বার্সেলোনা ও সাফল্যের মূল্য
২০১৭ সালে নেইমার বার্সেলোনা ছেড়ে যাওয়ার পরই ফরাসি ফুটবলার তরুণ উসমান দেম্বেলেকে দলে ভেড়ায় বার্সেলোনা। তবে উসমানকে দলে ভেড়ানোর প্রক্রিয়াও খুব একটা সহজ ছিল না।
জার্মান ক্লাব বরাসিয়া ডর্টমুন্ডের সাথে দেম্বেলেকে কিনে নেওয়ার চুক্তিতে বার্সেলোনার প্রস্তাবিত মূল্য ছিল ৯৬ মিলিয়ন ডলার। তবে ১৯৩ মিলিয়নের কমে দেম্বেলেকে ছাড়তে রাজি ছিল না জার্মান ক্লাবটি।
বার্সেলোনার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জোসেফ মারিয়া বার্তোমিউ প্রাথমিকভাবে ১২৭ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে পরবর্তী সময়ে বাকি ৫০ মিলিয়ন পরিশোধের শর্তে চুক্তি চূড়ান্ত করেন। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, সেসময় তার আর কিছু করার ছিল না।
এর কয়েক সপ্তাহ আগেই নেইমারের প্রস্থানের পর, চুক্তির জন্য এসে খালি হাতে ফেরার ঝুঁকি নিতে চাননি বার্তোমেউ। সেসময় বড় সাইনিং এর দরকার ছিল বার্সেলোনার, তার উচ্চ মূল্যই পরিশোধ করেছিলেন বার্তোমেউ।
বিলিয়ন ডলার ক্লাব
চলতি শতকে বার্সেলোনার মাঠের সাফল্যের পাশাপাশি ক্লাবের আয় ইর্ষান্বিত করেছে অনেক বিরোধী ক্লাবকেই। ১ বিলিয়ন বার্ষিক আয় অতিক্রম করা প্রথম ক্লাব বার্সেলোনা। ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসিও এই ক্লাবেই খেলেন।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ দৃশ্যপট বদলে গেছে অনেকটাই। বেশ কয়েক বছরের অব্যবস্থাপনা, হঠকারী সিদ্ধান্ত ও ঝোঁকের বশে স্বাক্ষরিত চুক্তি ক্লাবটিকে ভুগিয়েছে অনেক। কয়েক বছর ধরে ক্লাবটির বিশাল অঙ্কের আয় এসব ভুলগুলোকে চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও করোনাভাইরাস মহামারি এসে দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে।

বার্সেলোনার বোর্ডের সাবেক একজন সদস্যের মতে মহামারির কারণে ক্লাবটির আয় কমে যাবে প্রায় অর্ধ বিলিয়ন ডলার। ক্লাবটির স্যালারি বিল ইউরোপের ক্লাবগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। ইতোমধ্যেই ক্লাবটির ঋণের চুক্তি ভঙ্গ হয়েছে, ফলশ্রুতিতে সামনের বছরগুলোতে আরও উচ্চ সুদের হারে পাওনা পরিশোধ করতে হবে।
বিশ্বের সর্বোচ্চ আয়ের এই ক্লাবটি এখন শুধু আর্থিক সঙ্কটের মুখেই পড়েনি, আসন্ন বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও মেসিকে হারানোর আশঙ্কায়ও আছে ক্লাবটি।
তবে তারপরও এখন পর্যন্ত বেশি বেতনে খেলতে চাইলে খেলোয়াড়দের অন্যতম পছন্দ বার্সেলোনা। বিগত দশকে বিশ্বের অন্যতম সেরা দলের খেতাব, সাত বছরে তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা ছাড়াও এক ধরনের মানি-মেকিং মেশিনে পরিণত হয়েছে ক্লাবটি।
বিলিয়ন ডলার বার্ষিক আয়ের মাইলফলক ছোঁয়ার পাশাপাশি ক্লাবটির মোট ঋণের পরিমাণও এক বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।
