আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে ছুটে চলেছেন ‘ভারত্তোলক মা’

'দাগ থেকে যদি ভালো কিছু হয়, তবে দাগই ভালো'- বাংলাদেশের একটা জনপ্রিয় টিভিসির এই লাইনটা মিলে যায় শাম্মী নাসরিনের সাথে। চার বছর আগে স্বাস্থ্যগত সমস্যার শিকার হয়ে নাম লেখান জিমে। 'ভালো কিছু' ঘটে গত বছর। বাংলাদেশ ভারোত্তোলন অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক আয়োজিত প্রতিযোগিতার ৬৩ কেজি ক্যাটাগরিতে তৃতীয় হন শাম্মী। 'দাগ' তথা স্বাস্থ্যগত সমস্যা কাটিয়ে তো উঠেছেনই, অর্জন করেছেন অসাধারণ সাফল্য।
বাংলাদেশ ভারোত্তোলন অ্যাসোসিয়েশনের ফেসবুক পেইজ থেকে শাম্মীর ছবিসহ করা পোস্টটি রাতারাতি তার জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দেয়। শাম্মী যা করেছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা যথেষ্ট সাহসী ও শক্তিশালী পদক্ষেপ। দুই ছেলে ও এক মেয়ের জননী ৪৬ বছর বয়সী এই নারী রেখেছেন সমাজের প্রথা ভাঙার দৃষ্টান্ত।
খুলনার এক সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছেন তিনি। প্রায় দু'দশক ধরে সংসার করে আসা শাম্মী ও তার স্বামীর জন্য পরিবারের খরচ চালানো সব সময় খুব সহজ ছিলো না। তবে তিন সন্তানের পড়াশোনা ও ভরণপোষণে কোনো কমতি রাখেননি তারা।
কীভাবে নিজেকে ভারোত্তোলনে সম্পৃক্ত করলেন, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শাম্মী স্মরণ করেন চার বছর আগের কথা। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'আমার ছেলে (তানভীর ফয়সাল পল্লব) নিয়মিত জিমে যেত। আমার সে সময় কিছু স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়। তখন সে আমাকে জিমে নিয়ে যায়। সেখানে ওয়ার্ক আউট করে ফিটনেসে যথেষ্ট উন্নতি করেছিলাম।'
জিমে সবার কাছ থেকেই সাহায্য পেয়েছেন শাম্মী। সেখানেই ভারোত্তোলনের প্রতি আগ্রহ জন্মায় তার। শাম্মী বলেন, 'সেখানে ট্রেইনাররা বুঝতে পারেন যে আমার ভারোত্তোলনে আগ্রহ আছে। তখন তাদের মাধ্যমেই আমি জানতে পারি ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতার কথা। আমি তখন থেকে সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকি।'
২০১৯ সালে ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতায় মেয়েদের ৬৩ কেজি মাস্টার্স প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ৮ম হন শাম্মী। এই প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগীরা সবাই ছিলেন চল্লিশোর্ধ্ব বয়সের। তবে পরের প্রতিযোগিতায় ঘটনাচক্রে ছিল না বয়সের সীমা, এবার সেরা তিনে জায়গা করে নেন শাম্মী।

'দ্বিতীয়বার যখন প্রতিযোগিতাটা অনুষ্ঠিত হয় (২০২০ সালে), তখন আমার প্রস্তুতি ছিলো আরও ভালো। তখন চল্লিশোর্ধ্ব কোনো প্রতিযোগী না থাকায় আমাকে অংশ নিতে হয় ৬৩ কেজি ওপেন ক্যাটাগরিতে। সেবার আমি তৃতীয় স্থান অর্জন করেছিলাম।'
পরিবার থেকেও যথেষ্ট সহযোগিতা পেয়েছেন শাম্মী। তার ভাষায়, 'আমার স্বামী ও ছেলেরা আমাকে সব কিছুতে অনেক সাহায্য করেছে। আমার জন্য যা ভালো, সব সময় তারা সেটাই চেয়েছে।'
সপ্তাহে পাঁচদিন জিমে যাওয়া এখন রুটিনে পরিণত হয়েছে শাম্মীর তবে বাধা-বিপত্তি যে নেই, তেমনও নয়। শাম্মী বলেন, 'কিছু কিছু আত্মীয় আমার কাজটাকে এখনও ভালো নজরে দেখে না, বিশেষ করে যেহেতু এখানে ওয়েস্টার্ন জামা কাপড় পড়তে হয়। তবে আশা করি ভবিষ্যতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
শাম্মীর আশা দেশ পেরিয়ে বিদেশেও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া, বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করা, 'আমার ছোট ছেলে একজন সেমি প্রো-ফুটবলার। তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কানাডায় গিয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করা। আমিও বিদেশে যেতে চাই এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে চাই।'
শাম্মী চাওয়া, বড় হয়ে তার মেয়েও যেন জিমে যোগ দেয়, 'আমার মেয়ে এখন পড়াশোনায় মনোযোগ দিচ্ছে। ভিডিও গেম খেলাতে তার বেশ আগ্রহ আছে। যদি সে ভিডিও গেম নিয়ে কিছু করতে চায়, তবে আমি তাকে অবশ্যই সমর্থন করব।'
শাম্মী নাসরিন চান নিজের অর্জন ও অভিজ্ঞতা দিয়ে অন্যদের অনুপ্রাণিত করতে, 'কেউ যেন আমাদের বলতে না পারে যে, 'তুমি পারবে না'। সবার প্রতি আমার বার্তা, আপনার যদি স্বপ্ন থাকে, যদি আপনি কিছু করতে চান, করে ফেলুন। আপনি ঘর সামলান, তার মানে তো এই না যে আপনার কোনো ক্যারিয়ার বা শখের কিছু থাকতে পারবে না। আপনিই পারবেন স্বপ্ন পূরণ করতে, দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে।'