করোনাভাইরাস: সবার আগে ভ্যাকসিন পাবে কারা?
বিজ্ঞানীরা সফলভাবে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন তৈরি করার পরও চাহিদা অনুযায়ী ভ্যাকসিনের যোগান সীমিত থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো একটি কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি, টেস্টিং ও প্রস্তুতকরণের জন্য কী পরিমাণ সময় লাগতে পারে, নতুন করে এ ব্যাপারে নীতিমালা নির্ধারণ করা হচ্ছে।
ভ্যাকসিনকে সার্বজনীন করতে নেওয়া হচ্ছে অভূতপূর্ব কিছু পদক্ষেপ।
তবে আশঙ্কা করা হচ্ছে, ভ্যাকসিন পাওয়ার দৌঁড়ে ধনী দেশগুলো এগিয়ে থাকবে; ফলে বঞ্চিত হবে দরিদ্র দেশগুলো।
কোন দেশগুলো দ্রুত ভ্যাকসিন পাবে, দাম কেমন হবে, এই সংকটকালীন সময়ে সমবন্টন কীভাবে নিশ্চিত করা যায়- এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছেই।
সংক্রামক রোগের ভ্যাকসিন তৈরিতে সাধারণত বছরখানেক সময় লাগে, টেস্টিংয়ের কাজ শেষ করে বাজারজাতকরণ করতে সময় লাগে আরও বেশি। তারপরও ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার শতভাগ নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। বর্তমান সময় পর্যন্ত শুধু একটি সংক্রামক রোগ-ই সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা গেছে। তবু, স্মলপক্স দূরীকরণে সময় লেগেছে ২০০ বছর!
পোলিও, ধনুষ্টংকার, হাম, মাম্পস ও যক্ষ্মার মতো রোগগুলো আমরা সঙ্গে নিয়েই বসবাস করছি; ভ্যাকসিনের ফলে এসব রোগ এড়িয়ে চলা সম্ভব।
কবে নাগাদ ভ্যাকসিন সহজলভ্য হবে?
ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা প্রমাণের পরীক্ষণের জন্য ইতোমধ্যেই হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী ভ্যাকসিন ট্রায়ালে যোগ দিয়েছেন। গবেষণা থেকে প্রস্তুতকরণের এই প্রক্রিয়ায় সাধারণত পাঁচ থেকে ১০ বছর সময় লাগে। তবে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে এই সময় অনেক কমিয়ে আনা হয়েছে ইতোমধ্যেই।
দ্রুত কার্যকর ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীরা বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছেন।
রাশিয়ার স্পুটনিক ফাইভ ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীর শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে, অক্টোবরেই দেশটিতে গণহারে টিকা প্রদান কার্যক্রম শুরু হবে। চীনও ভ্যাকসিন ট্রায়ালে সফলতা পাবার পর প্রাথমিকভাবে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য এই টিকা যোগান দিয়েছে। তবে দুটি ভ্যাকসিনই অল্প সময়ে তৈরি হওয়ায় এ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই দুই ভ্যাকসিনের কোনোটিই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ করা ভ্যাকসিনের তালিকায় নেই।
আরও কয়েকটি ভ্যাকসিন এ বছরের মধ্যে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে ২০২১ সালের মাঝামাঝির আগে ভ্যাকসিন সহজলভ্য হবার আশা করছে না বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
ব্রিটিশ ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকা যুক্তরাজ্যে ১০০ মিলিয়ন ডোজ ও বিশ্বব্যাপী দুই বিলিয়ন ডোজ সরবরাহের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তবে ভ্যাকসিনের চূড়ান্ত পর্যায়ের পরীক্ষায় একজন অংশগ্রহণকারী অসুস্থ হয়ে পড়ায় এই কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।
