‘জাতীয় দলে একজন কোচ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হতে পারেন না’

চান্দিকা হাথরুসিংহে; বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রধান কোচ। পদের মতোই দলে অবস্থান তার। প্রধান কোচের দায়িত্ব থাকা লঙ্কান এই কোচই বাংলাদেশ দলে সর্বেসর্বা বা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) থেকে পাওয়া অধিকার বলে যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্তই নিতে পারেন তিনি। এর জন্য কাউকে কৈফিয়ত দিতে হয় না হাথুরুসিংহেকে।
কয়েকটি উদাহরণেই স্পষ্ট হবে দলে তার প্রভাব। দায়িত্বের প্রথম দফায় ২০১৭ সালে মাশরাফি বিন মুর্তজাকে টি-টোয়েন্টি দল থেকে অবসর নিতে এক প্রকার বাধ্য করেন হাথুরসিংহে। টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের ফিল্ডিং পজিশন বাইরে থেকে ঠিক করে দিয়েছেন তিনি। এবার তামিম ইকবালকে দলে না নিতে তিনিই প্রথম বিসিবি সভাপতিকে পরামর্শ দেন। বিশ্বকাপে ব্যাটিং অর্ডার ওলট-পালট করাটাও অনেকটা তার একক সিদ্ধান্ত।
হাথুরুসিংহের কোনো কৌশলই কাজে আসেনি, ব্যর্থতার বৃত্তে ঢুকে পড়া বাংলাদেশ নয় ম্যাচে মাত্র দুটিতে জিতেছে। হার মানা কোনো ম্যাচে ন্যূনতম লড়াইও করতে পারেনি তারা। কোনো দলে 'এক মাথা' থেকে সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সেই দলের ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে বলে মনে করেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম।
বিকেএসপির প্রধান ক্রিকেট উপদেষ্টার দায়িত্বে থাকা স্থানীয় প্রবীণ এই কোচের মতে, জাতীয় দলে একজন কোচ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হতে পারেন না। স্কুল ক্রিকেট পর্যায়ে কোনো দলের কোচ সর্বসের্বা হলে ঠিক আছে। বাংলাদেশ দলে হাথুরুসিংহের ভূমিকা, কোচদের কোচিং নীতি, বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যর্থতার কারণসহ আরও অনেক বিষয় নিয়েই দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন নাজমুল আবেদীন।
বিশ্বকাপে দল হয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ
এক কথায় তো বলা যায় যায় যে ব্যর্থ বিশ্বকাপ আমাদের জন্য। বিশ্বকাপ একটা সুযোগ তৈরি করে দেয় এই ফরম্যাটে চার বছর আগে কোথায় ছিলাম, সেটা যাচাই করে দেখার। সারা পৃথিবীকে দেখানোর সুযোগ করে দেয়, নিজেদেরকেও বোঝার সুযোগ করে দেয়। কোন কোন জায়গায় উন্নতি করা গেল, সেটা দেখা যায়। কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে তেমন কিছু আমরা দেখাতে পারিনি। দল হিসেবে বা ব্যক্তিগত খেলোয়াড়ের কথা যদি বলি, কোনো জায়গাতেই আমরা উন্নতি করতে পারিনি। হারতে পারি, তারপরও কিছু শক্তির জায়গা থাকে। সেদিক থেকে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
