‘অসম্ভবকে’ সম্ভব করে অস্ট্রেলিয়াকে জেতালেন ম্যাক্সওয়েল
অসাধারণ, অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়, অভূতপূর্ব কিংবা অন্য কোনো শব্দ। গ্লেন ম্যাক্সওয়েল কিংবা তার ইনিংসটির প্রশংসায় কোন শব্দটি সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত? সম্ভবত কোনোটিই নয়। এমন ইনিংসের মাহাত্ম্য বোঝানোর সাধ্য আছে এমন কোন শব্দের!
তবে ক্রিকেটে মহাকাব্য কেমন হয়, সেটার উত্তর জানতে বা ভিডিওতে দেখে নিতে ম্যাক্সওয়েলের ইনিংসটাতে চোখ রাখতে পারেন। যা দেখবেন সেটাই মহাকাব্য, ওয়ানডে ক্রিকেটের সবচেয়ে মহাকাব্যিক ইনিংস।
হারের দ্বারপ্রান্তে থাকা দলকে পথ দেখিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান খেললেন বিশ্বকাপ এবং ওয়ানডে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংস। ডাবল সেঞ্চুরি করে গাঁথলেন রেকর্ডের মালা। তার অবিশ্বাস্য ব্যাটিংয়ে ৯১ রানে ৭ উইকেট খোয়ানো অস্ট্রেলিয়াই শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তানকে হারালো ৩ উইকেটে। এই জয়ে সেমি-ফাইনালে উঠে গেল তারা।
টস জিতে আগে ব্যাটিং করতে নামে আফগানিস্তান। দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি করেন ইব্রাহিম জাদরান। ছোট ছোট ইনিংস খেলেন রহমত শাহ, অধিনায়ক হাশমতউল্লাহ শহিদি, আজমতউল্লাহ ওমরজাইরা। আর শেষ দিকে ঝড় তোলেন রশিদ খান। এদের ব্যাটে ৫ উইকেটে ২৯১ রান তোলে আফগানরা, যা বিশ্বকাপে তাদের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ।
জবাবে আফগানদের বোলিং তোপে ৪৯ রানেই ৪ উইকেট হারায় অস্ট্রেলিয়া। আজমতউল্লাহ ওমরজাই তখন হ্যাটট্রিক বলটি করবেন, এমন সময়ে উইকেটে যান গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। ওই বল থেকে নিজেকে বাঁচালেন, পরে পেলেন তিনটি জীবন।
সুযোগ কাজে লাগিয়ে একাই খেলে গেলেন তিনি, প্যাট কামিন্সের সঙ্গে গড়লেন রেকর্ড অষ্টম জুটি। খাদের কিনারে চলে যাওয়া অজিরাই পরে ম্যাচ জিতলো ১৯ বল হাতে রেখে। বিশ্বকাপে এটাই অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ রান তাড়া, আগের সর্বোচ্চ ছিল ২৮৭। অস্ট্রেলিয়ার মতো এই মাঠেও ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রান তাড়ার রেকর্ড এটা।
তাদের ইনিংস, জয়; সবই ম্যাক্সওয়েলময়; সেটা বলাই বাহুল্য। তার ইনিংসে হয়েছে অনেকগুলো রেকর্ডও। অজিদের করা ২৯৩ রানের মধ্যে ম্যাক্সওয়েল একাই করেছেন ২০১ রান। যা বিশ্বকাপে এবং ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়ার কোনো ব্যাটসম্যানের পক্ষে সেরা ইনিংস। প্রথম অজি ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরি করলেন ম্যাক্সওয়েল।
