রান পাহাড় টপকে বাংলাদেশকে হারিয়ে দিলেন কাইয়া-রাজা
কিছু রান কম হওয়ার আক্ষেপ থাকলেও সংগ্রহ ছোট ছিল না। ৩০০ ছাড়ানো সংগ্রহ গড়লে জয়ে চোখ থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। বল হাতে শুরুটাও হয় জম্পেশ। দুই ওভারের মধ্যেই দুই উইকেট তুলে নেন বাংলাদেশের পেসাররা, তৃতীয় উইকেট নিতেও বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু এরপর যে অধ্যায় রচনা করেছেন ইনোসেন্ট কাইয়া ও সিকান্দার রাজা, যেখানে হতাশা ছাড়া কিছুই নেই বাংলাদেশের জন্য।
অসাধারণ ব্যাটিংয়ে সেঞ্চুরির পাশাপাশি রেকর্ড জুটি গড়া এই দুই ব্যাটসম্যান রান পাহাড় টপকে জিম্বাবুয়ে উপহার দিয়েছেন দারুণ এক জয়। অবশ্য বাংলাদেশের গড়পড়তা বোলিং, ক্যাচ মিসের মহড়া ও পাড়ার মানের ফিল্ডিংও বাংলাদেশের হারের অন্যতম কারণ। শুক্রবার হারারে স্পোর্টস ক্লাবে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৫ উইকেটে হেরেছে তামিম ইকবালের দল।
বাংলাদেশের প্রিয় ফরম্যাট ওয়ানডেতেও দাপুটে শুরু হলো জিম্বাবুয়ের। তিন ম্যাচের সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল ঘরের মাঠের দলটি। এই জয়টি নিশ্চয়ই স্পেশাল তাদের কাছে। গত বেশ কয়েক বছর ধরে প্রায়ই বাংলাদেশের বিপক্ষে হেরে যাওয়া দলটি এবার কেবল বিজয়ের গল্প লিখে চলেছে। এ ছাড়া ওয়ানডেতে এটা জিম্বাবুয়ের তৃতীয় সর্বোচ্চ সফল রান তাড়া, বাংলাদেশের বিপক্ষে সর্বোচ্চ।
টস হেরে আগে ব্যাটিং করতে নামে বাংলাদেশ। ইনিংসের দুটি অংশে একেবারে ধীর গতির ব্যাটিং করলেও অধিনায়ক তামিম ইকবাল, লিটন কুমার দাস, এনামুল হক বিজয় ও মুশফিকুর রহিমের হাফ সেঞ্চুরিতে ২ উইকেটে ৩০৩ রানের বড় সংগ্রহ গড়ে বাংলাদেশ। এই মাঠে যা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ।
জবাবে দুঃস্বপ্নের শুরুর পরও দলকে দিক হারা হতে দেননি ইনোসেন্ট কাইয়া ও সিকান্দার রাজা। চতুর্থ জুটিতে রেকর্ড ১৯২ রানের জুটি গড়ে দলকে জয়ের খুব কাছে নিয়ে যান এই দুই সেঞ্চুরিয়ান। কাইয়া আউট হলে বাকি কাজটুকু সারেন ব্যাট হাতে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা রাজা। ছক্কা মেরে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছান ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতা ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। ৩০৪ রানের লক্ষ্য ৮ বল হাতে রেখে পেরিয়ে যায় জিম্বাবুয়ে।
