ক্যারিবীয়দের হোয়াইটওয়াশ করলো বাংলাদেশ
তাইজুল ইসলামের রেকর্ড গড়া বোলিংয়ের সঙ্গে অন্য বোলাররাও সুর মেলান সমান তালে। তাতে লক্ষ্যটা নাগালেই থাকে। ব্যাট হাতে শুরুটা ভালো না হলেও দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে চাপ সামলে নেয় বাংলাদেশ। অর্ধশত জুটিতে জয়ের পথে ছন্দে ছন্দেই এগিয়ে যেতে থাকে সফরকারীরা। কিন্তু মাঝে হয় ছন্দপতন, একটা সময়ে গিয়ে জয়ের পথ কঠিন মনে হচ্ছিল। এরপরও পথ হারায়নি বাংলাদেশ, ঠিকই জয়ের বন্দরে পৌঁছেছে তামিম ইকবালের দল।
শনিবার রাতে গায়ানার প্রভিডেন্স ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৪ উইকেটে জিতেছে বাংলাদেশ। এই জয়ে তিন ম্যাচের সিরিজে ক্যারিবীয়দের হোয়াইটওয়াশ করলো বাংলাদেশ। এ নিয়ে উইন্ডিজের বিপক্ষে টানা ১১টি ওয়ানডে জিতলো তারা। ২০১৪ সাল থেকে ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের ধারাবাহিকতাও ধরে রাখলো বাংলাদেশ।
এটা ছিল বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে ১১তম ওয়ানডে সিরিজ। এর মধ্যে বাংলাদেশ জিতেছে ৬টি সিরিজ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৫টি। ক্যারিবীয়দের এ নিয়ে ৩ বার হোয়াইটওয়াশ করলো বাংলাদেশ। বিপরীতে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে ৪ বার। এটা ছিল দুই দলের মধ্যে ৪৪তম ওয়ানডে ম্যাচ। জয়ে এক সময় অনেক এগিয়ে থাকলেও উইন্ডিজকে টানা ১১ ম্যাচে হারিয়ে সমতা এনেছে বাংলাদেশ। দুই দলেরই এখন সমান ২১টি করে জয়।
তিন ম্যাচের সিরিজটি ছিল বাংলাদেশের ৭৯তম দ্বিপাক্ষিক সিরিজ। এ নিয়ে ৩১টি সিরিজে জিতলো তারা। বিদেশের মাটিতে এটা তাদের অষ্টম সিরিজ জয়। সঙ্গে মিললো ১৬তম বারের মতো প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করার স্বাদ, বিদেশের মাটিতে চতুর্থবারের মতো। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলেছে ৫৮টি। এর মধ্যে ১১বার প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করেছে বাংলাদেশ, হোয়াইটওয়াশ হয়েছে ২৬ বার।
টস জিতে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেন তামিম। আগে ব্যাটিং করতে নেমে ম্যাচ সেরা তাইজুল ইসলামের স্পিন ছোবল ও বাংলাদেশের বাকি বোলারদের দারুণ বোলিংয়ে ৪৮.৪ ওভারে ১৭৮ রান তোলে স্বাগতিকরা। আসা যাওয়ার মিছিলের মাঝেও ৭৩ রানের ইনিংস খেলেন অধিনায়ক নিকোলাস পুরান। জবাবে লিটন কুমার দাসের হাফ সেঞ্চুরি এবং তামিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও নুরুল হাসান সোহানের মাঝারি ইনিংসে ৪৮.৩ ওভারে ৪ উইকেটের জয় পায় বাংলাদেশ।
