বাইসাইকেল

সুনির্মল বসুর 'সাইকেলে বিপদ' কবিতাটি দিয়েই শুরু করি:
ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং! সবে স'রে যাও-না,
চড়িতেছি সাইকেল, দেখিতে কি পাও না?
ঘাড়ে যদি পড়ি বাপু, প্রাণ হবে অন্ত;
পথ-মাঝে র'বে পড়ে ছিরকুটে দন্ত।
বলিয়া গেছেন তাই মহাকবি মাইকেল
'যেয়ো না যেয়ো না সেথা, যেথা চলে সাইকেল।'
তাই আমি বলিতেছি তোমাদের পষ্ট
মিছে কেন চাপা প'ড়ে পাবে খালি কষ্ট?
ভালো যদি চাও বাপু, ধীরে যাও সরিয়া
কি লাভ হইবে বলো অকালেতে মরিয়া?
সকলেই দিবে দোষ প্রতিদিন আমারে
গালি দিবে চাষা, ডোম, মুচী, তলী, কামারে।
এত আমি বলিতেছি, ওরে পাজী রাস্কেল
ঘাড়ে যদি পড়ি তবে হবে বুঝি আক্কেল?
রঘুনাথ একদিন না সরার ফলেতে
পড়েছিল একেবারে সাইকেল-তলেতে।
সতেরই বৈশাখ রবিবার দিন সে
চাপা পড়ে মরেছিল বুড়ো এক মিন্সে।
তাই আমি বলিতেছি—পালা নারে এখনি,
বাঙালী হয়েছ বাপু, পলায়ন শেখনি?'
বহুবছর আগে যাযাবর লিখেছিলেন, 'আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ; এতে আছে গতির আনন্দ, নেই যতির আয়েশ।'
যাযাবরের সামনে তখন দিল্লি শহর আর মোটরকার। সাইকেল বিজ্ঞানের হাই-টেক আবিষ্কার নয়। সাইকেল বেগ দিয়েছে কিন্তু আবেগ কেড়ে নেয়নি; গতির আনন্দ ও যতির আয়েশ দুই-ই মিলেছে দুই চাকার সাইকেলে।
জীবনের ভারসাম্য আর সাইকেলের ভারসাম্য আইনস্টাইনের কাছে একই রকম, দুটোতেই গতি থাকতে হবে, নতুবা হোঁচট আর হুমড়ি খেয়ে পড়া এড়ানো যাবে না।
সাইকেলের লেখক, লেখকের সাইকেল
'বাইসাইকেল, অবশ্যই বাইসাইকেল হবে ঔপন্যাসিক ও কবিদের বাহন', কথাটি ক্রিস্টোফার মোরলের। তলস্তয়ের বয়স যখন ৭০ ছুঁই ছুঁই, তখন সাইকেল চালাতে শিখলেন। ইয়াসনায়া পলিয়ানার বিশাল প্রান্তজুড়ে যারা তলস্তয়কে একসময় অশ্বারোহী দেখেছেন, তারা তাকে সাইকেল আরোহী হিসেবে দেখতে শুরু করলেন।
ঔপন্যাসিক টমাস হার্ডির স্ত্রী এমা ৫৫ বছর বয়সে সাইকেল চালাতে শিখলেন। তার চেয়ে এক বছরের বড় টমাসকে চেপে ধরলেন তাকেও শিখতে হবে। ১৮৯৬-এর জানুয়ারিতে তিনি সাইকেল চালনা শিখতে শুরু করলেন। অল্প দিনের মধ্যেই তার মনে হলো এটা 'নেশাকর' একটি কাজ। তারপর টমাস ও এমা হার্ডি পুডল টাউন ও ডরসেটের রাস্তায় দিনের পর দিন পাশাপাশি সাইকেল চালিয়েছেন। এমা তার সবুজ রঙের সাইকেলটির নাম দিয়েছেন গ্রাসহোপার, মানে ফড়িং। সাইকেলের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি সবুজ ভেলভেটের পোশাক পরে রাস্তায় নামতেন। আর টমাস হার্ডি পরতেন স্পোর্টসম্যানের পোশাক।
আর্থার কোনান ডয়েল ও তার স্ত্রী লন্ডনের রাস্তায় সাইকেল চালাতেন। হেনরি জেমস যদিও একটু মোটাসোটা ও বয়স্ক ছিলেন, তবে সাইকেল চালানোর মতো তারুণ্য তিনি ধরে রেখেছেন। দুপুরের খাবার আর বিকালের চায়ের মাঝখানের সময়টায় তিনি প্রতিদিন ২০ মাইল সাইকেল চালাতেন। সাইকেল খ্যাতি রয়েছে ভার্জিনিয়া উলফের। এইচ জি ওয়েলস ইংল্যান্ডের সারে হিলসের আশপাশে ঘুরে বেড়াতেন। আত্মজীবনীতেও তিনি সাইকেলপ্রীতির কথা লিখেছেন। সিডনি ওয়েব ও বিয়াট্রিস ওয়েব দম্পতি এইচ জি ওয়েলসকে ফ্যাবিয়ান সোসাইটিতে দলভুক্ত করার জন্য তাদের লন্ডনের বাড়ি থেকে সাইকেল চালিয়ে কেন্ট পর্যন্ত চলে যেতেন।