বাংলাদেশের এই সফরে জিম্বাবুয়ে যেন তাদের পুরনো দিনের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে, যখন বাংলাদেশের বিপক্ষে তারাই ফেবারিট থাকতো। সময়ের ব্যবধানে দুই দলের চেহারা পাল্টেছে। জিম্বাবুয়ে বিপক্ষে বাংলাদেশ হয়েছে হয়ে উঠেছে সব সময়ের ফেবারিট। সেই ফেবারিটরাই এবার পরাজিত দল। টি-টোয়েন্টি সিরিজ হারের পর ওয়ানডেতেও স্বাগতিকদের শাসন হজম করতে হলো তামিম-মুশফিকদের।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডেতে হারতেই ভুলে গিয়েছিল বাংলাদেশ। এই ফরম্যাটে দলটির বিপক্ষে খেলতে নামলেই শাসন করতো তারা। অবশেষে অপেক্ষা ফুরিয়ে নিলো জিম্বাবুয়ে। দীর্ঘ ৯ বছর ও ১৯ ম্যাচ পর বাংলাদেশকে ওয়ানডেতে হারারো তারা। সর্বশেষ ২০১৩ সালে মে মাসে বুলাওয়েতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে হারে বাংলাদেশ।
এই ম্যাচে ভুলের শেষ ছিল না বাংলাদেশের। হাতে উইকেট থাকতেও রান তোলার তাগিদ দেখা যায়নি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে। ১১ থেকে ২৫ এবং ৪৬ থেকে ৫০ ওভারের মধ্যে প্রচন্ড ধরিগতির ব্যাটিং করে বাংলাদেশ। না হলে সংগ্রহ ৩৫০ ছাড়াতেই পারতো। এরপর ফিল্ডিংয়ে দেখা যায় 'হযবরল' অবস্থা। বাংলাদেশের ফিল্ডারদের হাত থেকে ক্যাচই পড়েছে ৫টি, আর বাজে ফিল্ডিংয়ে বেরিয়ে গেছে অনেক রান।
অথচ বল হাতে কী দারুণ শুরুটাই না হয় বাংলাদেশের! প্রথম ওভারেই জিম্বাবুয়ের অধিনায়ক রেজিস চাকাভাকে ফিরিয়ে দেন মুস্তাফিজুর রহমান। পরের ওভারে আরেক ওপেনার তারিসাই মুসাকান্দাকে ফেরান শরিফুল ইসলাম। বিশাল রান তাড়ায় ৬ রানেই নেই ২ উইকেট, যেন মাঝ দরিয়ায় পড়ে যায় স্বাগতিকরা।
ওয়েসলে মাধেভেরেকে সঙ্গে নিয়ে এই চাপ কাটিয়ে তোলে ক্যারিয়ারের চতুর্থ ওয়ানডে খেলতে নামা কইয়া। দলীয় ৬২ রানে গিয়ে আউট হন মাধেভেরে, ১৯ রান করেন তিনি। এরপর শুরু হয় কাইয়া-রাজা পর্ব। ডানহাতি এই দুই ব্যাটসম্যান শুরুতে ধীর-স্থির থাকলেও উইকেটে মানিয়ে যাওয়ার পর থেকে দাপুটে ব্যাটিং করতে থাকেন।
বাংলাদেশের বোলারদের অসহায় বানিয়ে দ্রুত গতিতে রান তুলতে থাকেন কাইয়া-রাজা। চোখ ধাঁধানো ব্যাটিংয়ে চতুর্থ উইকেটে ১৯২ রানের জুটি গড়েন তারা। যেকোনো উইকেটে এটা জিম্বাবুয়ের তৃতীয় সর্বোচ্চ জুটি, বাংলাদেশের বিপক্ষে সেরা। চতুর্থ উইকেটে এটা জিম্বাবুয়ের দ্বিতীয় সেরা জুটি, বাংলাদেশের বিপক্ষে সর্বোচ্চ।
এই জুটির ব্যাটিং শো থামে কাইয়ার বিদায়ে। দলীয় ২৫৪ রানে কাইয়াকে ফেরান মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। এর আগেই ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি তুলে নেন কাইয়া। দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে ১২২ বলে ১১টি চার ও ২টি ছক্কায় ১১০ রানের ইনিংস খেলেন জিম্বাবুয়ের টপ অর্ডার এই ব্যাটসম্যান।
এরপর লুক জংওয়ে ১৯ রান করে ফিরলে ফিরলে মিল্টন শুম্বাকে সঙ্গে নিয়ে জয় তুলে নেওয়ার কাজটি সারেন ম্যাচসেরা রাজা। টি-টোয়েন্টি সিরিজে রানের ফোয়ারা বইয়ে দেওয়া অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান ১০৯ বলে ৮টি চার ও ৬টি ছক্কায় ১৩৫ রানের ঝলমলে এক ইনিংস খেলেন। বাংলাদেশের মুস্তাফিজ, শরিফুল, মোসাদ্দেক ও মিরাজ একটি করে উইকেট নেন।
