ইউরোপের শীর্ষ ফুটবল ম্যানেজাররা দল ছাড়ছেন কেন?
সিরি এ জেতার পরপরই ইন্টার মিলান ছেড়েছেন আন্তোনিও কন্তে, অন্যদিকে রিয়াল মাদ্রিদকে বিদায় জানিয়েছেন জিনেদিন জিদান এবং টটেনহাম চেষ্টা করছে পিএসজি থেকে কোচ মরিসিও পচেত্তিনোকে দলে ফিরিয়ে আনতে।
লিগ ওয়ান শিরোপা জিতেও লিলি'তে আর থাকার সৌভাগ্য হচ্ছে না ক্রিস্টোফার গালটিয়ারের। জুভেন্টাসও আন্দ্রে পিরলোকে বরখাস্ত করে ম্যাসিমিলিয়ানো অ্যালেগ্রিকে ফিরিয়ে আনবে, এমন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরেই। এদিকে হ্যানসি ফ্লিকের বায়ার্ন মিউনিখ ছেড়ে যাওয়া নিয়ে জার্মানিতে তৈরি হয়েছে ডমিনো ইফেক্ট।
২০২০-২১ ক্যাম্পেইন স্থির না হতেই দল ছাড়তে শুরু করেছেন ইউরোপিয়ান ফুটবলের শীর্ষ ম্যানেজাররা। এর পুঙ্খানুপুঙ্খ কারণ খুঁজতে শুরু করেছেন ইউরো লিগ বিশেষজ্ঞ থেকে ধরে গণমাধ্যম ও ভক্তরাও।
চরম পরিস্থিতির শিকার হয়েই এমন সিদ্ধান্ত
করোনাভাইরাস মহামারির ফলে চরম অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হয়েছে ফুটবল ক্লাবগুলো। বিজনেস সার্ভিস গ্রুপ কেপিএমজি সূত্র জানায়, ইউরোপের ৩২টি ক্লাবকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ৬ দশমিক ১ বিলিয়ন ইউরো (৫ দশমিক ২৭ বিলিয়ন পাউন্ড) লোকসান গুনতে হয়েছে।
জার্মানিতে ফ্লিক চলে যাওয়ায় বায়ার্নকে বেশকিছু পরিবর্তন আনতে হয়েছে দলে। এর মধ্যে রয়েছে জুলিয়ান নাগেলসমানকে নিয়ে আসা এবং হেসে মারস্কের আরবি লিপজিগে যোগ দেওয়া। ইতালি, স্পেন ও ইংল্যান্ডেও দেখা গেছে একই চিত্র।
বিবিসি রেডিও ফাইভকে ফুটবল সাংবাদিক রাফায়েল হনিংস্টাইন বলেন, 'পদত্যাগের একটি মূল কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে মহামারিকালে দলের মধ্যে টাকা-পয়সা নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বেড়ে গিয়েছিল। এখন একটা চরম পরিস্থিতি চলছে, যা আমরা দেখে অভ্যস্ত নই। আগে কখনো মৌসুম শেষে বড় ক্লাবগুলো থেকে এভাবে এত জন কোচ চলে যেতে দেখা যায়নি।'
হনিংস্টাইন জানালেন ফ্লিকের চলে যাওয়ার কারণ, 'ট্রান্সফার ইস্যুতে ব্যাপক মতবিরোধই ছিল মূল কারণ, তার সঙ্গে প্রেক্ষাপটে কোভিড-১৯ সংকট তো ছিলই। ফ্লিকের চাহিদামতো টাকা খরচ করতে বায়ার্ন অপারগ, তাই সেখান থেকেই মতানৈক্যের শুরু।'
ইউরোপের সবচেয়ে দামি ক্লাব, লা-লিগা রানারআপ রিয়াল মাদ্রিদের কোচ জিনেদিন জিদানও বোর্ড এবং প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের কাছ থেকে তেমন সহায়তা পাননি বলে জানান স্প্যানিশ ফুটবল বিশেষজ্ঞ গিলেম বালাগ।
১১ বছর পর ইন্টার মিলানকে প্রথম ইতালিয়ান লিগ শিরোপা জেতানো কোচ কন্তেও একই প্রেক্ষাপটে দল ছেড়েছেন। কারণ দলের যা অবস্থা, তাতে এই গ্রীষ্মে বেতন-ভাতার পরিমাণ ২০ শতাংশ কমাতেই হতো।
