দাবিতে অনড় রোহিঙ্গাদের সাড়া মিলেনি দ্বিতীয়বারেও
সকল আয়োজন সম্পন্ন করেও রোহিঙ্গারা সাড়া না দেওয়ায় দ্বিতীয়বারের মতো কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। মিয়ানমারের স্বীকৃতি দেওয়াদের তালিকায় থাকা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে প্রত্যাবাসনে রাজি করানো সম্ভব না হওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন দু’দেশের সরকারি কর্মকর্তারা ও আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থার লোকজন। তারপরও রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা প্রত্যাবর্তনে রাজি করানো সম্ভব হয়নি।
জোর করে পাঠিয়ে দেওয়ার ভয়ে তালিকায় নাম আসা টেকনাফ শালবন ক্যাম্পের বেশকিছু পরিবার বাসায় তালা লাগিয়ে গা-ঢাকা দেন। প্রত্যাবাসন ঘিরে টেকনাফের নয়াপাড়া, দক্ষিণের শালবাগান এবং জাদিমুরা এলাকা থেকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম পর্যন্ত নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার ছিল। অবশেষে আরআরআরসির ঘোষণা এল, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হননি।
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমাদের সকল আয়োজন থাকলেও আজ (২২ আগস্ট) রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হচ্ছে না। কোনো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্যে আসেননি। যারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হবেন শুধু তাদেরকেই ফেরত পাঠানো হবে। জোর করে কাউকে পাঠানো হবে না।”
তিনি আরও জানান, প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাক্ষাৎকার ও মতামত গ্রহণ অব্যাহত রেখেছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। প্রত্যাবাসন-প্রক্রিয়া দেখতে ঢাকায় মিয়ানমার ও চীন দূতাবাসের কর্মকর্তারা কক্সবাজারে অবস্থান করছেন। প্রত্যাবাসন-প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে ভারতও।
সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ের নয়াপাড়া- ২৬ নং ক্যাম্পে উপস্থিত হয়ে আরআরআরসির মোহাম্মদ আবুল কালাম বৃহস্পতিবারের প্রত্যাশিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন স্থগিতের ঘোষণা দেন। এ খবরে স্থানীয় লোকজনকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেলেও, ওই এলাকার রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ও কতিপয় এনজিওর মাঝে কিছুটা স্বস্তির আভাস পাওয়া গেছে।
এদিকে, বাংলাদেশ সীমান্তের ঘুমধুম পয়েন্টে বহুলপ্রত্যাশিত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ফেরত ও গ্রহণে উভয় দেশের কর্মকর্তারা তৎপর ছিলেন। উখিয়ার বালুখালী থেকে ঘুমধুম সীমান্তের মৈত্রী সেতু পর্যন্ত দুই কিলোমিটার নবনির্মিত মৈত্রী সড়কজুড়ে সীমান্তরক্ষী বিজিবি সদস্যদের সকাল থেকে কড়া নজরদারিতে থাকতে দেখা গেছে। বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে বিজিবি কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান ঘুমধুম সীমান্তে আসেন। কক্সবাজার-৩৪ বিজিবি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলী হায়দার আলী আজাদ সকাল থেকে ঘুমধুম বিজিবি বিওপিতে অবস্থান করেন।
অপরদিকে, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার সীমান্তে রোহিঙ্গাদের অভ্যর্থনা জানাতে সেদেশের কেন্দ্রীয় ও রাখাইন প্রাদেশিক মন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা অবস্থান করছিলেন বলে একটি সূত্র দাবি করেন। তাদের সঙ্গে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা, উন্নয়ন সংস্থা, রেড ক্রসসহ সংশ্লিষ্টরাও ছিলেন। রোহিঙ্গাদের ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের ঢেকিবনিয়া জিরো পয়েন্ট থেকে তুমব্রু লেটওয়ে ট্রানজিট ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সে হিসেবে তারাও প্রয়োজনীয় ট্রান্সপোর্ট মজুদ করেছিলেন।
কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট র্কনেল আলী হায়দার আজাদ আহমেদ বলেন, “প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দিতে ঘুমধুম সীমান্তে বিজিবি প্রস্তুত ছিল।”
