‘খেলা না হলে আমরা না খেয়ে মারা যাব’

যত দিন যাচ্ছে, শঙ্কার মেঘ ততই ঘনীভূত হচ্ছে। নতুন ভোর আসছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে আশার আলোর দেখা মিলছে না। বাতাসে কেবলই স্বজন হারানোর আর্তনাদ। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ছোবলে দিশেহারা হয়ে উঠেছে পুরো বিশ্ব। সব জায়গার মতো স্থবিরতা নেমে এসেছে খেলার মাঠেও। একে একে স্থগিত হয়ে গেছে বৈশ্বিক সব টুর্নামেন্ট।
বাংলাদেশেও একই চিত্র। অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে দেশের সব ধরনের খেলাধুলা। এক রাউন্ড পরই স্থগিত ঘোষণা করা হয় বঙ্গবন্ধু ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ। এই লিগটা নিয়েই মূলত ক্রিকেটারদের চিন্তা। বেশিরভাগ ঘরোয়া ক্রিকেটারের কাছে এই টুর্নামেন্টটি একমাত্র আয়ের উৎস।
করোনার প্রকোপ বাংলাদেশে বেড়েই চলেছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। রোববার সবচেয়ে বেশি ১৮ জন করোনা আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়েছে। এতে শঙ্কা বাড়ছে ক্রিকেটারদের মনেও। প্রশ্ন জাগছে, হবে তো প্রিমিয়ার লিগ? বেশিরভাগ ক্রিকেটারের চাওয়া- দ্রুত কেটে যাক এই অবস্থা। প্রিমিয়ার লিগ দিয়েই মাঠে ফিরুক ক্রিকেট।
প্রিমিয়ার লিগ না হলে রাস্তায় বসে যেতে হবে, না খেয়ে মারা পড়তে হবে- শঙ্কার কথা জানাতে গিয়ে এভাবেই বলছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত পারফর্ম করা এক ক্রিকেটার। এই অবস্থা দীর্ঘ হলে, লিগ বাতিল হয়ে গেলে ঘরোয়া ক্রিকেটারদের জন্য সময়টা কতটা চ্যালেঞ্জিং হবে, তা নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন ঘরোয়া ক্রিকেটের বেশ কয়েকজন সিনিয়র ক্রিকেটার।

শামসুর রহমান শুভ: এখন যে পরিস্থিতি, এটা খুব কঠিন। এখানে কিছু করার নেই। সবার ভালোর জন্যই সবকিছু স্থগিত রাখা হয়েছে। পুরো বিশ্বেই খেলা স্থগিত হয়ে আছে। আমরা যদি সচেতন থাকতে পারি এবং এটা যদি শেষ হয়, প্রিমিয়ার লিগের খেলাটা অবশ্যই হওয়া উচিত। কারণ এই একটা টুর্নামেন্টের ওপর ভিত্তি করেই আমাদের সারাটা বছর চলে।
প্রিমিয়ার লিগের মাত্র একটা ম্যাচ হয়েছে, লম্বা সময় বাকি আছে টুর্নামেন্টের। আমার মতে এই টুর্নামেন্ট যেহেতু শুরু হয়েছিল, আবার যখনই শুরু হোক, এটা শেষ করা উচিত।
শঙ্কা কাজ করে। আমাদের ৯০ শতাংশ ক্রিকেটার এই একটা টুর্নামেন্টের দিকে চেয়ে থাকে। আমাদের সংসারই চলে এই প্রিমিয়ার লিগ থেকে পাওয়া অর্থে। এখন প্রিমিয়ার লিগ যদি না হয়, সত্যি বলতে খুবই কষ্ট হবে খেলোয়াড়দের জন্য। যেহেতু সামনে দুটি ঈদ আছে, সবারই পরিবার আছে। তো এটা খুবই কষ্ট হবে।

