কুড়িতেও বয়ঃসন্ধিতে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট
মিনিট, ঘণ্টা, দিন, মাস এরপর বছর। দশক বা যুগের হিসাব কষারও সুযোগ আছে। সংখ্যায় ২০। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে আরও দুই বছর। মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর ২০ বছর পূর্ণ হয়েছে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের। ২০০০ সালের এই দিনে ভারতের বিপক্ষে অভিষেক টেস্ট খেলতে মাঠে নেমেছিলেন নাঈমুর রহমান দুর্জয়, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, মোহাম্মদ রফিকরা। সেই হিসাবে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটেরও প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কথা!
বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কতটা বয়স বাড়ল বাংলাদেশের সাদা পোশাকের ক্রিকেটের? প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে তো? এমন প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া কঠিন। ২০ বছরে বাংলাদেশ টেস্ট খেলেছে ১১৯টি। প্রত্যাশিতভাবে মেলেনি সাফল্য। জয় এসেছে মাত্র ১৪টি ম্যাচে। ড্র ১৬টিতে, যার পেছনে বেশিরভাগ অবদান বৈরি আবহাওয়ার। হারতে হয়েছে ৮৯টি ম্যাচে। সর্বশেষ খেলা ৫ টেস্টের চারটিতেই হেরেছে বাংলাদেশ। একমাত্র জয়টি ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।
টেস্ট মর্যাদার তিন বছরের মাথায়ই টেস্ট জয়ের স্বাদ পতে পারতো বাংলাদেশ। কিন্তু সম্ভাবনা জাগিয়েও মুলতান টেস্টে জেতা হয়নি বাংলাদেশের। টেস্টে প্রথম জয়ের দেখা পেতে ৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। ২০০৫ সালে চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো টেস্টে বিজয় কেতন ওড়ায় হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ।
প্রথম জয়ের দেখা মিললেও পরের কয়ক বছর সুখময় পথচলা ছিল না বাংলাদেশের। আবারও হারের বৃত্তে বন্দী হয়ে যায় টেস্ট ক্রিকেটর নবীণতম দলটি। দ্বিতীয় জয়ের দেখা পেতে চার বছর অপেক্ষা করতে হয়। ২১ হারের পর দেখা মেলে নতুন সূর্যের। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়ে টানা দুটি টেস্ট জেতে বাংলাদেশ। এরপর ধীরে ধীরে লড়াই করতে শেখা বাংলাদেশ জয়ের মুখ দেখতে থাকে।
ঘরের মাটিতে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো দলকে হারিয়েছে মুশফিকুর রহিমের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ। আছে হতাশার গল্পও। ২০১৮ সালে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাজেভাবে হেরে যায় বাংলাদেশ। গত বছর চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে নবাগত আফগানিস্তানের বিপক্ষে রীতিমতো নাকানিচোবানি খেতে হয় বাংলাদেশকে। ম্যাচটি দাপুটে স্টাইলে জিতে নেয় আফগানরা।
সাদা পোশাকে ২০ বছরের পথচলায় আয়ারল্যান্ড ছাড়া সব দেশের বিপক্ষেই টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ। সবচেয়ে বেশি ২০টি টেস্ট খেলেছে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। এরপর জিম্বাবুয়ে ১৭, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৬ ও নিউজিল্যান্ড ১৫ টেস্টের প্রতিপক্ষ। ১২টি দক্ষিণ আফ্রিকা, ১১টি করে ভারত ও পাকিস্তান, ১০টি ইংল্যান্ড, ৬টি অস্ট্রেলিয়া ও একটি ম্যাচের প্রতিপক্ষ আফগানিস্তান। সবচেয়ে বেশি ৭টি জয় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ৪টি ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং একটি করে শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে।
প্রতি বছরের ১০ নভেম্বর এসব হিসাব কষা হয়। ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত ফরম্যাটে সাফল্যের ঝুলি কতটা সমৃদ্ধ হলো, তা দেখতে অভিষেক টেস্টের দিনে রেকর্ডের পাতা ওলট-পালট করে দেখা হয়। অভিষেক টেস্ট খেলা ক্রিকেটাররা রোমাঞ্চ নিয়ে মনে করেন স্বপ্ন পূরণের সেই দিনটির কথা। অভিষেক টেস্ট ও টেস্টের বিভিন্ন দিক নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন বেশ কয়েকজন সাবেক ক্রিকেটার।
নাঈমুর রহমান দূর্জয় (অভিষেক টেস্টে বাংলাদেশের অধিনায়ক): ওই সময়টা একেবারেই নতুন ছিল। সবাই খুব বেশি আবেগপ্রবণ ছিল। আমাদের কাছে সব মুহূর্তই তখন ছিল অপরিচিত। কাজেই আমরা যারা সেই ম্যাচে খেলেছি, একটি মুহূর্তকে আলাদা করা কঠিন। আমাদের কাছে প্রতিটি মুহূর্তই অসাধারণ ছিল। আমি টেস্ট খেলার সুযোগ পাব, এটা আসলে চিন্তাও করিনি। টেস্টের অধিনায়ক হব, হতে পারি-এমন কিছু আমি কখনোই ভাবিনি।
আমিনুল ইসলাম বুলবুল (অভিষেক ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান): ওই ম্যাচটির প্রতিটি ঘটনা অসাধারণ। প্রতি ক্ষণে ক্ষণে আমি শিহরিত হচ্ছিলাম। ভারতের মতো দলের বিপক্ষে ব্যাটিং করছি, প্রতিটি বলেই আমার মধ্যে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছিল। আমার ক্যারিয়ারের অন্যতম অনুভূতির জায়গা জুড়ে আছে অভিষেক টেস্ট। ২০ বছর পরে আমাকে বলতে হচ্ছে আমাদের কোনো লক্ষ্য ছিল না। আমরা ২০ বছর পরে কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে চাই, সেই লক্ষ্য আমাদের ছিল না। সেটার ফলশ্রুতিতে আমরা এখনও কোথাও দাঁড়াতে পারিনি। এখনও আমরা কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
আকরাম খান: টেস্ট অভিষেকের ২০ বছর হয়ে গেছে, এটা খুবই গর্বের ব্যাপার। অনেক ভালো অনুভূতি, অভিষেক টেস্টের একজন সদস্য হতে পেরেছি। ক্রিকেটের যতগুলো ভালো অর্জন আছে, সবখানেই কোনো না কোনোভাবে আমি আছি। এটি আমার জন্য দারুণ প্রাপ্তির বিষয়। ওই টেস্টের আগের রাতে আমাদের সবার মধ্যে রোমাঞ্চ কাজ করছিল। এতোই রোমাঞ্চিত ছিলাম আমরা, কেউই ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি।
মোহাম্মদ রফিক: অভিষেক টেস্টের স্মৃতি সব সময়ই রোমাঞ্চিত করে। মনে পড়লে ভালো লাগে। বড় স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নেমেছিলাম। পারিনি অভিজ্ঞতার কারণে। তারপরও আমরা কিন্তু ভারতকে কঠিন সময় দিয়েছিলাম। আমাদের প্রতিটি মুহূর্তই রোমাঞ্চের মধ্য দিয়ে কেটেছে। তবে বর্তমান অবস্থা দেখে হতাশ হই। আমরা সেভাবে এগোতে পারিনি টেস্ট ক্রিকেটে। এখনও জিম্বাবুয়ের মতো দলের বিপক্ষে ভুগতে হয় আমাদের। টেস্ট ক্রিকেটে আরও মনোযোগ দিতে হবে। এভাবে টেস্ট ক্রিকেট হয় না।
হাবিবুল বাশার: ২০ বছর পরও আমরা টেস্ট ক্রিকেটে ধারাবাহিক হতে পারছি না। এটাই সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয়। ২০ বছর পরে আমাদের যতটুকু উন্নতি করা দরকার ছিল, আরও করতে পারতাম, সেটা হয়নি। তবে আমরা এখন ভালো টেস্ট দল। কিন্তু আবারও বলব আমরা ধারাবাহিক না। প্রত্যাশার জায়গাতে একেবারেই যেতে পারিনি সেটা বলব না। এখন আমাদের টেস্টে বড় বড় সেঞ্চুরি হয়। সব সময়ই হয়। টেস্ট দল হিসেবে অবশ্যই আমরা এগিয়েছি। কিন্তু টেস্ট দল হিসেবে যে ধারাবাহিকতা দরকার, সেটা আসেনি।
খালেদ মাসুদ পাইলট: ম্যাচের আগের রাতে অনেক বেশি রোমাঞ্চিত ছিলাম। পাশাপাশি খুব টেনশনেও ছিলাম। কী হবে, কীভাবে খেলবো। কোন অভিজ্ঞতাই তো আমার ছিল না। ম্যাচের আগের রাত আমাদের কারোই ঠিকমতো ঘুম হয়নি। ভারতের মতো দলের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ, সব মিলিয়ে বাড়তি একটা চাপ সময়ই কাজ করতো। টেস্টের প্রথম দিনের পর আমি কিছুটা স্বাভাবিক হতে পেরেছিলাম।
হাসিবুল হোসেন শান্ত: প্রথম টেস্টে সুযোগ পেয়েছি, সেটা অনেক বড় ব্যাপার। অনেক রোমাঞ্চিত ছিলাম। বাংলাদেশের হয়ে প্রথম বোলিং করব, সেটি ভেবে শিহরিত ছিলাম। ভয়ও কাজ করছিল। সত্যি কথা বলতে আমাদের তো টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা ছিল না। ২০ বছরেও আমাদের খুব বেশি উন্নতি হয়নি। আমাদের লংগার ভার্সন ক্রিকেট খুব কম হয়। আমাদের ছেলেরা প্রস্ততি নেওয়ার জন্য যথেষ্ট ম্যাচ সুযোগ পান না। অনুশীলন করে আসলে যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া যায় না। ম্যাচ খেলার কোনো বিকল্প নেই। ছেলেদের প্রচুর ম্যাচ খেলার সুযোগ করে দিতে হবে। তাহলেই আমরা এই ফরম্যাটে ভালো করতে পারব।