রোহিঙ্গা ফেরত কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে চীনের দুজন,মিয়ানমার দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক র্কমর্কতা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরের অবস্থান করছিলেন। একই সঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের অপর তিন কর্মকর্তাও কক্সবাজারে আসেন। পুরো প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন স্থাপনা দেখেছেন তাঁরা। সীমান্তের ওপারে দেশটির উচ্চ পর্যায়ের দুটি দল অবস্থানের কথাও কক্সবাজার শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম নিশ্চিত করেন।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোগত সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ৭ লাখেরও বেশি মানুষ। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নানা অজুহাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া অন্তত সাড়ে ৩ লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলে বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১২ লাখের কাছাকাছি।
এই বিপুল জনগোষ্ঠীতে ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে একাধিক চুক্তি করে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা- ইউএনডিপি ও শরণার্থী সংস্থা- ইউএনএইচসিআরএর সঙ্গে মিয়ানমার ত্রিপক্ষীয় চুক্তিও করে।
সর্বশেষ, জুলাই মাসে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে নতুন করে উদ্যোগের অংশ হিসেবে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থোয়ের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দল। ১৯ সদস্যের দলটি দু’ দিন ধরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা ও বৈঠক করেন। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর ঘোষণা আসে।
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম জানিয়েছেন, “মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে। আমরা এই তথ্যটি রোহিঙ্গাদের জানিয়েছি। তাদের অনেকে সম্মতি দিয়েছেন মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য। তবে কতজন রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন হবে সেটি এখন নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।”
গত দুদিনে সাক্ষাৎকার দেওয়া টেকনাফের শালবন ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নূর বাহার, নুরুল ইসলাম, নূর হাসান বলেন, “সরাসরি নাগরিকত্ব, ভিটেবাড়ি ও জমি-জমা ফেরত না দিলে এবং কারাগরে বন্দী রোহিঙ্গাদের মুক্তি না দিলে আমরা ফিরব না।”
প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গার মধ্যে গত মঙ্গল ও বুধবার দু’দিনে ২৯৩ পরিবারের মত যাচাই করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এবং শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন কার্যালয়। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার ২৯ পরিবারের এবং গতকাল বুধবার ২৬৪ পরিবারের মত যাচাই করা হয় বলে জানিয়েছে আরআরআরসি অফিস।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য নির্ধারিত টেকনাফের কেরুণতলী ঘাট ও ঘুমধুম সীমান্তের ট্রানজিট ক্যাম্প ঘুরে ব্যাপক প্রস্তুতি চোখে পড়ে। কেরুণতলীতে ট্রানজিট ক্যাম্পে ১১টি টিন শেড ব্যারাক নির্মিত হয়েছে । ওইসব ব্যারাকের প্রত্যেকটিতে তিনটি করে মোট ৩৩টি ঘর করা হয়েছে। অপরদিকে উখিয়ার কুতুপালং টিভি রিলে কেন্দ্রের বিপরীতে ঘুমধুমে নির্মিত অপর ট্রানজিট ক্যাম্পও প্রস্তুত করা হয়েছে।
বুধবার সন্ধ্যায় ‘যারা যেতে চাইবেন’ তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম। তিনি বলেছিলেন, “আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছি। আমাদের যে যানবাহন দরকার, অন্যান্য লজিস্টিক্যাল এবং স্ট্রাকচারাল যে সমস্ত প্রস্তুতি থাকা দরকার, এগুলো সম্পূর্ণ আমাদের প্রস্তুত আছে। বৃহস্পতিবার যারাই যেতে চাইবে, যাওয়ার জন্য যারা প্রস্তুত থাকবে, তাদের সকলকে পরিবহনে যানবাহন প্রস্তুত আছে। তাদের (রোহিঙ্গা) জন্য আমরা ৫টি বাস ও ৩টি ট্রাকের ব্যবস্থা করেছি। তাদের সাথে যে মালামাল থাকবে সেগুলো যদি বাসের মধ্যে সঙ্কুলান করা না যায়; তাহলে ট্রাকের মাধ্যমে আমরা সহায়তা দেব। আমরা টেকনাফের নয়াপাড়া থেকে দক্ষিণের শালবাগান এবং জাদিমুরা এলাকা থেকে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম পর্যন্ত নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছি।”
প্রসঙ্গত, জাতিগত নিধন ও গণহত্যার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্ন হয়। একই বছরের ৬ জুন নেপিদোতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মধ্যেও একটি সমঝোতা চুক্তি সাক্ষর হয়।