সমাজতান্ত্রিক আদর্শ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে উইলিয়াম মরিস সাইকেলে ঘুরে ঘুরে লিফলেট বিতরণ করতেন। একসময় সাইকেল হয়ে উঠল সমাজতন্ত্রের প্রতীক ও সমাজতন্ত্রীদের বাহন।
সাইকেলের স্বর্ণযুগ উঠে এসেছে সমারসেট মমের উপন্যাস 'কেকস অ্যান্ড এল', জেরোম কে জেরোমের 'থ্রি ম্যান অন দ্য বুমেল' ও এইচজি ওয়েলসের 'দ্য হুইলস অব চান্স'-এ।
টমাস হার্ডি বাথ ও ব্রিস্টলের মাঝামাঝি রাস্তায় সাইকেল দুর্ঘটনা ঘটিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার রেকর্ড জর্জ বার্নার্ড শর। তিনি দুর্ঘটনার তালিকাও তৈরি করেছেন। হার্টফোর্ডশায়ারে পাহাড়ি পথ দিয়ে দ্রুতগতিতে নামার সময় তার সামনে পড়ে পায়ে হাঁটা এক বুড়ি। তাকে বাঁচাতে গিয়ে এমনভাবে হুমড়ি খেয়ে পাথুুরে রাস্তায় পড়েন যে মুখের আদল বদলে যাওয়ার অবস্থা হয়। একবার তিনি লন্ডনের হে মার্কেট থেকে সাইকেলে ন্যাশনাল গ্যালারির দিকে যাচ্ছেন। সংঘর্ষ হলো ঘোড়ায় টানা ভ্যানের সঙ্গে, মুহূর্তের মধ্যে ভূপাতিত বার্নার্ড শ নিজেকে আবিষ্কার করলেন ভ্যানের চাকা আর ঘোড়ার পায়ের মাঝখানে। সাইকেল দুর্ঘটনা ঘটিয়েছেন মার্ক টোয়েন এবং 'বাইসাইকেল বশীকরণ' নামে একটি অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ রচনায় লিখেছেন, 'একটি সাইকেল জোগাড় করে নাও, বেঁচে থাকলে এর জন্য আফসোস করবে না।'
সাইকেলভক্ত ছিলেন জ্য পল সার্ত্র। তার কাছে হাঁটাহাঁটির ব্যাপারটি একঘেয়েমিতে ভরা। সাইকেল চালানো অনেক ভালো। সিমন দ্য বুভেয়ার মায়ের নিষেধাজ্ঞার পরও সাইকেল চালাতেন। দুবার দুর্ঘটনা ঘটিয়েছেন। জ্য পল সার্ত্রকে লেখা চিঠিতে সাইকেল চালনায় যৌনানন্দের কথা বলেছেন। একবার দুর্ঘটনায় চোখ-মুখ ক্ষতবিক্ষত হয়েছে এবং একটি দাঁত মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেছে।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে প্যারিসের রাস্তায় কেবল সাইকেল চালাতেনই না, ট্র্যাক রেসিংয়ে অংশগ্রহণ করতেন, তার সুপাঠ্য সাইকেল রেসিংয়ে রিপোর্টও রয়েছে। স্যামুয়েল বেকেট বক্সিং, রাগবি, ক্রিকেট ও সাইক্লিং নিয়ে মেতেছিলেন। তার লেখায় এমনকি সবচেয়ে বিখ্যাত 'ওয়েটিং ফর গডো'তে সাইক্লিং স্থান পেয়েছে।
হেনরি মিলার বলেছেন, সাইকেলের চাকার চেয়ে বড় বন্ধু আর নেই। তিনি যখন সাইকেল পেলেন, খুব দ্রুত বন্ধুদের প্রতি আগ্রহ হারাতে শুরু করলেন। চাকাই হয়ে উঠল তার একমাত্র বন্ধু।
'লরেন্স অব অ্যারাবিয়া'খ্যাত টি ই লরেন্স সাইকেল চালিয়ে ফ্রান্স ঘুরে এসে সাড়া ফেলে দিলেন।
