মাঠের লড়াইয়ের আগে দর্শকদের টিকেট যুদ্ধ
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে সবে, কোলাহল নেই বললেই চলে। দৈনন্দিন ব্যস্ততা শুরু হতে তখনও বেশ বাকি। কিন্তু মিরপুরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোন স্টেডিয়ামের আবহটা পুরো উল্টো। দিন এখনও যে শুরু হয়নি, সেখানকার অবস্থা দেখে বোঝারই উপায় নেই। লাইনে দাঁড়িয়ে, বসে শত শত মানুষ। উদ্দেশ্য- টিকেট কাটা।
কীসের টিকেট, সেটা বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা নয় নিশ্চয়ই। শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে বাংলাদেশ-পাকিস্তান টি-টোয়েন্টি সিরিজ। টিকেট বিক্রি শুরু হওয়ার কথা সকাল ১০টা থেকে, কিন্তু চার ঘণ্টা আগেই কাউন্টারের সামনে হাজির বাংলাদেশের ক্রিকেটপাগল দর্শকরা।
এমন হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। করোনাভাইরাসের থাবায় হঠাৎ-ই থেমে গিয়েছিল ক্রিকেটাঙ্গন। দীর্ঘ বিরতির পর খেলা মাঠে ফিরলেও দর্শকদের ভাগ্য ফেরেনি। দর্শকবিহীন মাঠে বেশ কয়েকটি সিরিজ অনুষ্ঠিত হয়। অবশেষে গ্যালারিতে বসে খেলার দেখার অপেক্ষা ফুরোচ্ছে তাদের। বাংলাদেশ-পাকিস্তান সিরিজে ৫০ শতাংশ গ্যালারি খুলে দেওয়া হবে। টিকেট স্বল্পতা থাকবে ভেবেই যেন দর্শকদের আগ্রহ রূপ নেয় দুশ্চিন্তায়।
এ ছাড়া দীর্ঘতম অপেক্ষা তো আছেই। সর্বশেষ গত বছরের মার্চে জিম্বাবুয়ে সিরিজে মাঠে বসে খেলা দেখার সুযোগ পান দর্শকরা। ৬১৮ দিন পর আবার মাঠে ফেরার সুযোগ হচ্ছে তাদের। করোনার দুটি টিকা নেওয়া আছে, এমন দর্শকরাই কেবল মাঠে প্রবেশ করতে পারবেন। এতেও কমেনি টিকেট প্রত্যাশীর সংখ্যা, টিকেট কিনতে কয়েক হাজার মানুষ হাজির হন সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে।
ক্রিকেটের জোয়ার এলে তা সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কেবল ঢাকার ক্রিকেটভক্তই নন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের দর্শকরা এদিন টিকেট কিনতে এসেছিলেন। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তারা কেউই ঢাকার নন। কুষ্টিয়া, সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ থেকে শুধু টিকেট কিনতেই আগে রাতে ঢাকা এসেছেন কেউ কেউ।
বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সের পর বাংলাদেশ দল নিয়ে আগ্রহ কমই থাকার কথা ছিল। প্রথম রাউন্ডে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে হারের পর বাকি দুই ম্যাচ জিতে সুপার টুয়েলভে উঠলেও দুঃস্বপ্নের সময় কেটে বাংলাদেশের। সুপার টুয়েলভের সবগুলো ম্যাচ হেরে বিদায় নেয় মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দল। এরপরও প্রিয় দলের খেলা দেখতে, মাঠে হাজির হয়ে দলকে সমর্থন জানাতে কার্পন্য নেই দর্শকদের।
মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম ২৫ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতার। সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামের কয়েকটি বুথে ১২ হাজার টিকেট বিক্রির ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। একজন সর্বোচ্চ দুটি করে টিকিট কিনতে পারবেন। ছেলেদের জন্য দুটি লাইন এবং মেয়েদের জন্য একটি লাইন করা হয়।