ফিজার ও বায়োএনটেক জানায়, তারা কোভিড-১৯-এর এমআরএনএ ভ্যাকসিন উৎপাদনে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে। অক্টোবরের মধ্যেই এই ভ্যাকসিনের অনুমোদন পেতে পারে বলেও জানায় প্রতিষ্ঠানটি। অনুমোদন পেলে প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে শেষে ১০০ মিলিয়ন ডোজ উৎপাদনে সক্ষম হবে। ২০২১ সালের শেষ নাগাদ ১.৩ বিলিয়নের বেশি ডোজ উৎপাদন করতে পারবে।
বর্তমানে ২০টি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। এই ভ্যাকসিনগুলোর কোনোটা কার্যকর প্রমাণিত হয়ে অনুমোদন পেলেও, তাৎক্ষণিকভাবে ঘাটতির সৃষ্টি হবে।
ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ প্রতিরোধ
ইতোমধ্যেই কিছু দেশের সরকার প্রার্থী ভ্যাকসিনগুলোর অনুমোদনের আগেই কোটি কোটি ডোজ পাওয়ার জন্য চুক্তি করছে। যুক্তরাজ্য সরকার ছয়টি প্রার্থী ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে।
২০২১ সালের জানুয়ারি নাগাদ ৩০০ মিলিয়ন ডোজ পাবার আশা করছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডসি) ১ নভেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যকে ভ্যাকসিন কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছে। তবে সব দেশের বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভ্যাকসিন কেনার সামর্থ্য নেই।
মেডিসিনস সানস ফ্রন্টিয়ারের মতো সংস্থাগুলো জানায়, ধনী দেশগুলোর এভাবে আগে আগে চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ভ্যাকসিন কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টার ফলে ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের বিপদজনক এক প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে দরিদ্র দেশগুলোর জনগণের জন্য ভ্যাকসিন সহজে সহজলভ্য হবে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহকারী মহাপরিচালক ড. মারিয়াঞ্জেলা সিমাও বলেন, 'আমাদেরকে ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ প্রতিরোধ নিশ্চিত করতে হবে। ভ্যাকসিনের নায্য বন্টনই বর্তমান লক্ষ্য, যাতে শুধু ধনী দেশ নয়, বরং সব দেশই ভ্যাকসিন পায়।'
ভ্যাকসিনের দাম
বিশ্বজুড়ে ভ্যাকসিন উৎপাদনে বিনিয়োগ করা হয়েছে কয়েক বিলিয়ন ডলার। বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হবে ভ্যাকসিন সরবরাহ ও কেনার জন্যও।
ভ্যাকসিনের ধরনের ওপর ডোজপ্রতি দাম নির্ভর করে। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি মডার্নার সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের প্রতি ডোজ কিনতে খরচ হবে ৩২ থেকে ৩৭ ডলারের মতো।
অ্যাস্ট্রাজেনেকা জানায়, তারা মহামারি চলাকালীন খুবই ক্ষুদ্র কিংবা বিনা লভ্যাংশে ভ্যাকসিন বিক্রি করবে। দ্রুত ভ্যাকসিন তৈরি করে কম মূল্যে ১০০ মিলিয়ন ডোজ কম ও মাঝারি আয়ের দেশগুলোতে বাজারজাতকরণের জন্য জিএভিআই এবং বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়াকে ১৫০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেয়। তারা জানায় এই ভ্যাকসিন ডোজপ্রতি ৩ ডলারে বিক্রি করা হবে।
অস্ট্রেলিয়া জানিয়েছে, তারা বিনামূল্যে জনগণের কাছে ভ্যাকসিন পৌঁছে দিবে। দাতব্য সংস্থাগুলোর মাধ্যমেও অনেক মানুষ বিনামূল্যে ভ্যাকসিন পাবেন।
অগ্রাধিকার পাবে কারা?
ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো ভ্যাকসিন তৈরি করলেও, ভ্যাকসিন প্রথমে কারা পাবে, তা তারা নির্ধারণ করতে পারবে না। অ্যাস্ট্রাজেনেকার এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট স্যার মিন পাঙ্গালোস বিবিসিকে বলেন, 'প্রতিটি দেশ বা সংস্থাকে প্রথমে এটি ঠিক করতে হবে কীসের ভিত্তিতে কাদের প্রথমে টিকা প্রদান করা হবে।'
ভ্যাকসিনের প্রাথমিক যোগান পর্যাপ্ত না হওয়ায়, এ ব্যাপারে মৃত্যুহার হ্রাস করা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার সুরক্ষাই প্রাথমিক অগ্রাধিকার হবে।
নিম্ন ও নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশগুলোর জন্য কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি মাধ্যমে ভ্যাকসিন কেনা ও সরবারাহের কাজে নেতৃত্ব দেবে ইউনিসেফ। কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটির পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথম দিকে উৎপাদিত ভ্যাকসিন থেকে যুক্ত হওয়া দেশগুলো ওই দেশের ৩ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় ডোজ পাবে।
প্রথম দিকের এই ডোজগুলো মূলত স্বাস্থ্য ও সমাজকর্মীদের জন্যই বরাদ্দ থাকবে। ভ্যাকসিন উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে, দেশগুলোর ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় ডোজ সরবরাহ করা হবে। এই ডোজগুলো বয়স্ক ও জটিল স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ থাকবে।
প্রতিটি দেশ তার ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় ডোজ বরাদ্দ পাবার পরই, অন্যান্য দিক বিবেচনা করে পরবর্তীকালে ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হবে।
নিজ অর্থে ভ্যাকসিন পেতে আগ্রহী দেশগুলোর আগামী ১৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটিতে যুক্ত হওয়া নিশ্চিত করে ৯ অক্টোবরের মধ্যে অগ্রিম ক্রয়চুক্তি সম্পন্ন করতে হবে।
জিএভিআই জানায়, ধনী দেশগুলো তাদের ১০-৫০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য ভ্যাকসিন ডোজ কেনার অনুরোধ জানাতে পারে; তবে 'কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি'তে যুক্ত প্রতিটি দেশ ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য ভ্যাকসিন পাওয়ার আগে, কোনো দেশকে এর বেশি ডোজ দেওয়া হবে না।
ড. বার্কলে জানান, কোনো স্থানে তীব্র প্রাদুর্ভাব এড়াতে, দাতব্য সংস্থার জন্য বা শরণার্থীদের জন্য উৎপাদিত ভ্যাকসিনের ৫ শতাংশ ডোজ মজুদ করা হবে।
বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন বিতরণের উপায়
ভ্যাকসিনের সরবরাহ প্রক্রিয়া অনেকটাই নির্ভর করে কোন ভ্যাকসিনটি সফল হবে, তার ওপর। একটি আদর্শ ভ্যাকসিন সাশ্রয়ী হওয়া প্রয়োজন, দীর্ঘমেয়াদি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সাধারণ শীতলীকরণ ব্যবস্থায় সংরক্ষণের সুবিধা থাকা ও দ্রুত উৎপাদন করার ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন।
ভ্যাকসিন সংরক্ষণের জন্য সাধারণত ২সি থেকে ৮সি তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। উন্নত দেশগুলোতে সরবরাহের জন্য এটি কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। তবে অবকাঠামোগতভাবে অনুন্নত ও বৈদ্যুতিক ঘাটতি আছে এমন দেশে এটি বেশ কঠিন কাজ।
এমএসএফ-এর মেডিকেল পরামর্শদাতা বারবারা সাইত্তা বিবিসিকে জানান, কোল্ড চেইনের মাধ্যমে ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও সরবরাহের কাজেই প্রতিকূলতার মুখে পড়বে দেশগুলো। এজন্য আরও বেশি যন্ত্রপাতি ও এর রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজনীয়।
অ্যাস্ট্রাজেনেকা জানায়, ২ সি থেকে ৮ সির সাধারণ কোল্ড চেইন ব্যবস্থার মাধ্যমেই তাদের ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করা সম্ভব। তবে ধারণা করা হচ্ছে, বেশ কয়টি প্রার্থী ভ্যাকসিন অনুমোদন পেলে, সরবরাহের কাজে সংরক্ষণের জন্য মাইনাস ৬০ সি বা অত্যধিক শীতল তাপমাত্রার সংরক্ষণ ব্যাবস্থার প্রয়োজন হবে।
বারবারা সাইত্তা আরও জানান, ইবোলা ভ্যাকসিন সংরক্ষণের জন্য মাইনাস ৬০ সি তাপমাত্রার প্রয়োজন হওয়ায়, বিশেষায়িত কোল্ড সিস্টেম ব্যবহার করতে হয়, কর্মচারীদেরও নতুন যন্ত্রপাতির ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিতে হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ড. সিমাও বলেন, 'ভ্যাকসিনই একমাত্র সমাধান নয়। রোগ নির্ণয়, আক্রান্তদের চিকিৎসা, মৃত্যুহার হ্রাসে কাজ করা, জনসচেতনতা ও ভ্যাকসিন- এ সবকিছুই প্রয়োজন।'
- সূত্র: বিবিসি