১৮৯৬ সালে আর্থার কোনান ডয়েল লিখলেন, 'যখন মনোবল নেমে গেছে, দিনটা মনে হয় আঁধার। কাজ ভীষণ একঘেয়ে লাগে, আশা আদৌ আছে বলে মনে হয় না, তখনই বাইসাইকেলে চেপে বসো, কোনো কিছু চিন্তা না করে রাস্তায় কয়েক চক্কর লাগাও, শুধু সাইকেল চড়ার জন্যই।'
লেখাটি তার কোনো গোয়েন্দা গল্পের নয়, 'সায়েন্টিফিক আমেরিকা'তে প্রকাশিত।
ট্রপিক অব ক্যানসার এবং ট্রপিক অব ক্যাপ্রিকর্ন-এর খ্যাতিমান লেখক হেনরি মিলারের সাইকেল-প্রেম সুবিদিত। তিনি নিজেই লিখেছেন, 'কেউ তার রোলস রয়েসের যে যত্ন নিত, আমি আমার চাকার একই যত্ন নিই। মেরামতের দরকার হলে মার্টল অ্যাভিনিউতে এড পেরি নামের এক নিগ্রোর মেরামতখানায় নিয়ে আসতাম। বলতে পারেন ছোট শিশুকে যেমন করে গ্লাভস পরে তোলা হয়, এড সেভাবেই আমার সাইকেলটাকে তুলে ধরত। খুব খেয়াল রাখত কখনো সামনের বা পেছনের চাকা যেন এপাশ-ওপাশ নড়চড় না করে। প্রায়ই বিনে পয়সায় আমার কাজটি করে দিত, কারণ তার ভাষায়, সে এমন কাউকে দেখেনি যে তার সাইকেলকে আমার মতো এতটা ভালোবাসে।
নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী আরেকজন উইলিয়াম গোল্ডিং জীবনের সফরটাকে সাইকেল আরোহণ মনে করেছেন। 'মানুষের জীবনের যাত্রাটি বাইসাইকেলে চড়ার মতোই। আমরা জানি মানুষ সাইকেলে চড়ে চলতে শুরু করে। কোনো এক সময় মানুষ থামে এবং সাইকেল থেকে নেমে যায়। আমরা জানি সে যদি চলা থামিয়ে দেয়, সাইকেল থেকে না নামে, তাকে পড়ে যেতেই হবে।'
বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ফ্রান্সিস ফোর্ড কোপোলা লিখেছেন, 'আমার বয়স যখন ১৩ বছর, আমি ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নে কাজ করতাম। সেখানে টেলিগ্রাম আসত, আমি আঠা দিয়ে টেলিগ্রাম কাগজের ওপর সেঁটে সঠিক ঠিকানায় বিতরণের জন্য আমার বাইসাইকেল নিয়ে ছুটতাম।'
বাংলাদেশের একজন কবি ও বৈজ্ঞানিক ডক্টর মফিজ চৌধুরী (হ্যামলেটের অনুবাদক, বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী) সাইকেল তৈরির কারখানা স্থাপন করেছিলেন।
জয়নুল আবেদিন তার ময়মনসিংহের জীবনে সাইকেল চালাতেন। পল্লিগীতির সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পী আবদুল আলীম সাইকেল চালাতেন। সাইকেলচালক কবিদের মধ্যে ফজল শাহাবুদ্দীন, নির্মলেন্দু গুণ, ওমর আলী এবং আরও কেউ কেউ রয়েছেন। কবি মাকিদ হায়দার নিশ্চিত করেছেন পাবনার দোহারপাড়ার হায়দার ব্রাদার্সের সব লেখক ভাই সাইকেল চালাতেন। আবু হেনা মোস্তফা কামালও সাইকেল চালিয়েছেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিধর চিত্রগ্রাহক শহীদুল আলমকে তার নিচু সাইকেলে পেডাল মেরে এগোতে অনেকেই দেখেছেন। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদও সাইকেল নিয়ে অভিযানে বেরিয়েছেন।

