‘আমি পারফর্ম করলে বেশিরভাগ ম্যাচ জেতার সম্ভাবনা থাকবে’
জাতীয় দলে ডাক মিলেছিল অলরাউন্ডার হিসেবে। কিন্তু অভিষেকের পর্বে ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে দুর্দান্ত বোলিংয়ের পর পরিচয় যেন বদলে যায়। অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজ থেকে হয়ে যান বোলার মিরাজ। দলে তাকে বিবেচনাই করা হতো বিশেষজ্ঞ অফ স্পিনার হিসেবে। বয়সভিত্তিক পর্যায়েই ব্যাটিং সত্তার কারণে প্রশংসিত মিরাজও যেন সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করেন।
তবে সময়ের ব্যবধানে তার ভাবনা বদলায়, কাজ শুরু করেন ব্যাটিং উন্নয়নের। কতোটা উন্নতি করতে পেরেছেন, সেটা তার পারফরম্যান্সই বলে দেয়। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি ম্যাচে ব্যাট হাতে একাই হাল ধরেছেন, পাল্টে দিয়েছেন ম্যাচের চেহারা। সর্বশেষ উদাহরণ পাকিস্তান সফর, ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজ জয়ে বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাট ব্যাটিংয়েও আলো ছড়িয়ে সিরিজ সেরা হন বাংলাদেশের হয়ে ৪৫টি টেস্ট খেলা মিরাজ।
শক্তির জায়গা বোলিংয়ে তার শিকার ১০ উইকেট, যা সিরিজের সর্বোচ্চ। ব্যাট হাতে দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে দলের চরম বিপর্যয়ে লিটন কুমার দাসের সঙ্গে রেকর্ডগড়া জুটিসহ অসাধারণ এক ইনিংস খেলেন। দুই টেস্টের ২ ইনিংসে ব্যাটিং করে দুই হাফ সেঞ্চুরিতে ৭৭.৫০ গড়ে ১৫৫ রান করেন মিরাজ। আগের চেয়ে অনেক আত্মবিশ্বাস নিয়ে এখন ব্যাটিং করেন, নিজের ওপর পান ভরসাও।
স্মরণীয় টেস্ট সিরিজ জিতে দেশে দলের সঙ্গে ফেরা বাংলাদেশের এই অলরাউন্ডার সিরিজ জয়ের আনন্দ, সিরিজ জেতার পথে সহায়ক, অলরাউন্ডার হিসেবে ভাবনা, ব্যাটিং সত্তা, বিশ্ব ক্রিকেটে ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা, দলে নিজের ভূমিকাসহ আরও অনেক বিষয় নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড: পুরো সফরটা কেমন ছিল, এমন সিরিজ জয়ের পর কেমন লাগছে?
মেহেদী হাসান মিরাজ: পুরো সফরটা দারুণ ছিল। পাকিস্তানে এর আগে আমরা এমন কোনো সিরিজ জয় করতে পারিনি। আগে তো ম্যাচও জিততে পারিনি আমরা। সফরজুড়ে দলের সবাই ভালো ক্রিকেট খেলেছে। এটাই বড় ব্যাপার যে, পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতা ছিল। ফিরে আসা বা ঘুরে দাঁড়ানোর মানসিকতা ছিল, চেষ্টা ছিল সবার মধ্যে। এই সিরিজটাতে আমরা যেভাবে খেলেছি, এটা বড় ব্যাপার। আমরা এভাবে একটানা ৯ দিন ভালো ক্রিকেট না খেললে জিততে পারতাম না।
টিবিএস: পাকিস্তানের বিপক্ষে এই সিরিজের আগে বাংলাদেশের টেস্ট রেকর্ড ছিল ১৩ ম্যাচে ১২ হার, একটি ড্র। সেই দলের বিপক্ষে এমন ফল, কীভাবে সম্ভব হলো?
