বিশ্বকাপ খেলতে না পারাটা আক্ষেপ হয়ে থাকবে: শরিফ

২০ বছরের লম্বা ক্যারিয়ার। এর মধ্যে সাত বছর আন্তর্জাতিক। এই সাত বছরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে দুটি বিশ্বকাপ। কিন্তু কোনোটিতেই খেলা হয়নি মোহাম্মদ শরিফের। ২০১১ বিশ্বকাপের জন্য বিবেচনায় থাকলেও বিশ্বকাপ স্বপ্ন পূরণ হয়নি শনিবার সব ধরনের ক্রিকেটকে বিদায় বলে দেওয়া ডানহাতি এই পেসারের। বিদায় বলে দেওয়ার সময় তাই এটা আক্ষেপ হয়ে ঝরলো তার কণ্ঠে। জানালেন এই আক্ষেপটা সারা জীবনই থেকে যাবে।
জাতীয় দলের হয়ে প্রাণভরে খেলা হয়নি শরিফের। ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ১০টি টেস্ট ও ৯টি ওয়ানডেতেই সীমাবদ্ধ তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। এর মাঝে বেশ কয়েকবার ইনজুরির কবলে পড়েছেন তিনি। হয়তো নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পেরেই নিজের সব নিবেদন ঢেলে দেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। এখানে তিনি বাংলাদেশের পেসারদের মধ্যে অগ্রভাগের সেনানী।
২০০০ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া শরিফ এই ফরম্যাটে ১৩২টি ম্যাচ খেলেছেন। বাংলাদেশের পেসারদের মধ্যে এটা সর্বোচ্চ। ১৩২ ম্যাচে নিয়েছেন ৩৯৩ উইকেট। এটাও বাংলাদেশি পেসারদের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রথম শ্রেণি ও লিস্ট 'এ'; দুই ফরম্যাটেই হ্যাটট্রিকের মালিক শরিফ প্রথম শ্রেণিতে পেসারদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫ বার ৫ উইকেট নিয়েছেন।
ব্যাট হাতেও কম যেতেন না শরিফ। একটি সেঞ্চুরি ও ১০টি হাফ সেঞ্চুরিতে প্রথম শ্রেণিতে ৩ হাজার ২২২ রান করেছেন তিনি। এই ফরম্যাটে ৭ উইকেটের কারণে ৪০০ পূর্ণ করতে না পারার আক্ষেপ থাকলেও ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে তৃপ্ত তিনি। কিন্তু ঘুরেফিরে সেই বিশ্বকাপের আক্ষেপ। ২০ বছরের লম্বা ক্যারিয়ারের অনেক কিছু নিয়েই দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন ডানহাতি এই পেসার।
টিবিএস: অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটা নিয়ে যদি বলতেন…
মোহাম্মদ শরিফ: অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। অনেক বছর ক্রিকেট খেলায় সবাই বলছে মাঠ থেকেই বিদায় নিতে। প্রিমিয়ার লিগে একটি ম্যাচ খেলে যেন বিদায় নিই, অনেকেই এমনটা চান। সবাই বলছে আপনি জাতীয় দলের খেলোয়াড়, মাঠ থেকে বিদায় নিলেই ভালো হবে। পরিস্থিতি ভালো হলে প্রিমিয়ার লিগে একটা ম্যাচ খেলে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে বিদায় নিয়ে নিব। তবে অবসর নিয়ে নিয়েছি আমি ক্রিকেট থেকে। একটা ম্যাচ না খেললেও মিরপুরে এসে সবার সামনে বিদায় নিতে চাই।
টিবিএস: করোনাভাইরাসের কারণে সব জায়গায় স্থবিরতা। মাঠে কোনো ধরনের ক্রিকেট নেই। এই সময়টাকে কেন বেছে নিলেন বিদায় বলার জন্য?
মোহাম্মদ শরিফ: এটা আসলে হুট করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা। কোনো কিছু চিন্তা করে এমন সিদ্ধান্ত নিইনি। এ বছর মনে হয় না লিগ আর হবে। সে ক্ষেত্রে খেলারও আর সুযোগ নেই। এ বছর জাতীয় লিগ, বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ খেলিনি। এ ছাড়া কাঁধেও একটি ইনজুরি আছে। এ বছর আর ম্যাচ নাও খেলা হতে পারে। সব মিলিয়েই আর কি অবসরের সিদ্ধান্ত নেওয়া। সামনে বিসিবি যদি কোনো দলের সঙ্গে বা বয়সভিত্তিক কোনো দলে কোচিং বা নির্বাচক প্যানেলে রাখতে চায়, তাহলে আগেই আমার দিকে থেকে সেটা জানিয়ে রাখা ভালো। যদি নাই খেলি, সেটা আগেই বলা ভালো। হয়তো এই সময়ে না বললেও পারতাম। পরিস্থিতি ভালো হলে হয়তো সেসময় ঘোষণা দিতে পারতাম। মাঠে গিয়ে বলতে পারলেই ভালো হতো। আসলে মজা করে বলতে বলতেই কথার ছলে বলে ফেলেছি।
টিবিএস: লম্বা একটা সফর শেষ হচ্ছে। সবশেষে কী মনে হচ্ছে, ক্রিকেটটা আসলে কেমন?
