বাদিয়ার জাদুর পানি
[মায়া আবু আল-হায়াত, জন্ম ১৯৮০, একালের অন্যতম প্রধান প্যালেস্টাইনি কথাসাহিত্যিক ও কবি। বাবা লেবাননে প্যালেস্টাইনি শরণার্থী, মা লেবানিজ, তার জন্ম বৈরুত। পড়াশোনা পূর্ত প্রকৌশল বিভাগে। ২০০৮ থেকে জেরুজালেমে স্বামী ও তিন সন্তানসহ থাকছেন। ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, সুইডিশ ও কোরিয়ান ভাষায় তার লেখা অনূদিত হয়েছে। গ্রন্থসংখ্যা কুড়ি ছাড়িয়ে গেছে।]
বাদিয়া রামাল্লা হাসপাতালের ভেতর এমনভাবে হাঁটাহাঁটি করে, দেখলে মনে হয় যেন সে নিজেই এটার মালিক। তার কোনো তাড়া নেই, সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই অভিবাদন জানাচ্ছে, আবার অন্যরা যখন তাকে অভিবাদন জানাচ্ছে—হেলেদুলে তার জবাবও দিচ্ছে। আর সাথে মোলাকাত করার জন্য সতর্কতা কৌতূহল ও আতঙ্ক মেশানো কাহিনিগুলো ঘুরে বেড়ায়। হাসপাতালের রিসেপশনিস্ট সামিরা বিয়ে করেছে অল্প দিন, তাকে সন্তুষ্ট রাখতে সচেষ্ট। সামিরাকে জিজ্ঞেস করে, ঘুমের ওষুধের কারণেই তার স্বামী তার সাথে ষাঁড়ের মতো সঙ্গম করছে না তো?
সাইদ নামের পিয়ন ছেলেটাকে মেরুদণ্ডের বিশেষ চিকিৎসা দেবার কথা দিয়েছ, তাতে রাতের বেলা শরীরটা খাড়া থাকবে। হ্যান্ডসাম তরুণ ডাক্তার সামি নার্সদের পছন্দ; তারা তাকে থামিয়ে হাস্যকর প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, কখনো আবহাওয়া নিয়ে কখনো দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়ে। সামি ছুটে আসে তার কাছে, পুরোনো দিনের ছায়াছবিতে নায়করা যেমন করত, তেমনি শ্রদ্ধাভরে তার হাতে চুমো খায়। বাদিয়া সশব্দে হেসে বলে, আল্লাহ তোমাকে বিপদ থেকে হেফাজত করুন।
বাদিয়া সামিকে তার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে। ছেলেকে ডাক্তার বানাবার জন্য মা সিত্তা ফিকরিয়া নিজের জীবনটাই উৎসর্গ করেছেন। বাদিয়া হেঁটে যায়, কমলা রঙের হাতব্যাগ দুলতে থাকে, ব্যাগে কী আছে, সে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার সাহস কারও নেই। গটগট করে বেসমেন্টের দিকে যাবার সময় মাথার লাল রঙের আলগা খোপা পিছলে স্কার্ফটা নেমে আসে, তরুণ ডাক্তারের হস্তচুম্বনের স্মৃতিটা বারবার তার মুখে বেহায়া হাসি ফুটিয়ে তুলছে। নিজেও পুনরাবৃত্তি করছে, আল্লাহ তোমাকে বিপদ থেকে হেফাজত করুন। যে চাবিটার মাথাটা নীল রঙের, সেটা দরজার কি-হোলে ঢুকিয়ে হাসপাতালের অটোপসি রুম-ময়নাতদন্ত কক্ষে প্রবেশ করে। কোটটা খুলে রেখে সাদা গাউনটা পরে নেয়। তার মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। ফোনে উম্মে সালামা, তাকে এটা বলার জন্য ফোন করেছে যে হাইফার সোরাসিস আক্রান্ত একটা মেয়েকে চিকিৎসার জন্য তার কাছে পাঠিয়েছে।
