Skip to main content
  • মূলপাতা
  • অর্থনীতি
  • বাংলাদেশ
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলা
  • বিনোদন
  • ফিচার
  • ইজেল
  • মতামত
  • অফবিট
  • চাকরি
  • প্রবাস
  • অন্যান্য
  • English
The Business Standard বাংলা
tbs
THURSDAY, MAY 19, 2022
THURSDAY, MAY 19, 2022
  • মূলপাতা
  • অর্থনীতি
  • বাংলাদেশ
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলা
  • বিনোদন
  • ফিচার
  • ইজেল
  • মতামত
  • অফবিট
  • চাকরি
  • প্রবাস
  • অন্যান্য
  • English
মসলা চাই মসলা! ভাস্কো দা গামার ভারত আগমন এবং পর্তুগিজ নৃশংসতার শুরু

ইজেল

শওকত হোসেন
12 February, 2022, 08:10 pm
Last modified: 12 February, 2022, 08:09 pm

Related News

  • বুড়িগঙ্গা!
  • ঢাকার হারানো পাখি, দৃশ্যমান পাখি
  • খেজুর: সুস্বাদু ঐতিহ্যের ছয় হাজার বছরের ধারাবাহিকতা
  • খেজুর কি সবচেয়ে প্রাচীন ফল?
  • পূর্ববঙ্গের এক কিংবদন্তি ঠগি কাহিনি

মসলা চাই মসলা! ভাস্কো দা গামার ভারত আগমন এবং পর্তুগিজ নৃশংসতার শুরু

ভাস্কো দা গামা। প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে নৌবহর নিয়ে ভারতের মাটিতে পা রেখে নায়ক হিসেবে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। কিন্তু এই ‘নায়ক’-এর হাত ধরেই ভারতবর্ষে সূচনা ঘটে পর্তুগিজ ত্রাসের। তার কাছে বার্তা নিয়ে যাওয়া পুরোহিতকে জ্বলন্ত কয়লায় দগ্ধ করার পর তার ঠোঁট কেটে কানের জায়গায় জাহাজের একটা কুকুরের কান লাগিয়ে দেন। মক্কা থেকে আসা প্রায় ৭৫০ যাত্রীসমেত গোটা জাহাজটা জ্বালিয়ে দেয় পর্তুগিজরা। এরকম অসংখ্য নিষ্ঠুরতার আখ্যানে ভর্তি ভারতের ‘পর্তুগিজ-অধ্যায়’।
শওকত হোসেন
12 February, 2022, 08:10 pm
Last modified: 12 February, 2022, 08:09 pm

২০ মে ১৪৯৮। ভারতের মালাবার উপকূলের উত্তরে ইউরোপ থেকে ভারতে পৌঁছানো প্রথম নৌবহর ভেড়ান ভাস্কো দা গামা। ভারতীয় মসলা ক্রেতা বহু জাহাজের বাণিজ্যের নিরিবিলি স্বর্গ ছিল কালিকট। মাত্র দুই বছর পর পর্তুগিজরা এইসব জাহাজ দখল করে নাবিকদের হত্যা করবে এবং জাহাজের কামান কালিকটের দিকে তাক করে নির্বিচারে বাড়িঘর ধ্বংস করে হত্যালীলা চালাবে। সূচনা ঘটবে পর্তুগিজ ত্রাসের।

ভারত মহাসাগর আদৌ অজ্ঞাত এলাকা ছিল না। ইউরোপ ও এশিয়ার ভেতর বাণিজ্যের চরিত্র পাল্টে দেওয়া আফ্রিকার চূড়া ঘুরে ইউরোপ থেকে ভারত যাত্রার পথ আবিষ্কার ছিল ভাস্কো দা গামার সাফল্য। তিনি ভারত মহাসাগরে পৌঁছানো নাগাদ এই সাগরে বাণিজ্যের বয়স অন্তত দুই হাজার বছর। ভারতীয় মসলা ইউরোপে সুপরিচিত ছিল। ইউরোপে এসব মসলা, বিশেষ করে মরিচের বিপুল কদর ছিল। তবে সাধারণত ভারত মহাসাগরের উত্তরাঞ্চলীয় বিভিন্ন বন্দর থেকে সাগর পথে আমদানির পর এগুলো স্থলপথে পাঠানো হতো। 

প্রাচীন মিসরে শাসক গোষ্ঠীর প্রলেপ হিসেবে ব্যবহৃত মসলাভান্ডারে মরিচ ছিল। কায়রো জাদুঘরে ১২১৩ খৃষ্টপূর্বাব্দে নিহত দ্বিতীয় রামেসিসের সংরক্ষিত মামির এক্স-রে পরীক্ষায় তার নাকে ঠেসে দেওয়া মরিচগুঁড়া মিলেছে। গ্রিক ও রোমকদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য ছিল দক্ষিণ ভারত থেকে আমদানি করা মরিচ। সিরকা এবং মধুর সাথে মিশিয়ে মরিচ জরায়ুর ঘায়ের চিকিৎসায় ব্যবহার করার কথা বলেছেন অ্যারিস্টটল। বিখ্যাত চিকিৎসক হিপোক্রিটাসও একে সমর্থন করেছেন। এসব মরিচের বেশিরভাগ সম্ভবত চতুর্থ শতকে গ্রিসের অধীনে যাওয়া মিসর মারফত গেছে। ধারণা করা হয়, রোমক সম্রাট অগাস্টাস একে মুখরোচক খাবারে পরিণত করার আগে মরিচের ব্যবহার ওষুধে সীমিত ছিল। তার আমলেই রোমকরা ৩০ খৃষ্টপূর্বাব্দে মিসর দখল করে আরব সাগরের বাণিজ্যের খোলনলচে পাল্টে দেয়। প্রথম শতকের মাঝামাঝি বর্ষা মৌসুমের সাথে পরিচিত হয়ে মিসর থেকে সরাসরি দক্ষিণ ভারতে ভ্রমণের উদ্দেশে বিশাল জাহাজ নির্মাণ করে তারা। আরবরা অবশ্য অনেক আগেই থেকেই এব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিল। প্লিনি দ্য এল্ডার আমাদের বলছেন, লোহিত সাগরের মোহনার ওসিলিস থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের মালাবার উপকূলের মুজিরিসে পৌঁছাতে এক মাস লাগত। মসলা বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তার করতে রোমকরা অডেনের প্রধান আরব বাণিজ্য কেন্দ্র ধ্বংস করে আরব উপকূলের একই ধরনের অন্যান্য বন্দরের সাথে চুক্তি করে। প্রথম শতকের শেষদিকে রোমকদের কাছে মসলা আর দুষ্প্রাপ্য বিলাসদ্রব্য ছিল না। বিশাল গুদাম নিয়ে আলেক্সান্দ্রিয়া মসলা বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। মরিচের ব্যবহার গোটা রোমক সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। খোদ রোমে সম্রাট ডোমিশিয়ান মরিচের গুদাম নির্মাণ করেন, যার ধ্বংসাবশেষ আজও চোখে পড়ে। মরিচ একাধারে রান্নায় এবং খাবার টেবিলে ব্যবহৃত হয়েছে। ফ্রান্স এবং ব্রিটেনে এই সময়ের বেশ কিছু বিচিত্র মরিচদানি পাওয়া গেছে। 