মিরাজ: আমার কাছে মনে হয় যে আমাদের প্রস্তুতি খুব ভালো ছিল। সিরিজটার জন্য আমরা প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা যে পাঁচ মাস ধরে টেস্টের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে, এটা আমাদের অনেক কাজে দিয়েছে। বিশেষ করে টাইগার্স ক্যাম্পটা যে হয়েছে, ওখানে সুযোগ-সুবিধা, অনুশীলনে নিবেদন, কোচিং স্টাফ যারা ছিলেন, তাদের আগ্রহ ও চেষ্টা; এসব কিছুর ফল হচ্ছে এই সিরিজ জয়। টেস্ট এমন একটা ফরম্যাট, যেখানে আপনি প্রস্তুত না থাকলে ভালো করতে পারবেন না। আমাদের সেই প্রস্তুতিটা ভালো ছিল, যা খুব কাজে দিয়েছে।
টিবিএস: পাকিস্তান ভালো দল, তার ওপর ঘরের মাঠে খেলেছে। এরপরও বাংলাদেশের বিপক্ষে লড়াই করতে পারেনি তারা। কোন দিকটা বাংলাদেশকে এগিয়ে দিয়েছে?
মিরাজ: যদি দুই দলের পার্থক্যের কথা বলেন, তাহলে আমরা প্রতিটা বিভাগে পাকিস্তানের চেয়ে ভালো ক্রিকেট খেলেছি। ব্যাটিং-বোলিংয়ে আমরা ওদের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলাম। আমাদের পেস বোলাররা দারুণ বোলিং করেছে, স্পিনাররা ভালো করেছে। ব্যাটিংয়ের কথাও যদি বলি, অনেকেই ভালো ব্যাটিং করেছে। সম্মিলিত পারফরম্যান্সে আমাদের জেতার পথ সহজ হয়েছে। দলগত খেলায় দল হিসেবেই জিততে হয়, আমরা সেটা করতে পেরেছি। প্রথম ম্যাচটা আমরা বড় ব্যবধানে জিতি। ওই ম্যাচে আমাদের বড় বড় জুটি ছিল। মুশফিক (মুশফিকুর রহিম) ভাইয়ের সাথে আমার একটা, সাদমানের সাথে সৌরভ ভাইয়ের (মুমিনুল হক) একটা ছিল। ওদের কন্ডিশনে আমাদের পেসাররা খুবই ভালো বোলিং করেছে। মোট কথা সবার অবদান ছিল। আমার মনে হয় এটাই মূল ও একমাত্র কারণ সিরিজ জিততে পারার।
টিবিএস: বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ে আপনি সেরা খেলোয়াড়। দলের জয়ে ব্যাটে-বলে অবদান রাখতে পারা এবং সিরিজ সেরা হওয়া; এটা নিশ্চয়ই গর্বের ব্যাপার আপনার জন্য…
মিরাজ: হ্যাঁ, অবশ্যই। এটা হয়তো সারা জীবন মানুষ মনে রাখবে যে, পাকিস্তানের মাটিতে তাদের বিপক্ষে সিরিজ জেতায় আমি ভালো করেছিলাম। আমি সিরিজ সেরা হয়েছিলাম। ম্যান অব দ্য সিরিজ হয়েছি, একটা সিরিজ শেষে এটা তো অবশ্যই বড় প্রাপ্তি। এই সিরিজ জয় যেহেতু আমাদের কাছে বিশেষ, সেখানে আমি সিরিজ সেরা হওয়ায় এটাও আমার কাছে বিশেষ। এটা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
টিবিএস: সফর বা সিরিজের আগে দলগত পরিকল্পনা সাজানো হয়। পাশাপাশি ক্রিকেটারদেরও ব্যক্তিগত পরিকল্পনা বা লক্ষ্য থাকে। আপনার পরিকল্পনার কতোটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন এই সফরে?