বিশ্বকাপে আমরা সেই অর্থে একটা দল হয়ে উঠতে পারিনি। একটা দলে অনেক ধরনের চরিত্র থাকে, খেলোয়াড় থাকে, জুনিয়র-সিনিয়র; সবাই মিলে একটা লক্ষ্যের দিকে চোখ রাখে। সেই লক্ষ্য অর্জনে কার ভূমিকা কী হবে, একটা প্রস্তুতি থাকে। মানসিক প্রস্তুতি, শারীরিক প্রস্তুতি, সব ধরনের প্রস্তুতি থাকে। এটা আমরা গুছিয়ে তুলতে পারিনি। বিশ্বকাপের আগে যে ঘটনাগুলো ঘটলো, দল নির্বাচনটাও খুব দেরিতে হলো। কে খেলবে না খেলবে, এগুলো নিয়ে আমরা নিশ্চিত ছিলাম না। তারপর দল যখন নির্বাচন হয়ে গেল, আমরা নিশ্চিত ছিলাম না যে এই দলটা আমরা কীভাবে সাজাব। এ কারণে আমরা প্রথম দিকে দেখলাম ব্যাটিং অর্ডার একটু এদিক-ওদিক করে যে, আরও ভালোভাবে প্রেজেন্ট করা যায় কিনা। এগুলোর কোনোটিই কিন্তু কাজে লাগেনি সেভাবে। এসবের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, বাংলাদেশ একটি দল হয়ে উঠতে পারেনি। সবকিছু বাদ দিয়ে আমাদের ওই ম্যাচটা জিততে হবে, এই যে চাওয়াটা; এই জায়গায় আমরা পৌঁছাতে পারিনি। সেই জায়গায় যেতে পারলে কারও বিপক্ষেই আমাদের একপেশে হার দেখতে হতো না।
শুরুতে ব্যাটিং অর্ডার এই জন্যই পরিবর্তন করা হয়েছে যে, অন্যভাবে বা আরও ভালোভাবে ব্যাটিং অর্ডারটাকে নিয়ে আসা যায় কিনা। কাজ না করাতেই পরে আরে সেদিকে যায়নি। তবে এটার কারণেই হয়েছে, তেমনও না। এটা একজন ব্যাটসম্যানকে একদম উলট-পালট করে দেবে, সেটা কিন্তু ঠিক নয়। আজ একজন ব্যাটসম্যান তিনের জায়গায় পাঁচে খেললাম, তার মানে তিনে কীভাবে খেলতে হয়, সেটা আমি ভুলেই গেলাম, পরের দিন তিনে খেলতে পারব না, এটা কোনো অজুহাত নয়। প্রস্তুত হয়ে যে বিশ্বকাপে যাওয়া, সেটা হয়নি। আমরা প্রস্তুতি নিয়ে বিশ্বকাপে যাইনি। কে কী কাজ করবে, সেটা ঠিক ছিল না। আত্মবিশ্বাসের জায়গায়ও কিছুটা দুর্বলতা ছিল। দল পরিচালনার ক্ষেত্রেই হয়তো এমন একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যেখানে দুর্বলতা চলে এসেছে।
অনুজ্জ্বল পেস আক্রমণ
পেস আক্রমণ নিয়ে প্রত্যাশা করাটা কিছুটা অবাক হওয়ার মতো। এটা ঠিক না যে আমরা বিশ্বের সেরা পেস আক্রমণের একটি, এটা মোটেও ঠিক নয়। এটা আমাদের অতি-মূল্যায়ন। হয়তো আমরা জোরাজুরি করে বলি আমাদের বোলারদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য। আমরা যদি ভারত, অস্ট্রেলিয়া বা ইংল্যান্ডের বোলিং আক্রমণ দেখি, তাদের চেয়ে কি আমাদের বোলিং আক্রমণ ভালো? অবশ্যই না। তো আমরা কেন চোখ বন্ধ করে বলে দিই আমরা বিশ্বের অন্যতম সেরা পেস বোলিং বিভাগ! এগুলো মোটেও ঠিক না, আমরা অতি মূল্যায়ন করে এমন জায়গায় নিয়ে যাই। তবে যতোটা সক্ষমতা ছিল আমাদের বোলারদের, সেই অনুযায়ী বোলিং করতে দেখিনি। সেটা এই কারণে হতে পারে, যে কন্ডিশনে খেলা হয়েছে, সেটা ব্যাটিং বান্ধব। সেখানে গিয়ে হয়তো আমরা কিছুটা ভরকে গেছি যে কী করতে হবে, বুঝে উঠতে পারিনি।