মালাবার থেকে কেবল ভারতে উৎপন্ন সামগ্রীই ইউরোপে যায়নি। রোমক আমলের বহু আগে থেকে দক্ষিণ ভারত ও পুবের ভেতর মসলা ও অন্যান্য সামগ্রীর বিকাশমান বিনিময় ছিল। ভারতীয় মসলা চীনে রপ্তানি হতো। লবঙ্গ এবং জায়ফলের মতো মসলা ইন্দোনেশিয়া থেকে ভারতে আসত। পরে এসব পণ্য প্রচুর পরিমাণে আরব ও ইউরোপে রপ্তানি হয়েছে। ভারতের মসলা রোমক কোষাগারের বিপুল অর্থ খসিয়েছে। ভারতে অল্প কিছু রোমক পণ্য— কাপড়, ধাতু, রংয়ের উপাদান, ওষুধ, প্রসাধনী এবং বিশেষত ভূমধ্যসাগরীয় লাল প্রবালের বাজার ছিল। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে লেখালেখি করা প্লিনি দ্য এল্ডার বলেছেন, ভারতীয় পুরুষদের কাছে, রোমক নারীদের কাছে ভারতীয় মুক্তার মতোই রোমক প্রবালের সমান কদর ছিল। কেবল আকর্ষণীয় অলংকার হিসেবেই মূল্যবান ছিল না, বরং অমঙ্গল এবং বিভিন্ন রোগে প্রবাল তাবিজের কাজও দিত। অবশ্য বেশিরভাগ মসলার বিনিময়ে সোনা দিয়ে দাম মেটাতে হওয়ায় সাম্রাজ্যের অর্থ হ্রাসের ফলে উদ্বিগ্ন ছিলেন প্লিনি। তিনি ভারত থেকে বিশেষত মচির আমদানির পেছনে বার্ষিক পঞ্চান্ন মিলিয়ন সেস্তারসেস— প্রায় আধমিলিয়ন ইংরেজ সোনার সমান বলে অনুমান করেন। দক্ষিণ ভারতে রোমক সোনা ও রুপার মুদ্রার অগুনতি ভান্ডারের খোঁজ পাওয়া গেছে। 

মিসর এবং মালাবার উপকূলের ভেতর বাণিজ্য পথসংক্রান্ত আমাদের বিদ্যার সিংহভাগের উৎস হচ্ছে খিষ্টীয় ৭৯ থেকে ৮৪ সাল নাগাদ আলেকসান্দ্রিয়ায় অবস্থানরত জনৈক গ্রিক ক্যাপ্টেনের লেখা বলে অনুমিত 'পেরিপ্লাস অব দ্য অ্যারিথ্রিয়ান সি'। রোমক সম্রাটের বহু জাহাজের চালক ছিল গ্রিক। এখানে লোহিত সাগর থেকে সিন্ধু নদ ও নর্মদা নদীর অববাহিকা থেকে উপকূল বরাবর মুজিরিস এবং আরও দূরে আরব এবং গ্রিকদের পাঠানো রসদবাহী বহু জাহাজে আকীর্ণ বেশ কিছু পশ্চিম ভারতীয় বন্দরে যাত্রার কথা বলা হয়েছে। 

তারা এসব বাজার শহরে বিপুল পরিমাণ মরিচ এবং মালাবাথ্রাম (তেজপাতা) পাঠাতে বিরাট জাহাজ পাঠাত, জুলাই মাসের দিকে এই অঞ্চলের উদ্দেশে মিসর থেকে বেরিয়ে পড়ত তারা।

রোমক এবং মালাবার উপকূলের ভেতর বাণিজ্য কয়েক শ বছর চালু ছিল। রোমক সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে অবশ্য তার অবসান ঘটে। তৃতীয় ও চতুর্থ শতকের মুদ্রা উদ্ধারের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারেই নিম্নমুখী। তবু সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি পর্যন্ত কিছু পরিমাণ বাণিজ্য অব্যাহত ছিল। খ্রিষ্টীয় ৪০৮ সালে প্রথম আলার্কিক দ্য ভিসিগথ রোম অবরোধ করে নগরীর মুক্তিপণের অংশ হিসেবে ৩ হাজার পাউন্ড মরিচ দাবি করেন। 

রোমক সাম্রাজ্যের পতনের ফলে ভারতের সাথে বাণিজ্য আরবদের হাতে চলে যায়। পর্তুগিজদের আবির্ভাবের আগপর্যন্ত আরব সাগরের বাণিজ্য সম্পূর্ণ তাদের অধিকারে ছিল। নবম শতকের দিকের বাণিজ্য-সংক্রান্ত প্রথম লিখিত বিবরণে মাস্কাট থেকে মালাবারের প্রধান বন্দরে পরিণত কুইলন অবধি মাসব্যাপী যাত্রার কথা রয়েছে। চৌদ্দ শতকে তানজিয়ার থেকে চীন যাওয়ার পথে ইবনে বতুতা কালিকট, কুইলন এবং মালাবারের আরও বহু জায়গা সফরের কথা বলেছেন। অবশ্য ভাস্কো দা গামার বহু শতক আগে ভারত সফরকারী আরবদের মতো তার রচনা ইউরোপে অজানা ছিল। 

ভাস্কো দা গামা

সৌভাগ্যক্রমে ইউরোপের নিজস্ব কয়েকজন ইতিহাসবিদ ছিলেন। ভেনেশীয় মার্কো পোলো এদের ভেতর সবচেয়ে বিখ্যাত। তেরো শতকের শেষদিকে তিনি জাহাজে করে চীন থেকে ভারত হয়ে পারস্য উপসাগরে ফিরে আসেন। তিনি কুইলন সফর, এখানকার মরিচ, চন্দন কাঠ এবং নীল, ক্রিশ্চান ও ইহুদিদের কথা লিখেছেন। চীন এবং আরবের সাথে বাণিজ্যের কথাও উল্লেখ করেছেন। মধ্য পনেরো শতক পর্যন্ত চীনা জাহাজবহর ছিল ভারতের নিয়মিত অতিথি। এসব নৌবহরের নিয়ন্ত্রণ চীনা রাজদরবারের হাতে ছিল। কিন্তু দরবার ক্ষমতা হারালে নতুন শাসক গোষ্ঠী বিদেশ সফর নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। মধ্যযুগীয় ইউরোপে দুজন পর্যটকের রচনা পরিচিত ছিল: ফরাসি ডোমিনিকান মিশনারি জর্দানাস এবং ইতালীয় ফ্রান্সিস্কান মিশনারি অদোরিক অব পোর্দেনোন। দুজনই চৌদ্দ শতকের গোড়ায় মালাবার সফর করেন। জর্দানাস কুইলনের মসলার নিখুত বিবরণসহ এখানকার জীবনযাত্রার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। এখানে একটা মিশন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তিনি।

'আদা আগাছার মতো পাতাওয়ালা একধরনের গাছের শেকড়। মরিচগাছ বিভিন্ন গাছ বেয়ে ওঠা অনেকটা বুনো আঙুরের মতো ফলওয়ালা আইভি লতার মতো। যেমন দেখছেন, এই ফল প্রথমে সবুজ থাকে এবং পরে পাকলে কালো হয়ে কুচকে যায়।'

পোপের কাছে ভারত মহাসাগরে একটা ক্রিশ্চান নৌবহর মোতায়েনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছিলেন তিনি। 

অন্ধকার যুগ থেকে মধ্যযুগের আগমনে ইউরোপে বিভিন্ন মসলার চাহিদাও বেড়ে ওঠে। মধ্যযুগের গোড়ার দিকে ইউরোপে মসলা অতি ব্যয়বহুল ছিল বলে শুধু অতি ধনীদের আওতায় ছিল। রাজরাজড়া এবং যাজকেরা নজর কাড়ার জন্য ব্যবহার করতেন। ১২৫৬ সালে স্কটল্যান্ডের রাজা তৃতীয় আলেক্সান্দার ইংল্যান্ডের তৃতীয় হেনরির সাথে দেখা করতে গেলে বিরাট ভোজের ভেতর দিয়ে উডস্টকে অভিষেক উদ্যাপন করেন। এই ভোজে পঞ্চাশ পাউন্ড ওজনের মরিচ, আদা এবং দারুচিনি ব্যবহার করা হয়। মধ্যযুগ বিকশিত হওয়ার পরিক্রমায় মরিচের দাম পড়ে যাওয়ায় মোটামুটি সচ্ছল বৃহত্তর অংশের ভোগের পথ খোলে। মধ্যযুগীয় সাধারণ মানুষকে খাওয়ানো পচা খাবারই নাকি মসলা, বিশেষত মরিচের অবিশ্বাস্য চাহিদার পেছনের কারণ ছিল। কিন্তু দুর্গন্ধওয়ালা খাবার এবং রোগের ভেতরের সম্পর্ক সর্বজনবিদিত ছিল বলে একে অন্যতম মূল কারণ মনে হয় না। বরং শীতের মাসগুলোতে খাবার টাটকা রাখতে ব্যবহৃত অস্বাভাবিক পরিমাণ লবণের স্বাদ লুকোনোই ছিল আসল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, হাল ফ্যাশনই ছিল এর ব্যবহার, কারণ, প্রথমে বিলাসিতার জন্যে ধনীরা ব্যবহার করেছে এবং পরে দাম কমায় অন্যরা অনুকরণ করেছে। উদ্দেশ্য যাই হোক, চাহিদা ছিল বিপুল। 

