স্মরণে রবীন্দ্রনাথ: আজ ২২ শে শ্রাবণ

‘...সত্যেরে সে পায়
আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে।
কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে,
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে
আপন ভাণ্ডারে।…’
অন্তরের সেই সত্য নিয়েই হয়তো বা আজ থেকে ৭৮ বছর আগে চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। আজ ২২ শে শ্রাবণ। বিশ্বকবির ৭৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২শে শ্রাবণ, ইংরেজি ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট ৮০ বছর বয়সে মারা যান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
মৃত্যু তাঁর কাছে গীতসুধারসে আসেনি। জগতে মাধুরী ছড়িয়ে দিয়ে তাঁর অন্তরের মাধুরী যদিও কমেনি একরত্তি, কিন্তু শারীরিক কষ্ট পেয়েছেন। তবে যাবার আগেও ছড়িয়ে গেছেন রসের করুনা ধারা। মৃত্যুর সাত দিন আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টিশীল ছিলেন। লিখেছেন ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছো আকীর্ণ করি…’
তবে আজ তাঁকে শুধু দুঃখ নিয়ে নয়, মনে করতে চাই একটু অন্যরকম করে। চলুন জেনে নিই কবিগুরুর অজানা কিছু তথ্য।
১। “আমার সোনার বাংলা” এর সুর ‘”কোথায় পাব তারে” গানটির সুর থেকে নেয়া।গগন হরকরার বাউল গান “কোথায় পাব তারে” থেকে “আমার সোনার বাংলা” এর সুর করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের সুরকার যে গগন হরকরা সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেননি।
২। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন খুব মজার মানুষ। একদিন শান্তিনিকেতনের ছেলেদের সঙ্গে অন্য এক প্রতিষ্ঠানের ছেলেদের ফুটবল খেলা ছিল। শান্তিনিকেতনের ছেলেরা আট-শূন্য গোলে জিতে। সবাই দারুণ খুশি। তবে এ জয় দেখে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করলেন “জিতেছে ভালো, তা বলে আট গোল দিতে হবে? ভদ্রতা বলেও তো একটা কথা আছে!”
৩। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নানা ধরনের খাবার ভালোবাসতেন এবং কখনো কখনো নিজ হাতে রান্নাও করতেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ানোর সময় সেসব জায়গার নিজস্ব খাবারের প্রতি তাঁর অনুরাগ জন্ম নেয়, যা থেকে কোনোটি পরবর্তী সময়ে তাঁর প্রিয় খাবারের তালিকায় সংযুক্তিও পেয়েছে। খাবার নিয়ে লিখেছেন মজার সব ছড়া আর কবিতা। যেমন-
‘আমসত্ত্ব দুধে ফেলি
তাহাতে কদলি দলি
সন্দেশ মাখিয়া...’
কবি দেশি খাবারের মধ্যে পছন্দ করতেন ইলিশের ঝোল, চিতল মাছ আর চালতা দিয়ে মুগের ডাল এবং নারকেল চিংড়ি।
এছাড়া তিনি কাবাব খেতে খুব পছন্দ করতেন। এর মধ্যে ছিল শ্রুতি মিঠা কাবাব, হিন্দুস্তানি তুর্কি কাবাব, চিকেন কাবাব নোসি।
কবিগুরু ছিলেন পানের ভক্ত। তার নাতজামাই কৃষ্ণ কৃপালিনী তাঁকে একটি সুদৃশ্য পানদানি বা ডাবর উপহার দিয়েছিলেন, যা আজও ঠকুরবাড়িতে রক্ষিত আছে।
৪। রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক আদর্শের অনেক বড় একটা অংশ জুড়ে ছিল শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার। এই উদ্দেশ্যে তিনি ১৯১৮ সালে তিনি বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ের নির্মাণ শুরু করেন।
কিন্তু বিশ্বভারতী যখন প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁর হাতে ছিল না কোন টাকা। এই বিদ্যালয়ের জন্য অর্থসংগ্রহ করতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন তিনি।নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে প্রাপ্ত সম্পূর্ণ অর্থ তিনি ঢেলে দেন এই বিদ্যালয়ের পরিচালনায়। এমনকি স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর গায়ের গয়না পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছিল তাঁকে। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে বিদ্যালয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে তিনি একাধিকবার ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণ করেন।
৫। রবীন্দ্রনাথ যে অসাধারণ রোমান্টিক ছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বাসরঘরে নতুন বৌকে স্বরচিত ও সুরারোপিত গানও শুনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। 'আ মরি লাবণ্যময়ী/কে ও স্থির সৌদামিনী...।'