মিরাজ: সব সময়ই চেষ্টা থাকে স্কিল উন্নত করার, এই সিরিজের আগেও আমি সেটা করেছি। তবে সত্যি বলতে সফরে দলের জন্য অবদান রাখতে পারাটাই একমাত্র পরিকল্পনা বা লক্ষ্য ছিল। দলের জন্য অবদান রাখতে পারা মানেই কিন্তু পারফরম্যান্স করা। পাকিস্তান যাওয়ার আগে আমারও পরিকল্পনা ছিল, সেভাবে এগোনোর চেষ্টা করেছি, অনেকটাই হয়েছে সেভাবে। আগেও যেটা বললাম, দেশের মাটিতে নেওয়া প্রস্তুতি আমাদের সবার কাজে দিয়েছে। ওখানে নেওয়া পরিকল্পনা আমরা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি, এই কারণে সিরিজটা ভালো গেছে।
টিবিএস: গত কয়েক বছরে কয়েকটি কঠিন ম্যাচে আপনি ব্যাট হাতে দায়িত্ব নিয়েছেন, হারতে বসা ম্যাচ জিতিয়েছেন। আগে যেটা করতে পারেননি, এখন পারছেন। কোন পরিবর্তনের ফল এটা?
মিরাজ: আমি যেটা চিন্তা করি, আমি যদি পারফর্ম করি, বেশিরভাগ ম্যাচ জেতার সম্ভাবনা থাকবে। কারণ আমি যেখানে খেলি (ব্যাটিং), সেই রোলটাই এমন। আমি বুঝতে পারি আমার পারফরম্যান্স দলে কতোটা প্রভাব রাখে, জেতার ক্ষেত্রে কতোটা সহায়ক। আমি চেষ্টা করি দলের জন্য খেলার। আমি মনে করি আমার ভূমিকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ দলের জন্য, ওখানে যদি আমি ভালো না খেলতে পারি দল ভুগবে অনেক। এখন পারছি, এটা বলতে পারেন অভিজ্ঞতার কারণে। বেশি খেললেই তো বেশি শিখি। যতো খেলবো, ততো অভিজ্ঞতা হবে, ততো ভালো বুঝবো নিজেকে। অভিজ্ঞতার ব্যাপারগুলো কাজে দিচ্ছে, আত্মবিশ্বাস বাড়ছে। আর নিজের ওপর ভরসা আছে আল্লাহর রহমতে।
টিবিএস: পাকিস্তান সিরিজের পারফরম্যান্সে অলরাউন্ডার র্যাঙ্কিংয়ে তিন ধাপ এগিয়েছেন, এই ভূমিকায় নিজেকে কীভাবে দেখতে চান?
মিরাজ: নির্দিষ্ট করে সেভাবে কিছু বলতে চাই না। তবে যেহেতু আমি অলরাউন্ডার, নিজেকে অলরাউন্ডার মনে করি; এই ভূমিকায় ব্যাটিং-বোলিং দুটিতেই দলের হয়ে পারফর্ম করতে চাই। এটা করতে পারলে দলের জন্য যেমন অবদান রাখা হবে, অলরাউন্ডার হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে। ব্যাটে-বলে ভালো করতে পারলে বড় সুযোগ থাকবে সামনে এগোনোর। এ ক্ষেত্রে ব্যাটিংয়ে আমার আরও অনেক উন্নতি করতে হবে। ব্যাটিংয়ে উন্নতি করতে পারলে অলরাউন্ডার হিসেবে আরও এগিয়ে যেতে পারব।
টিবিএস: জাতীয় দলে শুরু থেকেই আপনি বল হাতে সফল। তবে ব্যাটসম্যানের সেই সত্তা ছিল না, যদিও বয়সভিত্তিক পর্যায়ে আপনাকে নিয়ে আশা করা হতো। এই জায়গায় কীভাবে উন্নতি করলেন?