ক্যারিবীয়দের হোয়াইটওয়াশ করার মিশনে দলের লক্ষ্য অল্পের মধ্যে বেধে রাখতে স্পিনাররা কাণ্ডারীর ভূমিকা পালন করেন। যেখানে নেতার ভূমিকায় ছিলেন ২০২০ সালের মার্চের পর প্রথম ওয়ানডে খেলতে নামা তাইজুল। বাংলাদেশের বাকি বোলাররাও এদিন দুর্দান্ত বোলিং করেন। তাইজুলের বিপক্ষে কঠিন পরীক্ষা দিতে হয় ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানদের। ১০ ওভারে মাত্র ২৮ রান খরচায় ৫টি উইকেট নেন বাঁহাতি এই স্পিনার। দশম ওয়ানডে খেলতে নামা তাইজুলের এটাই ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং ও প্রথম ৫ উইকেট। কেবল নিজেরই নয়, বাংলাদেশের স্পিনারদের মধ্যেই এটা সেরা বোলিং।
আগের সেরা বোলিং ছিল আব্দুর রাজ্জাকের। ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২৯ রানে ৫ উইকেট নেন তিনি। তাইজুলের বোলিং ফিগারটি বিদেশের মাটিতেও বাংলাদেশের স্পিনারদের মধ্যেও সেরা। আগের সেরা বোলিং ছিল সাকিব আল হাসানের, ২০১৯ বিশ্বকাপে সাউদাম্পটনে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ২৯ রানে ৫ উইকেট নেন তিনি।
ছোট লক্ষ্য হলেও বাংলাদেশের শুরুটা ভালো ছিল না। দলীয় ২০ রানে বিদায় নেন নাজমুল হোসেন শান্ত। দলকে অবশ্য চাপ বুঝতে দেননি তামিম ও লিটন। দ্বিতীয় উইকেটে ৫০ রানের জুটি গড়েন তারা। তিন ম্যাচে ১১৭ রান করে সিরিজ সেরার পুরস্কার জেতা তামিমের বিদায়ে ভাঙে এই জুটি। ফেরার আগে ৫২ বলে ৪টি চারে ৩৪ রান করেন বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক।
এরপর লিটন-মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের জুটি থেকে ২৬ রান পায় বাংলাদেশ। লিটন ৬৫ বলে ৫টি চার ও একটি ছক্কায় ৫০ রান করে আউট হলে হঠাৎ দিক হারায় বাংলাদেশ। দ্রুতই ফিরে যান আফিফ হোসেন ধ্রুব। মোসাদ্দেককে সাবলীল মনে হলেও ১৪ রানের বেশি করতে পারেননি। ধীর গতিতে খেলা মাহমুদউল্লাহ ৬১ বলে ২৬ রান করে আউট হন। এরপর দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যান সোহান ৩২* ও মিরাজ ১৬* রান করে দলের জয় নিশ্চিত করেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্পিনার গুডাকেশ মটি ৪টি এবং আলজারি জোসেফ ও নিকোলাস পুরান একটি করে উইকেট নেন।
এর আগে ব্যাটিং করা ওয়েস্ট ইন্ডিজ আগের দুই ম্যাচের মতো এই ম্যাচেও ভালো শুরু করতে পারেনি। স্পিনে কাবু ক্যারবীয়রা এদিনও শুরুতেই পরীক্ষার মুখে পড়ে। ইনিংসে তৃতীয় ওভারেই স্বাগতিকদের শিবিরে আঘাত হানেন তাইজুল ইসলাম। বাঁহাতি এই স্পিনারের দারুণ ডেলিভারিটি বুঝতেই পারেননি ক্যারিবীয় ওপেনার ব্রেন্ডন কিং। রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে ফেরানোর চেষ্টা করলেও তাইজুলের গুড লেংন্থের ফ্লাইট দেওয়া ডেলিভারিটি গিয়ে ভেঙে দেয় ৮ রান করা কিংয়ের স্টাস্প।