খালাফের একটি পারফিউমের দোকানে মেয়েটাকে তার মার সাথে দেখেছে: সালামা তাকে বলেছে বাদিয়া তার জাদুর পানি দিয়ে রোগটা সারিয়ে তুলতে পারবে; তারপর বাদিয়ার হাসপাতালে যাবার পথ দেখিয়ে দিয়েছে। বাদিয়া উম্মে সালামার ওপর বিরক্ত; কারণ, এই গল্প সে অনেকের কাছেই করেছে, তার আশঙ্কা হচ্ছে রামাল্লা হাসপাতালটা না আবার দরগায় পরিণত হয়ে যায়, আল্লাহ না করুন কিংবা কোনো ক্লিনিকে। তাকে জাদুর পানির কথা বলা বাদিয়ার ঠিক হয়নি। আসলে ওসামার মৃত্যুর পর এই পানিতেই তার নিজের হাতে যে লাগাতার একজিমা ছিল, তা সেরে গেল।
জাদুর পানি চুরি করার জন্য এক নারী চুপিচুপি অটোপসি রুমে ঢুকে পড়েছিল, যে পানি একটি বালিকার শবদেহের ওপর থেকে ছিটকে পড়েছিল, বাদিয়া যখন তাকে বের করে দিতে চেষ্টা করছিল, সে দ্রুত নিচে পড়া পানি জিব দিয়ে চাটতে চেয়েছে।
সামাহ নামের নার্স প্রতিদিন যে তাম্মুন থেকে আসা-যাওয়া করে, সারা দিনের কাজের তালিকাটা সে-ই বানায়। দিনের মৃতের তালিকায় বেশ কজন। প্রথম মৃতদেহটি আল বাইরেহর একজন নারীর, তার বয়স আশির কাছাকাছি। দ্বিতীয় নারীর বয়স পঞ্চাশের ঘরে, তার মৃতদেহ নাবলুস পর্যন্ত যাবে, সেভাবে ঠিক করে দিতে হবে। কুড়ির ঘরের তৃতীয় নারী তো তরুণী, এর মধ্যেই তিন দিন তার মর্গে কেটে গেছে। লম্বা সময় ধরে প্রতীক্ষা, তবুও বাদিয়া তার বিশেষ হারবাল চা এবং সিগারেট শেষ না করে কাজটাতে হাত দেয় না।
বাদিয়া কম বয়সী নারীদের গোসল করানোটা পছন্দ করে না, বিশেষ করে কম বয়সী মায়েদের। তার পছন্দ বুড়ি-বয়স্ক নারী, যাদের আত্মীয়স্বজন চায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দাফনের কাজটা শেষ হয়ে যাক। আত্মীয়দের অনেকে এসে লাশও পাবে না। এ ধরনের মৃত বুড়ির মেয়ে এবং ছেলের বউরা গোপনে তার হাতে কিছু টাকাও গছিয়ে দেবে। বুড়ো মায়ের অনিবার্য মৃত্যু তাদের অসহায়ত্ব কমিয়ে দেয়—জীবিত মাকে নিয়ে সেই অসহায়ত্ব, বিশেষ করে যখন শুয়ে থাকা মায়ের পিঠে ঘা হয়ে যায়, ছেলেমেয়েরা নিজেদের জীবন ও কাজ নিয়ে ব্যস্ত, বিছানায় নিথর ঘুমানো মায়ের শরীর ফুলে ওঠে, গোলাপি বর্ণ ধারণ করে, জখম ও ঘায়ের সৃষ্টি করে। প্রথম দুই নারীর গোসল করানোর কাজটাই বাদিয়ার অগ্রাধিকার, কম বয়সীরটা পরে দেখা যাবে।
সামাহ বাদিয়াকে ভক্তি ও সমীহ করে, কিছুটা ভয়ও পায়। বাদিয়ার অদ্ভুত সব গল্প বন্ধুদের বলে সে মুগ্ধ করে। অবশ্য সামাহর মা তাকে সতর্ক করে দিয়েছে, বাদিয়ার অতটা কাছে ঘেঁষার কোনো দরকার নেই। এতে তার বিয়ে হবার সম্ভাবনা নাকচ হয়ে যেতে পারে। নাকি সে বাকি জীবন অবিবাহিত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। মৃত মানুষের জাদুর পানি অনেক কিছুই ঘটিয়ে দিতে পারে।
