কমপক্ষে বিশ পদের নিরামিষ খেতে পারবেন এখানে গেলে!
টেবিলে বসার সাথে সাথে পরিবেশনকারীরা সামনে রেখে দিয়ে যাবেন ছোট ছোট স্টিলের বাটি ভর্তি বিভিন্ন তরকারি আর সবজি। এর মধ্যে কোনো পদ হয়তো আপনি আগেই খেয়েছেন, আবার কোনো পদের নামটাই হয়তো প্রথম শুনবেন।
চারপাশের টেবিলের দিকে চোখ বোলালেও দেখা যাবে প্রতিট টেবিলে রয়েছে ট্রেতে ভর্তি হরেক রকম তরকারি আর সবজির মেলা। ট্রেতে সাজানো ছোট ছোট বাটিতে ৮-১০ পদ। সবই নিরামিষ। কাশ্মীরি পনির, ছানার ধোকা, সয়াবিন সবজি, পটোল-সরিষা ভুনা, ডালের বড়ার রসা—আরও নানা কিছু। শেষ পাতে মৌসুমী ফলের চাটনি আর শ্যামদানার পায়েস।
ঢাকা শহরের অলি-গলিতে অসংখ্য খাবারের রেস্তোরাঁর দেখা মিললেও, সেগুলো মূলত আমিষ খাবার নির্ভর। তাই নিরামিষ খাবারের এ ধরনের বর্ণনা দেখে হয়তো অবাকই হচ্ছেন কিছুটা। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, নিরামিষ খাবারের এমন সমাহার রয়েছে এই শহরের বুকেই।
কোথায় পাবেন এসব নিরামিষ খাবার? সেজন্য আপনাদের যেতে হবে পুরান ঢাকার তাঁতিবাজারে। বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী সব কাবাব-বিরিয়ানির ভিড়ের মাঝেই সেখানে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে ছয়-সাতটি নিরামিষ হোটেল। এসব হোটেল পরিচালনার দায়িত্বে আছেন ইসকন ভক্তরা।
চলুন, জেনে নেওয়া যাক পুরান ঢাকার তাঁতিবাজারের এমন তিনটি নিরামিষ হোটেল সম্পর্কে।
বিষ্ণুপ্রিয়া হোটেল
বয়সের দিক থেকে সবচেয়ে বড় বিষ্ণুপ্রিয়া হোটেল। ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে গ্রাহকদের ভিড় ধরে রেখেছে হোটেলটি। তবে কয়েক পুরুষের হাত বদল হওয়ায় বিষ্ণুপ্রিয়া হোটেলের বর্তমান ঠিকানা তাঁতিবাজারের ৯৫ নং মার্কেটের গেটের ভিতরে নিচ তলায়। এর আগে তাঁতীবাজারের ১১০ নম্বর মার্কেটে এর অবস্থান ছিল।
নিচ তলায় গেটের ভিতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে পরপর দুটি 'বিষ্ণুপ্রিয়া হোটেল' লেখা সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী যেতে থাকলে পেয়ে যাবেন ঐতিহ্যবাহী সেই বিষ্ণুপ্রিয়া হোটেল। ভেতরের সাজসজ্জা একদম সাধারণ এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। লোকজনের ভিড় এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ ঘরোয়া পরিবেশে খেতে চাইলে বিষ্ণুপ্রিয়া আপনার তালিকায় প্রথম জায়গাটি সহজেই দখল করতে সক্ষম।
২০১৭ সাল থেকে সরস্বতী হালদার হোটেলের মালিকানায় রয়েছেন। সাথে রয়েছেন ছেলে সুমন হালদার। হোটেলটির সার্বিক দেখাশোনার দায়িত্বে কাজ করছেন পরিবারের সদস্যরা। বাবুর্চির দায়িত্বে আছেন সুমন হালদারের মামা শংকর এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছেন মা সরস্বতী হালদার। বাইরের কোনো কর্মচারী না রেখে নিজেরাই সম্পূর্ণভাবে তদারকি করছেন।
