আফিম যুদ্ধে পরাজয়ের পর ১০০ বছর অপমানে ধুঁকেছে চীন, হারিয়েছে হংকং
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি- বাংলার পরাধীনতার সাথে এই প্রতিষ্ঠানটির নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে। বেনিয়া শক্তির লালসা থেকে জন্ম নেওয়া এই বাণিজ্যিক সংস্থাটি দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার সম্পদ লুঠের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল।
ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে শুরু করে চীন পর্যন্ত কোম্পানির অসাধু, শোষণমূলক বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড ও সরাসরি রাজ্য দখলে বিপর্যস্ত হয় লাখ লাখ জীবন-জীবিকা। মুনাফার নেশায় মত্ত ব্রিটিশ বণিকের হাতে রাজদণ্ড চলে যাওয়ার করুণ পরিণতি আজ কারোরই অজানা নয়।
অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিই প্রথম প্রকৃত কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান।
এশীয় সভ্যতাগুলোর চেয়ে আধুনিক সমর প্রযুক্তি আর নৌশক্তিতে বলীয়ান কোম্পানি জল ও স্থলপথে মাদক বাণিজ্যেও লিপ্ত হয়।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইতিহাস নিয়ে 'দ্য অ্যানার্কি' বা নৈরাজ্য নামক তার নতুন একটি বইয়ে স্কটিশ ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডেলরিম্পল বলেছেন, "কোম্পানির জন্য লাভজনক ব্যবসা হয়ে উঠেছিল চীনে আফিম বিক্রি। এজন্য তারা আফিম যুদ্ধে জড়ায় এবং দেশটির উপকূলে হংকং দখল করে ঘাঁটি গেড়ে বসে। লাভজনক মাদক ব্যবসা সুরক্ষিত রাখতে তারা চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখেনি।"
চীনের তৎকালীন চিং রাজবংশ এই বাণিজ্য ঠেকাতে মাদক পণ্যটিকে অবৈধ ঘোষণা করে দুই দুটি যুদ্ধ করলেও, ইউরোপীয় সমর প্রযুক্তির কাছে শোচনীয়ভাবে হার মানে। আফিমের মূল্য চুকাতে উজার হতে থাকে রাজকোষ।
প্রথম আফিম যুদ্ধের আগেই পরিস্থিতি এত বাজে রূপ নিয়েছিল, যা চিং রাজশক্তির হস্তক্ষেপ অপরিহার্য করে তোলে। ইউরোপীয় বণিকেরা তখন চীন থেকে চা কিনতো। কিন্তু একইসাথে শুল্কফাঁকি দিয়ে বিপুল পরিমাণ আফিম চোরাচালান শুরু করে। সমগ্র দক্ষিণ চীন আফিমের অবৈধ আড্ডায় ছেয়ে যায়। লাখ লাখ কর্মক্ষম মানুষ আফিম আসক্তে পরিণত হয়। মারাত্মক আকার ধারণ করে সামাজিক অনাচার।
আফিম বোঝাই প্রতিটি বাক্সের গড়পড়তা ওজন ছিল সাড়ে ৬৩ কেজি বা ১৪০ পাউন্ড।
আফিম বাণিজ্য নিয়ে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৭২৯ সালে চীনে বছরে মাত্র ২০০ বাক্স আফিম রপ্তানি করা হতো। ১৭৬৭ সাল নাগাদ তা ১,০০০ হাজার বাক্সে পৌঁছে যায়। আর প্রথম আফিম যুদ্ধের (১৮৩৯-৪২) আগে ১৮২০-১৮৩০ এর এক দশকে প্রতিবছর ১০ হাজার বাক্স আফিম বিক্রি করতো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৮৩৮ সাল নাগাদ যা ৪০ হাজার বাক্সে পৌঁছায়। ইউরোপীয় বণিকেরা স্থানীয় দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে চীনের বাজার আফিমে সয়লাব করে দেয়। আফিমের নেশা এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছায় যে, রাজকীয় সেনাবাহিনীর সদস্য থেকে শুরু করে সর্বস্তরের সরকারি কর্মকর্তারা আসক্ত হয়ে পড়েন।
তাই চীনের জন্য আফিম এমন বিষ হয়ে উঠেছিল, যা পরিবার থেকে শুরু করে সরকারি শাসন ব্যবস্থা, শান্তিশৃঙ্খলা, অর্থনীতি সবকিছু ধবংস করে দিচ্ছিল। পরবর্তী ১০০ বছরকেই বলা হয় চীনের অপমানের শতক। যখন বিদেশি শক্তিগুলো আফিম যুদ্ধে পরাজয়ের পর দেশটির সম্পদ ও ভূমি নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে। মূলত একারণেই বিংশ শতকের শুরুতে শিল্প, বিজ্ঞান আর অগ্রগতিতে চীন ছিল শোচনীয় অবস্থানে।
উৎপাদনেও শোষণ:
শুধু চীনেই নয়, আফিম সরবরাহের অন্যতম উৎস ভারতবর্ষেও চরম নিপীড়ন ও শোষণের শিকার হচ্ছিল এর চাষিরা।