ইতালীয় বণিকরা বেশির ভাগ বণ্টন নিয়ন্ত্রণ করত। কন্সট্যান্টিনোপল, বৈরুত, আলেপ্পো, আলেক্সান্দ্রিয়া এবং কায়রো থেকে বাণিজ্য চালাত তারা। কন্সট্যান্টিনোপলের পতনের ফলে আলেক্সান্দ্রিয়া এবং কায়রোর বাজার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। ইউরোপের উদ্দেশে মসলার প্রবাহ অব্যাহত থাকলেও কেবল মুসলিম শাসক ও বণিকদের হাতে মোটা অঙ্কের মুনাফা নিশ্চিত হওয়ার পরই সেটা ঘটত। ইউরোপের সাথে মসলা বাণিজ্যে ভেনেশীয়রা আধিপত্য বিস্তার করলেও মালাবারের সাগর বাণিজ্যের উৎসের নিয়ন্ত্রণে ছিল আরবরাই।

পনেরো শতকে ভারত সফরকারী দুজন ইউরোপীয় বণিক আপানাসি নিকিতিন এবং নিকোলো দে কন্টি এখানকার সম্পদ এবং বাণিজ্যের কার্যকর তথ্য সংগ্রহ করেন। ১৪৬৮ সালে রাশিয়া ছেড়ে আসা বণিক নিকিতিন কাস্পিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে পারস্য এবং এখানে ওরমুজ দ্বীপ থেকে ভারতের পশ্চিম উপকূলীয় বন্দর চাউলের উদ্দেশে জাহাজে চাপেন। দক্ষিণ ভারতীয় বাহমানি সুলতানাতে পৌঁছে তিন বছর ছিলেন তিনি। 'জায়গাটা মানুষে আকীর্ণ, বিশেষ করে পল্লিবাসীদের অবস্থা ছিল শোচনীয়, অন্যদিকে অভিজাত গোষ্ঠী চরম প্রচুর্য এবং বিলাসিজীবন কাটায়।' এছাড়া ক্যাম্বে, দাবুল এবং কালিকটও সফর করেন তিনি:

'এখানে মরিচ, আদা, রংয়ের গাছ, মাস্কাট, লবঙ্গ, দারুচিনি, সুগন্ধী শেকড়সহ সব ধরনের মসলাপাতি উৎপাদিত হয়। সবই ভীষণ সস্তা। কাজের লোকগুলো ভীষণ ভালো।'

পর্যবেক্ষণে নিকিতিন ছিলেন খোলামেলা:

'বিদেশি বণিকদের বেলায় স্বয়ং বাড়িওয়ালি রান্না করে, এমন সরাইখানায় থাকাই ছিল দস্তুর। আগন্তুকের সাথে বিছানায়ও যেত সেই নারী। পরিচিত নারীরা শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের পছন্দ করত বলে পছন্দের লোককেই বেছে নিত।'

ইতালি মসলার ইউরোপীয় বড়বাজার হওয়ায় ভেনেশীয় পর্যটক নিকোলো দে কন্টি ছিলেন নিকিতিনের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আনুমানিক ১৪১৯ থেকে ১৪৪৪ সাল পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, দক্ষিণ এশিয়া এবং সম্ভবত চীন সফর করেছিলেন তিনি। দামাস্কাসে আরবি ভাষা শিখে মুসলিম পরিচয়ে চলাফেরা করতেন। দেশে ফিরে পোপের সচিবের কাছে ভ্রমণবৃত্তান্ত বয়ান করে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন। সচিব পরে সেই বিবরণ লিখে পাণ্ডুলিপি আকারে বিলি করেন। ১৪৯২ সালে সেটি প্রথম ছাপা হয়েছিল। হতে পারে যে কন্টির বিবরণ পর্তুগিজ অভিযাত্রীদের পরবর্তীতে এই দেশে আসতে অনুপ্রাণিত করেছে। তবে নিশ্চিতভাবেই তা মানচিত্র আঁকিয়ে এবং ষোলো শতকের পর্যটকদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। 

উপসাগর থেকে গুজরাটের ক্যাম্বে পৌঁছে সেখান থেকে দক্ষিণে প্রতাপশালী সাম্রাজ্য বিজয় নগরে হাজির হন কন্টি এবং শেষে পূর্ব উপকূল থেকে জাহাজে চেপে দূরপ্রাচ্যের পথ ধরেন। এরপর আবার বাংলায় ফিরে গঙ্গা নদী বরাবর বারানসি অবধি গিয়ে স্থলপথে বার্মায় পাড়ি জমান। বার্মা থেকে জাহাজে করে জাভা, সেখান থেকে ভিয়েতনাম হয়ে আবার ভারতে আসেন। ক্যাম্বে যাওয়ার আগে কোচিন এবং কালিকট সফর করেছিলেন তিনি। পরে মধ্যপ্রাচ্য ও ভেনিসে ফেরার আগে আবার কালিকটে ফিরে আসেন। কন্টি ভারতের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে:

'ঘৃতকুমারী (ধুনা হিসেবে ব্যবহৃত), সোনা, রুপা, মূল্যবান পাথর এবং মুক্তার ছড়াছড়ি।' তিনি 'কালিকটে মরিচ, লিক, আদা, বড় আকারের দারুচিনি, মিরোব্যালন (ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত শুকনো ফল ও শাঁস) এবং জিদোরিত (কবিরাজদের পছন্দের শুকনো শেকড়) প্রচুর্যে' সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছিলেন।

প্রাচুর্যের এসব কাহিনি ইউরোপীয়দের কল্পনাকে উস্কে দিয়েছিল।

৮ জুলাই ১৪৯৭ ভাস্কো দা গামার নৌবহর পর্তুগাল থেকে উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে আফ্রিকার পুব উপকূল ধরে মালিন্দিতে আসে। এরপর জনৈক স্থানীয় শাসকের জোগানো পাইলটের সহায়তায় অনুূকূল বাতাসে দক্ষিণ ভারতের পথ ধরে। আফ্রিকা থেকে মালাবারে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল মাত্র ২৩ দিন। 

তিনটা জাহাজ, একটা রসদবাহী জাহাজ এবং ১৭০ জনের একটা বাহিনীর নেতৃত্ব ছিলেন ভাস্কো দা গামা। আধুনিক সময়েরর বিচারে তো বটেই, এমনকি সেকালের হিসাবেও এসব জাহাজ ছিল খুদে আকারের। বহরের সবচেয়ে বড়, দা গামার ছয় পাল এবং তিন মাস্তুলের জাহাজ সাও গ্যাব্রিয়েলের দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ৮৪ ফুট। বিশাল ফো'ক্যাসল এবং লম্বা স্টার্ন জাহাজকে তুলনামূলকভাবে উঁচু ভাব দিয়েছিল, যা জাহাজকে বিশটা কামানের বাড়তি পাল্লা জুগিয়েছিল। জবরজং ধরনের হলেও শক্তিশালী ছিল জাহাজটা। 

অবিশ্বাস্যভাবে দা গামা এবং তার সহচরেরা ভারতে অবস্থানের পুরো সময় ক্রিশ্চান রাজার অধীনে ক্রিশ্চান এলাকায় থাকার কথা ধরে নিয়েছিলেন।

বিপজ্জনক কাজের জন্যে নেওয়া বেশ কয়েকজন দাগি আসামিও ছিল নৌবহরে। এদেরই একজন সম্ভবত আরবি জানা ধর্মান্তরিত ইহুদিকে তথ্যের খোঁজে তীরে পাঠানো হলে তাকে দুজন মুসলিম বণিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে নিয়ে যাওয়া হয়। আফ্রিকার ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের ওরানোর লোক ছিল তারা। কাস্টিলীয় ভাষায় অতিথিকে সম্ভাষণ জানিয়ে তারা নাকি চমকে দিয়েছিলেন:

'আরে! এখানে কেন এসেছ?'

