চিকা মারার সেই দিনগুলো...
ডাউন উইথ আইয়ুব—লেখা হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। জিপিওর উল্টো দিকের দেয়ালে। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম মনে করতে পারেন, ঢাকায় আইয়ুববিরোধী প্রথম দেয়াললিখন এটি। মার্শাল ল চলাকালে এমন একটি কাণ্ড যে বেশ আলোড়ন তুলবে, তা বলা বাহুল্য। সেলিম তখন ঢাকা কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র। সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের ছাত্র ছিলেন। এসএসসিতে স্ট্যান্ড করেছিলেন; কিন্তু রাজনীতি করবেন বলে মনস্থির করায় নটর ডেম কলেজে ভর্তি হননি। ঢাকা কলেজে বিকল্প পদ্ধতি খোলা ছিল। যেমন ছাত্র ইউনিয়নপন্থী ছাত্রসমাজ সংঘবদ্ধ ছিল অগ্রগামী নামে আর ছাত্রলীগ ছিল জাগরণী নামে। সে সময় দেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই প্রকাশ্যে ছাত্ররাজনীতির সুযোগ ছিল না।
ঢাকাবাসী চমকে গিয়েছিল
স্কুলে থাকতেই সেলিম সমাজ পরিবর্তনের আদর্শের সংস্পর্শে আসেন; তবে রাজনীতিতে সক্রিয় হন মেট্রিক পাস করার পর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা আর মধুর ক্যানটিন ছিল ছাত্ররাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। প্রকাশ্যে যেহেতু ছাত্রসংগঠন করা যায় না, তাই গোপনে হারিকেনের আলোয় হতো কর্মিসভা বা পাঠচক্র। বিশেষ বিশেষ দিবস যেমন খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড (১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলে বামপন্থী নেতা-কর্মীদের ওপর সংগঠিত নির্বিচার হত্যাকাণ্ড) দিবস বা মে দিবস পালিত হতো অতি সংগোপনে। তখন কমিউনিস্ট পার্টিও ছিল নিষিদ্ধ, কর্মীরা ছিলেন আন্ডারগ্রাউন্ডে। গোপনে পার্টি কর্মীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করত। কখনো কখনো নিজ উদ্যোগে চলে যেতেন শ্রমিক এলাকায়। রাজনীতি করাই যেহেতু ছিল তার প্রধান লক্ষ্য, তাই কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিলেন সর্বদা।
এ জন্য ভুগতেও হয়েছে; আর তার শুরু কলেজ থেকেই। সরকারি কলেজগুলোয় বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা এলে সেলিমরা একে সরকারের শিক্ষা সংকোচন নীতির অংশ হিসেবে দেখলেন এবং আন্দোলনও গড়ে তোলেন। আন্দোলনের মুখে সরকার ঘোষণা থেকে সরে এলেও সেলিমসহ চারজনকে ঢাকা কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তারা পরে জগন্নাথ কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন।
১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণা করেন শেখ মুজিবুর রহমান। কমিউনিস্ট পার্টি এবং ছাত্র ইউনিয়ন একে মুক্তির সনদ না মানলেও স্বাধিকারের সনদ হিসেবে গ্রহণ করে এবং কর্মীদের এর সঙ্গে থাকার জন্য বলে। সেলিমও পার্টির সিদ্ধান্ত মেনে ছয় দফার পক্ষে অবস্থান নেন। আর সেই বছরই ঢাকায় দেয়ালে প্রথম আইয়ুববিরোধী দেয়াললিখন দেখতে পাওয়া যায়। আইয়ুববিরোধী এমন দুঃসাহস ঢাকাবাসীকে চমকে দিয়েছিল। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা দেখিয়েছিলেন সে দুঃসাহস। দেয়াললিখিয়ে দলের একজন ছিলেন সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক। সেলিম বললেন, সারা রাত চিকা মেরে যখন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীরা একটু বেলা করে মধুর ক্যানটিনে পৌঁছাল, ততক্ষণে ঘটনাটি রাষ্ট্র হয়ে গেছে। ছাত্রলীগের কর্মীরা এমন ভাব দেখাতে লাগল যে এ দুঃসাহসী কাজটি তারাই করেছে। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের ওদিকে মাথার চুল ছেঁড়ার দশা। তারা বলতেও পারছে না কাজটি তারাই করেছে, আবার ছাত্রলীগকে মিথ্যা কৃতিত্ব দিতেও বাধছে। কিন্তু উপায় ছিল না বলে হজম করতে হলো।