সামাহ এই কথাগুলো এড়িয়ে বাদিয়াকে বলে, রাস্তায় রাস্তায় কত ইসরায়েলি চেক পয়েন্ট, সে জন্য রাস্তায় জ্যাম। এটা আসলে তার মূল আলাপে যাবার একটা ভূমিকা মাত্র।
মাসখানেক আগে বাদিয়া সামাহর মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে। মনে হচ্ছে তার মধ্যে গোপনীয় একটা কিছু চলছে, যা সে কাউকে বলছে না, এমনকি তাকেও নয়। অথচ সকলেই বাদিয়ার কাছে এসে নিজেদের অন্তর খুলে দেয়। এক মাস ধরে এটা সামাহর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে—তার শিফটের মধ্যে অনুরোধ করে এক ঘণ্টা আগে বেরিয়ে যাচ্ছে। লম্বা ছুটি কাটিয়ে আসার পর থেকেই এভাবে তার কাজ থেকে বেরিয়ে যাবার ব্যাপারটা শুরু হয়েছে। অবশ্য সে বলেছে, ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে পরিবারের সাথে ছিল।
কেউ যদি নিজে থেকে তার গোপন কথা না বলে, বাদিয়া তাকে কেন জিজ্ঞেস করতে যাবে, এটা তার ধাঁচ নয়।
প্রথম লাশের কাজটা বাদিয়া শেষ করল, এটা সহজ কাজ। সবকিছুই আগে থেকে তৈরি, বুড়ির দুই ছেলের বউ ভালোভাবেই এবারে দেখভাল করেছে। তারা অটোপসি রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বাদিয়া মোটাসোটা লাশের ওপর পানি ঢালে। সুরা ও দোয়া-কালাম পড়ে। সে ভাবে, যে মায়ের মেয়ে নেই, তার চেয়ে নির্মম ভাগ্য আর কার হতে পাওে! যে মায়ের মেয়ে নেই, তার জন্য শোক করার কেউ নেই। কাজ শুরু করার আগে ছেলের বউদের একজন তার হাতে পঞ্চাশ ডলার গুঁজে দিয়েছে, এতে মন লাগিয়ে কাজ করার আগ্রহ তার বেড়ে গেছে।
দুই পায়ের মাঝখানে একটা পরিষ্কার তোয়ালে রাখে, তারপর শরীরের ডান দিকটা তার দিকে টেনে নেয় এবং সাফ করে, তারপর বাঁ দিকটা। তারপর তাকে অজু করায়, কাফনের কাপড়ে মাথা ঢাকে, তারপর পুরো শরীরটা। যে নারীর লাশ তার পরিবারের সদস্যদের সাথে নাবলুস যাবে, তার জন্য বাদিয়া এতটা পরিশ্রম করে না, কারণ সেখানে নিয়ে তাকে আবার গোসল দেওয়া হতে পারে।
বাদিয়া এবার একটু বিরতি দেয়, সিগারেট ফুঁকবে। সকালে সিগারেটের স্বাদটা যেমন ছিল, এটা ঠিক তেমন নয়। এটা প্রতীক্ষার সিগারেট। সিগারেট টানছে এবং আশা করছে সামাহ শিগগির আসবে। কিন্তু সামাহ আরও সময় নেয়, ফলে তিন নম্বর লাশটা নিয়ে কাজ শুরু করা পিছিয়ে দেবার আর কোনো অজুহাত থাকে না। কম বয়সী মেয়েদের শরীর তাকে আতঙ্কিত করে। এ ধরনের লাশ যে সে হাসপাতালে খুব বেশি দেখেছে, এমনও নয়। তার এ ধরনের কম বয়সী মক্কেল তরুণীরা নিহত হয়ে থাকে ভালোবাসা ও সন্দেহের দ্বিধাদ্বন্দ্বে। মাত্র দুজনে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। বাইদা জানে এই কাজটি শেষ করার পর দিনের বাকিটা তার বিষণ্নতায় ভরে থাকবে।
