বিষণ্ণ কমলার দেশ

[ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সাহিত্যিক গাসসান কানাফানি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৩৬ সালে আকা শহরে। বারো বছর বয়সে পরিবারের সবার সাথে ইয়াফা শহর ছেড়ে চলে যেতে হয় লেবাননের শরণার্থীশিবিরে। ১৯৪৮ সালে ইয়াফা শহর ইহুদিরা দখল করে নেয় এবং ফিলিস্তিনিদের গণহারে হত্যা ও বহিষ্কার করে। লেবানন থেকে পরবর্তীতে তারা সিরিয়ার দামেস্ক শহরে বসবাস করেন। নির্বাসিত জীবনের কঠিন সময়ে তিনি কাজে করেছেন প্রিন্টিং প্রেসে, সংবাদপত্র বিক্রেতা হিসেবে এবং রেস্টুরেন্টে। সান্ধ্যকালীন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন ১৯৫৩ সালে। এরপর চিত্রকলার শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেন জাতিসংঘ পরিচালিত এক স্কুলে। এ সময় জর্জ হাবাশের সাথে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নামে। পাশাপাশি রাজনৈতিক কলাম লিখতে শুরু করেন। এরপর কুয়েতে যান বোনের কাছে। সেখানে আর্ট ও অ্যাথলেটিকসের শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেন একটি স্কুলে। শিক্ষকতার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার জন্য দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি সাহিত্য বিষয়েও পড়াশোনা করেন। কুয়েতে আরব কালচারাল সেন্টার থেকে তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখেন। ১৯৫৭ সালে আল ফাজর পত্রিকায় তার প্রথম গল্প 'একটি নতুন সূর্য' প্রকাশিত হয়। ১৯৬০ সালে কুয়েত ছেড়ে আবার দামেস্কে স্থায়ী হন। কানাফানি পপুলার ফন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন; পরে পলিটিক্যাল ব্যুরো নির্বাচিত হয়ে দলটির মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর আল হাদাফ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন ১৯৬৭ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত। তার প্রতিবাদী কণ্ঠ ও লেখনীকে চিরতরে শেষ করে দেয়া হয় বৈরুতে তার গাড়িতে পেতে রাখা বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই ক্ষণজন্মা গাসসান ছিলেন রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সম্পাদক ও চিত্রকর।
তার অসাধারণ উপন্যাস 'রিজাল তাহতাশ শামস' বা 'রৌদ্রদগ্ধ মানুষগুলো' নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ফিলিস্তিনকে নিয়ে লেখা তার গল্প উপন্যাস বা সাক্ষাৎকার অনূদিত হয়েছে বহু ভাষায়। অনূদিত গল্পটি আরবি 'আরদুল বুরতুকাল আল হাজিন' গল্পের অনুবাদ।]
যখন আমরা ইয়াফা থেকে আকার পথে রওনা দিই, তখন তাতে কোনো দুঃখের চিহ্ন ছিল না। যেমন আমরা প্রতি ঈদেই অন্য শহরে ছুটি কাটাতে যেতাম, তেমন যাওয়া। আকাতে আমাদের দিনগুলো অস্বাভাবিক কিছু ছিল না; বরং ছোট হিসেবে ভালোই উপভোগ করছিলাম সেই সময়টা। স্কুল যাওয়ার কোনো তাড়া ছিল না। কিন্তু সবকিছু সুস্পষ্ট হতে শুরু করল আকাতে বড় হামলার পর থেকে। সব দৃশ্যপট পাল্টে যেতে শুরু করে।
