করোনায় লাশ দাফনে সহায় ‘শেষ বিদায়ের বন্ধু’
গত বছর করোনার শুরুর দিকে করোনা আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির লাশ দাফনে যখন দেশে অমানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, আক্রান্ত ব্যক্তির মৃতদেহ দাফনে ও সৎকারে কেউ এগিয়ে আসছিল না বা অনেক জায়গায় বাধা দিচ্ছিল, তেমনই সংকটময় মুহূর্তে চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে যাত্রা শুরু হয় 'শেষ বিদায়ের বন্ধু' (শেবিব), [Friend in the ultimate Farewell (FUF)] সংগঠনের।
গত বছরের ৮ এপ্রিল গড়ে ওঠা এই সংগঠন করোনা আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির দাফন এবং করোনা বিষয়ে জনসচেতনতায় কাজ করে যাচ্ছে।
২১৬ জনের ১৮টি টিমে প্রতি টিম লিডারের অধীনে ৫ জন করে নারী ও ৭ জন করে পুরুষ স্বেচ্ছাসেবায় কাজ করে যাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী ও খাগড়াছড়ি জেলায় গত ১ বছরে ৯২ ব্যক্তির লাশ দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করেছে এই সংগঠন। এর মধ্যে করোনা পজিটিভ, করোনা সাসপেক্টিভ এবং স্বাভাবিক মৃত নারী-পুরুষ রয়েছে।
শুরুতে করোনা আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে এই সংগঠনের সেবার পরিধি আরও বিস্তৃত হয়েছে।
বর্তমানে সংগঠনটি করোনা পজিটিভ, বেওয়ারিশ এবং যেকোনো মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনের ব্যবস্থা, লাশ ধোয়ানোর ব্যবস্থা, ২৪ ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস ও অক্সিজেন সার্ভিস, এতিম, দরিদ্র ও অসচ্ছলদের সহায়তা, দুর্যোগকালীন ত্রাণ সহায়তা, ফ্রি কাফনের কাপড় বিতরণসহ নানা মানবিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন ওয়ারলেস এলাকায় সংগঠনটির নিজস্ব কার্যালয় থেকে পরিচালিত হচ্ছে এসব কর্মসূচী।
দেশে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে মসজিদের ইমাম মোয়াজ্জিন ও নুরানী মাদ্রাসার শিক্ষকদের ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়। ১০০ হাফেজ শিক্ষার্থীকে জুব্বা ও পায়জামা এবং নারীদের বোরকা প্রদান করা হয়। বিভিন্ন শিল্প গ্রুপের সহযোগিতায় করোনা সচেতনতায় মাস্ক বিতরণ, পরিবেশ রক্ষায় মসজিদ মাদ্রাসার শিক্ষকদের মাঝে গাছের চারা বিতরণ করে শেবিব।
সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান সমন্বয়কারী সাংবাদিক নুরুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুতে করোনা আক্রান্ত ভেবে নিজের মাকে রাস্তায় ফেলে দেওয়ার ঘটনা আমাদের ভীষণভাবে ব্যথিত করেছিল। কেউ যখন করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যান, তার আত্মীয়-স্বজন তাকে কবর দেওয়ার সাহস করছিল না। তখন আমরা স্থানীয় কয়েকজন তরুণ এগিয়ে আসি।'
তিনি বলেন, 'গত বছরের ৩ জুন মিরসরাইয়ের কাতার প্রবাসী সালেহ আহমদ দেশে এসে করোনা নিয়ে চট্টগ্রামের হালিশহরে মারা গেলে তার ভাই কবর দেওয়ার জন্য তাকে গ্রামে নিয়ে আসেন। এই খবর শুনে সে বাড়ির সব লোক বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। সারা দিন বৃষ্টির মধ্যে লাশটি ভিজেছিল। লাশের ওপর বিচরণ করছিল হাঁস-মুরগি । আমরা খবর পেয়ে লাশ দাফন করি।'