১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাইকেলই ছিল আমার একমাত্র বাহন। ১৯৭৪-এর ১৬ মার্চ বুদ্ধদেব বসুর মৃত্যুসংবাদ শোনার পর তার শৈশব ও যৌবনের স্মৃতিচিত্র হাতে নিয়ে সেগুনবাগিচা থেকে শুরু করে ওয়ারি হয়ে বংশাল পর্যন্ত খুঁজে বেড়িয়েছি তিনি কোন বাড়িতে বাস করেছেন, কোন বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছেন, কোন পথে হেঁটেছেন, একটি কি দুটি বৃক্ষবহুল বাড়ি শনাক্তও করেছি। কিন্তু একসময়ের হাউস বিল্ডিং ফিন্যান্স করপোরেশনের ঋণ এবং পরবর্তী সময়ের ডেভেলপার বুদ্ধদেব বসুর সব স্মৃতি মুছে দিয়েছে।
চলচ্চিত্র বিষয়ের অন্যতম কথক শফিউজ্জামান খান লোদি আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ষাটের দশকে বাংলাদেশের সিনেমায় নায়কের প্রতিভা বিকশিত হয়েছে সাইকেলের চাকার ঘূর্ণনে। ১৩ নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেনে সাইকেলে তরুণ রাজ্জাক দেয়ালের ওপর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সুজাতাকে বললেন, 'কাল আমার বিয়ে!'
সাইকেলে ঠেস দিয়ে গার্লস স্কুল কি গার্লস কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নগর সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে উঠেছিল। সাইকেলের হরাইজন্টাল ক্রসবারে নায়িকাকে বসিয়ে নায়কের পৌরুষ প্রদর্শনের অনেক দৃশ্য মনে পড়ছে।
সাইকেল আরোহী সপ্তপদী সিনেমার উত্তম কুমারকে কি সহজে ভোলা যায়! সাইকেল চড়তেন খেটে খাওয়া নায়ক, আর আয়েশ করে সাইকেলে ঘুরে বেড়াতেন নায়িকা ধনাঢ্য জমিদারের নাতনি।
'কল্লোল যুগ', 'সম্পাদকের বৈঠকে', 'কলেজ স্ট্রিটে সত্তর বছর' গ্রন্থে সাইকেল আরোহী কলকাতার লেখকদের সঙ্গে দেখা মিলবে। বিনয় মজুমদারের 'ফিরে এসো চাকা' চাকাটি সাইকেলের নয়, তবুও চাকা তো। চাকা বিনয়ের কাছে গায়ত্রী, আমাদের কাছে গতি।
অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন সেভেনটি নাইন ডেজ
১৮৭৩ সালে প্রকাশিত জুল ভার্নের 'অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ'-এ ৮০ দিনে বিশ্ব ভ্রমণের চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফিলিয়াস ফগ যাত্রা করে, সঙ্গে পরিচালক জ্য পাসপার্তু। তার এ বিস্ময়কর কল্পভ্রমণে বাইসাইকেলেরও একটি ভূমিকা ছিল। জুল ভার্ন বহু অভিযাত্রীকে অনুপ্রাণিত করেছেন। গ্রন্থটি প্রকাশের ১৪৪ বছর পর মার্ক বিউমন্ট কেবল বাইসাইকেলে ৮০ দিনে বিশ্বভ্রমণের চ্যালেঞ্জ নিয়ে পথে নামলেন। তার প্রাথমিক হিসাব ছিল প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা সাইকেল চালাবেন, অতিক্রম করবেন ২৪০ মাইল। ৮০ দিনে ১৮ হাজার মাইল বা ২৯ হাজার কিলোমিটার ঘুরে আসা অসম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত পুরো এক দিন ও কয়েক ঘণ্টা হাতে থাকতেই তিনি ভ্রমণ সম্পন্ন করেন। কাজেই এ ভ্রমণ হলো সেভেনটি নাইন ডেজে।
বাইসাইকেল চুরি
এমো ফিলিপস লিখেছেন, 'আমি যখন ছোট ছিলাম, প্রতি রাতে একটা বাইসাইকেল পাওয়ার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতাম। একসময় বুঝতে পারলাম ঈশ্বরের প্রক্রিয়াটি ভিন্ন। সুতরাং আমি একটি বাইসাইকেল চুরি করে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলাম।'