সরস্বতী হালদারের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, এখানে আসার আগে তিনি এবং ভাই শংকর দশ বছর কাজ করেছেন জগন্নাথ ভোজনালয়ে। পরে বিষ্ণুপ্রিয়া হোটেলের মালিকানা কিনে নেন।
সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকে হোটেলটি। দুপুর ও রাতে ১৫ থেকে ২০ ধরনের নিরামিষ পাওয়া যায়। মৌসুম অনুযায়ী তরকারি রান্না হয়। নিয়মিত পদের তালিকায় আছে সয়াবিন সবজি, পাঁচ সবজি, কাশ্মীরি পনির, ছানার রসা, আলু-পটোলের রসা, মুগ ডাল, বুটের ডাল, বিভিন্ন ধরনের শাকভর্তা, চাটনি, পায়েস। সঙ্গে থাকে অন্ন বা সাদা ভাত। শীতকালে ভাতের পাশাপাশি 'পুষ্পান্ন' (পোলাও) আর খিচুড়িও পাওয়া যায়। আর সকাল-বিকেলে নাশতার ব্যবস্থাও আছে। সব খাবারের দাম ১০ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে। সরস্বতী হালদার বলেন, "১০০ টাকার কমেই এখানে পেট ভরে খাওয়া যায়।"
জগন্নাথ ভোজনালয়
তাঁতিবাজার এলাকার বাকি নিরামিষ হোটেলের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় হলো জগন্নাথ ভোজনালয়। তাঁতিবাজার শিবমন্দির থেকে ডানদিকে একটু আগালেই সামনে পড়বে হোটেলটি। ওপরে বৈদুত্যিক খুঁটি আর কালো তারের বেড়াজালে অনেকটাই লোকচক্ষুর আড়ালে রয়েছে একটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা 'জগন্নাথ ভোজনালয়'।
সাধারণ মানের ছিমছাম এই হোটেলটিতে একসঙ্গে জায়গা হয় প্রায় ৩৬ জনের। সকাল ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গ্রাহকদের আনাগোনায় মুখরিত থাকে জগন্নাথ ভোজনালয়।
এখানে ভাত এক প্লেট ১০ টাকা, পাপড় ভাজা, বেগুনী ৫ টাকা করে, সব্জির দাম অনুসারে কিছু তরকারির দাম কম-বেশি হলেও, বেশিরভাগই ২৫ টাকা করে। ১৫০-২০০ টাকা ধরলে এখানে আপনি তৃপ্তি নিয়েই উদরপূর্তি করতে পারবেন।
তাঁতিবাজারের এই হোটেলটির যাত্রা ১৫ বছর আগে নিতাইপালের হাত ধরে। সবাই তাকে নিতাইবাবু বলেই ডাকত। করোনায় মৃত্যুর পর হোটেলের মালিকানা হাত বদলায়। বর্তমানে এটির তত্ত্বাবধানে আছে অশোক কবিরাজ। একজন বাবুর্চি, চারজন সহযোগীসহ মোট পাঁচজন এখানে বর্তমানে কর্মরত।
করোনায় ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে অশোক কবিরাজের স্ত্রী শিল্পী রানী বলেন, করোনায় গ্রাহকসংখ্যা অর্ধেকের বেশি কমে আসলেও আমরা অন্য দোকানগুলোর মতো একেবারে বন্ধ করে দিইনি। একবেলা খোলা থাকতো তখন।
কথা হয় ব্যাংক কর্মকর্তা রূম্পার সঙ্গে। রূম্পা বলেন, "লাঞ্চ ব্রেকে আমি প্রায়ই এই নিরামিষ হোটেলগুলোতে আসি। সাধারণত বাসায় নিরামিষের এই আইটেমগুলো রান্না করা হয় না। কিন্তু এখানে আসলে মৌসমী তরকারিসহ অন্য অনেক আইটেম খেতে পারি।বৈচিত্র্যের পাশাপাশি তরকারিগুলো খেতেও অনেক সুস্বাদু আর স্বাস্থ্যকর।"
