অলিম্পিক পিন সংগ্রহের নেশায় মত্ত জাপানি সংগ্রাহকের গল্প
আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির অফিসিয়াল ম্যাগাজিন অনুসারে, গেমসের ইতিহাস জুড়ে আনুমানিক ৬৫ হাজার পিন ডিজাইন করা হয়েছে। এসবের মধ্যে কিছু দুর্লভ পিনের দাম নিলামে কয়েক হাজার ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে।
১৯৯৪ সালে যখন শ্লোমি সাফরির যখন জাপানের নাগানোতে আসেন, তখনও তিনি জানতেন না অলিম্পিক গেমস কিভাবে তার জীবন বদলে দেবে।
তিন বছর পর, নাগানো স্টেশনের বাইরে দুজন আমেরিকানের সঙ্গে তার দেখা হয় যারা নাগানো উইন্টার গেমসের আগে অলিম্পিক পিন বিক্রির জায়গা খুঁজছিলেন। সাফরির তাদেরকে নাগানোর চারপাশ ঘুরিয়ে দেখানোর ফলে তারা তাকে ১০০ টি পিন সম্বলিত একটি ব্যাগ দিয়েছিলেন, এবং সেগুলো কিভাবে বিক্রি করতে হবে ও ব্যবসায় লাগানো যাবে তার উপায়ও বলে গিয়েছিলেন।
মূলত ইসরায়েল থেকে আসা সাফরির বলেন, "তারা আমাকে বলেছিলো, 'আপনি যা করছেন ভুলে যান- এটিই আপনার ভবিষ্যৎ'।"
যদিও তাদেরকে সাফরির বিশ্বাস করেননি, ১৯৯৮ সালে নাগানো গেমস শুরু হওয়ায় আগে তিনি ২৪ ঘণ্টার জন্য পিনের একটি দোকান খুলেছিলেন। দুই দশকেরও বেশি সময় পর, সাফরির এর সব কক্ষ ফ্রেমযুক্ত পিনের বাক্সে ভরা। তার কাছে অলিম্পিক স্মৃতিচারণের এক লক্ষেরও বেশি টুকরা রয়েছে বলে তার অনুমান। এ পিনগুলো সংগ্রহ করা, বিক্রি করা এখন তার পূর্ণকালীন কাজ। এ কাজের বদৌলতে তিনি বিদেশের নিলামের ঘরগুলিতে যাতায়াত এমনকি অলিম্পিক প্রতিনিধিদের জন্য পিন ডিজাইন করার সুযোগ পেয়েছেন।
পিনে আচ্ছাদিত একটি কালো জ্যাকেট এবং ২০০৪ সালের এথেন্স গেমসের একটি শার্ট পরিহিত অবস্থায় সিএনএন-কে তার বিশাল সংগ্রহের মধ্য থেকে কিছু জিনিস দেখিয়েছিলেন সাফরির। এর মধ্যে রয়েছে জাপানের সাম্রাজ্য পরিবারের মালিকানাধীন একটি ব্যাজ। তার বিশ্বাস "জুডোর জনক" খ্যাত কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদ কানো জিগোরোর একটি ব্যাজ এটি।
সাফরির বলেন, "এ বাড়িতে প্রায় প্রতিটি আলমারি খুললেই আপনি অলিম্পিকের কোনো না কোনো জিনিস পাবেন।"
প্রতিটি অলিম্পিকে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজারের মধ্যে নতুন ডিজাইন বাজারে আসে। এর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ক্রীড়াবিদ, স্পন্সর ও মিডিয়া সংস্থার জন্য বিশেষ ধরণের পিনও রয়েছে।
তবে এ বছরের হতাশাগ্রস্ত পিন ব্যবসায়ীদের মধ্যে সাফরিরও একজন। চলমান মহামারির কারণে তার বিক্রি ও নতুন ডিজাইন সংগ্রহ করার সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নাগানোর এক রেস্তোরাঁর মালিক ও পিন ব্যবসায়ী মায়াসুকি তানাকার মতে, দর্শকদেরকে ভেন্যুতে নিষিদ্ধ করার ফলে ব্যক্তিগতভাবে ব্যবসা করার সুযোগ বেশ কমে গিয়েছে।
তিনি বলেন, "আমি খুবই দুঃখিত যে এবার আমি নতুন বা বিস্ময়কর পিন দেখতে পারছি না।"
সর্বাধিক চাহিদাসম্পন্ন পিনগুলোর মধ্যে রয়েছে বাতিলকৃত অলিম্পিকের পিন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বা জাপানি রাজনীতিবিদদের জন্য তৈরি করা পিন। অনেকেই স্মরণীয় কিছু পিনের জন্য সংগ্রাহকদের কাছে আসেন। যেমন, চীনের "বার্ডস নেস্ট" স্টেডিয়ামের নির্মাণের সময় অবশিষ্ট ইস্পাত ব্যবফার করে বানানো কোকা-কোলার ২০০৭ সালের অলিম্পিক পিন।
যুগ যুগ ধরে বিবর্তন
১৮৯৬ সালে এথেন্সে প্রথম আধুনিক গেমগুলো থেকে অলিম্পিক পিনের উৎপত্তির সন্ধান পাওয়া যায়। সেসময় প্রতিনিধিরা অফিসিয়াল কার্ডবোর্ড ব্যাজ পড়তেন।