বাইসাইকেল চুরি নিয়ে তৈরি হয়েছে ভিত্তোরিও ডি-সিকার হাতে বিশ্বখ্যাত সিনেমা 'বাইসাইকেল থিভস'। চোরের অন্যতম টার্গেট বাইসাইকেল। কিন্তু পৃথিবীতে যত সাইকেল চুরি হয়, তার একাংশই কেবল পুলিশের খাতায় ওঠে। তবে গবেষকেরা বলেন, এ চোর অত্যন্ত দক্ষ সাইক্লিস্ট হয়ে থাকবেন।
যুদ্ধোত্তর দারিদ্র্যজর্জর ইতালি। বেকারত্ব হ্রাসের লক্ষণ নেই। বাস থেকে নেমে বেকার লোকজন ভ্যালমেলানিয়া কর্মসংস্থান অফিসের সামনে ভিড় করে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে চায়, অফিসার ধমক দেয়। সবাইকে নিচেই থাকার নির্দেশ দিয়ে আন্তোনিও রিক্কিকে নাম ধরে ডাকে। সম্ভবত জনতার মধ্যে আন্তোনিও নেই। অন্য একজন তাকে ডেকে আনে। অন্যদের মতো চাকরি পেতে সে-ও মরিয়া হয়ে উঠেছে। জনতার মধ্য থেকে রাজমিস্ত্রিরা চেঁচিয়ে ওঠে। আমরা তো না খেয়ে মরতে বসেছি। নির্বিকারভাবে অফিসার বলে তার করার কিছু নেই।
অলৌকিকই বলতে হবে, অফিসার আন্তোনিওকে একটি চাকরি সাধলেন। তাকে গোটা শহরে পোস্টার লাগাতে হবে। অফিসার তাকে চাকরির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, ওয়ার্ক পারমিট এবং অবশ্যই একটি সাইকেলসহ চাকরিদাতার সঙ্গে দেখা করতে বলেন।
আন্তোনিও বলে তার একটি সাইকেল আছে, তবে প্রথম কদিন হেঁটে হেঁটে কাজটা করবে। অন্যরা হাত তুলে বলে তাদের সাইকেল আছে, এখনই সাইকেল নিয়ে আসতে পারবে।
চাকরি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে ভেবে আন্তোনিও মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেয় কালকেই সাইকেল নিয়ে হাজির হবে। এটা পুরোপুরি মিথ্যেও নয়। তার সাইকেলটি বন্ধক দেওয়া আছে। আন্তোনিও বাড়ি ফিরে নিজের জন্ম হওয়াকে অভিশপ্ত বলে আখ্যায়িত করছিল। তার স্ত্রী মারিয়া এগিয়ে এসে বলল, 'চিন্তা নেই। আমরা তো বিছানা ছাড়াই ঘুমোতে পারি।' সুতরাং বাড়ির চাদর বন্ধক রেখে ৭৫০ লিরা পেল। সেখানে চাদরের বিশাল স্তূপে তাদের বান্ডিলটা রাখা হলো। তারপর বন্দকের দোকান থেকেই সাইকেলটা ছাড়িয়ে নিয়ে চাকরিদাতার কাছে ছুটল। জানল প্রতি দুই মাসে তার বেতন হবে ৬ হাজার লিরা, পারিবারিক ভাতা, ওভারটাইমও পাবে। আনন্দে উত্তেজিত আন্তোনিও।
সাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। এই কাহিনি নিয়ে ভিত্তোরিও ডি-সিকা নির্মাণ করেন 'বাইসাইকেল থিভস', সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিনেমো হিসেবে সমাদিৃত।
মানুষ একটা দুই চাক্কার সাইকেল
হাওয়ার ওপর চলে গাড়ি
লাগে না পেট্রল-ডিজেল
মানুষ একটা দুই চাকার সাইকেল।
কী চমৎকার গাড়ির মডেল গো
চমৎকার গাড়ির মডেল
মানুষ একটা দুই চাক্কার সাইকেল।
জনপ্রিয় একটি গান দিয়েই আমাদের সাইকেল ও জীবন বন্দনা। এ গানটি বাউল গণি সরকারের লেখা।
'বাইসাইকেলের জন্য প্রণতি' লিখেছেন পাবলো নেরুদা