হাসপাতাল স্টাফরা লাশটাকে রুমের মাঝখানে বড় পাটাতনের ওপর শুইয়ে দেয়। পৃথিবীর সবচেয়ে নরম শরীরও তিন দিন ফ্রিজে থাকার পর শক্ত হয়ে যায়। বাদিয়ার হঠাৎ মনে হয় জানালা দিয়ে এক ফালি আলো ভেতরে ঢুকে রুমের অন্ধকারকে দ্বিখণ্ডিত করেছে। রুমের ভেতর বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা এই আলোর রেখার ওপর দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। রাস্তায় হকারের হাঁকডাক, সেই সাথে কাছাকাছি কাদদুরা ক্যাম্প গার্লস স্কুলে মেয়েদের লাঞ্চ ব্রেকের সময়কার হইচই হাসপাতালের বেসমেন্টেও কিছুটা এসে পৌঁছেছে।
বাদিয়া মেয়েটার মুখের ওপর থেকে চাদরটা সরায়, বেরিয়ে আসে তার ঘন ঢেউ খেলানো লালচে চুল, শরীরের প্রায় অর্ধেক পর্যন্ত নেমে এসেছে। দুই স্তন দুপাশে হেলে আছে—দৃশ্যটা বাদিয়াকে থামিয়ে দেয়, তার মনে হয় একটা শিশুর ঠোঁট স্তনের বোঁটা আঁকড়ে ধরে আছে। শরীর লালচে, প্রদাহের চিহ্ন কোথাও কোথাও দৃশ্যমান। জরায়ু ঢেকে রাখা ত্বক ও নাভি দেখে মনে হয় একটি সন্তান সে প্রসব করেছে, কিন্তু তা খুব বেশি আগে নয়। বাদিয়া তার ত্বক স্পর্শ করে আঁতকে ওঠে এবং তারপর পিছিয়ে আসে। তিন দিন রেফ্রিজারেটরে থাকা শরীর এমন উষ্ণ ও কোমল কেমন করে হলো?
বাদিয়া দ্রুত মেয়েটার ফাইল দেখতে চলে যায় এবং পড়ে। বয়স ২৯ বছর, নার্স, রক্তে বিষের আলামত পাওয়া গেছে। বাদিয়ার মনে হয় তাহলে তারা মেয়েটিকে হত্যা করেছে। নিজেই বলে, তাকে তারা হত্যা করেছে। মুহূর্তের জন্য বাদিয়া নিজের হৃৎপিণ্ড চেপে ধরতে বুকের ওপর হাত রাখে। সবই তার মনে পড়ছে, যেন একটু আগে ঘটেছে।
তার বয়স তখন ঠিক সতেরো বছর, ওসামার সাথে দেখা হয়, কালো পোশাক পরে সাদা ঘোড়ায় চড়ে ওসামা আল বাইরেহ থেকে তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, দেখেই ভালো লাগল, মসজিদে সান্ধ্য নামাজ পরে এ পথেই সে ফিরবে, সে রাস্তার ওপর তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। তার জন্য প্রতীক্ষা যতই করছিল, ভালোবাসাও তেমনি বেড়ে যাচ্ছিল। সেদিন সে পথে সে আসেনি। দেখা হয়নি। ভালোবাসা বাড়তেই থাকে, যতক্ষণ না তার সাথে একদিন রামাল্লার বাজারের একটি দোকানে দেখা হয়।
কেবল সে সময়ই সে বুঝতে পারে রামাল্লা আর আল বাইরেহর তফাৎ কোথায়। একটা শহরের ওপর আছড়ে পড়া আর একটা শহর, কল্পিত একটি রেখায় বিভাজিত। বাস্তবে সে রেখা কোথাও নেই, আছে কেবল বাসিন্দাদের মগজে। এটা স্পষ্ট হলো, যখন ওসামার সাথে তার সাক্ষাতের জায়গাটি নির্ধারিত হলো রামাল্লায়, আল বাইরেহতে নয়, তার মা ও মায়ের বৃহৎ পরিবারের দৃষ্টিসীমার বাইরে।