মোহাম্মদ শরিফ: লম্বা ক্যারিয়ারে অনেক কিছুই পেয়েছি। এর মাঝেও আক্ষেপ থাকবে। ৭ উইকেট নিতে পারলে প্রথম শ্রেণিতে ৪০০ উইকেট হতো আমার। এটা একটা অপূর্ণতার জায়গা। এ ছাড়া সাড়ে তিন হাজার রানও করা হয়নি। তবে প্রত্যাশা যেটা ছিল প্রথম শ্রেণিতে ৫০০ উইকেট ও ৫ হাজার রান করা। কিন্তু এসব আর সম্ভব না। এসব করতে গেলে আরও কয়েক বছর খেলতে হবে। হয়তো আমার ফিটনেস আছে, কিন্তু সেভাবে আর হবে না।
লম্বা ক্যারিয়ারে যখনই ভালো ভালো কিছু করার সুযোগ এসেছে, ইনজুরি থাবা দিয়েছে। ইনজুরিতে তো কারো নিয়ন্ত্রণ বা হাত নেই। অনেক সময়ই ইনজুরি মন ভেঙে দিয়েছে। তারপরও শুকরিয়া যে পেস বোলার হয়েও এত বছর খেলে যেতে পেরেছি। প্রথম শ্রেণিতে কোনো পেসার আমার আশেপাশেও নেই। এটা আমার বড় অর্জন। আরেকটু বাড়াতে পারতাম, হয়তো আরও দুই বছর খেলতে পারতাম। কিন্তু যেটা বললাম নতুনদেরও আসার সুযোগ দিতে হবে।
লম্বা ক্যারিয়ারে অনেক চড়াই-উতড়াই আছে। আপনি যতই ভালো খেলেন, একটা আফসোস কিন্তু থাকেই যে আরও ভালো হতে পারত। ইশ, কেন ভালো হলো না! এ সমস্ত ইশ আর কত মাথায় নিব! ২০ বছর খেলার পর এখনও আমার মনে হয় ইশ, আরও দুই বছর খেলতে পারতাম।
টিবিএস: অবসরের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কারও সাথে কথা বলেছিলেন?
মোহাম্মদ শরিফ: না, ওইভাবে হয়নি। সুজন (খালেদ মাহমুদ) ভাইয়ের সাথে কথা হয়। উনাকে জিজ্ঞাস করেছিলাম, উনি বলছিলেন, "পুরোটাই তোর ওপর। তুই ফিট থাকলে, খেলতে চাইলে খেলতে পারিস। আর যদি এটা ছেড়ে কোচিংয়ে আসতে চাস সেভাবে ভাবতে পারিস। বিসিবি হয়তো চিন্তা করবে।" তো আমার মনে হয়েছে বিদায় বলাটা ঠিক হবে। পরিস্থিতি ভালো হলে মিরপুরে এসে মিডিয়ার সামনে ঘোষণা করব। এটা আপাতত মৌখিকভাবে জানিয়ে রাখা।
টিবিএস: ২০০১ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত খেলেছেন। সফরটা আরও লম্বা হতে পারত। এটা নিয়ে আফসোস কাজ করে?
মোহাম্মদ শরিফ: অবশ্যই আফসোস কাজ করে। বড় হতে পারত আমার জাতীয় দলের জার্নিটা। কিন্তু ইনজুরি বারবার আমাকে থামিয়ে দিয়েছে। ২০০২ থেকে ইনজুরি। ২০০৫ সালে এসে ফিরি। বিশ্বকাপের ভাগ্যটা আমার হচ্ছিল না। তিনবারই আমি খুব কাছাকাছি ছিলাম। ২০০৩ বিশ্বকাপে আমি শতভাগ এক নম্বর খেলোয়াড় হিসেবে ছিলাম। কিন্তু গ্রোয়েন ইনজুরির কারণে আমার ভাগ্যে সেটা হলো না। ২০০৫ সালে ফিরলাম, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খেললাম। জিম্বাবুয়েতে গিয়ে আমি এক বল করতে পারিনি, ৯.৫ ওভার করি। জিম্বাবুয়েতে, দল ঘোষণা করার আগের দিন এটা। সেখানে আমি একটা বল করতে পারিনি বলে আমি বিবেচনা থেকেও বাদ পড়লাম।
টিম ম্যানেজমেন্টের কনফিউশন ছিল যে আমি রিকভার করতে পারব কিনা সাতদিনের মধ্যে। কারণ জিম্বাবুয়ে থেকে এসে আবার দুইদিন পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ চলে যাবে। তো সেখানে অনিশ্চয়তার কারণে বাদ পড়লাম। আমার ভাগ্য খারাপ আরকি। ৯.৫ ওভার করলাম কিন্তু একটা বল করতে পারিনি। ওই একটা বলের জন্য বাদ পড়া। আমি আটদিনের মধ্যেই ফিট হই। কিন্তু এর মধ্যে সৈয়দ রাসেলকে নিয়ে নেয়। এরপর ২০১১ বিশ্বকাপের আগে ঘরোয়াতে খুব ভালো পারফর্ম করি। সবাই বলছিল আশা আছে, সবাই ভাবছিল ডাকতে পারে আমাকে। সেখানেও ম্যাচে কাঁধের ইনজুরি। এরপর আমি ধরে নিই আমার আর বিশ্বকাপে খেলা হবে না, জাতীয় দলেও খেলা হবে না।
টিবিএস: বিশ্বকাপে না খেলতে পারাইটাই আপনার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ?