সেই ভয়ংকর কঠিন রাত পার হয়েছিল পুরুষদের দুশ্চিন্তা আর নারীদের দোয়া পড়ার মাধ্যমে। তুমি এবং আমি বা আমাদের মতো ছোটরা এই কাহিনির শুরু আর শেষ বোঝার চেষ্টা করছিলাম। ভোর হবার সাথেই সাথেই সবকিছু আরও পরিষ্কার হতে থাকে, যখন ইহুদিরা আমাদের সবকিছু ছুড়ে ফেলে দেয়, হুমকি দেয়, ভয় দেখায়। আমাদের বাড়ির দরজায় বিশাল এক লরি আসে। খুব সাধারণ বালিশ-কম্বলগুলোও লরিতে নিক্ষেপ করা হয় খুবই দ্রুততার সাথে।
আমি তখন আমাদের বাড়ির প্রাচীন দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখলাম তোমার মাকে গাড়িতে তোলা হলো, তারপর তোমার খালা ও ছোটদের। তোমার বাবা আমাকে ও অন্য ভাইবোনদের টেনে নিয়ে মালপত্রের ওপর উঠিয়ে দেওয়া হলো।
বাবা আমাকে উঁচু করে ড্রাইভারের আসনের ওপরের লোহার তাকে বসিয়ে দেন। সেখানে আমার ভাই রিয়াদ চুপচাপ বসেছিল। ঠিকঠাক মতো বসার আগেই লরি চলতে শুরু করে আর একটু একটু করে প্রিয় আকা হারিয়ে যেতে থাকে রাস নাকুরার পাহাড়ি পথের আড়ালে।
সেদিন ছিল মেঘলা আকাশ। ঠান্ডা বাতাস এসে বিঁধছিল আমার শরীরে। আকাশের দিকে তাকিয়ে খুবই চুপচাপ বসেছিল রিয়াদ। গোড়ালি লোহার ফাঁকে রেখে মালপত্রে ঠেস দিয়ে স্থির বসেছিল। আমি দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছিলাম আমার পা দুটোকে। আর মুখ গুঁজে রেখেছিলাম হাঁটুর ফাঁকে। দুই ধারে কমলাগাছের সারি। তীব্র ভয় যেন আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছিল। লরি যখন নরম মাটিতে পৌঁছে, তখন দূরের গোলাগুলির আওয়াজকে মনে হচ্ছিল বিদায় সংগীত।
দূরের নীলাভ দিগন্তের কাছে যখন রাস নাকুরা শরণার্থীশিবির দৃষ্টিগোচর হয়, তখন লরি থেমে যায়। নারীরা গাড়ি থেকে নামে এবং অদূরেই এক ঝুড়ি কমলা নিয়ে বসে থাকা লোকটির দিকে এগিয়ে যায়। কমলা হাতে নিতেই তারা কাঁদতে শুরু করে। তখন আমার মনে হচ্ছিল কমলা খুবই প্রিয় একটা জিনিস। এই বড় বড় পরিষ্কার ফলগুলো আমাদের কাছে খুবই আকাক্সিক্ষত কোনো বস্তু। কমলা নিয়ে সবাই আমার মা-খালারা গাড়িতে ফিরে আসে। চালকের পাশে বসা বাবাও নামেন লরি থেকে। হাত বাড়িয়ে একট কমলা নিয়ে কিছুক্ষণ নীরবে নেড়েচেড়ে দেখেন, তারপরেই শিশুর মতো ডুকরে কেঁদে ওঠেন।
রাস নাকুরা শিবিরে অনেক গাড়ির পাশে আমাদের গাড়িও থামে। এখানে পুরুষেরা তাদের অস্ত্রগুলো সমর্পণ করছে দায়িত্বরত পুলিশ অফিসারদের কাছে। আমাদের পালা আসতেই দেখলাম টেবিলে সাজিয়ে রাখা মেশিনগান ও রাইফেলগুলো। সারি সারি লরিগুলো চলে যাচ্ছে লেবাননের দিকে আর কমলার দেশ থেকে বহুদূরে হারিয়ে যাচ্ছে সবাই। অবশেষে আমিও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। কেঁদে ফেললাম সশব্দে। মা তখনো কমলার দিকে তাকিয়েই আছে নীরব দৃষ্টিতে। বাবার দুচোখে তখন ভেসে ওঠে ইহুদিদের জন্য ফেলে আসা সব কমলাগাছগুলো। ফলবান সেই গাছগুলো বাবা কিনেছিল একটু একটু করে। তার চেহারাতে যেন অঙ্কিত হচ্ছে সব গাছের ছবি। পুলিশ অফিসারের সামনেও বাবা নিজের অশ্রু থামাতে পারলেন না।