সোহরাওয়ার্দী শুভ: আমরা তো এটা কল্পনাও করতে পারি না প্রিমিয়ার লিগ হবে না বা বাতিল হয়ে যাবে। হয়তো আরও এক মাস বা আরও পরে খেলা শুরু হবে, এমন হতে পারে। এটা তো আর সব সময় থাকবে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে প্রিমিয়ার লিগ হওয়ার কথা, যেহেতু খেলা শুরু হয়েছিল। অবস্থা যদি এমনই থাকে, তাহলে আমাদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাবে। আমরা তো বিপদে পড়ে যাব।
আমরা অবশ্যই চাই প্রিমিয়ার লিগ দিয়ে মাঠে খেলা ফিরুক। অনেক শঙ্কা কাজ করে মনে। কারণ আমাদের তো ব্রেড এন্ড বাটার এই প্রিমিয়ার লিগই। অনেকে চাকরি করছে, অবস্থা খারাপ হলে অর্ধেক বা যাই হোক পাবে। সবাই কোনো না কোনো কিছু করে খাবে। আমাদের খেলা না হলে তো না খেয়ে মারা যাব।
এখন না হয় কাছে কিছু টাকা আছে, খেয়ে পড়ে চললাম। কিন্তু এমন চলতে থাকলে সঙ্কট তৈরি হবে। তখন তো আমরা পুরোই বিপদে পড়ে যাব। আর আমাদের প্রথম শ্রেণির বেতনটা চালু থাকলেও হতো, সেটা চার-পাঁচ মাস ধরে বন্ধ আছে। ওটা চালু থাকলে খেলোয়াড়রা এখন ভালো একটা ব্যাকআপ পেত। এটা হয়ে গেলে ৯১জন খেলোয়াড়ের পরিবারটা চলতো। অন্তত বাজার-সদাই করে তো খেতে পারা যেত। এই চিন্তাটা না থাকলেই তো অনেক স্বস্তি।

মোহাম্মদ আশরাফুল: পুরো বিশ্বেই অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। এটা আগে থামতে হবে। আগে জীবন, পরে খেলা। তবে এটা চলতেই থাকলে অনেক কঠিন হবে। কারণ বেশিরভাগ খেলোয়াড় এই প্রিমিয়ার লিগের টাকা দিয়ে পুরো বছরের পরিকল্পনা করে। এই প্রথম বেশিরভাগ ক্লাবই কিন্তু পেমেন্ট দেয়নি খেলোয়াড়দের। অন্যান্য সময় ৬০ বা ৮০ শতাংশ টাকা দিয়ে দেয়। চার-পাঁচটি ক্লাব হয়তো দিয়েছে, বেশিরভাগই দেয়নি। যেমন আমরাও প্রথমভাগের পারিশ্রমিক পাইনি।
এক ম্যাচ শেষেই বন্ধ হয়ে গেছে, এখন কিছু বলারও নেই। বোর্ড এখন চুক্তির বাইরের সবাইকে এক মাসের জন্য টাকা দিচ্ছে। কত মাস চলে এখন দেখা যাক। আমাদের অবশ্যই চাওয়া, প্রিমিয়ার লিগ দিয়ে শুরু হোক। মে-জুনেও শুরু হলেও খেলা দেওয়া যেতে পারে। যদিও বৃষ্টির মৌসুম, তবু খেলা দেয়া যায়। অবস্থা ভালো হলে আশা করি প্রিমিয়ার লিগ যেখানে থেমেছে, ওখান থেকেই শুরু হবে।

তুষার ইমরান: আমরা আসলে অপেক্ষা করছি। অপেক্ষা করা ছাড়া তো উপায় নেই। আর যখনই শুরু হোক ক্রিকেট, প্রিমিয়ার লিগ দিয়ে শুরু হবে। দুই-তিন মাস পরে হলেও প্রিমিয়ার লিগ দিয়ে শুরু হোক। কারণ বছর শেষ হতে তো সময় আছে। যখনই পরিস্থিতি ভালো হবে, প্রিমিয়ার লিগ দিয়ে যেন শুরু হয়, এটা চাওয়া থাকবে।
এভাবে চলতে থাকলে চ্যালেঞ্জিং সময়েই পড়তে হবে। কিন্তু সবার আগে তো জীবন। পরে না হয় পেশাদার বা পেশা। খেলার চেয়ে জীবন বড়। জীবন বাঁচাতে পারলে পরে অনেক কিছুই করা যাবে। যেভাবে করোনা আক্রান্ত রোগী সংখ্যা বাড়ছে আর মানুষ মারা যাচ্ছে, এখন তো মনে হচ্ছে জীবনটাই আগে।

এনামুল হক জুনিয়র: সবাই তো বিসিএল-বিপিএল খেলে না বা খেলার সুযোগ পায় না। সেদিক থেকে প্রিমিয়ার লিগটা আমাদের সবার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই সব খেলোয়াড়েরই চাওয়া, খেলা যখনই শুরু হয়, প্রিমিয়ার লিগ দিয়ে যেন শুরু হয়। তাহলে ক্ষতিটা আমরা হয়তো পুষিয়ে নিতে পারব।
পরিস্থিতি এমন চলতে থাকলে শুধু খেলোয়াড়রাই নয়, পুরো বাংলাদেশের মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে এটা এখন বৈশ্বিক সমস্যা, এটা মেনে নিতেই হবে।