আইওসির টিভি এবং মার্কেটিং শাখার ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিমো লুম্মে বলেন, "ক্রীড়াবিদ, বিচারক এবং কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করার উপায় হিসেবে অলিম্পিক পিন ব্যবহার শুরু হয়েছিল। কিন্তু গত ১২৫ বছরে এটি অলিম্পিক গেমসের একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে, যেখানে ক্রীড়াবিদ থেকে শুরু করে ইভেন্ট স্টাফ, সাংবাদিক এবং দর্শক সবাই অলিম্পিক অঙ্গনে এবং এর বাইরে পিন সংগ্রহ ও বাণিজ্যে অংশ নেয়।"
ক্রীড়াবিদ ও কর্মকর্তারা শীঘ্রই কার্ডবোর্ড থেকে মসৃন এনামেল পিনের দিকে চলে এলেন, এবং এটি অলিম্পিক কমিটির কিছু খরচ বহন করার মাধ্যম হয়ে উঠলো। ১৯৩৬ সালের গ্রীষ্মকালীন এবং শীতকালীন অলিম্পিক গেমের অর্থায়নে প্রায় ১০ লাখ পিন বিক্রি করে। আইওসির ম্যাগাজিন অনুসারে, ১৯৯৪ সালে লিলিহ্যামারের শীতকালীন অলিম্পিকে একটি স্থানীয় কোম্পানি ১ কোটি ৮০ লাখ পিন তৈরি ও বিক্রি করেছিলো। এ সংখ্যা আয়োজক দেশ নরওয়ের জনসংখ্যার চেয়ে তিনগুণেরও বেশি, এবং সে বছর আয়োজক কমিটি ১ কোটি ৮০ লাখ রয়্যালটি সংগ্রহ করেছিলো।
১৯৮০-র দশকে ব্যবসায়ীয়া লেক প্লাসিড, মস্কো অলিম্পিক গেমস এবং আনহিউজার-বুশ ও কোকা-কোলার মত স্পন্সরদের সাথে অফিসিয়াল পিন ট্রেডিং সেন্টার চালু করার পর থেকে পিন সংগ্রহের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেড়ে গিয়েছিলো।
২০২০ সালে পিনের নতুন ডিজাইনগুলোতে নতুন নতুন খেলা এবং টোকিও মাসকট মিরাইটোওয়া সংযোজন করা হয়েছে। এমনকি ১৯৬৪ সালে শহরের শেষ অলিম্পিক উদযাপনের জন্য বিশেষ 'ঐতিহ্যের' সংগ্রহও রয়েছে, যার মধ্যে একটি প্রায় ৬৪ হাজার ইয়েনে (৫৮৪ ডলার) বিক্রি হয়েছে।
তবে এ বছর ব্যবসায়ীরা গেমসে উপস্থিত হতে না পারায় অলিম্পিক আয়োজকরা অনলাইনে পিনগুলো এনএফটি বা নন-ফাঞ্জিবল টোকেন (এনএফটি) হিসেবে বিক্রি করে এ ধারা বজায় রাখছেন।
সদ্য প্রকাশিত ভার্চুয়াল পিনগুলোর মধ্যে রয়েছে মাসকট-অনুপ্রাণিত ডিজাইন এবং পূর্ববর্তী অলিম্পিক যেমন, ১৯২৪ সালের চামোনি গেমস (প্রথম শীতকালীন অলিম্পিক) এবং ১৯১২ এর স্টকহোম গেমসের ডিজিটালভাবে অ্যানিমেটেড পোস্টার। এনএফটি পিনগুলোতে বিনিয়োগকারী সংগ্রাহকদের মধ্যে সাফরির অন্যতম, তিনি এটিকে একটি "জিনিয়াস" আইডিয়া হিসেবে দেখছেন, যদিও আগের পিন বাণিজ্যের অবস্থা থেকে এটি এখনো অনেকটাই পিছিয়ে।
সাফরির এবং তানাকার জন্য পিনগুলো কেবল একটি বিনিয়োগ বা শখের চেয়ে বেশি - এটি মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের উপায়। তার বেশিরভাগ বন্ধুরা পিন সংগ্রাহক বলে জানান সাফরির, এবং তিনি আমেরিকান একজনের সাথে প্রতি সপ্তাহে কথা বলেন যিনি তার পিনের প্রথম ব্যাচ ১৯৯০ এর দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের একজন অভিজ্ঞ সৈনিককে দিয়েছিলেন।
এদিকে পিন ব্যবসায়ীদের জন্য তানাকা তার রেস্তোরাঁ উইন্ডস (অথবা তার বর্ণনা মতে, 'নাগানো পিনের অভয়ারণ্য') এর জন্য একটি মাসিক সভার আয়োজন করেন। এমনকি ব্র্যান্ডেড অলিম্পিক পাঠানো পিন-প্রেমী আইবিএম কর্তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছেন তিনি।
তানাকা বলেন, "যদিও আমি ইংরেজি বলতে পারি না, আমি পিনের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারি। প্রতিটি পিনের একটি গল্প আছে। আমার মনে আছে আমি কোথায় প্রতিটি সংগ্রাহকের সাথে দেখা করেছি এবং নিজে কী পেয়েছি। কত বছর পেরিয়ে গেলেও আমি আবারও সেসকল লোকদের সাথে দেখা করতে চাই যারা আমাকে পিন দিয়েছিলো। এটি স্মৃতিচারণ ও যোগাযোগের অনন্য এক রূপ।"
- সূত্র: সিএনএন