আটষট্টি সালে প্রথমবারের মতো কারাবন্দী হন সেলিম। তারপর আরও কয়েক দফা কারাবরণ করেছেন। জেলখানায় থাকার সময় সমমনা সহবন্দীদের নিয়ে পয়লা মে বা একুশে ফেব্রুয়ারিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। গাছের পাতা দিয়ে রং বানিয়ে তখন কারাপ্রাচীরে চিকা মারা হতো।
পূর্বদেশের কাগজ ছিল ভালো
বাংলাদেশ সাম্যবাদী দলের সমন্বয়ক শুভ্রাংশু চক্রবর্তী বাষট্টি সালে প্রথম মিছিলে যান শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে। 'বইপত্রের দাম কমাও', 'শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না' ইত্যাদি স্লোগান দিয়েছিলেন। তখন তিনি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম মহকুমার লালমনিরহাট থানায় ছিল তাদের বাড়ি। গত শতকের শুরু থেকেই লালমনিরহাট ছিল রেলওয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। অনেক নন-বেঙ্গলি সেখানে কর্মরত ছিলেন। লালমনিরহাটবাসী তাদের অশোভন, অশালীন আচার-আচরণে যারপরনাই ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাই জাতীয়তাবাদী কোনো আন্দোলনে লালমনিরহাটে উৎসাহ দেখা দিত।
বাষট্টি সালের সেদিনটির কথা। বৃষ্টি হচ্ছিল জোর। ক্লাসের ক্যাপ্টেন শুভ্রাংশুদের বলেছিল, ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে গুলি করা হয়েছে, তোমরা কি রেলপথ অবরোধ কর্মসূচিতে যোগ দিতে চাও? যারা রাজি হয়েছিল, তারা রাজারহাট রেলস্টেশন পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে রেললাইনের ওপর শুয়ে পড়েছিল। তখনকার লালমনিরহাট ছিল পাড়াগাঁ। দেয়াল বেশি ছিলই না, তাই দেয়াললিখনের প্রশ্ন আসে না। তবে পোস্টার লেখা হতো। খাগড়ার কলম দোয়াতে চুবিয়ে লেখা হতো দাবিনামা। কালো কালির বড়ির দাম ছিল ২ পয়সা, লাল কালির বড়ি ১ আনা। পোস্টারের কাগজ হিসেবে ব্যবহৃত হতো ছাপা পত্রিকাও; যেহেতু লেখা হতো মোটা হরফে, তাই পড়তে অসুবিধা হতো না। পূর্বদেশ পত্রিকার কাগজ পোস্টারের জন্য তুলনামূলক ভালো ছিল দৈনিক আজাদের চেয়ে। তবে এগুলো করা হতো খুবই গোপনে; কারণ, চৌকিদার দেখে ফেললে থানায় খবর পৌঁছাত, থানা থেকে খবর দিত বাড়িতে। বলা হতো, ছেলেটা তো ভালো, কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গোল্লায় যাচ্ছে, একটু দেখে রাখবেন।
পয়ষট্টি সালে শুভ্রাংশু ভর্তি হন কুড়িগ্রাম কলেজে। ছেষট্টিতে তিনি সচেতনভাবে আওয়ামী ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। যেহেতু কলেজে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ছিল, তাই ছাত্রসেবক নামের সংগঠনের মধ্য দিয়ে তৎপরতা চালিয়ে যান। আটষট্টি সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে ছাত্র আন্দোলন পূর্ণোদ্যমে বেগবান হয়। সেটা ছিল এমন সময়, যখন সারা পূর্ব বাংলায় আইয়ুব শাহির ত্রাসের রাজত্ব চলছে। আওয়ামী লীগ করা মানে বিপদগ্রস্ত, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য মানে আন্ডারগ্রাউন্ড অথবা জেলখানা। শুভ্রাংশু চক্রবর্তী বললেন, আসলে ছাত্রলীগই দাঁড় করিয়েছে আওয়ামী লীগ। স্কুলশিক্ষক, কলেজশিক্ষক আর নতুন উকিলদের সংগঠন ছিল আওয়ামী লীগ। ছাত্রলীগ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে উনসত্তরে। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ছাত্রলীগের বিস্তৃত ঘটায়। সেই সময়ও কিন্তু সাংগঠনিক শক্তি ভালো ছিল ছাত্র ইউনিয়নের; এমনকি দুই ভাগ হয়ে যাওয়ার পরেও। যত দূর মনে পড়ছে, কুড়িগ্রামের কোনো কোনো দেয়ালে 'স্বাধীন পূর্ব বাংলা' কথাটি এক-দুবার দেখা গেছে। বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন এসব চিকা লিখেছিল বলে জানতে পেরেছিলাম। তবে ঢাকায়ই চিকা মারা হতো, আর্ট ইনস্টিটিউটে ছাত্র ইউনিয়নের বড়সড় সমর্থক গোষ্ঠী ছিল। তারা বেশ সক্রিয় ছিল।
শরীর ভালো? চিকা মারতে যাবি?
চিকা মারা প্রবচনের প্রচলন ঘটেছিল ষাটের দশকের শেষ দিকেই। আইয়ুব আমলে বাক্স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না বললেই চলে। তখন দেয়াল হয়ে উঠেছিল দাবি প্রকাশের মাধ্যম। কিন্তু তা-ও করতে হতো অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে, সরকারি নজরদারি এড়িয়ে। চার থেকে ছয়জনের দল থাকত। দিনের বেলা ঘুরে ঘুরে দেয়াল বাছাই করা হতো। রাতে বালতি, ব্রাশ নিয়ে বের হতো দেয়াল লেখার দল। কীভাবে দেয়াল লেখা চিকা মারায় পরিণত হলো, তার বর্ণনা দিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বললেন: দেয়ালের দুই পাশে দুজন পাহারায় থাকত, দুজন দ্রুত হাতে দেয়ালে রং লেপত ও কথা লিখত। এর মধ্যে পুলিশ আসার শব্দ পেলেই পাহারাদাররা বলে উঠত, ওই চিকা চিকা ধর ধর। মানে পুলিশকে বোঝাত চিকা বলে। চিকা মারার জন্যই তারা রাতের ঘুম হারাম করছে। পরের দিন আবার একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করত, কিরে শরীর ভালো? চিকা মারতে যাবি? চিকা মারা কথাটা এভাবে দেয়াললিখনের প্রতিশব্দ হয়ে উঠেছিল। চিকা মারায় ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের লেখন শৈলী এমনভাবে স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছিল যে, যা দূর থেকে এক নজর দেখলেই বোঝা যেত।
চিকা মারার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাফিতি বা দেয়ালচিত্রের প্রচলন কি দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ঘটেছিল? সেলিম বললেন, আইয়ুব খান ক্ষমতা ছাড়ার পরে আপাত শিথিল কিছু সময় পাওয়া গিয়েছিল। তখন চারুকলার নবীন-প্রবীণ শিল্পীদের অনেকে যেমন কামরুল হাসান, নিতুন কুণ্ডু, হাশেম খান, রফিকুন্নবী, কাইয়ুম চৌধুরী, প্রাণেশ মণ্ডল, আবুল বারক আলভী প্রমুখ সমাজতান্ত্রিক চেতনা ধারণ করতেন। তারা গ্রাফিতি, হোর্ডিং, কাটআউট তৈরি করতেন। সেগুলোয় স্লোগানের সঙ্গে মায়ের কোলে সন্তান, ধাবমান মিছিল, মুষ্টিবদ্ধ হাত ইত্যাদি ছবি থাকত। কাজেই গ্রাফিতির ব্যবহার শুরু হয়েছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই। রাতভর শিল্পীরা কাজ করত চারুকলার বড় ঘরটায়, নয়তো জিমনেসিয়ামে। আমি আঁকতে পারতাম না; কিন্তু এটা-সেটা এগিয়ে দিতাম মানে সহযোগী ছিলাম। কাঠ কাটা বা জোড়া দেওয়ায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের কাঠমিস্ত্রিদের তখন দারুণ সহযোগিতা পাওয়া গেছে।
ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা দেয়াললিখনের নানান ধরন আবিষ্কার এবং কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন। চিকা মারা নিয়ে জেলায় জেলায় কর্মশালাও আয়োজন করেছে ছাত্র ইউনিয়ন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ডাকসুর প্রথম ভিপি হয়েছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তখন কলা ভবনের চারতলার ওপর থেকে নিচ অবধি বড় বড় করে লেখা হয়েছিল—বিশ্ববিদ্যালয় হোক সমাজতন্ত্রের কারিগর তৈরির কারখানা। তারপর আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী স্লোগানই ঘুরেফিরে এসেছে। স্লোগান ঠিক করেছে সময়, সহজ করে বলা যায় সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হয়েছে স্লোগানের ভাষা। একসময় অনেক লেখা হয়েছে—'পূর্ব বাংলা শোষণ করা চলবে না' অথবা 'মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ হাত গুটাও' কিংবা 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই'। ইংরেজিতেও কিছু স্লোগান লেখা হয়েছিল; তবে তা সংখ্যায় কম, যেমন 'ইয়াংকিজ গো হোম', 'উই আর উইথ ইউ ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম', 'ডাউন উইথ ইম্পেরিয়ালিজম' ইত্যাদি।
চিন যাও ব্যাঙ খাও
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সার্বিক পরিবর্তন সাধিত হলো। একদিকে ছিল পাকিস্তানি নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দ, অন্যদিকে খাদ্য, শিক্ষা, চাকরি ইত্যাদির সংকট তীব্রতর হলো। তার ওপর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র হাতে তুলে অগণিত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আত্মপ্রকাশ করল, যারা লিপ্ত হলো বেধড়ক লুটপাট, রাহাজানিতে। দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি হলো। শুভ্রাংশুরা তাদের ব্যঙ্গ করে বলতেন, সিক্সটিনথ ডিভিশন। আসল মুক্তিযোদ্ধারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে প্রতিরোধী হয়ে উঠতে চাইলেন। ফলে দেশ স্বাধীন হওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই মেধাবী ও সৃজনশীল ছাত্র-জনতা সংগঠিত হলো। তারা সমাজতন্ত্রের পক্ষে আওয়াজ তুলল। প্রকাশিত হলো গণকণ্ঠ। পয়লা মে সংখ্যার হেডলাইন হয়েছিল, 'আমরা লড়ছি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে'। প্রথমে পত্রিকাটি ছিল সাপ্তাহিক, পরে দৈনিক হয়েছিল। এতই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে ১০ টাকা দাম দিয়েও কিনতে পিছপা হতো না পাঠক। শুভ্রাংশু চক্রবর্তী বলছিলেন, ব্যানার, লিফলেট আর দেয়ালে লেখা হতে লাগল, শোষণমুক্তির লড়াই সমাজতন্ত্রের লড়াই। প্রচুর দেয়াললিখন হয়েছে সে সময় মূলত লাল কালিতে। তারপরে আসে ভয়াবহ তিয়াত্তর, চুয়াত্তর। একদিকে লুণ্ঠন, অন্যদিকে অনাহার। দেয়াললিখনে তখন রিলিফ চুরির প্রসঙ্গটি বারবার এসেছে। 'কেউ খাবে তো কেউ খাবে না' স্লোগানটিও ফিরে এসেছিল সময়ের দাবিতেই। দেয়াললিখনের জন্য আকর্ষণীয় জায়গা ছিল সচিবালয়ের দেয়াল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা।