আসরের ওয়াক্তে যখন আমরা সায়দাতে পৌঁছলাম, তখন আমরা শরণার্থী হয়ে গেছি।
আমরা অন্যদের সাথে রাস্তাতেই ছিলাম। বাবাকে মনে হচ্ছিল আগের চেয়ে বুড়ো হয়ে গেছে এরই মধ্যে। যেন তিনি ঘুমাননি বহু রাত। মালপত্রের বোঝা নিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম রাস্তার মধ্যেই। এখানে আমাদের লরি থেকে কোনোরকম নামিয়ে দেয়া হয়েছে। আমার মনে হচ্ছিল যদি আমি তার কাছে এখন কিছু জানতে চাই, তিনি প্রচণ্ড রাগে ধমক দেবেন। অভিশপ্ত হোক তোমার বাবা! অভিশপ্ত হোক! এই গালিই যেন শুধু ফুটে আছে তার চেহারায়। অবশ্য এই গালি ছাড়া আমার মাথাতেও কিছু নেই। যে শিশু কঠোর ধর্মীয় শিক্ষা পেয়েছে স্কুলে, সে-ও এই মুহূর্তে ভাবতে বাধ্য হবে—সত্যিই কি আল্লাহ মানুষকে সুখী করতে চায়! আমার আরও সন্দেহ হতে থাকে আল্লাহ কি সত্যিই সব শুনতে পান! সব কী দেখেন? স্কুল, গির্জা থেকে আমাদের যে রঙিন ছবিগুলো দেয়া হতো, তার সাথে প্রভুর কোনো সম্পর্ক কি আছে? সেই ছবিতে দেখেছি প্রভু শিশুদের দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে দেখছেন আর তাদের মুখে মিষ্টি হাসি। এইগুলো কি সত্যি, না পুরোই মিথ্যাচার। আমি এখন নিশ্চিত ফিলিস্তিনে আমাদের যে খোদাকে চেনানো হয়েছিল, সে কি আমাদের সঙ্গে আছেন, না সে-ও ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে গেছেন! আমরা শরণার্থীরা রাস্তার ধারে বসে আছি, নতুন ভাগ্যের আশায়। কোথায় আমরা রাত কাটানোর জন্য মাথার ওপর একটি ছাদ পাওয়া যাবে— শিশুদের সহজসরল মনেও তীব্র কষ্ট।
রাত মানেই ভয়ংকর একটা কিছু। রাত নামতেই গাঢ় অন্ধকার আমাদের ঘিরে ধরে। ভীষণ ভয়ে আমি কাঁপতে শুরু করি। যখন ভাবি, এই রাস্তার ধারেই আমাদের রাত কাটাতে হবে—ভয় আমার মন থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। কেউ আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে না বা মমতার চোখে দেখছে না। আমি আশেপাশে এমন কাউকেই দেখছি না, যাকে জড়িয়ে একটু আশ্রয় পাব। বাবার পাথরের মতো নীরব দৃষ্টি আমার ভয় আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। মায়ের হাতে সারাক্ষণ থাকা কমলাটার দিকে তাকালেও রাগে মাথায় আগুন ধরে যাচ্ছে। আর সবাইও চুপচাপ। কালো রাস্তার দিকেই সবার দৃষ্টি। মনে হচ্ছে রাস্তার শেষ প্রান্ত থেকে আমার তাকদির আসবে এবং সব সমস্যার সমাধান করে দিবে। তার সাথে গেলে আমরা কোনো আশ্রয় পাব। আর সত্যিই আমাদের তাকদির তখন দৃষ্টিগোচর হয়। আমাদের আগেই এখানে এসেছিল চাচা। আর এই চাচাই এখন আমাদের তাকদির।
এমনিতেই চাচা খুব একটা নীতি-নৈতিকতার ধার ধারতেন না। তিনি যখন নিক্ষিপ্ত হলেন রাস্তায়, নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি; জোর করেই এক ইহুদি বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলেন। নিজের মালপত্র রেখে রাগত স্বরে বলেছিলেন, তোমরা ফিলিস্তিনে যাও!