প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে দলকে জেতানো ম্যাক্সওয়েল ১২৮ বলে ২১টি চার ও ১০টি চক্কায় নিজের ইনিংসটি সাজান। বিশ্বকাপের ইতিহাসে তার ইনিংসটি তৃতীয় সেরা এবং এবারের আসরে এখন পর্যন্ত সেরা। ডাবল সেঞ্চুরি করে বিশ্বকাপে এবং ওয়ানডেতে দলকে জেতানো একমাত্র ব্যাটসম্যান হলেন তিনি। তার আগে বিশ্বকাপে ডাবল সেঞ্চুরি করা দুই ব্যাটসম্যান হলেন মার্টিন গাপটিল ও ক্রিস গেইল।
ওয়ানডে ও বিশ্বকাপে ছয় নম্বরে নেমে ডাবল সেঞ্চুরি করা প্রথম ব্যাটসম্যানও ম্যাক্সওয়েল। অথচ এক সময় মনে হচ্ছিল মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে তাকে। ৭৬ বলে সেঞ্চুরি পূর্ণ করা অজি এই ব্যাটসম্যানের ডান পায়ে টান পড়ে। কয়েকবার মাঠেই চিকিৎসা নিতে হয় তাকে। অনেক বলে রান নেননি, আবার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পূর্ণ করেছেন কিছু রান। একবার ছক্কা মেরে মাটিতে শুয়ে ব্যথায় কাতরান তিনি। ডান পায়ে টান পড়ায় ফুটওয়ার্ক ছিলই না তার, ডান পা না সরিয়ে চোখ ধাঁধানো সব শটে চার-ছক্কার বৃষ্টি নামান ম্যাক্সওয়েল।
৯১ রানেই ৭ উইকেট হারানোর পর কামিন্সের সঙ্গে জুটি বাধেন ম্যাক্সওয়েল। অধিনায়ককে একপাশে রেখে একাই ঝড় বইয়ে দিতে থাকেন তিনি। দুজনের প্রথম ১০০ রানের জুটিতে কামিন্সের অবদান ছিল মাত্র ৮ রান, বাকি সব রান ম্যাক্সওয়েলের। শেষ পর্যন্ত ২০২ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়েন তারা। যা অষ্টম উইকেটে অস্ট্রেলিয়া ও বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা জুটি।
বিশ্বকাপে যেকোনো উইকেটে অস্ট্রেলিয়ার ষষ্ঠ সেরা জুটি এটা। ম্যাক্সওয়েলকে দারুণ সঙ্গ দেওয়া কামিন্স ৬৮ বলে একটি চারে ১২ রানে অপরাজিত থাকেন। এর আগে বিপর্যয়ের মাঝে খেই হারানো ডেভিড ওয়ার্নার ১৮, মিচেল মার্শ ২৪, মার্নাস লাবুশেন ১৪, মার্কাস স্টয়নিস ৬, মিচেল স্টার্ক ৩ রান করেন। ট্রাভিস হেড ও জশ ইংলিস রানের খাতা খুলতে পারেননি। আফগানিস্তানের নাভিন-উল-হক, আজমতউল্লাহ ও রশিদ খান ২টি করে উইকেট পান।
এর আগে ব্যাটিং করা আফগানিস্তানের ইনিংসের পুরোটাই ইব্রাহিমময়। ওপেনার হিসেবে নেমে একদম শেষ বল পর্যন্ত ব্যাটিং করেন তিনি। ২১ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যান ১৪৩ বলে ৮টি চার ও ৩টি ছক্কায় ১২৯ রানে অপরাজিত থাকেন।
শেষদিকে রশিদ খানের ঝড়ে আফগানদের সংগ্রহ বড় হয়। তারকা এই লেগ স্পিনার ১৮ বলে ২টি চার ও ৩টি ছক্কায় হার না মানা ৩৫ রান করেন। এ ছাড়া রহমত শাহ ৩০, হাশমতউল্লাহ ২৬ ও আজমতউল্লাহ ২২ রান করেন। অস্ট্রেলিয়ার জস হ্যাজলউড ৩৯ রানে ২টি উইকেট নেন। একটি করে উইকেট পান মিচেল স্টার্ক, ম্যাক্সওয়েল ও অ্যাডাম জাম্পা।