আগুন ঝলসানো রাস্তা ধরে
আমি হাঁটছিলাম
আগুন লাগা ভুট্টাখেতে
ভুট্টা ফোটার মতো সূর্য ফুটছিল
পৃথিবী
গরম ছিল
মাথার ওপর শূন্য নীলাকাশের
অনন্ত বৃত্ত।
কয়েকটি বাইসাইকেল চলে যায়
আমার পাশ দিয়ে
গ্রীষ্মের সেই
শুকনো মুহূর্তে
কেবল কীটপতঙ্গ
নিশ্চুপ,
মথ হয়ে আছে
দ্যুতি ছড়াচ্ছে
তারা আর বাতাস
তোলপাড় করে না।
তাদের চোখ
গ্রীষ্মকে দিয়ে
তাদের মাথা
আকাশে উঁচিয়ে গুরবে পোকা ধাঁচের
শক্ত পাটাতনে বসে
শ্রমিক ও বালিকারা
কারখানার পথে চলেছে
তারা সাইকেলের
চাকা ঘোরায়, বাইসাইকেল
সশব্দে সেতু, গোলাপবন
কাঁটাবন পেরিয়ে
মধ্যদুপুরে যায়।...
একালের কবি প্যাট্রিশিয়া পোলিকার্পিয়ো লিখেছেন— সাইকেল চড়া:
আমি জানতাম না কেমন করে সাইকেল চালায়
সুতরাং তুমি বাইকটা আঁকড়ে ধরলে এবং আমাকে দেখিয়ে দিলে
কিন্তু কেমন করে যে তুমি করলে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি
সুতরাং তুমি পেছন দিকে ধরে রেখে আমাকে চালাতে বললে
আমি প্রথমে ধীরে ধীরে পেডাল মারলাম
তারপর ক্রমেই দ্রুততর হলো আমার পেডাল
যতক্ষণ না আমার মুখাবয়রে মৃদু বাতাসের ঝাপটা লাগে
এবং আমার ঠোঁটে ফুটে ওঠে হাসি—
শেষ পর্যন্ত আমি ভাবলাম, আমি চালানো শিখে গেছি
তারপর আমি পেছনে তাকাই, দৃশ্যগুলো দেখি
সাইকেল তোমার হাতে ধরা নেই, তুমি আমার কাছ থেকে অনেক দূরে,
আমিও তোমার কাছ থেকে অনেক দূরে, তুমি হাত নেড়ে
বিদায় জানালে, কাজেই আমি উত্তরের দিকে বাঁক নিই
আরও আরও পেডাল মারতে থাকি
শেষ পর্যন্ত আমি ভাবলাম, সাইকেল চালানো শিখে গেছি
আমি জানতাম না কেমন করে সাইকেল চালায়
কিন্তু তুমি আমাকে শিখিয়েছ, আমি উত্তরের দিকে বাঁক নিই
এবং আরও কিছু পেডাল মারতে থাকি
শুধু তোমার সাথে দূরত্বটা বেড়ে গেছে, বেড়ে যাচ্ছে।
সাইকেল রঙ্গব্যঙ্গ
ক) এক পথচারী আপন মনে রাস্তা পার হচ্ছিল। এ সময় এক দ্রুতগামী সাইক্লিষ্ট এসে তাকে ধাক্কা দিলে চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেল।
দাঁত কড়মড় করে ক্ষুব্ধ পথচারী সাইক্লিস্টের দিকে তাকাল। সাইক্লিষ্ট বলল, তুমি বড় ভাগ্যবান। বড় বাঁচা বেঁচে গেলে।
আরও রুষ্ট হয়ে পথচারী বলল, তুমি কি বলতে চাও, আমি প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছি।
সাইক্লিষ্ট বলল, সাইকেলটাকে ধন্যবাদ দাও, তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছি, আমি আসলে আন্তজেলা ট্রাক চালাই।

খ) এক সর্দারজি ফুটপাথ ধরে হাঁটছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে তার গা ঘেঁষে নতুন চকচকে এক সাইকেল নিয়ে কেউ একজন পাহাড়ের দিকে চলে গেল। ফুটপাথ ধরে হাঁটা সর্দারজি সাইকেল দেখে মুগ্ধ হয়ে এই সাইক্লিস্টের ফেরার অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঢাল বেয়ে সেই সাইকেল নিয়ে যে নেমে এল, দেখা গেল সেও একজন সর্দারজি। তাকে থামিয়ে প্রথম সর্দারজি জিজ্ঞেস করল, এমন চমৎকার সাইকেল কোথায় পেলে?