জবাবে দাগি আসামি বলেছিল:

'ক্রিশ্চান আর মসলার খোঁজে।'

ইসলামের সাথে পর্তুগিজদের বিবাদের দীর্ঘ ইতিহাস ছিল। উত্তর আফ্রিকার মুসলিমরা শেষতক ১২৪৯ সালে পর্তুগাল থেকে বিতাড়িত হলেও লাগোয়া স্পেন থেকে বিতাড়িত হয় ১৪৯২ সালে। ইতিমধ্যে পুব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে তুর্কি সাম্রাজ্যের উত্থানের গতি বজায় ছিল। ১৪৫৩ সালে তুর্কিদের কন্সট্যান্টিনোপল বিজয় ইউরোপের ক্রিশ্চান সম্প্রদায়কে সতর্ক করে তোলে। ক্যাথলিক সংখ্যাগরিষ্ঠ পর্তুগাল ক্রিশ্চান ধর্ম এবং ইসলামের বিরোধকে শুভ-অশুভের লড়াই মনে করত। 

বার শতক থেকে শুরু করে পুবের ক্রিশ্চান সাম্রাজ্যগুলোয় গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ম্যাজাইদের উত্তরসূরি হিসেবে কথিত প্রেস্টর জন নামের এক সম্রাট নাকি পুবের বহু ক্রিশ্চান রাজার ওপর আধিপত্য বজায় রেখেছেন। এসব গুজব সম্ভবত ইথিওপিয়ায় সত্যিকারের ক্রিশ্চান রাজ্যের অস্তিত্বের কারণে ইন্ধন পায়। পনেরো শতকের গোড়ার দিকে পর্তুগিজ রাজকুমার হেনরি দ্য নেভিগেটর প্রেস্টর জনের রাজ্যে পৌঁছাতে পশ্চিম আফ্রিকার উপকূল বরাবর পথের খোঁজে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভিযানের আয়োজন করেন। তিনি ব্যর্থ হলেও এসব অভিযানই পর্তুগালের রাজাকে ভাস্কো দা গামাকে আরও পুবে পাঠাতে অনুপ্রাণিত করা আফ্রিকার দক্ষিণ চূড়ার খোঁজ পাওয়া বার্থেলেমিউ ডায়াসের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে পর্যবসিত হয়েছিল। গামার পটভূমি বা তাকে মনোনীত করার পেছনের কারণ সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না। সম্ভবত পর্তুগালের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এক খুদে জেলে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। ডিউকের অধীনে একজন নাইট তার বাবা সেখানকার গভর্নর ছিলেন। ১৪৯২ সালে পর্তুগালের রাজা দ্বিতীয় জন ভাস্কো দা গামাকে পর্তুগিজ জাহাজের বহরে হামলা চালানো ফরাসি নৌবহর দখলের দায়িত্ব দেন। তার কৃতিত্বই রাজার নজর কেড়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ভাস্কো দা গামার জন্ম বছর জানা না গেলেও পুবে রওনা দেওয়ার সময় তার বয়স সম্ভবত চল্লিশের নিচে ছিল।

নতুন বিশ্বে পা রাখার পথ আবিষ্কারের পর ইউরোপের দুটি নৌ পরাশক্তি স্পেন ও পর্তুগাল ১৪৯৪ সালে তর্দেসিলা চুক্তিতে সাক্ষর করে। পোপের আশীর্বাদপুষ্ট এই চুক্তি বিশ্বকে দুটি প্রভাব বলয়ে বিভক্ত করে— স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ। কেপ ভার্দে দ্বীপমালার আনুমানিক ১ হাজার মাইল পশ্চিমে, পশ্চিম আফ্রিকায় ছিল এই বিভক্তিরেখা। এই রেখার পশ্চিমের এলাকা ছিল স্পেনের, পুবের অংশ পর্তুগালের।

পর্তুগালের রাজা ইসলামবিরোধী যুদ্ধে প্রেস্টর জনের সাথে মৈত্রী স্থাপনের আশায় ছিলেন। পর্তুগিজদের পক্ষে মসলা কেনা সম্ভব হলে তাকে বিশেষভাবে স্বাগত জানানো হবে— কারণ, মসলা বাণিজ্য একদিকে পর্তুগালের সমৃদ্ধি ডেকে আনবে, অন্যদিকে মুসলিমদের রাজস্বের অন্যতম প্রধান উৎস থেকে বঞ্চিত করবে।

পর্তুগিজরা হাজির হওয়ার মুহূর্তে কালিকটের হিন্দু শাসক জামোরিন শহরের বাইরে থাকলেও ফিরে আসার পর ভাস্কো দা গামার সাথে দেখা করতে রাজি হন। নৌবহরকে পনেরো মাউলি উত্তরের পান্টালাইনি কোলামের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যেতে একজন পাইলটও পাঠান তিনি। ভারতে পৌঁছার এক সপ্তাহ পর অবশেষে তীরে নামেন ভাস্কো দা গামা।

দা গামা এবং তার জনা বারো সঙ্গীর সাথে জামোরিনের জনৈক দূত এবং একটি সশস্ত্র দল দেখা করেন। এরপর উৎসুক জনতার চোখের সামনে পালকিতে চড়ে কালিকটের পথ ধরেন তারা। মাঝপথে স্থানীয় এক অভিজাতের বাড়িতে যাত্রাবিরতি শেষে নৌকায় করে শহরের উদ্দেশে রওনা হন। নৌকা ছাড়ার পর একটা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। 

দা গামারই এক সহচরের লেখা বিবরণ থেকে সেটা হিন্দুদের মন্দির হওয়ার কথা স্পষ্ট। যাজকের ঊর্ধ্বাঙ্গে আড়াআড়িভাবে সুতো পরার কথা বলা আছে সেখানে। এবং দেয়ালে মুখের থেকে ইঞ্চিখানেক বাইরে উঁচিয়ে থাকা দাঁত এবং চার/পাঁচ হাতওয়ালা মুকুটধারী সাধুদের রংচঙা ছবিও ছিল। তবু দা গামা ও তার সঙ্গীরা ক্রিশ্চানদের দেখা পেতে উদ্গ্রীব ছিলেন বলে গির্জায় ঢুকেছেন ভেবে হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা শুরু করেন। 'এই দেশের ক্রিশ্চানরা কপাল, ঘাড়, বুক আর বাহুতে মাখতে অভ্যস্ত সাদা মাটিও' নিয়েছিলেন তারা। অবিশ্বাস্যভাবে দা গামা এবং তার সহচরেরা ভারতে অবস্থানের পুরো সময় ক্রিশ্চান রাজার অধীনে ক্রিশ্চান এলাকায় থাকার কথা ধরে নিয়েছিলেন। নিজেদের রাজার কাছে বিষয়টি নিশ্চিত করতে পর্তুগালে ফিরে যাবেন তারা। 

ঢাকঢোল বাজিয়ে জাঁকজমকের সাথে পর্তুগিজদের কালিকটের পথে নিয়ে যাওয়া হয়। বাড়িঘরের ছাদ আর বারান্দা ছিল লোকে লোকারণ্য। রাজপ্রাসাদে ঢোকার মুখের বিশাল জটলায় মারপিট লেগে গেলে বেশ কয়েকজন আহত হয়। 

প্রাসাদের ভেতরে সোনার নকশা করা ছাউনির নিচে সবুজ মখমলের গদিতে বসা জামোরিনের দেখা পান তারা। তার বাঁয়ে একটা সোনালি পিকদানি। বিরাট সোনার গামলা থেকে তাকে পান পরিবেশন করা হচ্ছিল। পর্তুগিজদের তিনি কলা এবং কাঁঠাল খেতে দিয়ে দা গামাকে একজন সভাষদের কাছে তার সফরের উদ্দেশ্য বয়ান করতে বলেন। ভাস্কো দা গামা পর্তুগালের রাজার প্রতিনিধি হওয়ায় সরাসরি জামোরিনের সাথে আলোচনার ওপর জোর দেন। দা গামা পর্তুগালের কথা বলার সময় মনোযোগ দিয়ে শোনেন জামোরিন।