দ্বিতীয় ছোবল বসাতেই বেশি সময় নেননি তাইজুল। নিজের পরের ওভারেই তার শিকার আরেক ওপেনার শেই হোপ। বাংলাদেশ স্পিনারের বাতাসে ঝুলিয়ে দেওয়া ডেলিভারিটি সামনের পা এগিয়ে কভারে খেলার চেষ্টা করেন হোপ। কিন্তু তাইজুলের টার্নের কাছে পরাস্থ হন তিনি। পা বেরিয়ে আসায় বল কুড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে স্টাম্প ভাঙেন উইকেটরক্ষক নুরুল হাসান সোহান। টিভি রিপ্লে দেখে ২ রান করা হোপকে আউট ঘোষণা করেন থার্ড আম্পায়ার।
১৫ রানেই দুই উইকেট হারিয়ে মাহ বিপদে পড়ে যাওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপদ আরও বাড়ান একমাত্র পেসার হিসেবে একাদশে জায়গা পাওয়া মুস্তাফিজুর রহমান। পরের ওভারেই এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলে শেমার ব্রুকসকে ফিরিয়ে দেন তিনি। এখান থেকে দিকহারা দলকে পথ দেখানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন কিচি কার্টি ও অধিনায়ক নিকোলাস পুরান।
শুরুর ধাক্কা সামলে এই জুটি দলকে এগিয়ে নিতে থাকে। ধীর গতিতে রান তুললেও দলকে ছন্দে ফেরান কার্টি-পুরান। চতুর্থ উইকেটে ৬৭ রান যোগ করেন তারা। কার্টিকে ফিরিয়ে এই জুটি ভাঙেন নাসুম আহমেদ। বাঁহাতি এই স্পিনারের বলে তামিমের হাতে ক্যাচ দেওয়ার আগে ৬৬ বলে ২টি চার ও একটি ছক্কায় ৩৩ রান করেন কার্টি।
পুরানের সঙ্গে যোগ দিয়ে রভম্যান পাওয়েলও থিতু হয়ে উঠেছিলেন, এই জুটি থেকে আসে ৩৪ রান। কিন্তু তাইজুলের স্পিন ছোবলের কাছে হার মানতে হয় রভম্যানকে। এলবিডব্লিউ হয়ে সাজঘরের ফেরার আগে ২৯ বলে একটি ছক্কায় ১৮ রান করেন তিনি। অন্য প্রান্তে ভাঙনের সুর বাজতে থাকলেও পুরান নেতার মতো ব্যাট চালিয়ে যেতে থাকেন।
রভম্যানের বিদায়ের কিছুক্ষণ পরই কিমো পলকে নিজের চতুর্থ শিকারে পরিণত করেন তাইজুল। এরপর আকিল হোসেনকে এক পাশে রেখে ঝড় তোলেন পুরান। মেহেদী হাসান মিরাজের করা ইনিংসের ৪০তম ওভারে টানা দুই ছক্কা ও এক চারে ১৪ রান তোলেন ক্যারিবীয় অধিনায়ক। আকিল অবশ্য পুরানকে বেশি সময় সঙ্গ দিতে পারেননি। ৮ বলে ১ রান করে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের দারুণ এক ডেলিভারিতে বোল্ড হন তিনি।
উইকেট পড়তে থাকলেও রান তোলায় মনোযোগী পুরান নিজের ছন্দে ব্যাট চালিয়ে যেতে থাকেন। তার সামনে বাধার দেয়াল তুলতে সক্ষম হন রেকর্ড গড়া বোলিং করা তাইজুল। স্টাম্প উপড়ে পুরানকে নিজের পঞ্চম শিকারে পরিণত করেন তিনি। ফেরার আগে ১০৯ বলে ৪টি চার ও ২টি ছক্কায় ৭৩ রান করেন উইন্ডিজ অধিনায়ক। শেষ দিকে রোমারিও শেফার্ড ১৯ ও আলজারি জোসেফ ৭ রান করেন।
তাইজুলের স্বপ্নের মতো দিনে মোসাদ্দেক সবচেয়ে কৃপণ বোলিং করেন। ডানহাতি এই অফ স্পিনার ১০ ওভারে মাত্র ২৩ রান খরচায় একটি উইকেট নেন। নাসুম ৯.৪ ওভারে ৩৯ রানে ২ উইকেট নেন। মুস্তাফিজ ৯ ওভারে মাত্র ২৪ রান দিয়ে ২ উইকেট নেন। মিরাজ এদিন সবচেয়ে খরুচে ছিলেন, ৮ ওভারে ৬১ রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকেন তিনি।