টিকেট প্রত্যাশী কয়েক হাজার মানুষ হাজির হওয়ায় অনেককেই দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হয়। কেউ কেউ সকাল সাতটা-আটটায় লাইনে দাঁড়িয়ে দুপুরেও বুথের কাছাকাছি যেতে পারেননি। এদের মধ্যে একজন রুহান। দ্বাদশ শ্রেণির এই শিক্ষার্থী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'টিকেট পাব কিনা, এখন সেটা নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। সকাল সাড়ে ৭টায় লাইনে দাঁড়িয়েছি, এখন বাজে প্রায় একটা। কিন্তু এখনও বুথের কাছে পৌঁছাতে পারলাম না।'
বাংলাদেশ বাজে ফর্মে, বিশ্বকাপে করুণ দশা ছিল। দারুণ ছন্দে থাকা এই পাকিস্তানের বিপক্ষে সেভাবে হয়তো লড়াই-ও করতে পারবে না তারা, এরপরও এত আগ্রজ নিয়ে টিকেট কিনতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন? এমন প্রশ্ন করা হলে রাসেল আহমেদ নামের একজন বলেন, 'ঘরের মাঠে খেলা, আর আমরা যাব না? দল খারাপ খেলেছে ঠিক, কিন্তু এটা তো আমাদের দল। আমাদের সমর্থনেই চেনা চেহারায় ফিরবে তারা।'
এ সময় একজনকে হুল্লোড় করে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। এগিয়ে যেতেই বোঝা গেল কারণ, দুটি টিকেট কিনতে পেরেছেন তিনি। একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে কাজ করেন আহমেদ শাওন নামের এই ব্যক্তি। ছুটির দিনে খেলা, সেটার টিকেট পেয়ে আনন্দের সীমা নেই তার। অনেকদিন পর বাংলাদেশের খেলা দেখার রোমাঞ্চের কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, 'এতদিন পর মাঠে গিয়ে খেলা দেখব, ভাবতে খুব ভালো লাগছে। রাতে ঘুম হবে কিনা জানি না।'
ময়মনসিংহ থেকে আসা মো. বাসেদ নামের একজনও টিকেট পেয়ে মহাখুশি। ঢাকায় থাকার জায়গা নেই তার। হোটেলে থেকে কাল খেলা দেখবেন এই ক্রিকেটভক্ত। এর আগে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচের টিকেট কাটবেন তিনি। অর্থাৎ, শুক্রবার সকালেও লাইনে দাঁড়াবেন রাসেদ। দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি দেখে বাড়ি ফেরার পরিকল্পনা তার।
কতোটা ঝক্কি পোহাতে হবে, সেটা নিয়ে কোনো ভাবনাই নেই রাসেদের। ক্রিকেট পাগল এই ব্যবসায়ী বলেন, 'প্রথম ম্যাচের টিকেট পেয়ে গেছি, আপাতত চিন্তা নেই। কাল আবার আসব টিকেট কাটতে। প্রথম দুই ম্যাচ দেখেই ওইদিনই বাড়ি ফিরব। এসব কষ্ট একটু মনে থাকবে না, যদি কিনা বাংলাদেশ ভালো খেলে। পাকিস্তান ভালো দল, কিন্তু ঘরের মাঠে আমরাও খারাপ দল নই। বিশ্বকাপের ব্যর্থতা ভুলে বাংলাদেশ ভালো খেলবে, এই প্রত্যাশায় আছি।'
চার দিনে তিনটি টি-টোয়েন্টি খেলবে বাংলাদেশ-পাকিস্তান। ১৯ নভেম্বর প্রথম টি-টোয়েন্টি, দ্বিতীয় ম্যাচ পরের দিনই। একদিন বিরতির পর ২২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ টি-টোয়েন্টি। সবগুলো ম্যাচেই মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বেলা ২টায় শুরু হবে।