২০২০ সালের ৮ এপ্রিল অস্থায়ী কার্যালয় দারুল উলুম মাদ্রাসা থেকে শুরু হয় 'শেষ বিদায়ের বন্ধু' সংগঠনের আনুষ্ঠানিক পথচলা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এই সংগঠনের লক্ষ-উদ্দেশ্য নিয়ে পোস্ট করা হলে ব্যাপক সাড়া পড়ে। জনপ্রতিনিধি, ডাক্তার, সাংবাদিক, মাদরাসা শিক্ষক, মসজিদের ইমাম ও সমাজের সকল স্তরের মানুষের সহযোগতিায় সংগঠনটি দ্রুত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। ধীরে ধীরে সংগঠনের সেবা ছড়িয়ে পড়ে মিরসরাইয়ের সীমানা ছাড়িয়ে পাশ্বর্বতী উপজেলা ও জেলায়। বর্তমানে সেবার সুবিধার্থে বিভিন্ন উপজেলায় সংগঠনটির শাখা অফিস রয়েছে। 'শেষ বিদায়ের বন্ধু'রা সম্পূর্ণ বিনা খরচে নির্ভয়ে লাশের গোসল করিয়ে খাটিয়ায় তুলে কাঁধে নিয়ে দাফন সম্পন্ন করেন।
মিরসরাই উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভায় শেবিবের ১৮টি ইউনটি গঠিত হয়। প্রতি ইউনিয়নে ৭ জন পুরুষ ও ৫ জন নারীর আলদা টিম রয়েছে। মোট ১৮টি ইউনিটে ২১৬ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন।
নুরুল আলম আরও বলেন, 'এমনও দিন ছিল, রাত ৩টায় শেষ বিদায়ের বন্ধুরা লাশের গোসল, দাফন-কাফন করে নিজ ঘরে থাকতে পারেননি, নিজ গ্রামেও আসতে পারেননি। একদিকে পরিবারের সুরক্ষার চিন্তা; অন্যদিকে সমাজের এক শ্রেণির মানুষের করোনার লাশ দাফনের অজুহাতে স্বপরিবারে গ্রাম ছাড়া করার হুমকি ছিল করোনার চেয়েও ভয়ংকর। তবু রাত-দিন অ্যাম্বুলেন্স আর কাফনের কাপড় নিয়ে সদা প্রস্তুত থাকতেন শেষ বিদায়ের বন্ধুরা। করোনায় আক্রান্ত হয়ে কোনো রোগীর মৃত্যু খবর পেলেই দাফন-কাফনে ছুটে যেতেন সংগঠনটির সদস্যরা।'
শুরুতে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির লাশ দাফন করতে গিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে সংগঠনটির সদস্যদের। লাশ দাফনের পর কবরে দেওয়ার জন্য ময়লা পানি, খাটিয়া দিতে অস্বীকৃতি, বাসার সামনে বৃষ্টিতে লাশ পড়ে থাকার পরও স্বজনদের কাছে না যাওয়া, বিদেশ থেকে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি লাশ আসার পর কফিন খুলতে সরঞ্জাম না দেওয়াসহ নানা অমানবিক আচরণেও দমে যাননি সংগঠনের সদস্যরা।
সংগঠনটির সমন্বয়কারী নিজাম উদ্দিন বলেন, 'কর্মসূচী অব্যাহত রাখতে গিয়ে আমাদের সংগঠনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা নিজেরা করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। মিরসরাইসহ দেশ-বিদেশে অবস্থানরত অনেকের সহযোগিতায় আমাদের কর্মসূচী অব্যাহত থেকেছে।'
কুমিল্লায় সিআইডিতে কর্মরত পুলিশ পরিদর্শক রাশেদ খান চৌধুরী বলেন, 'আমার নিকটাত্মীয় করোনা আক্রান্ত হলে অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করে শেষ বিদায়ের বন্ধু সংগঠন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে সংগঠনটির অ্যাম্বুলেন্সের সহযোগিতা নিয়ে তাকে চট্টগ্রাম নগরীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তার মৃত্যুর পর পুনরায় সহযোগিতা চাইলে সংগঠনটির অ্যাম্বুলেন্স সহকারে লাশ চট্টগ্রাম শহর থেকে মিরসরাইতে তাদের অফিসে নিয়ে গোসলের ব্যবস্থা করে। এর পর দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করেন সংগঠনের সদস্যরা।'
তিনি আরও বলেন, 'করোনার এই দুঃসময়ে শুধু মিরসরাই নয়, দেশের প্রতিটি অঞ্চলে এমন মানবিক সংগঠন গড়ে ওঠা প্রয়োজন।'
আবদুর রহমান ঈশান বলেন, 'গত বছরের ৮ জুলাই আমার শ্বশুর করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ওই সময়ে করোনা নিয়ে দেশে চরম ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। এমনই পরিস্থিতিতে মিরসরাই থেকে নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলায় গিয়ে তার পারিবারিক করবস্থানে দাফন কাফনের ব্যবস্থা করেন শেষ বিদায়ের বন্ধু সংগঠনের সদস্যরা।'