মোট ঋণের ৬০ শতাংশই স্বল্প মেয়াদের ঋণ, এ সংখ্যাও ইউরোপের অন্য যে কোনো ক্লাবের চেয়ে বেশি। তবে তারপরও ট্রান্সফারের ক্ষেত্রে খরচ কমানোর কথা ভাবেনি ক্লাবটি। দেম্বেলেকে কিনে নেওয়ার কয়েক মাস পরেই লিভারপুলের সাথে ১৪৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে ফিলিপ কুতিনহো-কে কিনে নেয় বার্সেলোনা। সামর্থ্য নেই এমন মূল্যেই কুতিনহোকে কিনে নেওয়ার চুক্তি করে বার্সেলোনা।
ক্লাবের ওপর খেলোয়াড়দের বেতন পরিশোধের চাপও সেইসাথে বাড়তে থাকে। ক্লাবটির অন্তবর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস তাসকেটস জানিয়েছেন, ক্লাবটির বার্ষিক আয়ের ৭৪ শতাংশই খেলোয়াড়দের স্যালারি বিলে চলে যায়, যা প্রায় ৭৭১ মিলিয়ন ডলার। বেশিরভাগ ক্লাবই এ সংখ্যা ৬০ শতাংশেই সীমাবদ্ধ রাখে।

কিছুক্ষেত্রে বার্সেলোনা নিজের সাফল্যেরই ভুক্তভোগী। খেলোয়াড়রা যতো ভালো খেলবেন, ততোই তাদের বেশি বেতনের আলোচনার পথ সুগম হয়। মেসি ছাড়াও ক্লাবটির তারকা খেলোয়াড় জেরার্ড পিকে, সার্জিও বুস্কেৎস ও জর্দি আলবাই এর প্রমাণ। লা মেসিয়া অ্যাকাডেমি থেকে ক্লাবটির প্রথম সারির দলে পৌঁছানোর পথে ক্লাবের চেয়ে খেলোয়াড়রাই বেশি লাভবান হয়েছেন তার দৃষ্টান্তও তারাই।
বার্সেলোনার আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী ভিক্টর ফন্টের ভাষ্যে, "নেতৃত্বের অভাব, বোর্ডের না বলার অক্ষমতা এব্যাপারগুলোই সামনে দিনগুলোতে কাটিয়ে উঠতে হবে।"
খেলোয়াড়দের বেতন অত্যন্ত বেশি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এক বিলিয়ন ডলার আয়ের মধ্যে ৭০০ মিলিয়ন ডলার খেলয়াড়দের পেছনেই খরচ করা কিছুটা চিন্তার বিষয় হলেও বার্সেলোনা এ খরচ বহনে সক্ষম ছিল বলে জানান জরডি ময়েক্স।
"এরফলে খুব বেশি অর্থ জমানোর সুযোগ না থাকলেও, তারাই আমাদের দলের চালিকাশক্তি। আমরা চুক্তিতে রাজি না হলে তারা হয়তো ক্লাবেই থাকতো না," বলেন তিনি।
বার্তোমেউ ও তার বোর্ড অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিলেও, এব্যাপারটি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
"বর্তমান অবস্থার দায় কতোটুকু ব্যবস্থাপনার আর কতোটুকু কোভিডের, এক্ষেত্রেও বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোচনার সুযোগ আছে," বলেন তিনি।
তবে কারণ যাই হোক না কেন, এই ক্ষতির অঙ্কও বেশ বড়। বার্ষিক ১১৭ মিলিয়ন ডলার লোকসানের কথা জানিয়েছে ক্লাবটি। মহামারির কারণে ইতোমধ্যেই ২৪৬ মিলিয়ন ডলার লোকসান হয়েছে এমন পূর্বাভাসও দিয়েছে ক্লাবটি। ময়েক্সের মতে এ সংখ্যা শেষ পর্যন্ত ৬০০ মিলিয়ন ডলার অতিক্রম করতে পারে।
অন্যদিকে, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য ক্লাবের কাছে ক্লাবটির ঋণের পরিমাণ ৩২৭ ডলারে পোঁছেছে। ২০২১ সালে এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করছেন ক্লাবটির কর্মকর্তারা। এই মৌসুমের বেশিরভাগ সময়েও বন্ধ থাকতে পারে ক্লাবটির স্টেডিয়াম ও জাদুঘর।

ফারাও