তখন প্রথম ইন্তিফাদা চলছিল। ওসামার সাথে তার এনগেজমেন্ট হলো, একসাথে ইউনিভার্সিটিতে ঢুকল, ফাঁকি দিয়ে ভাড়া করা গাড়িতে সিটি সেন্টার থেকে বিরজিট পর্যন্ত আসা যাওয়া করল। সেই সব প্রণয়ের ক্ষেত্রগুলো মধুময় ছিল, এমনকি উম্মে সালামার বাড়িতে প্রণয়ের মুহূর্তগুলো থেকেও।
কিন্তু ওসামার মৃত্যুটা ছিল আকস্মিক। বাদিয়ার পেটে সে রেখে গেল তার উপহার। ওসামার সাথে তার কী চলছিল, তা যদি মার চোখে ধরা পড়ত, নিজেই অনেক আগে মারা পড়ত।
বিপর্যয় থেকে কেমন করে বেরিয়ে এসেছে, বাদিয়া তা আর স্মরণ করতে চায় না। তার মা যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার সাথে তাকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করেছে, জন্মের পরপরই শিশুটার মৃত্যু হলো—ছেলে না মেয়ে মা বলেনি, সে নিজেও জিজ্ঞেস করেনি। যখন মা বলল বাচ্চাটা মরা, তার মনে হলো একটা বড় বোঝা, তার কাঁধ থেকে সরে গেছে; সঙ্গোপনে যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, জেরুজালেমের সেই প্রাইভেট হাসপাতালের করিডর দিয়ে মৃত শিশু অদৃশ্য হয়ে গেল। একটা ভয়ংকর শূন্যতার বিপর্যয় তাকে পেয়ে বসল। তখন থেকেই তার বুক আর জরায়ুর মধ্যে বিশাল শূন্যতা বিরাজ করতে থাকে। সেই শূন্যতা সে ভরেছে অট্টহাসি দিয়ে, সহকর্মীদের সমস্যার সমাধান করে আর মৃতদেহ গোসল করিয়ে। এই কাজটা সে সেধেই নিয়েছে, যখন দেখা গেল তার মায়ের মৃত্যুর পর তাকে গোসল করানো আর কাফন পরানোর মতো কাউকে পাওয়া যায়নি। নির্দ্বিধায়, নির্ভয়ে কাজটা করে যাচ্ছে। এ কাজ তাকে একধরনের স্নিগ্ধতা আর প্রশান্তির গভীর এক অনুভূতি দিয়েছে। হাসপাতালের চাকরিটা সে লুফে নিয়েছে, নারীর লাশ গোসল করানো। তখন থেকে একটা সাধারণ জীবনেই সে তৃপ্তি খুঁজে নিয়েছে, অন্যের দুঃখ ও আনন্দ নিয়ে নিজের জীবনটা ব্যয় করছে।
তার সামনে পাটাতনের ওপর শোয়ানো মেয়েটিকে মোলায়েমভাবে ধরছে সে, মেয়েটি কষ্ট পেতে পারে এমন একটি আশঙ্কা তার মনে জেগেছে। বাদিয়া তার মাথায় পানি ঢালে, শরীরে সহিংসতার চিহ্ন আছে কি না, খুঁজতে থাকে—যেন সে মেয়েটির কাহিনি পুনর্নির্মাণ করবে। এই মেয়েটির জন্ম ১৯৯০-এর অক্টোবরে।
বাদিয়া হৃৎস্পন্দন বাড়তে থাকে। আবার ওপরের দিকটা আলতো করে ওঠায়। ওপরের অংশটা বাদিয়ার হাতের ওপর যেন বিশ্রাম নিচ্ছে। তার মাথা বাদিয়ার বাঁ কাঁধে, ঘুমোচ্ছে। শান্ত শিশুটি যেন তার মায়ের কোলে। যে মেয়েটার লাশের জন্য কেউই অপেক্ষায় নেই, তার জন্য বাদিয়ার কষ্ট বাড়তে থাকে। গাল বেয়ে অশ্রু নেমে আসছে। মেয়েটির মাথা কাঁধে নিয়ে বাদিয়া কাঁদতে থাকে। কিন্তু সে তো মা, এটা তো স্পষ্ট, কোথায় সেই সন্তান? সন্তানের বাবা?