তারা ফিলিস্তিনে যাবে না, কিন্তু তারা এমন রাগী মানুষকে দেখে ভয় পেয়ে পাশের কক্ষে চলে যায়। চাচা সেদিন পান একটি ছাদ আর পাকা মেঝে।
চাচা এখন আমাদের সেই ঘরেই নিয়ে যাচ্ছেন। তার মালামাল আর পরিবারের সাথে আমরাও আশ্রয় নিলাম সেখানে। সেই রাতে আমরা বড়দের পোশাক দিয়ে শরীর আবৃত করে মেঝেতে ঘুমাই। সকালে জেগে দেখি বড়রা চেয়ারে বসেই রাত কাটিয়েছে। এর পর থেকে দুর্ভাগ্য যেন এক মসৃন পথ দিয়ে পৌঁছে যায় আমাদের সবার শিরায় শিরায়।
সায়দাতে আমরা বেশি দিন থাকিনি। আমাদের জন্য চাচার এই কক্ষটি যথেষ্ট প্রশস্ত ছিল না, তবু তিন রাত কাটিয়েছি সেখানে। এরপর মা বাবাকে তাগাদা দিতে শুরু করেন কোনো কাজ শুরু করার জন্য। অথবা যেন আমরা ফিরে যাই আমাদের কমলার বাগানে। কিন্তু বাবা ক্রুদ্ধ হয়ে ধমকে ওঠেন মাকে। তারপর মা-ও আর কিছু বলে না। শুরু হতে থাকে আমাদের পারিবারিক সমস্যা। একটি সুখী যৌথ পরিবার পিছনে ফেলে আসে তাদের ভূমি, বাড়ি আর শহীদদের।
আমি জানি না—কোথা থেকে বাবার কাছে টাকা আসত। জানতাম যে তিনি গয়না বিক্রি করেছেন। যে গয়না একদিন তিনি মাকে কিনে দিয়েছিলেন তাকে খুশি করার জন্য; যে গয়না পরে মা গর্ব করে সবাইকে বলতেন যে তার স্বামী তাকে ভালোবেসে কিনে দিয়েছেন; কিন্তু এই গয়না বিক্রির টাকা আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম ছিল। আমাদের আরও অনেক টাকার প্রয়োজন। আমরা কি অন্যদের কাছে ধার করতে পারি? অথবা বাবার কাছে আরও গোপন কোনো বস্তু আছে, যা বিক্রি করা যায়। আমি আসলে এসব কিছুই জানি না। কিন্তু মনে পড়ে, আমরা চলে যাই সায়দা শহর থেকে শহরতলির দিকে এক গ্রামে। সেই গ্রামের এক পাথুরে উঁচু প্রান্তরে বসে বাবাকে প্রথম হাসতে দেখি। মে মাসের ১৫ তারিখে তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন বিজিত সৈন্যদের পথ চেয়ে।
১৫ মে আসে বহু অপেক্ষার পর। বারোটার পর বাবা পা দিয়ে মৃদু ঠেলা দিয়ে আমাকে ওঠানোর চেষ্টা করেন। আমি তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম। বাবা আমাকে জাগাতে জাগাতে খুব আশান্বিত কণ্ঠে বলেন, ওঠো আর সাক্ষী থাকো আরব সৈন্যদের ফিলিস্তিন অভিযানের। আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েই মধ্যরাতে পাহাড় বেয়ে খালি পায়ে নিচের রাস্তায় নেমে আসি বাবার সাথে। প্রায় মাইলখানেক পথ হেঁটে আসি। বড়-ছোট সবাই খুশিতে পাগলের মতো নাচতে শুরু করি। দূরের পথে গাড়ির আলো দেখা যায়; যে গাড়িগুলো উঠে যাচ্ছে রাস নাকুরার পাহাড়ি পথ বেয়ে। রাস্তায় পৌঁছে আমার ঠান্ডা লাগতে শুরু করে। কিন্তু বাবার আনন্দ চিৎকারে আমাদের সব অনুভূতি হারিয়ে যায়। সৈন্যদের ট্রাকের পিছনে বাবা শিশুদের মতো নাচতে শুরু করেন। সৈন্যদের অভিবাদন জানান। চিৎকার করে তাদের উদ্দেশে অনেক কিছু বলেন এবং হাঁপাতে থাকেন উত্তেজনায়। আমরাও তাকে ঘিরে নাচতে থাকি আর চিৎকার করি। ভালো সৈন্যগুলো হেলমেটের নিচ দিয়ে নীরব ও স্থির দৃষ্টিতে আমাদের দিকে শুধু একটু তাকায়। আমরা সবাই তখন হাঁপাচ্ছিলাম। পঞ্চাশোর্ধ আমার বাবা তখন তরুণদের মতো লাফাতে লাফাতে পকেট থেকে সিগারেট বের করে সৈন্যদের দিকে ছুড়ে দেন আর উৎসাহিত করতে থাকেন। ছাগলের বাচ্চার মতো আমরাও বাবাকে ঘিরে লাফাতে থাকি।