'দোম মানুয়েল নামের এক রাজা পর্তুগাল শাসন করছেন। তিনিই তাকে তিনটা জাহাজ নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন। তাকে নৌবহরের ক্যাপ্টেন-মেজর মনোনীত করে ক্রিশ্চান রাজার সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত পর্তুগাল ফিরতে নিষেধ করেছেন, নইলে তার গর্দান কাটা যাবে। রাজদর্শন পেলে তাকে দেওয়ার জন্যে দুটো চিঠি দেওয়া হয়েছে, আগামীদিনই সেটা দেবেন তিনি। 

জামোরিন ছিলেন হিন্দু, আর দা গামাও স্থানীয় ভাষার মাথামুণ্ড কিছুই জানতেন না, তাই আঁচ করা যায় যে দা গামার ভাষ্য তর্জমায় বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। 

কিন্তু তার আনা উপহার নিয়ে জামোরিনের পুরোহিতদের সাথে বিরোধ বাধায় পরদিন ফেরত যাননি দা গামা। পর্তুগাল থেকে আনা ওয়াশবেসিন, টুপি, তেলের কাস্ক, মধু এবং কাপড় দেখে হাসিতে ফেটে পড়েছিলেন পুরোহিতরা। এসব জিনিস অগ্রহণযোগ্য বলে সোনা ছাড়া অন্য কিছু চলবে না, সাফ জানিয়ে দেন তারা। 

পরদিন জামোরিনের সাথে দেখা করেন দা গামা। বিনা উপহারে হাজির হওয়ায় দা গামার ধনী দেশ থেকে আসার কথা জামোরিনের বিশ্বাসই হচ্ছিল না। ফলে এই সাক্ষাৎ ছিল বেশ কষ্টকর। অবশ্য গামার কাছে থাকা আরবিতে লেখা একটা চিঠি তর্জমা করে পড়ে শোনানোর অনুমতি দেন তিনি। সম্ভবত চিঠির তোষামুদে ভাষার কারণেই দা গামাকে তার জাহাজের মামুলি রসদ খালাস করে বিক্রির অনুমতি দিয়েছিলেন। 

পান্টালাইনি কোলামে ফিরে আসে পর্তুগিজরা। এখানে উত্তেজনার চেয়ে বেশি কিছু ছিল। পর্তুগিজদের জাহাজে ফিরতে দিলে কর না মিটিয়েই তাদের পালিয়ে যাওয়ার ভয় ছিল জামোরিনের কর্মকর্তাদের। অন্যদিকে পর্তুগিজদের তাদের জিম্মি করার শঙ্কা ছিল। যা হোক, দুদিন বাদে পর্তুগিজরা জামানত হিসেবে কিছু পণ্য খালাস করায় ফায়সালা হয়। ভাস্কো দা গামা ও তার সঙ্গীরা জাহাজে ফেরার অনুমতি পান। 

কালিকট ও তার আশপাশের উপকূল এলাকা হিন্দু-অধ্যুষিত হলেও বহু মুসলিম বণিকও ছিলেন এখানে। এদের কেউ কেউ ছিলেন আরব, অন্যরা নিজেদের নবম শতকে বেপুর নদীতীরে বসতিকারী তোরোজন আরব বণিকের উত্তরসূরি দাবি করা মপলাস ইন্ডিয়ান। খোদ কালিকট বন্দর হিসেবে তেমন সুবিধার না হলেও ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে সব ধরনের বণিকদের নিরাপদ এবং সস্তা সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা দিয়েই মালাবার উপকূলের প্রধান বন্দরে পরিণত হয়েছিল। জনৈক আরব যেমন পর্যবেক্ষণ করেছেন:

'এই শহরের নিরাপত্তা এবং ন্যায়বিচার এমন সুপ্রতিষ্ঠিত যে সবচেয়ে ধনী বণিকেরা বিভিন্ন সমুদ্রতীরবর্তী দেশ থেকে উল্লেখযোগ পরিমাণ পণ্য নিয়ে আসেন। এগুলো খালাস করে হিসাব বা পণ্য পাহারা দেওয়ার কথা না ভেবেই বিভিন্ন বাজারে পাঠান।'

ভারত মহাসগরের উত্তর উপকূলীয় বিভিন্ন বন্দরের সাথে কালিকটের সিংহভাগ বাণিজ্য ছিল। মুসলিম বণিকেরা পর্তুগিজদের প্রতি ভীষণ বৈরী ছিলেন। এমন হতে পারে, আফ্রিকান উপকূলে ভাস্কো দা গামার নৌবহরের সাথে মুসলিমদের বেশ কয়েক দফা সংঘাতের খবর আগেই পেয়েছিলেন তারা। কিন্তু লোভনীয় মসলা বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়ও ছিল তাদের। পর্তুগিজদের অবশ্যই মুসলিমদের প্রতি কোনো দুর্বলতা ছিল না। পারস্পরিক এই বৈরিতার ফলে পান্টালাইনি কোলামের মুসলিম সম্প্র্রদায়ের কাছে পর্তুগিজ পণ্য কদর পায়নি। জনৈক নাবিক যেমন উল্লেখ করেছেন: 'আমাদের কেউ জমিনে পা রাখলেই থুতু ফেলে ওরা বলত, "পর্তুগাল পর্তুগাল।" সত্যি বলতে শুরু থেকেই আমাদের পাকড়াও করে হত্যার ফিকিরে ছিলো ওরা।'

পর্তুগিজদের পণ্য যাচাই করতে জামোরিন অন্য কয়েকজন বণিককে পাঠালে দা গামা প্রতিবাদ করেন। এই বণিকেরাও পণ্য পছন্দ করেননি, কিছুই কেনেননি তারা। বিক্রির জন্যে নিজ খরচে কালিকটে পণ্য পৌঁছে দিতে রাজি হন জামোরিন। তাতে কিছু পণ্য বিক্রি হলেও ভালো দাম মেলেনি। অবশ্য কিছু পরিমাণ লবঙ্গ, দারুচিনি এবং দামি পাথর কেনার মতো যথেষ্ট টাকা মিলেছিল। পর্তুগিজ ক্রুরা দু-তিনজনের একেকটি দলে তীরে নেমে ব্যক্তিগত কেনাবেচাও করেছে।

অবশ্য কেবল মুসলিমদের বেলাতেই নিষ্ঠুরতাকে সীমিত রাখেননি দা গামা। কোচিন থাকতেই এক হিন্দু পুরোহিত কালিকটের জামোরিনের তরফে একটা বার্তা নিয়ে এসেছিলেন। জ্বলন্ত কয়লায় দগ্ধ করার পর গুপ্তচরবৃত্তির স্বীকারোক্তি দিয়ে আত্মহত্যার সুযোগ চান তিনি। কিন্তু দা গামা সেই আবেদন অগ্রাহ্য করে জামোরিনের কাছে জবাব পাঠাতে তার একজন লোকের প্রয়োজনের কথা বলেন। ঠোঁট কেটে কানের জায়গায় জাহাজের একটা কুকুরের কান লাগিয়ে ব্রাহ্মণকে আবার কালিকটে ফেরত পাঠানো হয়।

১৩ আগস্ট ১৪৯৮ ভারতে পৌঁছানোর প্রায় তিন মাস পর ভাস্কো দা গামা জামোরিনকে কিছু উপহার পাঠিয়ে পর্তুগালে ফেরার ঘোষণা দেন। তার সাথে কয়েকজন দূত দিলে তিনিও অবিক্রিত মালসামানের পাহারায় কয়েকজন পর্তুগিজকে রেখে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। খালাস করা পণ্যের বিনিময়ে রীতি মোতাবেক কর দাবি করেন জামোরিন। দা গামা পালিয়ে যেতে পারেন ভেবে তীরে নামা পর্তুগিজদের পাহারার ব্যবস্থা করে নৌকা নিয়ে জাহাজে যাওয়া নিষিদ্ধ করেন তিনি।