এর আগে ব্যাটিং করা বাংলাদেশের হয়ে যে উইকেটে গেছেন, সেই রানের দেখা পেয়েছেন। ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে বাংলাদেশের প্রথম চারজন ব্যাটসম্যানই হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন। শেষ দিকে নেমে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও রানের দেখা পান।
টস হেরে আগে ব্যাটিং করতে নামা বাংলাদেশের শুরুটা হয় দারুণ। ধীর গতিতে রান উঠলেও উইকেট হারানো নিয়ে ভাবতে হয়নি সফরকারীদের। উদ্বোধনী জুটিতে ২৫.৪ ওভারে ১১৯ রানের জুটি গড়েন অধিনায়ক তামিম ও লিটন। যা ওয়ানডেতে তাদের চতুর্থ শতরানের জুটি।
এই জুটি গড়ার পথে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৫৪তম হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন তামিম। এরপর আরও ৭ রান করে পৌঁছান অনন্য এক মাইলফলকে। বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান ও এশিয়ার পঞ্চম ওপেনার হিসেবে ওয়ানডেতে ৮ হাজার রান পূর্ণ করেছেন তামিম। ২২৯ ওয়ানতে অভিজ্ঞ এই ওপেনারের রান এখন ৮ হাজার ৫। মাইলফলকে ছোঁয়ার দিনে তামিম ৮৮ বলে ৯টি চারে ৬২ রান করেন।
এরপর পর বিজয়ের সঙ্গে জুটি গড়েন লিটন। এ সময় দ্রুত গতিতে রান তোলার দিকে মন দেন লিটন। ধীর মেজাজে হাফ সেঞ্চুরি করা ডানহাতি এই ওপেনারই মারকুটে মেজাজে রান তুলতে থাকেন। ৭৫ বলে ওয়ানডের ষষ্ঠ হাফ সেঞ্চুরি করা লিটন ৮৯ বলে ৯টি চার ও একটি ছক্কায় করেন ৮১ রান। সেঞ্চুরির দেখা পেতেই পারতেন তিনি। কিন্তু রান নেওয়ার সময় ডান উরুতে টান পড়ায় স্ট্রেচারে করে মাঠ ছাড়তে হয় লিটনকে।
লিটন মাঠ ছাড়লেও চাপ বুঝতে হয়নি বাংলাদেশকে, রান এসেছে ছন্দময় গতিতেই। তৃতীয় উইকেটে জুটি গড়ে দারুণ ব্যাটিং করতে থাকেন বিজয় ও এই ম্যাচ দিয়ে বাংলাদেশ দলে ফেরা মুশকিফুর রহিম। তৃতীয় উইকেটে ৯৬ রান যোগ করেন এ দুজন। এর মধ্যে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের চতুর্থ হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন ৩ বছর পর এই ফরম্যাটে খেলতে নামা বিজয়। ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান ৬২টি বলে ৬টি চার ও ৩টি ছক্কায় ৭৩ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন।
এরপর মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে যোগ দেন মাহমুদউল্লাহ। এ দুজন ৩৬ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়েন। মুশফিক ৪৯ বলে ৫টি চারে ৫২ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন, এই ফরম্যাটে এটা তার ৪২তম হাফ সেঞ্চুরি। মাহমুদউল্লাহ ১২ বলে ২টি চারে ২০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন। জিম্বাবুয়ের অভিষিক্ত পেসার ভিক্টর নিয়াউচি ও সিকান্দার রাজা একটি করে উইকেট নেন।