অ্যালান শিয়ারার: বিশ্বাস করুন, অবসরের বেদনা নরকের মতো
এক হাজার গজ দূর থেকে তাকালেও যে-কেউ উরুগুয়ের চোখে অবিশ্বাসের আভাটি স্পষ্ট দেখতে পাবেন। কারও কারও কাছে এটি আরও বিস্ফোরক এবং প্রকাশ্য। লুইস সুয়ারেজ তো বেঞ্চে বসেই কাঁদছিলেন। বেশিরভাগ মানুষের জন্য এটি একটি আকস্মিক ধাক্কা। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর অনুশীলন করে খেলার জন্য আপনি শরীরকে মানিয়ে নিয়েছেন। একটি ম্যাচ, টুর্নামেন্ট, আরও একটি গ্রুপ পর্ব, আরও একটি গোল এবং তারপর! কিছু বুঝে ওঠার আগেই আপনার বিশ্বকাপের দৌড়টি শেষ হয়ে গেল।
দর্শক হিসেবে এটা নিশ্চয়ই বোঝা সহজ, জীবনে যা একবার ঘটে যায়, তা কখনোই আবার ঠিক হবে না। যে ম্যাচ আপনি হেরেছেন বা ড্র করেছেন, তাতে সমীকরণ আপনাকে বিশ্বকাপের লড়াই থেকে বের করে দিয়েছে। খেলোয়াড় হিসেবে এই হার মেনে নেয়া কষ্টের। সব পরিশ্রম বৃথা হয়ে গিয়েছে। উরুগুয়ের জন্য কাতার বিশ্বকাপের পথ চলাটা গ্রুপ পর্বেই শেষ।
বিশ্বকাপের ব্যবসায়িক সফলতার জন্য ম্যাচগুলো ছোট পরিসরে দুঃখ নিয়ে হাজির হচ্ছে। বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে জার্মানদের বিদায়ের পর আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটু খুনসুটি করেছিলাম। অন্যদিকে, টমাস মুলারের ৩৩ বছর বয়সে মাঠের খেলা থেকে অবসর নেয়া আমার পুরনো দিনের কথাও মনে করিয়ে দেয়। ওয়েলসের গ্যারেথ বেল, উরুগুয়ের সুয়ারেজ, বেলজিয়ামের 'সোনালি প্রজন্মের' কয়েকজনের সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটছে। তারা সবাই কাতার বিশ্বকাপ থেকে বাড়ি ফিরছেন এবং অবসরের গুঞ্জন আসছে। এই খেলোয়াড়দের কাউকেই আমি ঠেলে বের করে দেয়ার চেষ্টা করছি না, এরা অনেকেই মহাতারকা হয়ে উঠেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অকালে অবসরে যাচ্ছেন—এ বিষয়ে আমি কথা বলতে চাই।
আমি একটাই বিশ্বকাপ খেলেছি। ১৯৯৪ সালে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে পারেনি। আমি তখন তেইশ পেরিয়ে ২৪-এ পা দিয়েছিলাম। ওই সময় প্রিমিয়ার লিগে ৩১টি গোল করেছিলাম। আর ১৯৯৮-এর ফ্রান্স বিশ্বকাপে নিজেকে অজেয় ভাবতে শুরু করেছিলাম। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে আমাদের শেষ ষোলোর খেলা যখন পেনাল্টিতে যায় এবং ডেভিড ব্যাটিস আমাদের ত্রাতা হয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করেন, তখন সেটি আমাদের জন্য এক অসাধারণ অনুভূতি ছিল। কারণ ইউরো '৯৬-এর সেমিফাইনালে পৌঁছানোর পর (যেখানে আমরা জার্মানির কাছে হেরেছিলাম) আমরা সবাই অনুভব করেছি যে আমরা এবারও এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারব।
তখন আমরা গ্যারেথ সাউথগেটের বর্তমান ইংল্যান্ড দলের মতোই ছিলাম। চার বছর আগে একটি সেমিতে এবং শেষ ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে পৌঁছেছে বলে ইংল্যান্ড দল ভাবছে এই বিশ্বকাপ জিততে তাদের আর কোনো বাধা নেই। কিন্তু আপনার পরিকল্পনামতো যখন কিছুই হবে না, তখন একটি বড় আঘাত আসে খেলোয়াড়ের উপর, সর্বোপরি দলের মানসিক দৃঢ়তার উপর।
১৯৯৮ সালে ভেবেছিলাম আমি ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত খেলা চালিয়ে যাব। একজন ফুটবলার হিসাবে আপনার সেই লক্ষ্য থাকাটাই স্বাভাবিক। খেলোয়াড় হিসেবে আপনার জন্য প্রতিটা দিন পরিকল্পনা করা থাকে। তরুণ খেলোয়াড়েরা নিজেদের সব বিপত্তি থেকে দূরে রাখতে চান। তাদের জীবনে খারাপ সময় আসতে পারে, এটা তারা ভাবতেও চান না। আমারও একই অবস্থা ছিল।
মাত্র দুই বছর পর, ২০০০ সালেই ইংল্যান্ডের হয়ে আমার দৌড় থেমে গেল। বাস্তবতাটা আমার জন্য একটু কঠিন ছিল। দুটি গুরুতর ইনজুরি নিয়ে জীবনের ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলি। আমার ছেলেবেলার স্বপ্ন ছিল ইংল্যান্ড দলের অধিনায়কত্ব করা। স্বপ্নপূরন হলেও আমি বেশিদিন আঁকড়ে ধরে থাকতে পারিনি। সে বছরেই অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেই। কিন্তু জানতাম যে, আমি আমার সামর্থ্যের সেরা দুটি কাজ আর কখনোই করতে পারব না।
নিজেকে নিয়ে আমার বেশ ভয় ছিল। আমার আত্মবিশ্বাস ছিলো যে আমি চাইলে খেলা চালিয়ে যেতে পারব। কিন্তু আমি চাইনি যে কেউ আমাকে বলুক, 'তুমি ভালো নেই। ভালো খেলছো না।' ইউরো ২০০০-এর আগেই তাই ঘোষণা দিয়েছিলাম, 'এবার আমি অবসরে যাব।'
ইংল্যান্ড জাতীয় দল থেকে অবসর নেয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল। এরপর আরও ৬ বছর আমি নিউক্যাসেল ইউনাইটেডের হয়ে খেলতে পেরেছিলাম। এই সময়ে আমি বিশ্রাম নিয়েছি, শরীর ঠিক রেখেছি এবং প্রিমিয়ার লীগের খেলা চালিয়ে গিয়েছি।
সেই অর্থে, ২০০০ সালের ইউরোর আগে অবসর নেওয়ার ধারণার সঙ্গে আমি শান্তি স্থাপন করতে আরম্ভ করেছিলাম। জেনেশুনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যা-ই ঘটুক না কেন, এটাই হবে আমার শেষ টুর্নামেন্ট। আমি নিজের সঙ্গে লড়েছি বেশ কিছুদিন, আমি জানি এটা কতটা কঠিন ছিল।
গ্রুপ পর্বের তৃতীয় খেলা, পর্তুগালের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই আমরা হেরে যাই। অবশ্য পরের ম্যাচে জার্মানিকে ১-০ গোলে হারাই। আমরা জানতাম দুই বছর আগের মতো সেরা দল নিয়ে আমরা মাঠে আসিনি। আমাদের আত্মবিশ্বাসে ভাটা পড়েছিল। পরের ম্যাচেও আমরা রোমানিয়ার বিপক্ষে হেরে গিয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিই।
২৯ বছর বয়সে আমার অস্তিত্বের একটি অংশ শেষ হয়ে গিয়েছিল সেদিন। যার জন্য এত পরিশ্রম করে বড় হয়েছি, তা মুহূর্তেই আমার চোখের সামনে ধসে পড়েছিল। সেদিনের ড্রেসিং রুম থেকে বাড়ি ফিরে যাওয়া পর্যন্ত বিষয়টা মানতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো।
ছোটবেলায় আমার কয়েকটি স্বপ্ন ছিল—নিউক্যাসলের হয়ে ফুটবল খেলব, আমার দেশের প্রতিনিধিত্ব করবো এবং ওয়েম্বলিতে হাঁটব। হঠাৎ করেই একদিন আমি বুঝতে পারলাম, আমি আর কখনও ইংল্যান্ডের হয়ে খেলব না। আমি সহানুভূতি চাইছি না, শুধু ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি। এক হিসেবে আমি ভাগ্যবান। আমার ওপর অনেকের আশীর্বাদ ছিল বলেই আট বছরের ক্যারিয়ারে ৬৩টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ৩০টি গোল করেছি। কিন্তু বড় কোনো ট্রফি জিততে পারিনি; কজনই বা পারে!
তারকা ফুটবলার হয়ে ওঠার জন্য টুর্নামেন্ট খেলার বিকল্প নেই। কিন্তু টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে হোঁচট খেলে অথবা বাদ পড়লে তারকা খসে পড়ে যায়। এটাই জীবন, এটাই ফুটবলের পথ, প্রতিভার অবিরাম পুনরুত্থান হয়ে চলবে—কিন্তু মুলার, বেল ও অন্যরা তাদের সাথে তাদের ঝিকিমিকি আলো নিয়ে যেতে যেতে সবার হৃদয় ছুঁয়ে গেছেন।
কাতার বিশ্বকাপ ইতোমধ্যেই প্রমাণ করেছে এটা একটা অস্বাভাবিক টুর্নামেন্ট। খেলার সময়, খেলার মাঠ সব কিছুই অস্বাভাবিক। এখানে যে-কেউ যে-কাউকে হারাতে পারছে।
লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর আখ্যান আমরা দেখেছি। এ দুই জীবন্ত কিংবদন্তি যখনই খেলেন, তখনই চারদিকে নানা রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হন। তাদের উপর প্রত্যাশার চাপ থাকে আকাশসমান। কিছু ভাগ্যবানের জন্য স্বপ্ন চিরকাল সোনালি বর্ণেরই থেকে যায়। আর বেশিরভাগের জন্য এটি শেষ হয়ে যায়। বিশ্বাস করুন, অবসরের বেদনা নরকের মতো; এই বেদনা আমার চোখে তাকালেই আপনি টের পাবেন।
- অ্যালান শিয়ারার: সাবেক ইংলিশ ফুটবলার
- সূত্র: দি অ্যাথলেটিক থেকে অনূদিত