আর মৃণালিনী ছিলেন সত্যিকার অর্থেই তাঁর জীবন সঙ্গিনী। ঠাকুর বাড়িতে এসে সংস্কৃত থেকে 'মহাভারত'-এর অনুবাদ এবং 'রামায়ণ'-এর অনুবাদ করেছিলেন তিনি। বাংলা রামায়ণটি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সংশোধন করে দেন। কিন্তু এগুলো সংরক্ষিত হয়নি। তিনি পূর্ববাংলায় ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন 'রূপকথা' সংগ্রহ করেছিলেন। অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ এটি। রবীন্দ্রনাথের সোনারতরীতে 'রাজার ছেলে' 'রাজার মেয়ে', 'বিম্ববতী' প্রমুখ যে কবিতাগুলো রয়েছে তার উৎস মৃণালিনীর সংগৃহীত এই রূপকথাগুলি।
৬। ১৯০২ সালে ৩ কন্যা ও ২ পুত্র রেখে মারা যান মৃণালিনী দেবী। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি লেখেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘বীরপুরুষ’। সেই যে, ‘মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে, মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে…’।
৭। ১৯০৩ সালে তাঁর মেয়ে রেনুকা, মানে রানী মারা যান। মৃত্যুপথযাত্রী অসুস্থ রেণুর বিছানার পাশে বসে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গান ’আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’...।
৮। ১৯৩০ সালের ২৬ জুলাই রবীন্দ্রনাথের কাহিনী অবলম্বনে প্রথম বাংলা নির্বাক চলচ্চিত্র “দালিয়া” মুক্তি পায়। রবীন্দ্রনাথের কাহিনী অবলম্বনে ১৯৩২ সালে প্রথম সবাক চলচ্চিত্র “চিরকুমার সভা” মুক্তি লাভ করে।
রবীন্দ্রনাথ কি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন ? সাম্প্রতিক কালের গবেষণায় জানা গেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনে একটি মাত্র চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন, সেটি ছিলো “নটীর পূজা”। মূলত: এটি তাঁরই লেখা নাটক।
জেনে রাখা ভালো, রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাহিনী নিয়ে নির্মিত ছায়াছবিতে অভিনয়ও করেছেন। তাঁর নাটক “তপতী” ব্রিটিশ ডমিনিয়ন ফিল্মস লিমিটেড ১৯২৯ সালের চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করেছিল। যে ছবি শুটিং হয় শান্তিনিকেতনে ১৯২৯ সালে। কবি এতে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেন। ৮ রিলের ছায়াছবির হাতধরেই রূপালি পর্দায় কবির প্রথম আবির্ভাব।
৯। বাংলা চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসংগীতের প্রয়োগ শুরু হয় ১৯৩৭ সালে। ওই বছর নিউ থিয়েটার্স প্রাইভেট লিমিটেড প্রযোজিত ও প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত ‘মুক্তি’ চলচ্চিত্রে প্রথম রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করা হয়।
এই ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী পঙ্কজ কুমার মল্লিক। পঙ্কজকুমার মল্লিক রবীন্দ্রনাথের অনুমতি নিয়ে কবির খেয়া কাব্যগ্রন্থের "শেষ খেয়া" কবিতাটিতে সুরারোপ করেন এবং এই চলচ্চিত্রে প্রয়োগ করেন। গানটি "দিনের শেষে ঘুমের দেশে" শিরোনামে রেকর্ডে প্রকাশিত হয় ও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ‘মুক্তি চলচ্চিত্রে পঙ্কজকুমার মল্লিক রবীন্দ্রনাথের "আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে", "তার বিদায়বেলার মালাখানি" ও "আমি কান পেতে রই" গান তিনটিও ব্যবহার করেছিলেন।
১০। কবির মৃত্যু হয় অর্শ রোগের অস্ত্রোপচারে। দীর্ঘ দিন থেকে কবি মূত্রনালী সমস্যায় ভুগছিলেন। কবিকে মূত্রনালীর পাথর অপসারণের জন্য হাসপাতালে ভর্তি করাতে চাইলে কবি গুরু অস্বীকৃতি জানান। ফলে, জোড়াসাঁকোতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিয়ে এসে বিনা এ্যানেসথেসিয়ায় কবির মূত্রনালী অপারেশন করা হয়। এই বিনা এ্যানেসথিয়া অপারেশনে কবিকে কি নিদারুণ কষ্টই না সহ্য করতে হয়েছিলো! সপ্তম দিনের মাথায় অপারেশনের জায়গায় ইনফেকশন দেখা দেয়। অপারেশনের ১৫ দিনের মাথায় কবিকে সীমাহীন কষ্ট আর যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে পরলোকগমন করতে হয়।
১১। মৃত্যুর পরও কবির যন্ত্রণার শেষ হয় নি। শকটে করে কবির শবদেহ যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন কবির ভক্তরা মাথার চুল ও দাড়ি শ্রদ্ধার সাথে সংরক্ষণের জন্য ছিঁড়ে নিয়ে যায়! শ্মশানে শব দেহ আনা হলে কবির একমাত্র পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি কারণে যেন কবির মুখাগ্নি দিতে পারেনি। দূর সম্পর্কের এক নাতনী এসে কবি গুরুর মুখাগ্নি দেয় বলে জানা যায়।
কিন্তু জীবন যখন শুকিয়ে গেছে, গীত সুধারসের অপেক্ষা তিনি করেছেন, করুণ ধারায় মৃত্যুর অপেক্ষা করেছেন। আর তাই ঈশ্বরের কাছ থেকে হয়তো অর্জন করেছেন শান্তির অক্ষয় অধিকার। তাঁর শেষ লেখার সূত্র ধরেই বলে যাই-
‘...অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার…’