মিরাজ: ব্যাটিংয়ের গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করেছি। স্কিল অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করছি। কোন জায়গায় উন্নতি করা দরকার, সেটা বের করে কাজ করেছি। কীভাবে ব্যাটিং উন্নত করা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করার চেষ্টা আমার মধ্যে সব সময়ই ছিল। সব সময়ই দেশি কোচদের তত্ত্বাবধানে ব্যাটিং নিয়ে কাজ করি আমি। সোহেল স্যার (কোচ সোহেল ইসলাম), বাবুল স্যার (কোচ মিজানুর রহমান বাবুল) আমার ব্যাটিং নিয়ে কাজ করেন। বোলিংয়ে সোহেল স্যারের সাথে কাজ করেছি। এ ছাড়া মুশফিক ভাইয়ের সাথে কথা বলি, পরামর্শ নেওয়ার চেষ্টা করি। এসব আমার ব্যাটিংয়ে ভূমিকা রাখে।
টিবিএস: দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে যেভাবে ব্যাটিং করেছেন, আপনার দৃঢ়তা প্রকাশ পেয়েছে। ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে আগের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হয়?
মিরাজ: হ্যাঁ, ব্যাটসম্যান হিসেবে আমি আগের চেয়ে আত্মবিশ্বাসী। এখন আমার মনে হয় উইকেটে গেলে টিকতে পারব বা ইনিংস বড় করতে পারবো। এখন আত্মবিশ্বাস নিয়ে উইকেটে যেতে পারি যে, এভাবে খেলবো। পরিকল্পনা করে যাই এবং সেই অনুযায়ী খেলার চেষ্টা করি। আগেও এমন ভাবনা থাকতো, তবে সেভাবে বাস্তবায়ন করা হয়ে উঠতো না। ভালো করার চেষ্টা থাকে, নিজের নির্দিষ্ট কিছু জায়গা আছে, যেখানে উন্নতি করার চেষ্টা থাকে। এসব চেষ্টা এবং কিছু ম্যাচে পাওয়া সফলতাই আমাকে আত্মবিশ্বাস জোগায় এখন।
টিবিএস: উপরের দিকে ব্যাটিং করা বা ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে কোন অবস্থানে দেখতে পারলে সন্তুষ্ট হতে পারবেন?
মিরাজ: ভালোর তো বিভিন্ন পর্যায় থাকে, এটার শেষ নেই। ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে আরও ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। যে চেষ্টার মধ্যে আছি, এটা ধরে রাখতে হবে। উন্নতি করার মাধ্যমে পরের পর্যায়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বিশ্ব ক্রিকেটে ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজের একটা অবস্থান দেখতে চাই, প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। সেখান থেকে আমি বেশ দূরে, আরও অনেক কাজ করতে হবে। বিশ্ব পর্যায়ে ডমিনেট করতে হলে আমাকে ধারাবাহিকভাবে ৫-৭ বছর ভালো খেলতে হবে। এক-দুই বছর ভালো খেলে সেটা করা সম্ভব নয়।
টিবিএস: বাংলাদেশ বেশির ভাগ সময়ে স্পিন নির্ভর দল ছিল, স্পিনেই বেশি ভরসা করা হতো। এবার পেসাররা প্রথমবারের মতো ইনিংসে ১০ উইকেট নিলেন, অন্যান্য সময়েও অবদান রাখছেন। স্পিনার হিসেবে এটা আপনাদের জন্য সুবিধা বা স্বস্তির কিনা?
মিরাজ: হ্যাঁ, অবশ্যই এটা স্বস্তি বা ভালো লাগার জায়গা। পেস বোলাররা ভালো করলে স্পিনারদের জন্য কাজটা সহজ হয়ে যায়। পেসাররা শুরুর দিকের ব্যাটসম্যানদের উইকেট নিলে মাঝে বা শেষে উইকেট নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের জন্য ভালো হয়। পেসাররা উইকেট নিয়ে প্রতিপক্ষ এমনি চাপে থাকে, তখন চাপ আরও বাড়িয়ে উইকেট ভাঙার চেষ্টা করা যায়। দলে সবারই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। নতুন বলের বোলাররা উইকেট নিলে সেটা আমরা যারা স্পিনার, তাদের জন্য বড় একটা সাহায্য হয়, স্বস্তির হয়।