বাংলাদেশ দলে হাথুরুসিংহের ভূমিকা ও কোচিং স্টাফ পরিবর্তন প্রসঙ্গে
এটা তো আর স্কুল টিম নয়। একটা স্কুল দল যখন হয়, সেখানে একজন কোচ সর্বেসর্বা হন। কারণ স্কুল টিমের খেলোয়াড়দের ওপর ভরসা করা যায় না সব ব্যাপারে, ওদেরকে বুঝিয়ে দিতে হয়। কিন্তু একটা জাতীয় দলে একজন কোচ সর্বেসর্বা হতে পারেন না। ওখানে ওনারশিপদের মধ্যে অনেক ভাগ থাকা উচিত। সবার মধ্যেই দায়িত্ববোধ থাকবে, ওনারশিপ থাকবে, দায়বদ্ধতা থাকবে। ব্যাপারটা এমন হবে না যে একজন কোচ, তার নির্দেশে সব নিশ্চিন্ত। তাহলে বিভিন্ন দিক থেকে ইনপুট আসবে না। সবদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা যে আসতে পারে, সেটা আসবে না। শুধু একদিক থেকেই যাবে। এটা ভালো পরিবেশ নয়।
এমন পর্যায়ে সুজনশীল বা সৃষ্টিশীল হওয়া খুব জরুরি। যদি কেবল একজন নির্দেশক হন বা একদিক থেকেই সব যায়, তাহলে এসব হবে না। কোচের দায়িত্ব হচ্ছে মাঝখান থেকে আস্তে আস্তে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া, যেন খেলোয়াড়রা নিজেরা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কোচ আছেন, প্রয়োজন হলে তিনি সিদ্ধান্ত দিয়ে সাহায্য করবেন। কিন্তু খেলোয়াড়রা যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, সেই পরিবেশটা দেওয়া খুবই জরুরি।
আমি যতটুকু জানি, কোচিং স্টাফ পুরোটাই বদলে যাচ্ছে। পেস ও স্পিন বোলিং কোচ আমাদের নেই মনেহয়। ফিল্ডিং কোচও হয়তো থাকছে না। আমি জানি না হাথুরুসিংহের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত আসবে। সে হয়তো মনে হয় থেকে যাচ্ছে। কিন্তু ওর কাছ থেকে আমরা কী চাই, কীভাবে চাই; এবং সেটা আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করব সময়ে সময়ে, এটার ব্যাপারে খুব পরিষ্কার হওয়া উচিত। সে কী কাজ করছে, সামনের বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দেখার সুযোগ হবে। কিন্তু এক বছর পরে তাকে মূল্যায়ন না করে তাকে যদি আমরা বিভিন্ন সময়ে মূল্যায়ন করার পথ বেছে নিতে পারি, সেটা সবচেয়ে ভালো। না হলে একটা বিশ্বকাপ, তারপর মূল্যায়ন করা হবে, ততোদিনে অনেক সময় চলে যাবে।
'টাইম টু টাইম' মূল্যায়ন করার একটা পদ্ধতি বের করা দরকার আমাদের। এটা হওয়া খুব জরুরি। বোর্ড যদি মনে করে তার হাতে সব কর্তৃত্ব দিয়ে দিবো, সে সব নিয়ন্ত্রণ করবে; ক্লাব ক্রিকেটে যেমন হয়। কিন্তু এটা ক্লাব ক্রিকেট নয়। আমরা যদি খেলোয়াড়দের কাছ থেকে পারফরম্যান্স বের করে নিতে চাই, ওদেরকে ওনারশিপ দিতে হবে। ওদেরকে বুঝতে দিতে হবে, এটা ওদেরই দল। ওদেরই দল, এটা আমরা ওদেরকে বুঝতে দিতে চাই না। আমরা মনে করি, ওরা বেতন পাওয়া মানুষ। ওরা খাটবে, ওদের কাজই খেটে খেটে খেলা। ব্যাপারটা তা নয়, ওনারশিপ দেওয়া খুবই জরুরি। যেটা আমরা দিই না।