আবার ফাইলের কাছে যায়। মেয়েটি কি একাকী? সন্তানটি কি বিয়েবহির্ভূত? সন্তান খালাস করতে কি তাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে? লাশ ও ফাইলের মধ্য দিয়ে ছুটোছুটি করতে করতে একবার থেকে মেয়েটির মাথার কাছে আসে, নাকের ভেতরের দিকটা পরিষ্কার করে, মুখ খুলে দুই ঠোঁটের মাঝখান দিয়ে ভেতরে আঙুল ঢোকায়। বাঁ কান পরিষ্কার করার জন্য মুখটা তখন ডান দিকে ঘোরায়, তার চোখের পাতা খুলে যায়। চোখ দুটা সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে আছে। এই দৃষ্টি তার পরিচিত। নিজের সদ্যোজাত সন্তান মৃত প্রসব করার পর বাদিয়া ঠিক এভাবেই তার মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের এই দৃষ্টি, গ্রহণের ও মুক্তির।
সামাহ অটোপসি রুমে প্রবেশ করে। বাদিয়ার হুঁশ ফিরে আসে এবং নিজেকে ধরে রাখতে চেষ্টা করে। অবশ্য এদিকে সামাহর কোনো মনোযোগ নেই। সামাহ ভেঙে পড়েছে, কাঁদছে।
বাদিয়া মেয়েটিকে সোজা করে শোয়ায়, আবারও একটা চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়। সামাহর দিকে তাকায়। সামাহ এখন তাকে সব কথা বলতে চাচ্ছে।
বাদিয়া এমন কিছু একটাই সন্দেহ করেছিল। সামাহরও একটি বিয়েবহির্ভূত সন্তান হয়েছে। যে মানুষটাকে সে ভালোবাসত, সে গর্ভবতী হয়ে পড়ার পর তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। কিন্তু তাকে এটা বলেছে যে বাচ্চাটা হয়ে যাবার পর বিয়ে করবে। সামাহ তা বিশ্বাস করেছে। সামাহ বাড়িতে বলেছে, সে একটা ট্রেনিং ওয়ার্কশপে যাচ্ছে, অনেক দিন থাকতে হবে—পরিবারের সদস্যদের দৃষ্টির আড়ালে রামাল্লাতে বাচ্চাটার জন্ম হয়।
তার সেই প্রেমিকের বাবা বাচ্চাটাকে গ্রহণ করেছে, এই হাসপাতালে কাজের মধ্যে এই যে সে বেরিয়ে যায়, আসলে সে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে যায়। কিন্তু বাচ্চার দায়িত্ব থেকে সরে আসতে তার প্রেমিক বালিশ চেপে শ্বাসরুদ্ধ করে তাকে মেরে ফেলতে চেষ্টা করেছে। সামাহ এখন দিশেহারা—একদিকে ঘাতক বাবার হাত থেকে সন্তানকে রক্ষা করতে চায়, অন্যদিকে তার আতঙ্ক বিষয়টা তার পরিবারের জানা হয়ে যাবে।
বাদিয়া সামাহর হাত ধরে এবং বলে, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সবার আগে যত ভালো করে সম্ভব এই মেয়েটিকে প্রস্তুত করতে হবে। সামাহ তখনই যেন ভারমুক্ত হয়, সে দেখছে তার দেখা শ্রেষ্ঠ শেষকৃত্যের আচারটিই যেন বাদিয়া সম্পন্ন করছে। ব্যাগ থেকে বের করছে ভারতীয় ধূপ, একটি তামার বাটি, সাদা কাপড়, হাবলুস সাবান, জেসমিন পারফিউম, আবদুল বাসিতের কণ্ঠে রেকর্ড করা কোরআনের সুরার একটি টেপ। টেপটা পুরোনো রেকর্ডারে ঢুকিয়ে দেবার পর নারীর জন্য নির্ধারিত সুরা বাজতে শুরু করল, বাদিয়া মেয়েটিকে গোসল দিচ্ছে, সামাহকে নির্দেশ দিচ্ছে ডান দিকে