আসামের নাগরিকত্ব সংকট: ‘জকিগঞ্জ যেন আরেক টেকনাফ না হয়’
“জকিগঞ্জ যেন আরেক টেকনাফ না হয়”,বললেন আজির উদ্দিন। জকিগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা আজির সিলেটের একটি কলেজের স্নাতক শ্রেণীর ছাত্র। তার পাশেই বসে ছিলেন উপজেলার বারহাল এলাকার স্কুলশিক্ষক সমীর দাস। আজির উদ্দিনের সঙ্গে যোগ করলেন তিনি, “নিজেরাই কত সমস্যায় আছি! দিন দিন কৃষিজমি কমছে। লেখাপড়া করে ছেলেরা চাকরি পাচ্ছে না। এখন নতুন করে বাইরের অনেক লোক চলে আসলে তো মহাবিপদে পড়তে হবে।”
সোমবার সিলেটের জকিগঞ্জ শুল্ক স্টেশনের পাশে সবুর আহমদের চায়ের দোকানে বসে কথা হচ্ছিল আজির ও সমীরের সঙ্গে। আলাপের এ পর্যায়ে দোকান মালিক সবুর আহমদও যুক্ত হন।
তার বক্তব্য, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েই কত সমস্যায় পড়তে হচ্ছে আমাদের। এখন ওদের ফেরতও পাঠানো যাচ্ছে না। তাদের এলাকাতেও এমন কোনো পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয় সেটাই চান সবুর।
ভারতের আসাম রাজ্য সরকারের প্রকাশিত সাম্প্রতিক নাগরিক তালিকা নিয়ে আলাপ চলছিল ওদের সঙ্গে। তালিকা থেকে আসামের প্রায় ১৯ লাখ মানুষ বাদ পড়ায় এ নিয়ে নিজেদের উদ্বেগ আর শঙ্কার কথা জানালেন জকিগঞ্জের এই সাধারণ মানুষেরা।
যেখানে বসেছিলেন সবাই তার পাশেই একটি নদী। ঢেউ আর স্রোতের বাড়াবাড়ি নেই তার বুকে। একান্তই শান্ত। এ নদীর নাম সুরমা। শান্ত এই নদীর দু’পাড়ে হঠাৎ দেখা দিয়েছে বিপরীতমুখী এক অস্থিরতা। নদীর দক্ষিণ পাড়ে ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ। আর উত্তর পাড়ে বাংলাদেশের সিলেট জেলার জকিগঞ্জ।
শনিবার ৩১ আগস্ট ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসাম রাজ্যের বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেটি থেকে বাদ পড়েছেন রাজ্যের প্রায় ১৯ লাখ নাগরিক। ফলে হঠাৎ রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়েছেন এক বিপুলসংখ্যক মানুষ। অস্থিরতা দেখা দিয়েছে ওই রাজ্যে।
ভারতের উজান থেকে সুরমায় পানি নেমে আসার মতো ও পাড়ের অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে এ পাড়েও। সেদেশের বিজেপি সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলা না হলেও ক্ষমতাসীন দলটির অনেক নেতা বলছেন, এনআরসি থেকে বাদ-পড়ারা বাংলাদেশের নাগরিক। তালিকার বাইরে থাকা বিপুলসংখ্যক ভারতীয় নাগরিক এদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাতে পারেন এমন শঙ্কা জকিগঞ্জের বাসিন্দাদের মধ্যে।
জকিগঞ্জের সঙ্গে আসামের করিমগঞ্জ ও কাছাড় জেলার প্রায় ৫৪ কিলোমিটার সীমান্ত। এছাড়া আসাম রাজ্যের সঙ্গে সীমান্ত-সখ্যতা রয়েছে সিলেটের কানাইঘাট ও বিয়ানীবাজার উপজেলার। মৌলভীবাজারের বড়লেখা, কুলাউড়া ও কমলগঞ্জ উপজেলার অবস্থানও আসাম সীমান্তে।
শুল্ক স্টেশন এলাকায় কথা হল উপজেলার আটগ্রাম এলাকার শ্রমিক নেতা মহসিনের সঙ্গে। তিনি বললেন, “ভারত থেকে কেউ বাংলাদেশে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করতে চাইলে তাদের অবশ্যই ঠেকাতে হবে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের মতো কোনো সমস্যা এখানে চাই না আমরা।”
এনআরসিতে ১৯ লাখ বাসিন্দাকে বাদ দিয়ে ভারত সরকার একটি অমানবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী আল মামুন। তিনি বলেন, “ওপারের অস্থিরতায় এপারের সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এমনিতেই এ অঞ্চলের মানুষের অনেক সমস্যা। তার উপর নতুন করে কেউ এলে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা। এর প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।”
তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে উত্তেজনা-উদ্বেগ আর অস্থিরতা থাকলেও বাহ্যত এর প্রভাব পড়েনি কোথাও। সীমান্ত এলাকা আগের মতোই শান্ত। পাশের সুরমার মতেই নিরিবিলি। বিজিবি বা অন্য কোনো বাহিনীর বাড়তি নজরদারিও চোখে পড়েনি।
যদিও আসামে এমন অস্থিরতার খবরে সতর্ক রয়েছেন বলে জানিয়েছেন জকিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মোহাম্মদ আবু নাসের। তিনি জানালেন, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে পুলিশ যথেষ্ট সচেতন ও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। সীমান্ত পেরিয়ে কেউ যাতে অবৈধভাবে আসতে না পারে সেদিকে প্রশাসন কড়া নজরদারি রেখেছে। পাশাপাশি এই পরিস্থিতিতে কেউ যাতে আতঙ্কিত না হয়, সে বিষয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গেও কথা বলেছে পুলিশ।
জকিগঞ্জের ইমিগ্রেশনের দায়িত্বে থাকা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীর আলমও একইভাবে বললেন, ওপার থেকে কেউ যেন অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক রয়েছে তাদের ইমিগ্রেশন পুলিশ।
এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গেও কথা হল। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে যে কোনো সঙ্কট মোকাবেলার কথা জানালেন তারা।
জকিগঞ্জের পৌর মেয়র মোহাম্মদ খলিল উদ্দিন বললেন, “বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। আশা করি ভারত সরকার এর সুষ্ঠু সমাধান করবেন। আমাদের জনগণ এ ব্যাপারে খুবই সচেতন।”
ওদিকে, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান লোকমান উদ্দিন চৌধুরীর মনে করেন, ভারত সরকারের এমন সিদ্ধান্ত খুব দুঃখজনক। যে কোনো পরিস্থিতিতে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সরকারের পাশে থাকার কথাও বললেন তিনি।
বিজিবি’র জকিগঞ্জ ক্যাম্পের কমান্ডার নায়েক সুবেদার রবিউল ইসলাম জানালেন সীমান্তে সতর্ক থাকতে তাদেরকে নির্দেশনা দেওয়ার কথা। তিনি বললেন, “আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। এছাড়া কোনো অবৈধ অনুপ্রবেশের তথ্য পেলে আমাদের জানানোর জন্য সীমান্ত এলাকার মসজিদগুলোতে প্রচারণা চালানো হয়েছে।”