২০১৭ সালে বার্সেলোনার সাথে মেসির স্বাক্ষরিত ৩০ পৃষ্ঠার চুক্তিটি প্রকাশ করেছিল একটি স্প্যানিশ সংবাদপত্র। সাইনিং বোনাস হিসেবে ১৩৯ মিলিয়ন ডলার, লয়ালটি বোনাস ৯৩ মিলিয়ন সহ চুক্তির সব শর্ত মেসি মেনে চললে মেসি ৬৭৫ মিলিয়ন ডলার পাবেন বলে উল্লেখ করা হয় চুক্তিতে।
এই চুক্তিই বার্সেলোনার ধ্বংসের কারণ উল্লেখ করে একে 'ফারাওনিক' আখ্যা দিয়েছে স্প্যানিশ দৈনিক এল মুন্দো।
মেসির সাথে ক্লাবের সম্পর্কেও আচড় লেগেছে নানা সময়। তবে টানা তিনটি হতাশাজনক মৌসুমের পর চ্যাম্পিয়নস লিগে বায়ার্ন মিউনিখের সাথে ৮-২ গোলে পরাজয়ের পর দল ছেড়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন মেসি।
তবে মেসির সিদ্ধান্ত আমলে না নিয়ে কোনো ক্লাব মেসিকে কিনে নিতে চাইলে চড়া মূল্য দিতে হবে ঘোষণা দেন। অবশেষে দল ছাড়া হয়নি আর মেসির।
এর ছয় মাস পরই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে মেসির ভবিষ্যতও। জুনেই তার চুক্তির মেয়াদ শেষ। আগামী মৌসুম থেকে তার স্পেনের বাইরের ক্লাবে যাওয়ার পথ খোলা ছিল জানুয়ারি থেকেই। তবে মৌসুম শেষেই সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন মেসি।
বার্সেলোনার সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে মেসির প্রস্থান বর্তমান অবস্থায় মন্দের ভালো।
তবে ময়েক্সের মতে, 'আশীর্বাদ নিয়ে দরকষাকষি চলে না।'

বার্সেলোনার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এগিয়ে আসায় সব প্রার্থীই ক্লাবটির আর্থিক সঙ্কট সমাধানের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
বার্সেলোনার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও আসন্ন নির্বাচনের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জোয়ান লোপার্টা বলেছিলেন, 'বার্সেলোনা ৩ বিলয়নের ক্লাব: আয় ১ বিলিয়ন, খরচ ১ বিলিয়ন, বাকি ১ বিলিয়ন ঋণ।'
প্রেসিডেন্ট হলে ক্লাবের আর্থিক দুরবস্থা কাটিয়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি তার অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের মতোই।
নতুন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের কথাবার্তায় ভবিষ্যতে খেলোয়াড়দের চুক্তির অর্থমূল্য কমিয়ে আনা হতে পারে এমন আভাসই মিলেছে। তবে একাজও সহজ নয়। বর্তমানে অর্থদাতাদের সাথে আলোচনা করছে ক্লাবটি। টেলিভিশন আয়ের ভবিষ্যৎ উপার্জন পাওয়া বা নতুন চুক্তির মাধ্যমে অর্থপ্রাপ্তির চেষ্টা করছে ক্লাবটি।
অবশ্য জটিল প্রক্রিয়া ছাড়াও বার্সেলোনার হাতে থাকা সবচেয়ে সহজ উপায় হলো মেসিকে বিদায় জানানো। তবে বার্সেলোনা বোধহয় এখনও প্রস্তুত নয়।
'ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়ের বাণিজ্যিক মূল্যও আছে," বলেছিলেন ফন্ট। মেসির প্রস্থান ঠেকাতে তিনি এতোটাই মরিয়া যে, তিনি হয়তো মেসিকে আজীবন চুক্তিবদ্ধের প্রস্তাব দিতে পারেন। বার্সেলোনাকে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে আসা এ খেলোয়াড়ের জন্য তা পূর্ণাঙ্গ উপহারও বটে।
- সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস