উড়ন্ত পাকিস্তানকে থামিয়ে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া
শাহিন শাহ আফ্রিদির করা ১৯তম ওভারের তৃতীয় বলে ম্যাথু ওয়েডের তোলা ক্যাচটি মাটিতে ফেলে দিলেন হাসান আলী। ওটা ক্যাচ নয়, ম্যাচটাই মাটিতে ফেলেছে পাকিস্তান। জীবন ফিরে পাওয়ার পরের তিন বলে তিন ছক্কা মেরে নিমেষেই পাকিস্তানের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিলেন ওয়েড। রোমাঞ্চে ভরপুর ম্যাচ জিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে গেল অস্ট্রেলিয়া।
দুর্বার, দুরন্ত কিংবা অপ্রতিরোধ্য; কোনো বিশেষণই যথেষ্ট হচ্ছিল না পাকিস্তান ক্রিকেট দলের জন্য। ১০ উইকেটের বিশাল জয়ে বিশ্বকাপের মিশন শুরু করা বাবর আজমের দল একের পর এক ম্যাচ জিতে যাচ্ছিল। সেই তাদের নামের পাশেই এবার যোগ হলো, 'পরাজিত' শব্দটি। বৃহস্পতিবার দুবাইয়ে দ্বিতীয় সেমি-ফাইনালে পাকিস্তানকে ৫ উইকেটে হারিয়েছে অস্ট্রেলিয়া।
ওয়ানডে বিশ্বকাপের পাঁচবারের চ্যাম্পিয়নরা দ্বিতীয়বারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠল। ২০১০ বিশ্বকাপের ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয় তাদের। এবার অজিদের সামনে সুযোগ প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা ছুঁয়ে দেখার। শিরোপার লড়াইয়ে আগামী ১৪ নভেম্বর দুবাইয়ে নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হবে অ্যারন ফিঞ্চের দল।
টস হেরে আগে ব্যাটিং করতে নেমে বাবর-রিজওয়ানের জুটির পর ফকর জামানের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে বড় সংগ্রহ গড়ে পাকিস্তান। তিনজন ব্যাটসম্যানের চোখ জুড়ানো ব্যাটিংয়ে ৪ উইকেটে ১৭৬ রানের বড় সংগ্রহ দাঁড় করায় বাবর আজমের দল। চলতি আসরে এই মাঠে এখন পর্যন্ত এটাই সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ।
জবাবে দুঃস্বপ্নের শুরুর পরও ঠিক পথে থাকে অস্ট্রেলিয়া। দারুণ ব্যাটিংয়ে দলকে পথ দেখানো ডেভিড ওয়ার্নার আউট না হয়েও মাঠ ছাড়লে বিপদ বেড়েছিল। ব্যবধান হয়ে গিয়েছিল অনেক। কিন্তু মার্কাস স্টয়নিস ও জয়ের নায়ক ম্যাথুয়েডের ব্যাটে ৫ উইকেটে এক ওভার বাকি থাকতেই জয়ের বন্দরে পৌঁছায় অস্ট্রেলিয়া।
বড় লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নেমে দুঃস্বপ্নের শুরু হয় অস্ট্রেলিয়া। পাকিস্তান পেসার শাহিন শাহ আফ্রিদি একেকটা গোলা ছাড়ছিলেন। তৃতীয় বলেই আসে বিপদ। আফ্রিদির দারুণ এক ডেলিভারিতে এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরে যান অজি অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ। পরের বলে মিচেল মার্শ ফিরতে পারতেন। কিন্তু আম্পায়ার্স কলের কারণে বেঁচে যান তিনি। ১ রানে ১ উইকেট নিয়ে প্রথম ওভার শেষ করেন আফ্রিদি।
শুরুতেই উইকেট হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া রান তুলতে ধুঁকছিল। চতুর্থ ওভারে সেটা কাটিয়ে তোলেন ডেভিড ওয়ার্নার। পাকিস্তানের বাঁহাতি স্পিনার ইমাদ ওয়াসিমের ওপর দিয়ে ঝড় বইয়ে দেন তিনি। এই ওভারে ওয়ার্নারের মারা একটি ছক্কা ও ২টি চারসহ ১৭ রান পায় অজিরা। পরের ওভারে হারিস রউফের পরীক্ষা নেন মার্শের। তার মারা একটি ছক্কা ও একটি চারসহ এই ওভার থেকে ১৪ রান মেলে।
দুই ওভার থেকে ৩১ রান তুলে ভালো অবস্থানে চলে যায় অস্ট্রেলিয়া। পাওয়ার প্লে ৬ ওভার থেকে ৫২ রান পায় অজিরা। পাওয়ার প্লে দারুণ ব্যাটিংয়ে স্বস্তি অবশ্য একটু পরই মিলিয়ে যায়। শাদাব খানের করা সপ্তম ওভারের দ্বিতীয় বলে উড়িয়ে মারতে গিয়ে আসিফ আলীর হাতে ধরা পড়েন মার্শ। ফেরার আগে ২২ বলে ৩টি চার ও একটি ছক্কায় ২৮ রান করেন তিনি।