কিছু বণিক অবশ্য জামোরিনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে পর্তুগিজদের সাথে বাণিজ্য চালিয়ে যান। তাদের আঠারোজনকে জিম্মি করেন ভাস্কো দা গামা। জটিল দর-কষাকষির পর পর্তুগিজ পণ্যের বিনিময়ে বন্দী হস্তান্তরের রফা হয়। পর্তুগালের রাজার কাছে পৌঁছে দিতে একটি চিঠিও পাঠান জামোরিন। 

'আপনার রাজ্যের এক ভদ্রলোক ভাস্কো দা গামা আমার দেশে আসায় আমি অনেক খুশি হয়েছি। আমার দেশ দারুচিনি, লবঙ্গ, আদা, মরিচ এবং মূল্যবান পাথরে সমৃদ্ধ। সোনা, রুপা, প্রবাল এবং লাল কাপড়ের সাথে এসব বিনিময় করার প্রস্তাব রাখছি।'

পর্তুগিজরা আপসরফার মর্যাদা রাখেনি। কিছু পণ্য ফেলে ২৯ আগস্ট ১৪৯৮ ছয়জন ভারতীয় জিম্মিসহই পর্তুগালের পথ ধরে তারা। পরদিন কালিকটের অদূরে প্রায় সত্তরটা জামোরীয় জাহাজ তাদের নৌবহরে হামলা চালাতে হাজির হয়। সৌভাগ্যক্রমে সহসা বজ্রঝড় শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত কামানের গোলা ছুড়ে পর্তুগিজরা তাদের প্রতিহত করে অবশেষে পালিয়ে যায়। 

ভাস্কো দা গামার ফিরতি যাত্রায় হাওয়া ছিল প্রতিকূল। সাগরপথে পুব আফ্রিকায় যেতে প্রায় তিনমাস লেগে যায়। নাবিকদের অনেকেই খোসপাচড়ায় ভুগে প্রাণ হারায়। বাকিদের অবস্থা এমন শোচনীয় ছিল যে অল্প কয়েকজনই কাজ করার মতো সুস্থ ছিল। পুব আফ্রিকার মোম্বাসায় কাজের লোকের ঘাটতি দেখা দেওয়ায় দা গামা বাকি দুটো জাহাজ চালাতে একটা জাহাজ পুড়িয়ে দেন। মূল নাবিক দলের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ প্রাণ নিয়ে পর্তুগালে ফিরতে পেরেছিল।

বিপুল অভ্যর্থনার ভেতর দেশে ফেরেন ভাস্কো দা গামা ও তার বাহিনী। ভারত যাওয়ার সাগরপথের খোঁজ পেয়েছেন তারা, ক্রিশ্চানদের (কিংবা তাই ভেবেছিলেন তারা) দেখা পেয়েছেন এবং মূল্যবান সামগ্রী ফিরিয়ে এনেছেন। পর্তুগিজ নৌবাহিনীর মোকাবিলা করার মতো বিশাল কোনো নৌবহর দেখেননি তারা। সুতরাং পর্তুগালের পক্ষে ভারত মহাসাগরের বাণিজ্য এবং নৌচলাচল পথের দখল নেওয়া অনায়াস হবে বলেই মনে হয়েছে। পর্তুগালের রাজা খুশি হয়ে 'লর্ড অব গিনি অ্যান্ড অব দ্য কনকোয়েস্ট, নেভিগেশন, অ্যান্ড কমার্স অব ইথিওপিয়া, আরব, পার্সিয়া অ্যান্ড ইন্ডিয়া' নামে বাড়তি খেতাব গ্রহণ করেন। দা গামার অভিযানের আশু লক্ষ্য মুনাফা না হলেও মসলা এবং অন্যান্য পণ্য, যার বেশিরভাগই ভারত থেকে এসেছে, বিক্রি থেকে বিপুল অর্থ— অভিযানের মোট খরচের প্রায় ষাট গুণ পাওয়া যায়! পর্তুগালের পক্ষে বিপুল সম্পদ অর্জনের পাশাপাশি ইসলামের ওপর আঘাত হানার সুযোগ পাওয়ার আশায় রাজা অবিলম্বে আরেকটা অভিযানের নির্দেশ দেন। স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দ এবং রানি ইসাবেলাক তিনি লেখেন:

'এসব অভিযাত্রীর দেখা ক্রিশ্চানরা বিশ্বাসের বিচারে এখনো অতটা শক্তিশালী নয়...কিন্তু তাদের বিশ্বাস সংহত হলে, এই অঞ্চলের মুরদের ধ্বংস করার একটা সুযোগ তৈরি হবে। এছাড়া ঈশ্বরের সহায়তায় এখন মুরদের সমৃদ্ধ করে তোলা বিপুল বাণিজ্য...আমাদের নিজস্ব অঞ্চলের আনাড়ি এবং জাহাজের হাতে আসবে।'

১৫০০ সালের মার্চ। ভাস্কো দা গামার প্রত্যাবর্তনের মাত্র ছয় মাস পর পেদ্রো আলবারেস ক্যাব্রালের অধীনে তোরোটি সশস্ত্র পর্তুগিজ জাহাজের একটা বহর ভারতের পথে নামে। দুর্র্ভাগ্য ছিল এর নাছোড় সঙ্গী। কিছু পথহারা হয়ে দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলের দিকে ভেসে যায়; চারটা জাহাজ আফ্রিকার চূড়ার কাছে ঝড়ে ডুবে যায় এবং জাহাজের আরোহীদের সলিল সমাধি ঘটে। অবশিষ্ট ছয়টি জাহাজ ১৩ সেপ্টেম্বর ১৫০০ কালিকটের অদূরে নোঙর ফেলে। ভাস্কো দা গামার সাথে দেখা হওয়া সেই জামোরিনের এক উত্তরসূরি অভিযানের ক্ষমতা জেনে পর্তুগিজদের বাণিজ্য কেন্দ্র বা 'কারখানা' স্থাপনের অনুমতি দেন। 

অবশ্য আবারও পর্তুগিজ ও আরবদের ভেতর বিরোধ বাধে। পর্তুগিজরা মরিচ কেনার একক কর্তৃত্ব পাওয়ার দাবি করায় বিরোধ আরও প্রবল হয়ে ওঠে। পর্তুগিজরা বন্দরের একটা আরব জাহাজ দখল করে বসলে ক্লাইমেক্সে পৌঁছায় ঘটনাপ্রবাহ। দাঙ্গায় তিরিশ থেকে চল্লিশজন পর্তুগিজ নিহত হয়। কালিকটে বোমাবর্ষণের হুকুম দিয়ে বসেন ক্যাব্রাল। বন্দরের কিছু জাহাজও দখল করে তিনটা হাতিসহ রসদপত্র ছিনিয়ে নেন। হাতিগুলোকে পরে হত্যা করে ফিরতি যাত্রার জন্যে লবণ মাখিয়ে মজুত করা হয়েছিল। জাহাজের ক্রুদেরও হত্যা করা হয়। শহরের ওপর দুদিন স্থায়ী গোলাবর্ষণে বহু কাঠের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়, বহু বাসিন্দা প্রাণ হারান। কালিকাতবাসীর সৌভাগ্য, কামানের প্রবল ধাক্কায় ক্যাব্রালের জাহাজও ক্ষতিগ্রস্ত হলে বৈরিতা ভুলে কেটে পড়তে বাধ্য হন তিনি। 

এরপর কোচিনের এক শ মাইল দক্ষিণে চলে আসেন ক্যাব্রাল। জামোরীয় দরবারের প্রতিদ্বন্দ্বী কোচিনের রাজা পর্তুগিজদের মেহমানদারিতে সুযোগ দেখে তাদের মসলা কেনার এবং কারখানা স্থাপনের অনুমতি দেন। দুই সপ্তাহের ভেতর ক্যাব্রালের জাহাজগুলো সম্পূর্ণ বোঝাই হয়ে যায়। তখনই কালিকটের জামোরিনের নৌবহরের হামলা চালাতে উপকূল ধরে ছুটে আসার খবর আসে। রাতের অন্ধকারে তাড়াহুড়ো করে কারখানায় তিরিশজন পর্তুগিজকে ফেলে পালিয়ে যান ক্যাব্রাল। পরদিন ক্যাব্রাল ও জামোরিনের নৌবহর পরস্পরের দেখা পেলেও যুদ্ধে নামার আগেই বাতাস পড়ে যায়। বাতাস বইতে শুরু করলে পালিয়ে যান ক্যাব্রাল। 