ষাটের দশকের বৈশিষ্ট্য ছিল স্বাদেশিকতা ও জাতীয়তাবাদ, আর সত্তরের দশকের বিষয় ছিল পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ভাঙো এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ো। তাই ষাটের দশকের স্লোগান ছিল—'পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা' আর সত্তরের দশকের স্লোগান হয়ে উঠেছিল 'সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক, সমাজতন্ত্র মুক্তি পাক'। একটা ব্যাপার খেয়াল করার মতো ছিল, দেয়াললিখন কিন্তু মূলত রাজনৈতিক কর্মীরাই লিখত। এতে কখনো কখনো সৌন্দর্যে ঘাটতি তৈরি হলেও আবেগের প্রকাশ ঘটত ব্যাপকভাবে, ফলে জনতার মধ্যে আলোড়ন তুলত বেশি। আবার চিকা মারতে মারতে অনেককে এতই পারদর্শী হয়ে উঠতে দেখেছি যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিতরাও তাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা ভাবত না।
দেয়াললিখন কি প্রভাববিস্তারী ছিল? শুভ্রাংশু চক্রবর্তী বললেন, নিশ্চয়ই এর প্রভাব ছিল ব্যাপক এবং গভীর। নয়তো আওয়ামী ছাত্রলীগ কেন না সইতে পেরে বলত, হো হো মাও মাও, চিন যাও ব্যাঙ খাও। হো চি মিন আর মাও সে-তুং তখন কত বড় নেতা—ভাবা যায়! সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতায় হো এবং মাওয়ের অবদান তাদের বুকে কাঁপন ধরাত। তাই ওই দুই নেতাকে তারা অগ্রাহ্য করতে না পেরে ব্যঙ্গ করত। আমাদের কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হতো না।
চাকরি দিবি না, দিবি না, গুলি করলি কেন?
'নিপীড়ক সরকারের বিরুদ্ধে যখন কথা বলাও অপরাধ, তখন দেয়াল কথা বলে ওঠে। দেয়ালের ভাষাই হয় মানুষের মনের ভাষা। তাই আমাদের অঞ্চলে এর সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব রয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে এর প্রকাশ খানিক ভিন্ন। সেখানে প্রতীক দিয়ে, বিদ্রুপের মাধ্যমে ভাব প্রকাশ করার রেওয়াজ, আমাদের দেয়ালের লিখন অত্যন্ত স্পষ্ট। চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এর সম্যক প্রকাশ দেখা গেল। মুগ্ধ যখন বলে, "পানি লাগবে পানি"—তখন সারা দেশে হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে। অথবা যখন দেখতে পাই ছাত্ররা প্রশ্ন করছে, চাকরি দিবি না দিবি না, গুলি করলি কেন? তখন এই একটা প্রশ্ন শত সহস্র প্রশ্নকে হার মানিয়ে দেয়।' বলছিলেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বা বাসদের সহসম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন।
তিনি মনে করিয়ে দিলেন, আইয়ুব সরকারের আমলে যখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা ছিল না, তখনই কিন্তু দেয়াললিখনের প্রসঙ্গ আসে। আর দেয়াললিখন কথাটা আড়াল করতে বলা হতো চিকা মারা।
১৯৮২ সালে এরশাদ আমলে মজিদ কমিশন শিক্ষানীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে যে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল, তার সুবাদে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন রতন। রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার আগে থেকেই দেয়ালের লিখন তাকে ভাবাত। 'পৃথিবীকে বদলানোর আগে নিজেকে বদলাতে হবে'—এমন লেখা পড়তে পড়তে তার ভাবনা আলোড়িত হতো। আবার যখন দেখতেন, শিক্ষা আমার অধিকার, এই অধিকার সবার চাই, তখনো উদ্দীপ্ত হতেন। অতি অল্প কথার স্লোগানটিতে ব্যক্তির অধিকারকে সমষ্টির অধিকারে উন্নীত করা হয়েছে।
