আধা পচা ফলের ব্যবসায় তাদের বেঁচে থাকা
রাজধানীর কড়াইল বস্তির বউ বাজারের মাছ পট্টির একটি গলিতে ব্যবসা করেন সুমা খাতুন। এক ব্যতিক্রমী ব্যবসায় নাম লিখিয়েছেন তিনি। ব্যবসাটা মূলত ফলের। তবে তা স্বাভাবিক কোন ফলের দোকান নয়। নগরীর বড় ফলের দোকানের আধা পচা ফল সংগ্রহ করে, তা বস্তির নিম্ন আয়ের ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন এই নারী।
কেনো এই ব্যবসাই বেছে নিলেন তার উত্তরে জানালেন, এই কাজ করেই তার সংসার চলে।
"এখন রোজগারের অন্য কোনো পথ নেই। তাই গুলশানের ফলের দোকান থেকে এগুলো কম দামে নিয়ে এসেছি। সারাদিন ধরে বিক্রি করবো,"
"আগে বাসা-বাড়িতে কাজ করতাম। দিন মজুরের কাজও করেছি। কিন্তু এখন সেই সুযোগ না থাকায় এই ব্যবসা নিয়ে বসেছি," বলেন তিনি।
কোনোভাবে সংসার চালানোর ব্যবস্থা করাই মূল চিন্তা অভাবী এই নারীর।
তার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই একজন ক্রেতা আসলেন। তিনি আধা কেজি আঙুর নিতে চান। সুমা খাতুন ১২০ টাকা কেজি দরে দাম হাকালেন। দু'দফা দর কষাকষির পর ৫০ টাকায় আধা কেজি আঙুর কিনলেন সেই ক্রেতা।
এর মাঝেই তার সঙ্গে কথা চলতে থাকলো। জানালেন, ৭০০ টাকার পুঁজি লাগিয়েছেন আজ। এরমধ্যে ৫০০ টাকার আঙুর কিনেছেন। আর বাকি দুই'শ টাকার কমলা, আপেল, মাল্টা নিয়ে এসেছেন। এগুলো বিক্রি করে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা লাভ পাবেন তিনি। তা দিয়ে ঘরের বাজার করবেন।
এসব ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে কিনা, এমন প্রশ্ন করলে তেমন কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি। তবে তা নিয়ে বিশেষ কোনো মাথা ব্যাথাও দেখাননি এই নারী। পেটের ক্ষুধাই তার কাছে বড়। নিতান্তই ক্ষুধা নিবারণের জন্য এই পেশা বেছে নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
সুমা খাতুন বলেন, "এ কাজ করেই আমার সংসার চলছে। বাচ্চাদের খাবার দিতে পারছি। এটাই বড় কথা। আমরা গরীব মানুষ। এতোকিছু ভাবলে আমাদের পেট চলবে না,"
এর মধ্যে আরেকজন ক্রেতার সাথে দর কষাকষি শুরু করলেন তার সঙ্গে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আবার আলাপ শুরু হলো। কথায় কথায় জানালেন জীবিকা আর জীবন সংগ্রামের কথা।
তিনি বলেন, "দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে আমার সংসার। স্বামী থেকেও নেই। গ্রামে আরেক বিয়ে করে সেই সংসার করছেন। ঢাকায় থাকা ছেলে-মেয়েসহ এই পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন তো দূরের কথা, খোঁজখবরও রাখেন না,"
তিনি আরও বলেন, "কতো দিন হলো তার বাবার সঙ্গে কথা হয় না। জীবন সংগ্রামে এখন প্রায় সবকিছু ভুলতে বসেছি। দুই মেয়ের একজনের বিয়ে দিলাম নিজে। তবে ছোট মেয়ের বিয়ে নিয়ে বিপদে আছি,"
পাশে ৮ বছর বয়সী ছেলে রমজান আলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, "ওই আমার ভরসা। ছেলেটা বড় হয়ে যদি আমার দুঃখ বোঝে। এছাড়া আর তেমন কোন অবলম্বন নেই। বাবা মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার পথও নেই,"
রমজান আলী বলেন,"আমি স্থানীয় দারুল উলুম কড়াইল মাদ্রাসায় নজরানা বিভাগে পড়ি। মাদ্রাসায় থাকি, তবে খাবার বাসায় খেতে হয়। ব্যবসায় সাহায্য করতে রোজ বাজারে মায়ের কাছে আসি,"
বড় হয়ে চাকরি করবেন এটিই প্রত্যাশা তার।
সুমা খাতুন বলেন, "ভালো কোনো কাজ পেলে সেটা করতাম। তাতে আমাদের থাকা খাওয়া হলেই চলে। ব্যবসায়ে তো লাভ-ক্ষতি থাকে। কোনো দিন ফল বিক্রি না হলে বিপদে পড়ে যাই। এই ফল তো সংরক্ষণ করা সম্ভব না। তাই অনেকদিন লস করে বিক্রি করতে হয়,"
"কিন্তু লস দিতে হলে আবার চালান থাকেনা। সেই ভয় তো আছেই। এখানে যে বসতে হয় এই ভাড়াও লাগে। যেদিন ভালো বেচাকেনা হয় সেদিন দিতে পারি। অন্যদিন বলে কয়ে ভাড়ার টাকাটা মাফ করি," জানালেন তিনি।
তবে লকডাউনে গুলশানের ফলের দোকানগুলো বন্ধ থাকায় এখন প্রতিদিন কম দামে ভালো কিছু ফল কিনতে পারছেন তিনি। সেগুলো বিক্রি করতে সুবিধা হচ্ছে। এছাড়া এতোদিনে নিয়মিত কিছু ক্রেতাও জুটে গেছে তার।