দেশে ফেরার আগে কালিকটের আশি মাইল উত্তরের কান্নানোরে যাত্রা বিরতি করেছিল পর্তুগিজরা। শাসকের আমন্ত্রণে তারা আরও মসলা বোঝাই করে। ফিরতি যাত্রায় আরও একটি জাহাজ ধ্বংস হয়। ৩১ জুলাই ১৫০১ লিসবনে পৌঁছান ক্যাব্রাল। আদি তেরোটি জাহাজের ভেতর মাত্র পাঁচটি জাহাজ ফিরে এলেও সেগুলোর বহন করা মসলা ক্ষতির চেয়ে বেশি লাভ জুগিয়েছে। অভিযানের সহযাত্রী ফ্রান্সিস্কান যাজক হিন্দু ও ক্রিশ্চানের ভেতর পার্থক্য আবিষ্কার করেছিলেন। মৈত্রীস্থাপনের মতো রাজ্য না থাকায় (যদিও বিভিন্ন জায়গায় সিরিয়াক ও অন্যান্য ক্রিশ্চান ছিল এবং ক্রানগানোরের দুজন ক্রিশ্চান ক্যাব্রালের সাথে দেখা করতে এসেছিল) রাজাকে মালাবার উপকূলের হিন্দু শাসকদের সাথে রফা করার পরামর্শ দেন ক্যাব্রাল। 

কালিকটের জামোরিনের সাথে ক্যাব্রালের গুরুতর বাজে সম্পর্ক ছিল। কিন্তু কান্নানোর এবং কোচিনের রাজার সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন তিনি। কালিকটের উপযুক্ত বন্দরের অভাব থাকলেও কোচিনের বন্দর ছিল অসাধারণ। সেই সাথে শক্তির বিচারেও কোচিন কালিকটের চেয়ে এগিয়ে ছিল। তারা পর্তুগিজদের সাথে মৈত্রী স্থাপনেও উৎসাহী ছিল। কোচিন মালাবারে পর্তুগিজদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হতে যাচ্ছিল।

ক্যাব্রাল ফিরে আসার ছয় মাস পর, ১০ফেব্রুয়ারি ১৫০২ পনেরোটি জাহাজ নিয়ে পর্তুগাল থেকে আবার মালাবারের পথ ধরেন ভাস্কো দা গামা। পুব আফ্রিকার কাছে আরও পাঁচটি জাহাজের একটি বহর যোগ দেয় তার সাথে। এখন মালাবারে শক্তিশালী ক্রিশ্চান রাজ্যের অস্তিত্ব না থাকার কথা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ায় অভিযান ছিল মূলত বাণিজ্যিক। তবু ভারতের সাথে বাণিজ্য রাজার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে থাকার ব্যাপারে নিশ্চিত থাকায় খোদ পর্তুগালের রাজার হুকুমে অভিযান শুরু হয়েছিল। 

মালাবার উপকূল ধরে এগোনোর সময় ভাস্কো দা গামার নৌবহর মক্কা থেকে তীর্থযাত্রীদের নিয়ে আসা মিরি নামের একটি জাহাজের মুখোমুখি হয়। পর্তুগিজরা ওই জাহাজে চাপলে কয়েকজন ধনী বণিক দা গামার সাথে মুক্তিপণের বিষয়ে ফায়সালার চেষ্টা করেন, কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। কিছু মূল্যবান পণ্য পর্তুগিজদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তারা জাহাজের মজুত থেকেও বেশ কিছু পণ্য ছিনিয়ে নেয়। এসব পণ্য খালাসের পর ভাস্কো দা গামা তার লোকদের মিরিতে আগুন লাগানোর নির্দেশ দেন। জাহাজের ক্রু এবং তীর্থযাত্রীরা আগুন নিভিয়ে ফেললে গামার লোকজন আবার জাহাজে আগুন ধরাতে ফিরে যায়। জনৈক পর্তুগিজ প্রত্যক্ষদর্শী নারীদের জীবন বাঁচাতে পরনের অলংকার দোখানোর কথা বলেছেন। কোলের শিশুদের তুলে ধরে 'ওদের দয়া করার' কথা বলেছে। আরেক পর্তুগিজ প্রত্যক্ষদর্শী নেহাত সত্য ঘটনা তুলে ধরেছে:'মক্কা থেকে আসা একটা জাহাজ দখল করে নিই আমরা। ওই জাহাজে ৩৮০ জন পুরুষ এবং প্রায় সমানসংখ্যক নারী-শিশু ছিল। প্রায় ১০ হাজার দুকাত দামের সামগ্রীসহ আরও ১২ হাজার দুকাত নিয়েছি জাহাজ থেকে। সমস্ত যাত্রীসহ জাহাজটা গানপাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দিই।' 

পর্তুগিজ নৌবহর এরপর কালিকটের অদূরে নোঙর ফেলে। ক্যাব্রালের হাতে শহরের ক্ষতির কথা ভেবে এবং মিরির পরিণতি জানা থাকায় শান্তি প্রস্তাব পাঠান জামোরি। জবাবে ক্যাব্রালের লোকদের হারানো পণ্যের ক্ষতিপূরণ এবং সকল আরব বণিকের বিতাড়ন দাবি জানান দা গামা। জবাবে যথেষ্ট যুক্তির সাথেই জামোরিন বলেন, কালিকটই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং মিরির সম্পদ পর্তুগিজদের হারানো সম্পদের চেয়ে ঢের বেশি মূল্যবান। তিনি কয়েক হাজার আরবকে বহিষ্কারের দাবি উপেক্ষা করেন। জামোরিন তার শর্ত না মানায় পরদিন কালিকচ শহরে গোলাবর্ষণের ঘোষণা দেন দা গামা। 

পর্তুগিজরা বেশ কিছু ছোট ছোট জাহাজ এবং সেগুলোর ক্রুদের আটক করে। ১ নভেম্বও ১৫০২ দুপুরে বন্দীদের ফাঁসিতে ঝোলায় তারা। চৌত্রিশ জন নাবিককে হত্যার পর ফাঁসিকাঠ থেকে নামিয়ে হাত-পা কেটে নৌকায় স্তূপ করে রাখা হয়। একটা বার্তাসহ বন্দরের দিকে ভেসে গেছে নৌকাগুলো: ক্যাব্রালের লোকদের আসল ঘাতকেরা আরও নির্মম মৃত্যুর কথা ভাবতে পারে। এসব নিরীহ মানুষের খণ্ডিত লাশ পরে সাগরে ফেলে দেওয়া হলে স্রোতের টানে তীরে ভেসে গেছে। তারপর শুরু হয় কালিকটের ওপর গোলাবর্ষণ। 

পরদিন জামোরিনের সাথে দেখা করেন দা গামা। বিনা উপহারে হাজির হওয়ায় দা গামার ধনী দেশ থেকে আসার কথা জামোরিনের বিশ্বাসই হচ্ছিল না।

ষোলো শতকের ইউরোপীয় জাহাজে ভারী কামান ছিল না। রট আয়রনের সরু খণ্ড থেকে এগুলোর ব্যারেল তৈরি হতো। এই জাতীয় কামান বেশি গানপাউডার ধারণ করতে না পারায় এগুলোর পাল্লা ছিল দুই হাজার গজের মতো। ক্যাব্রালের বোমাবর্ষণের শিকার জামোরিন আগেই তালগাছের গুঁড়ি দিয়ে শহর প্রতিরক্ষা প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন। তবে তার গোলাবারুদের মজুত ছিল নগণ্য। ফলে দা গামা অনায়াসে তার জাহাজবহর তীরের বেশ কাছে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। সেদিন এবং তার পরদিন শহরের বিপুল ক্ষতি সাধন করেন তিনি। দা গামা এরপর শহর অবরোধের লক্ষ্যে ছয়টি জাহাজ ফেলে কোচিনের পথ ধরেন। 