কিছু উপনিবেশিক ইতিহাসবিদের দাবি, আফিম বাণিজ্য ভারতের গ্রামীণ এলাকার কৃষি অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছিল, কৃষকেরা ভালো দাম পেয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু, ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও সামাজিক ইতিহাসের অধ্যাপক রলফ বাওয়ের তার গবেষণায় এমন দাবিকে খণ্ডন করেছেন। বরং উল্টোটাই সত্য বলে উঠে এসেছে তার অনুসন্ধানে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকারের আওতাধীন একটি বিশেষ সংস্থা- ওপিয়াম এজেন্সি উৎপাদনের তদারকি করতো। ভারতজুড়ে সংস্থাটির ছিল ১০০ এর বেশি কার্যালয়। পপি চাষে কৃষকদের বাধ্য করা এবং উৎপাদিত ফসলের মান নিয়ন্ত্রণের কাজ করতো আড়াই হাজারের বেশি কর্মকর্তা। পুলিশের মতোই নিজস্ব বাহিনী ছিল এই সংস্থার।
চীনে সময়ের সাথে সাথে কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ যত দুর্বল হতে থাকে, ততোই বাড়তে থাকে ওপিয়াম এজেন্সির রমরমা। ১৯ শতকের শুরুতে মাত্র চার হাজার বাক্স হলেও, ১৮৮০ সালের দিকে সংস্থাটি ৬০ হাজার বাক্স আফিম রপ্তানি করে। ফলে ভারতবর্ষে ভূমি করের পর ব্রিটিশ উপনিবেশিক সরকারের দ্বিতীয় বৃহৎ রাজস্ব উৎস হয়ে ওঠে আফিম থেকে অর্জিত আয়।
বাওয়ের জানান, 'রাষ্ট্রায়ত্ত এ শিল্প ছিল উপমহাদেশের অন্যতম বড় ব্যবসা। প্রতিবছর যাতে উৎপাদিত হতো হাজার হাজার টন মাদক। এই সংখ্যাটি কেবল আধুনিক যুগে আফগানিস্তানের কুখ্যাত আফিম শিল্পের সাথেই তুলনীয়, যা বিশ্ববাজারে আফিমজাত হেরোইন পাচারে জড়িত।'
পপিশস্য চাষের প্রভাব ভারতের লাখ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকাকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল বলেও উল্লেখ করা হয়েছে তার গবেষণায়।
ক্ষতির এই চক্র ছিল যেমন আর্থিক তেমনি এর সামাজিক প্রভাবও ছিল সুদূরপ্রসারী।
প্রথমেই পপি চাষিদের ঋণ দেওয়া হতো। শুনতে ভালো উদ্যোগ মনে হলেও যা ছিল ঋণ ও দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে ফেলার সুচতুর আয়োজন।
ড. বাওয়ের বলেছেন, পপি চাষে সার, সেচ এবং কৃষি শ্রমিকের মজুরি যত বেশি ছিল, সে তুলনায় কাঁচা আফিমের (অপ্রক্রিয়াজাত) জন্য কৃষকেরা কম মূল্য পেত। অর্থাৎ, উৎপাদন খরচের চাইতে কৃষকের প্রাপ্ত মূল্য ছিল কম। ফলে তারা চুক্তিভিত্তিক উৎপাদনের চক্রে বাঁধা পড়ে, যা থেকে নিস্তার পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না।
তাছাড়া, ওপিয়াম এজেন্সি উৎপাদনের কড়া লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিত, অধিকাংশ ক্ষুদ্র চাষিকে তাই লাভজনক শস্য বাদ রেখে নিজের পুরো জমিতেই পপি চাষ করতে হতো।
বাওয়ের বলেছেন, "উপনিবেশিক সরকারের রপ্তানি নীতির আওতায় তাদের জমি ও শ্রমকে সমর্পণ করতে হতো।"
জমিদার বা ভূস্বামীদেরকেও তাদের প্রজাদের আফিম উৎপাদনে বাধ্য করতে চাপ দিত সরকার। জমির মালিকেরা কৃষকের অন্য ফসল ধবংস করে বা তাদের অপহরণ ও নির্যাতনের মাধ্যমে আফিম চাষে বাধ্য করতেন। চাষ করতে অস্বীকার করায় অনেক চাষিকে কারাগারে নিক্ষেপ করার চল ছিল। "এটি প্রচণ্ড শোষণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা" বলে উল্লেখ করেছন বাওয়ের।
তিনি বলেছেন, মাত্র কয়েক হাজার আমলা লাখ লাখ চাষিকে তাদের জন্য প্রচণ্ড ক্ষতিকর আফিম চাষে বাধ্য করেছিলেন। তাই এখানে চাষির আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার দাবি মোটেও সত্য নয়। বরং ফসলটি চাষের অঞ্চল উত্তর ভারতের কৃষক সমাজ নিঃস্ব, কপর্দকহীন হয়ে পড়েছিল। ফলে এই অঞ্চলে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক শূন্যতার যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তা আজো অনেকাংশে রয়ে গেছে।