ইতালিয়ান ক্রীড়া সাংবাদিক গ্যাব্রিয়েল মার্কোতি বলেন, 'কন্তে দুয়েকটা বড় চুক্তি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার বদলে ইন্টারকে তাদের গুরুত্বপূর্ণ কজন খেলোয়াড়কেই বিক্রি করতে হচ্ছে। এখন সময় বদলে গেছে। আপনি যদি পেপ গার্দিওলা কিংবা ইয়ুর্গেন ক্লপ না হন, তাহলে এসব চাহিদা দাবি করাটা কঠিন।'
মার্কোতির মতে, একদল নতুন খেলোয়াড় আনার চেয়ে একটা নতুন কোচ নিয়ে আসা সুবিধাজনক। এর প্রতিক্রিয়া হবেই; কিন্তু টাকা, বিনিয়োগ এবং করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থাই এখানে মূল ব্যাপার।
তিনি বলেন, 'ঠিক সে কারণেই জিদান রিয়ালকে বিদায় জানিয়েছেন। এবারের ট্রান্সফার উইন্ডোর বাস্তবতা কোচ ও খেলোয়াড়দের জন্য ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা হবে।'
ক্লান্তি এবং নতুন চ্যালেঞ্জ
মহামারিতে আগের ক্যাম্পেইন ব্যর্থ হওয়া এবং কড়া সময়সূচি ও চাপের মধ্য দিয়ে একটি মৌসুম পার করার পর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ইউরোপের ক্লাবগুলো। সেখান থেকেই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সূত্রপাত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
কিন্তু এসব চ্যালেঞ্জ, মতবিরোধ সত্ত্বেও কন্তের মতো গুটিকয়েক কোচের সাফল্য নতুন করে কিছু প্রশ্ন জন্ম দিয়েছে।
জিদান এই মৌসুমে কোনো শিরোপা জিততে না পারলেও বুড়ো খেলোয়াড়দের নিয়েই লা লিগার শিরোপা দৌড়ে এবং চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সেমিফাইনাল পর্যন্ত টিকিয়ে রেখেছিলেন রিয়াল মাদ্রিদকে।
ফ্রেঞ্চ ফুটবল সাংবাদিক জুলিয়েন লরেনের ভাষ্যে, "জিদানের জন্য এটা একটা বিশেষ মৌসুম ছিল। তিনি রিয়ালের জন্য যা যা সম্ভব, করেছেন। কিন্তু জিদান হয়তো-বা ভেবেছেন, এর চেয়ে ভালো কি তিনি আর করতে পারবেন? অন্যসব বিদায়ী কোচের মনেও হয়তো একই চিন্তা ছিল যে, 'এবার যা করেছি, আসন্ন মৌসুমে কি তারচেয়ে ভালো পারদর্শীতা দেখাতে পারব?'"
তবে বালাগ মনে করেন, ক্লাবগুলো কোচদের বিদায় জানাচ্ছে কারণ তাদের হাতে বড় কিছু অপশন রয়েছে।
কে কোথায় যাচ্ছেন?
ছোটবড় ক্লাবগুলোর কোচদের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে কে কোথায় থিতু হবেন, তা নিয়েও চলছে হিসাবনিকাশ ও জল্পনা-কল্পনা। কন্তের সম্ভাব্য ঠিকানা মনে করা হচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ অথবা টিটেনহামকে।
পিএসজি'র সাবেক কোচ পচেত্তিনোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে স্পারস, যদিও মার্কোতি বিবিসি রেডিও ফাইভকে জানিয়েছেন, রিয়ালেরও মূল টার্গেট পচেত্তিনো।
আন্দ্রে পিরলোর ভাগ্যে কি দাঁড়াবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। ইন্টার মিলান হয়তো-বা কন্তের পরিবর্তে সিমোন ইনজাগিকে ভাবছে।
গালটিয়ার জানিয়েছেন, তিনি বিশ্বাস করেন লিলিতে তার সময় শেষ হয়েছে। তিনি ফ্রেঞ্চ ক্লাব নিসে ও লিওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। অন্যদিকে সাবেক উলভস বস নুনো এসপিরিতো সান্তোও জায়গা খুঁজছেন নতুন কোনো ক্লাবে।
-
সূত্র: বিবিসি