দা গামার বিদায়ের পর কান্নানোরের রাজার বার্তা নিয়ে একটা জাহাজ হাজির হয়। জনৈক আরব বণিক নাকি দেনা না মিটিয়েই বন্দর ছেড়ে গেছেন। পলাতক বণিককে পাকড়াও করতে দা গামা তার একটি জাহাজ পাঠান। তখন তিনি দেনা শোধ করলেও রাজাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন। পর্তুগিজরা তাকে মেরে অচেতন করে মুখে মল আর শুয়োরের মাংস ঠেসে জাহাজে ফেরত পাঠায়। 

কোচিনে ভাস্কো দা গামা স্বভাবের বাইরে গিয়ে রাজার সাথে সুসম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করেন। কালিকটের ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মুসলিম বণিকেরা বৈরী ছিলেন। দা গামা হিন্দু শাসকের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে একটা গরু বাঁচিয়ে মুসলিমদের আরও দূরে ঠেলে দেন। কয়েকজন মুসলিম পর্তুগিজদের কাছে গরু বিক্রি করায় হিন্দু রাজা দা গামার কাছে প্রতিবাদ জানান। মুসলিমরা আবারও গরু বিক্রি করতে এলে দা গামা তাদের ধরে কর্তৃপক্ষের হাতে সোপর্দ করলে সবাইকে হত্যা করা হয়। 

অবশ্য কেবল মুসলিমদের বেলাতেই নিষ্ঠুরতাকে সীমিত রাখেননি দা গামা। কোচিন থাকতেই এক হিন্দু পুরোহিত কালিকটের জামোরিনের তরফে একটা বার্তা নিয়ে এসেছিলেন। জ্বলন্ত কয়লায় দগ্ধ করার পর গুপ্তচরবৃত্তির স্বীকারোক্তি দিয়ে আত্মহত্যার সুযোগ চান তিনি। কিন্তু দা গামা সেই আবেদন অগ্রাহ্য করে জামোরিনের কাছে জবাব পাঠাতে তার একজন লোকের প্রয়োজনের কথা বলেন। ঠোঁট কেটে কানের জায়গায় জাহাজের একটা কুকুরের কান লাগিয়ে ব্রাহ্মণকে আবার কালিকটে ফেরত পাঠানো হয়। 

কোচিনে পর্তুগিজরা মসলা কিনতে এবং জাহাজ মেরামতে সক্ষম হয়। কোচিনকে কুইলন এবং অন্যান্য দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর থেকে মসলা সংগ্রহের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছিল তারা। কান্নানোরে গিয়ে সেখানকার বন্দর ব্যবহারের লক্ষ্যে শাসকের সাথে চুক্তিও করেছে। অবশেষে কোচিন থেকে বিদায় নেওয়ার আগে রাজার সাথে পর্তুগিজ কারখানা নির্মাণের আনুষ্ঠানিক চুক্তি করেন ভাস্কো দা গামা। ভবিষ্যতের অভিযানের জন্যে মসলা কেনার নির্দেশ দিয়ে কেরানি, শ্রমিক, প্রহরীসহ একজন প্রতিনিধি রেখে যান। 

কান্নানোর থেকে আদা সংগ্রহের জন্য উত্তরে যাওয়ার পথে কালিকটের জামোরিনের পাঠানো বত্রিশটা বিশাল জাহাজের এক বিরাট নৌবহরের হামলার মুখে পড়ে ভাস্কো দা গামার জাহাজ। প্রতিটি জাহাজে ছিল কয়েক শ লোক এবং অসংখ্য ছোট ছোট জাহাজ। জামোরিনের জাহাজ পর্তুগিজদের জাহাজের কাছে পৌঁছাতে পারলে হয়তো সহজেই তাদের পরাস্ত করতে পারত। কিন্তু পর্তুগিজদের অপেক্ষাকৃত ভারী কামান আবারও শত্রুকে ঠেকিয়ে দেয়। জামোরিনের বহু জাহাজ ডুবে যায়। অন্য জাহাজগুলোয় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। জামোরিনের চোখের সামনে পুড়ে ছাই হতে কালিকটের বন্দরের দিকে ভেসে যায় সেগুলো। 

কান্নানোরে এসে মসলা বোঝাই করে কারখানা চালাতে এবং ভবিষ্যতের জন্যে আরও মসলা সংগ্রহ করতে লোকজন রেখে বিদায় নেন দা গামা। কান্নানোর এবং কোচিনের কারখানা পাহারা দিতে চাচা ভিনসেন্ট সোদরের অধীনে পাঁচটি জাহাজও রেখে যান। ২৮ ডিসেম্বর ১৫০২ পর্তুগালের পথে রওনা হন তিনি। 

১৫২৪ সালে দা গামা অল্প সময়ের জন্যে আবার ভারতে ফিরে আসেন। এর মাত্র তিন মাস পর মারা যান তিনি। কোচিনের সান্তা আন্তোনিও, পরে সেইন্ট ফ্রান্সিসে কবর দেওয়া হয় তাকে। ১৫৩৯ সালে তার লাশ পর্তুগালে নিয়ে যাওয়া হয়। 

[রয় মক্সহ্যামের দ্য থেফট অব ইন্ডিয়া গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় অবলম্বনে]

Related Topics

টপ নিউজ

ইজেল / পর্তুগিজদের অত্যাচার / ইউরোপীয়দের আগমন / ভাস্কো দা গামা / উপনিবেশ

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.

MOST VIEWED

  • দেশের ৫টি ব্রান্ডের চিনিতে মিলল মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি
    দেশের ৫টি ব্রান্ডের চিনিতে মিলল মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি
  • ইউরোর বিপরীতে রুবলের দাম পাঁচ বছরের সর্বোচ্চ রেকর্ডের কাছাকাছি
  • সাপের জন্য ভালোবাসা!
  • ৪৪ বিলিয়ন ডলারে টুইটার কেনা স্থগিত করলেন ইলন মাস্ক
  • রিজার্ভ বাঁচাতে কঠোর নিয়ন্ত্রণে সরকার, স্থগিত রাখা হবে বেশকিছু উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ
  • ভারতে গ্রেপ্তার পি কে হালদার

Related News

  • বুড়িগঙ্গা!
  • ঢাকার হারানো পাখি, দৃশ্যমান পাখি
  • খেজুর: সুস্বাদু ঐতিহ্যের ছয় হাজার বছরের ধারাবাহিকতা
  • খেজুর কি সবচেয়ে প্রাচীন ফল?
  • পূর্ববঙ্গের এক কিংবদন্তি ঠগি কাহিনি

Most Read

1
দেশের ৫টি ব্রান্ডের চিনিতে মিলল মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি
বাংলাদেশ

দেশের ৫টি ব্রান্ডের চিনিতে মিলল মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি

2
আন্তর্জাতিক

ইউরোর বিপরীতে রুবলের দাম পাঁচ বছরের সর্বোচ্চ রেকর্ডের কাছাকাছি

3
ফিচার

সাপের জন্য ভালোবাসা!

4
আন্তর্জাতিক

৪৪ বিলিয়ন ডলারে টুইটার কেনা স্থগিত করলেন ইলন মাস্ক

5
অর্থনীতি

রিজার্ভ বাঁচাতে কঠোর নিয়ন্ত্রণে সরকার, স্থগিত রাখা হবে বেশকিছু উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ

6
বাংলাদেশ

ভারতে গ্রেপ্তার পি কে হালদার

The Business Standard
Top

Contact Us

The Business Standard

Main Office -4/A, Eskaton Garden, Dhaka- 1000

Phone: +8801847 416158 - 59

Send Opinion articles to - oped.tbs@gmail.com

For advertisement- sales@tbsnews.net

Copyright © 2022 THE BUSINESS STANDARD All rights reserved. Technical Partner: RSI Lab