দ্বিতীয় সর্দারজি বলল, সে এক ইতিহাস। গতকাল যখন এ পথ দিয়ে হাঁটছিলাম বিশ^সুন্দরী টাইপের এক নারী সাইক্লিস্ট এসে আমার পাশে থামল। প্রথমে তার গায়ের সবগুলো পোশাক খুলে ছুড়ে ফেলল। তারপর ধাক্কা দিয়ে সাইকেলটা ফেলে দিয়ে নিজেও ওপাশে গিয়ে বলল, তোমার যা ইচ্ছে, যাকে ইচ্ছে নিয়ে যাও।
দ্বিতীয় সর্দারজি বলল, বুঝলে, আমি বাইকটাই নিলাম।
প্রথম সর্দারজি বলল, গুড চয়েস, কাপড়গুলো তোমার গায়ে ঠিকঠাক ফিট হতো না।
গ) পুলিশ একজন টেনডেম (দুজনের বাইসাইকেল) সাইক্লিস্টকে তাড়া করে ধরল।
'আমি কি অপরাধ করেছি অফিসার?
'পুলিশ বলল, তুমি সম্ভবত খেয়াল করোনি। প্রায় দুই মাইল আগে তুমি যখন শক্ত ব্রেক কষলে তোমার স্ত্রী পেছন সিট থেকে পড়ে গেল। শব্দ শোনোনি?
ঈশ^রকে অনেক ধন্যবাদ, আমি ভেবেছিলাম ঈশ^র আমাকে বধির করে দিয়েছেন।
ঘ) স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক অনেক খারাপ হয়ে যাওয়ায় কাউন্সিলরের শরণাপন্ন হলো এক স্বামী।
কাউন্সিলর : সাইকেল আছে?
স্বামী : আছে।
কাউন্সিলর : চালাতে জানো?
স্বামী: জানি।
কাউন্সিলর : তাহলে প্রতিদিন ৫০ মাইল সাইকেল চালাবে এবং ১০ দিন পর তোমার অবস্থা কি ফোনে জানাবে।
১০ দিন পর কাউন্সিলর ফোন পেল, 'ডক্টর আমি আগের চেয়ে ভালো আছি, এখন আমি আমার স্ত্রীর কাছ থেকে ৫০০ মাইল দূরে।
ঙ) ধর্মযাজক রাতের বেলা সাইকেল চালিয়ে চার্চে ফিরছিলেন। তার সাইকেলের ব্যাক লাইট জ¦লছিল না।
পুলিশ তাকে আটকে বিষয়টা বলল।
ধর্মযাজক বললেন, অসুবিধে নেই, আমার সাথে ঈশ^র আছেন।
এবার পুলিশ বলল, কী বললেন? এমন সাইকেলে দুজন আইনত অপরাধ। ফাইন ২৫ ডলার।
চ) প্রশ্ন : তুমি কি জানো সাইকেল চালানো শেখার সবচেয়ে কঠিন অংশ কোনটা?
জবাব : পাকা রাস্তা।
ছ) যারা সাইকেলের ভাস্কর্য তৈরি করেন, তাদের এককথায় কী বলা হয়?
সাইকেলেঞ্জোলা।