রান্নার বিশেষত্ব নিয়ে জানতে চাইলে শিল্পী রানী বলেন, "দৈনিক ১৬-১৭ পদের নিরামিষ রান্না হয় এখানে। একাদশীর দিন ছাড়া অন্যদিনে এখানে মিলবে সয়াবিন রসা, বড়া, কাঁচকলার রসা, শুক্ত, সজনে তরকারি, কলার মোচার তরকারি, কাঁঠালের ঋতুতে কাঁঠাল তরকারি, বুট, মাষকলাই ও মুগ ডাল, লাউয়ের তরকারি ও বেগুনি। একাদশীর দিনে পাওয়া যাবে পুষ্পান্ন, খিচুড়ি, ছানার রসা, বাদাম ভুনা, ফুলকপির রসা, সাগুদানা ভুনা ও পাঁচ তরকারি। মিষ্টান্ন হলো শ্যামা দানার পায়েস। একাদশীর দিন ছাড়া অন্যান্য দিনেও এ পদগুলো মিলবে।
এই দিনের পদগুলোর সঙ্গে অন্যদিনের পদগুলোর পার্থক্য হচ্ছে মসলা ও তেলে। এ দিনে মসলা বলতে শুধু আদা ও কাঁচা মরিচ ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া সয়াবিন তেলের বদলে ব্যবহার করা হয় সূর্যমুখীর তেল। সাধারণ দিনে সয়াবিন তেল ও সাধারণ মসলাদি দিয়েই রান্না করা হয়। তবে পেঁয়াজ ও রসুনের ব্যবহার হয় না কোনো দিনই। হয় না মাছ, মাংস ও ডিমের কোনো পদ।
কথা হয় স্বপন কুমার হালদার নামক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের সঙ্গে। সাভার থেকে পুরান ঢাকায় নিরামিষ খাবারের সন্ধানে এসেছেন। তিনি জানান, 'আমরা বন্ধুরা মিলে প্রায়ই আসি পুরান ঢাকার নিরামিষ হোটেলগুলোতে। বিশেষ করে এখানকার ছানার রসা জিভে লেগে থাকার মতো।"
হোটেলের অন্যতম কর্মচারী সঞ্জয় ১০ বছর ধরে লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, "নিতাই বাবুর মৃত্যুর পর মালিকানা বদল হলেও নিতাইবাবুর তৈরি করা নিয়মেই এখনও সব চলছে।"
আদি গোবিন্দ হোটেল
তাঁতিবাজারের শিবমন্দিরের কাছেই আদি গোবিন্দ রেস্টুরেন্ট; ২০১০ সাল থেকে হোটেলটির যাত্রা। বিষ্ণুপ্রিয়া আর জগন্নাথের মতো গোবিন্দ হোটেলেরও মালিকানার হাত বদলেছে। বর্তমানে এর তদারকি করছেন তিন ভাই মিলে। মেজো ভাই সুমন শিকদার জানান, "প্রতিদিন প্রায় ৮-১০টি নিরামিষ খাবারের পদ তৈরি করা হয়। ফ্রিজের ব্যবস্থা নেই বলে প্রতিদিন নতুন নতুন সবজি কিনে নিত্য নতুন খাবার রান্না করি আমরা।"
"এখানে শুধু ভাত আর ডাল মাত্র ২৫ টাকা। এছাড়া অন্যান্য সবজি প্রতি প্লেট মাত্র ৫০ টাকা। টাকার পরিমাণ যেমন কম, খাবারের মান ও স্বাদ তেমনই ভালো," তিনি জানান।
এছাড়া রয়েছে রাধামাধব নিরামিষ হোটেল, জয় মা তারা আর গোপীনাথ নিরামিষ ভোজনালয়। দোকানগুলোর সবই তাঁতিবাজার শিবমন্দিরের আশপাশে। এসব দোকানেও একই রকম নিরামিষ খাবার পাওয়া যায়, দামও প্রায় কাছাকাছি। শুধু তাই নয়, এই প্রায় প্রতিটি হোটেলেই রয়েছে খাবার পার্সেল নেবার সুবিধা। আর জগন্নাথ ভোজনালয় আপনাকে দিবে হোম ডেলিভারির সুবিধা।
নিরামিষ আমাদের শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমতে দেয়না, স্নায়ু সতেজ রাখে এবং চুল ও ত্বককে সুস্থ রাখে। তাছাড়া এখানকার বেশিরভাগ হোটেলেই ফ্রিজের ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিদিনের খাবার প্রতিদিন রান্না করা হয়। তাই যারা স্বাস্থ্যসচেতন তাদের জন্য এই হোটেলগুলো হতে পারে আদর্শ হিন্দু হোটেল। মাছ-মাংসে অভ্যস্ত জিভের স্বাদ বদলাতে ঘুরে আসা যেতে পারে এ দোকানগুলো থেকে।