এরপর উইকেটে গিয়ে সংগ্রাম করতে হয় স্টিভ স্মিথকে। তার পথটাও তাই লম্বা হয়নি। ৫ রান করেই ফিরে যান তিনি। গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ওয়ার্নার। কিন্তু ১১তম ওভারের প্রথম বলে বাধে বিপত্তি। অজিদের পরীক্ষা নিয়ে যাওয়া পাকিস্তানি লেগ স্পিনার শাদাবের প্রথম ডেলিভারিতে কট বিহাইন্ডের আবেদনে আঙুল তোলেন আম্পায়ার। মাঠ ছাড়েন ওয়ার্নার, কিন্তু পরে রিপ্লেতে দেখা যায় তার ব্যাটে বলে ছোঁয়নি।
রিভিউ না নেওয়ায় ততক্ষণে কিছুই করার ছিল না, নতুন ব্যাটসম্যান হিসেবে ম্যাথু ওয়েড তখন উইকেট চলে গেছেন। খারাপ সময় থেকে অস্ট্রেলিয়াকে টেনে তোলা ওয়ার্নার ৩০ বলে ৩টি করে চার ও ছক্কায় ৪৯ রান করেন। চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ম্যাক্সওয়েল পারেননি। ৭ রান করা ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান রিভার্স শট খেলতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দেন।
দলকে জেতানোর গুরু দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এগোতে থাকেন মার্কাস স্টয়নিস ও ম্যাথু ওয়েড। কিন্তু পাকিস্তানি বোলারদের বিপক্ষে সেভাবে রান তুলতে পারছিলেন না তারা, তাতে বাড়ছিল ব্যবধান। জয়ের জন্য ২৪ বলে ৫০ রান দরকার ছিল অজিদের। পরের ওভারে ১৩ রান নিয়ে ব্যবধান কমান স্টয়নিস। এর পরের ওভার থেকে আসে ১৫ রান।
শেষ ১২ বলে অস্ট্রেলিয়ার দরকার ছিল ২২ রান। ১৯তম ওভারটি করতে আসেন শাহিন আফ্রিদি। প্রথম ২ বলে এক রান দেন তিনি। তৃতীয় বলে গিয়ে সবচেয়ে বড় ভুলটি করেন পাকিস্তান। ওয়েডের তোলা ক্যাচ ফেলে দেন হাসান আলী। জীবন পেয়ে পরের তিন বলে তিন ছক্কায় খেলা শেষ করে দেন ম্যাচসেরা ওয়েড।
বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান মাত্র ১৭ বলে ২টি চার ও ৪টি ছক্কায় ৪১ রানে অপরাজিত থাকেন। ৩১ বলে ২টি চার ও ২টি ছক্কায় ৪০ রানে অপরাজিত থাকেন স্টয়নিস। বল হাতে জাদু দেখানো পাকিস্তানি লেগ স্পিনার শাদাব খান ২৬ রান খরচায় ৪টি উইকেট নেন। বাকি উইকেটটি নেন শাহিন আফ্রিদি।
এর আগে ব্যাটিংয়ে নামা পাকিস্তানকে বরাবরের মতোই সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন অধিনায়ক বাবর আজম। রিজওয়ান শুরুতে কিছুটা নড়বড়ে থাকলেও বাবর কেলতে থাকেন দারুণ ছন্দে। কিছুক্ষণের মধ্যে রিজওয়ানও সাবলীল ব্যাটিং শুরু করেন। উদ্বোধনী জুটিতে ১০ ওভারে ৭১ রান যোগ করেন তারা।
দারুণ সূচনায় দল যখন বড় সংগ্রহের পথে, তখন থামেন বাবর। ডানহাতি এই ওপেনার ৩৪ বলে ৫টি চারে ৩৯ রান করেন। চারটি হাফ সেঞ্চুরিতে চলতি আসরে ইতোমধ্যে ৩০৩ রান করেছেন পাকিস্তান অধিনায়ক। যা এখন পর্যন্ত আসরের সর্বোচ্চ। দেশের হয়ে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড নিজের করে নেওয়ার পথেই ছিলেন বাবর। কিন্তু ৭ রানের জন্য সেটা হয়নি। ২ হাজার ৫১৩ রান নিয়ে সবার ওপরে মোহাম্মদ হাফিজ। বাবরের রান ২ হাজার ৫০৭।
বাবরের বিদায়ের পর রিজওয়ানের সঙ্গে জুটি গড়েন ফকর জামান। এই জুটি থেকে ইনিংস সেরা সর্বোচ্চ ৭২ রান পায় পাকিস্তান। রিজওয়ানের বিদায়ে ভাঙে এই জুটি। ফেরার আগে ৫২ বলে ৩টি চার ও ৪টি ছক্কায় ৬৭ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেলেন তিনি। ডানহাতি উইকেটরক্ষক এই ব্যাটসম্যান বিশ্বকাপে তিনটি হাফ সেঞ্চুরিতে ২৮১ রান করেছেন। যা এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
বাকিটা সময়ে কেবল ফকর জামানই রান তুলেছেন। বাকিরা দলের স্কোরকার্ডে রান যোগ করতে পারেননি। ঝড়ো ব্যাটিংয়ে ফকর জামান ৩১ বলেই হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন। বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান ৩২ বলে ৩টি চার ও ৪টি ছক্কায় ৫৫ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন। আসিফ আলী ০ ও শোয়েব মালিক ১ রান করেন। অস্ট্রেলিয়ার মিচেল স্টার্ক ২টি এবং প্যাট কামিন্স ও অ্যাডাম জ্যাম্পা একটি করে উইকেট নেন।