উঁচু করো, বাঁ দিকে তোলো। বাদিয়া তার ঝঙ্ঘা অঞ্চলে, ঊরুতে পানি ঢালে, তারপর তামার বাটিতে মেয়েটির শরীর থেকে ঝরে পরা ফোঁটা ফোঁটা পানি সঞ্চয় করতে থাকে। খুব শ্রদ্ধাভরে বাটিটা টেবিলে রাখে। তারপর ভালো করে শরীরটা মুছে, শুকিয়ে নেয়, তারপর সাদা কাপড়ের স্তর একটার পর একটা সাজিয়ে তাকে ঢেকে দেয়। তাকে ধরে একটু দূর থেকে তার গায়ে সুঘ্রাণ পারফিউম ছড়ায়। তারপর তার পাশে এসে বসে। তারপর মেয়েটিকে নিজের বুকে চেপে ধরে দীর্ঘ সময় ধরে কাঁদতে থাকে। সামাহ বিস্মিত হয়। কখনো সে আশা করেনি এমন ক্ষমতাধর বাদিয়া একজন সাধারণ মায়ের মতো আচরণ করবে—যেন মা তার সন্তান হারিয়েছে।
তার কাজ শেষ হয়েছে। বাদিয়া সামাহকে বলল, অফিসারদের জানিয়ে এসো যাবার জন্য প্রস্তুত।
সে নিজের টেবিলে বসে, সিগারেট ধরায়। তারপর সামাহকে তার সেই পুরুষ মানুষটির ঠিকানা জিজ্ঞেস করে। সামাহকে জোর দিয়ে বলে, সাবধান, সেই লোকটি তার সাথে যোগাযোগ না করা পর্যন্ত সে যেন নিজে থেকে না এগোয়।
পরদিন বাদিয়া তার নিজের পথে লাইব্রেরি স্ট্রিট অতিক্রম করে। হাসপাতালে আসা-যাওয়ার পথের ধারের পরিত্যক্ত বাড়িটির সামনে থামে, পরিত্যক্ত বাগান থেকে কোনো দিন ফুল তুলে নেয়। পার্লামেন্ট গোলচত্বরের কাছে উম্মে সালামার সাথে দেখা হয়। সালামা জানতে চায় সোরাসিস আক্রান্ত মেয়েটি তার সাথে দেখা করতে গিয়েছে কি না। উত্তর দেয়, না আসেনি। মনে হচ্ছে মেয়েটি তাকে বিশ্বাস করতে পারেনি, জাদুর পানিতে কাজ হবে এমন আস্থা হয়তো তার হয়নি। লাশ ধোয়ানো সঞ্চিত জাদুর পানি। মেয়েটির জন্য দুঃখিত বোধ করল। যারা বিশ্বাস করে না, বাদিয়া তাদের জন্য কিছুই করতে পারে না। উম্মে সালামা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
সামাহ উদ্বিগ্ন হয়ে অটোপসি রুমের দরজায় বসেছিল। তার প্রশ্নটা নিয়ে বাদিয়ার কাছে এগিয়ে আসে। বাদিয়া তাহলে কী করেছে? শিশুটির বাবা গত রাতে তার সাথে দেখা করে বিয়ে করার জন্য তার হাত-পা ধরেছে।
বাদিয়া হাসে, তার ব্যাগ হাতড়ে তামার বাটি বের করে।
বাদিয়া বলল, জাদুর পানি সব ধরনের আপদ-বালাই সারাতে পারে। জাদুর পানির পাত্র তুলতে তুলতে যুবকের চেহারা স্মরণ করল এবং বলল, যদি সে সামাহকে বিয়ে না করে, এই পানি তার শরীরে স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করবে। বাদিয়ার নাম সে অনেক শুনেছে, এটা শোনামাত্র সেই লোক আতঙ্কে কাঁপতে থাকল এবং অজ্ঞান হয়ে গেল।
সামাহকে আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে বাদিয়া দিনের কী কী কাজ নির্ধারিত আছে—জানতে চাইল। কোনো মৃতদেহ নেই। পুরোটাই অবসর, কাজশূন্য। বাদিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, কোট খুলে নিজের সাদা গাউন পরে এবং নিজের তৈরি বিশেষ হারবাল চায়ে চুমুক দেয়।