মোহাম্মদ শরিফ: অবশ্যই এটা। বিশ্বকাপে খেলতে পারিনি আবার বারবার ইনজুরির হানা। বারবার থামতে হয়েছে আমাকে। ভাগ্যর একটা ব্যাপার থাকে, ভাগ্যটা আমার সাথে ছিল না জাতীয় দলে খেলার পথে। তবে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে ঘরোয়াতে খেলে আসতে পেরেছি। আমার সাথের অনেক খেলোয়াড়ই হারিয়ে গেছে। আমি, মাশরাফি, আশরাফুল, নাফিস ইকবাল, সব এক সাথেই শুরু করা। আমরা তিনজন আছি, নাফিস আগেই ছেড়ে দিয়েছে। আমাদের সাথের অনেক খেলোয়াড়ই নেই। আমার অনেক পরে এসেও তারা হারিয়ে গেছে।
ঘরোয়াতে আমি সফল, কিন্তু আন্তর্জাতিকে আমি সফল নই। যা আশা ছিল তা করতে পারিনি। তারপরও ১৩২টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছি। ৪০০ এর কাছাকাছি উইকেট, সাড়ে তিন হাজারের মতো রান করেছি। এটাই আমার কাছে বড় পাওয়া। ওয়াকার ইউনিসের মতো কিংবদন্তিকে দেখে ৫০০ উইকেটের স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু সেটা এখন সম্ভব না। এর জন্য আমাকে আরও তিন বছর খেলতে হবে অন্তত। যেটা আমাদের এই কন্ডিশনে সম্ভব না। স্বপ্ন দেখে এগিয়েছি, ইনজুরির কারণে হয়নি। তবু সন্তুষ্ট এই জন্য যে পেসার হিসেবে আমি যা করছি, সেটার আশে পাশে কেউ নেই।
টিবিএস: লম্বা এই ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিয়েছে কোন বিষয়টা?
মোহাম্মদ শরিফ: সবচেয়ে বড় আনন্দ স্ট্রাগল করে এত বছর টিকে থাকা। ২২ বছর ফিটনেস ধরে রেখে যে আমি খেলে এসেছি, আমাদের দেশে ফাস্ট বোলারদের তো এতদিন ক্যারি করার কথা না। এটা আমাকে আনন্দ দেয়। খেলোয়াড়রাই আমাকে বলে আপনি এটা পারছেন। এটাকে আমি বড় করে দেখি। এ বছর আমি ১১.১ দিয়েছি ফিটনেস টেস্টে। ফিটনেসের এই ব্যাপারটি আমি বড় করে দেখি।
টিবিএস: ইনজুরি থেকে বারবার ফিরে আসাটাই আপনাকে বেশি প্রশান্তি দিয়েছে?
মোহাম্মদ শরিফ: অবশ্যই এটা তৃপ্তির জায়গা, ভালো লাগার জায়গা। এর মধ্যে একটা ব্যাপার যে বিশ্বকাপটা খেলা হলো না।
টিবিএস: কোন পারফরম্যান্সটা এখনও মনে গেঁথে আছে, যেটা মনে পড়লে শান্তি পান…
মোহাম্মদ শরিফ: ২০০১ সালে আমার অভিষেক উইকেটটা। জিম্বাবুয়ের অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলকে আউট করেছি। টেস্ট ও ওয়ানডে দুটিতেই ওর উইকেট দিয়ে আমার শুরু। এটা এখনও মনে গেঁথে আছে। আরেকটা ছিল নিউজিল্যান্ডে। তিন উইকেট পেয়েছিলাম। ওই সময় আমি আমার সেরা রিভার্স সুইং করেছিলাম। যদিও ওই ম্যাচ খেলে আমি ইনজুরিতে পড়ি। এ ছাড়া প্রথম শ্রেণিতে বরিশালের বিপক্ষে জাতীয় লিগে দুই ইনিংসেই হ্যাটট্রিক করেছি। এটাও মনে পড়লে ভালো লাগে।