাই সাম্পান নির্ভর ছিল। এখনও খাতুনগঞ্জ থেকে পণ্য আনা-নেওয়া করে কিছু সাম্পান।
তবে অঘোষিত লকডাউনের কারণে খাতুনগঞ্জে ব্যবসায় স্থবিরতা চলছে। কমে গেছে বাণিজ্য। তাই পণ্য পরিবহনে লিপ্ত সাম্পানগুলো ঘাটে পড়ে আছে।
কুতুবদিয়া নৌরুট মাঝি সমিতির নেতা নুরুল হুদা মাঝি বলেন, করোনার বন্ধ শুরুর আগে ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মালামাল মজুদ করেছে। বন্ধ শুরুর পর পন্য আনা নেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগির আহমদ বলেন, প্রায় তিন শতাধিক সাম্পান ও নৌযান খাতুনগঞ্জ থেকে দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ, হাতিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়াসহ নানা এলাকায় পণ্য পরিবহন করে। করোনার কারণে ব্যবসা কমে যাওয়া পণ্য পরিবহন কমে গেছে। তাই সাম্পান মাঝিরা বেকার হয়ে পড়েছেন।
চট্টগ্রামে নৌ-শিল্পের ঐতিহ্য ১২শ' বছরের পুরনো। সমুদ্রতীরে চট্টগ্রামের অবস্থান হওয়ার কারণে পরিবেশগত কারণ এখানকার মানুষ আবিষ্কার করছিলেন সাম্পান। আকারের দিক থেকে সাম্পান বিভিন্ন ধরনের হয়। সবচেয়ে ছোট আকারের সাম্পানের দৈর্ঘ্য আনুমানিক ২০ ফুট ও প্রস্থ কমপক্ষে ৫ ফুট হয়। এ রকম একটি সাম্পানে ১৫ থেকে ১৮ জন যাত্রীধারণ করা যায়। বড়সাইজের সাম্পানগুলোতে ৩৫ থেকে ৪০ জন যাত্রী উঠানো যায়। আকারভেদে প্রতিটি সাম্পানে ৩০ থেকে ৮০ টন পণ্য পরিবহন করা যায়।