যে দেয়াল স্বপ্ন দেখায়, সেটি সুন্দর
এ কারণে দেয়াললিখন স্বৈরাচারকে ভীত করে আর সে ভয়ে পরিচ্ছন্নতার দোহাই দিয়ে নগরকর্তারা দেয়াললিখনে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
রাজেকুজ্জামান রতন যোগ করলেন, 'যে দেয়াল স্বপ্ন দেখায়, ভবিষ্যৎ চেনায়, সংগ্রামের ডাক দেয়, সে দেয়াল সুন্দর। হোক হাতের লেখা অপরিপক্ক বা কাঁচা।'
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও যোগ করলেন, ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হলে সৃজনশীলতা কমে যায়; কিন্তু ভয়কে যখন জয় করা হয়ে যায়, তখন তার বাঁধভাঙা প্রকাশ দেখতে পাই। আগে যখন একদলীয় শাসনের নিগড়ে বন্দী ছিল ক্যাম্পাসগুলো, তখন সবটাই ছিল নিষ্প্রাণ, এখন কাঁচা বা আধা কাঁচা হাতেও ছাত্ররা যখন মনের ভাব প্রকাশ করছে, তখন সৃষ্টি সুখের উল্লাস ছড়িয়ে পড়ছে শহর থেকে গ্রাম—সবখানে।
স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শহীদ নূর হোসেনকে জীবন্ত দেয়াল আখ্যা দিলেন রতন। এ দেয়াল এতটাই জীবন্ত যে মৃত্যুর তিন যুগ পরেও কথা বলছে, আন্দোলন বেগবান করছে। 'স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক' কথাটা নূর হোসেনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেয়ালে দেয়ালে এত বেশি ছড়িয়ে পড়েছিল যে এরশাদের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিল। রতন আশির দশককেই দেয়াললিখনের নান্দনিক সময় বলে উল্লেখ করলেন। সে সময় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চিকাবিশেষজ্ঞ ছিল। তাদের নেতৃত্বে চিকা মারা দল গড়ে উঠত। তারা রেললাইনের পাশের বড় দেয়াল, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দেয়ালগুলোতে চিকা মারত। চুন, জিংক অক্সাইড, রেড অক্সাইড, নীল, বালতি, ব্রাশ, ঝাড়ু, মই ছিল তাদের উপকরণ। তাদের একজন পরিষ্কার করত, আরেকজন চুন লাগত, আরেকজন আউটলাইন তৈরি করত, আরেকজন ব্রাশ চালাত—এটা ছিল একটা কমপ্লিট টিমওয়ার্ক। কাজ করতে করতেই তারা শিখে ফেলত ব্যাকগ্রাউন্ড কী হবে বা আউটলাইন হবে কোন রঙে।
ওয়াল আছে ফেসবুকেও
রতন বললেন, 'উপজেলা পদ্ধতি প্রবর্তন করে এরশাদ একটি উপকার করেছিলেন, তা হলো, স্থানীয়ভাবে অনেক বড় বড় দেয়াল পাওয়া গিয়েছিল, যাতে চিকা মারা যেত। পরের দিকে চিকা মারার দল ডাস্টবিনও বাদ দেয়নি।'
রাজেকুজ্জামান রতন শেষে বললেন, 'শব্দ বদলে যেতে পারে, প্রতীক বদলাতে পারে। দেয়ালও বদলাচ্ছে। এখন যেমন এসেছে ফেসবুক ওয়াল, নতুন প্রজন্ম এ দেয়ালে কথা বলছে, কিন্তু কথা ওই একই, গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক কিংবা কেউ খাবে তো কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না। যখন যেখানে স্বৈরশাসন, তখন সেখানেই দেয়াল কথা বলে ওঠে মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়ে।'
আর এবারের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে দেয়াল যেভাবে কথা কয়ে উঠেছে তাতে রচিত হয়েছে ইতিহাসের আরেক অধ্যায়।