হঠাৎ করেই গাড়ির বহর শেষ হয়। আমরাও ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরতে শুরু করি। অন্ধকার পথে বাবা আর কোনো কথা বলছেন না। আমাদেরও আর কথা বলার মতো শক্তি অবশিষ্ট নাই। হঠাৎ পাশ দিয়ে যাওয়া গাড়ির আলো বাবার মুখে পড়তেই দেখলাম তার দুই গাল বেয়ে অশ্রু ঝরছে।
এরপর, সবকিছু ঘটতে থাকে খুবই ধীরে। কথার ফুলঝুরিতে প্রথমে আমরা প্রতারিত হই; তারপর সত্যিই সত্যিই আমরা ধোঁকা খাই। নতুন করে আবার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে চেহারাগুলো। বাবার খুব কষ্ট হতো ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে কথা উঠলে। তিনি আর বলতে পারতেন না তার সুখী অতীত জীবন সম্পর্কে, তার বাড়ি বা বাগান নিয়ে। তার নতুন জীবনে দুশ্চিন্তার পাহাড় হয়ে উঠলাম আমরা। খারাপ মানুষের মতো তিনি একটি সহজ উপায় আবিষ্কার করেছিলেন। খুব ভোরে তিনি আমাদের পাহাড়ে যেতে বলতেন। এর অর্থ হলো যেন আমরা সেই সময়ে নাশতার জন্য বিরক্ত না করি।
সব বিষয় আরও কঠিন হতে থাকে। সহজ বিষয়গুলো কঠিন লাগতে শুরু করে বাবার কাছে। আমার ঠিক মনে নাই—কী জিনিস চেয়েছিল কেউ একজন বাবার কাছে। তিনি লাফিয়ে ওঠেন এবং বৈদ্যুতিক শক খাবার মতোই কাঁপতে থাকেন। তিনি আমাদের দিকে তাকান। মনে হয় তিনি কোনো কূটবুদ্ধি পেয়ে গেছেন। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি এমন যেন তিনি একটি সন্তোষজনক সমাধান পেয়েছেন অবশেষে; যেন তিনি সেই মানুষ, যিনি বুঝতে পারছেন এবার তার সমস্যা শেষ হচ্ছে।
কিন্তু আবার ভয়ংকর কিছু করার আগে তিনি ভীত হয়ে বকাঝকা শুরু করেন। তিনি চারপাশ ঘুরতে শুরু করলেন যেন এমন কিছু একটা খুঁজছেন, যা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। তারপর একটা বাক্স বের করলেন, যা আমরা আকা থেকে এনেছিলাম। খুব কম্পিত রাগান্বিত হাতে তিনি কিছু বের করার চেষ্টা করছেন। মা মুহূর্তেই সব বুঝে ফেললেন এবং তাই করলেন, যা প্রত্যকে মা-ই করেন সন্তানকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে। আমাদের সবাইকে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দিয়ে পাহাড়ের দিকে যেতে বললেন। কিন্তু আমরা কোথাও গেলাম না। জানালার ফাঁক দিয়ে সব দেখতে থাকলাম। বাবা রাগান্বিত হয়ে বলছেন, আমি ওদের সবাইকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করতে চাই। আমি সব শেষ করে দিতে চাই। আমি চাই...
এরপর আবার বাবা চুপ হয়ে গেলেন। আমরা তখন দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, বাবা মেঝেতে পড়ে গোঙাচ্ছেন। দাঁত কামড়িয়ে কাঁদছেন। আর মা পাশে বসে ভীত হয়ে তাকে দেখছেন।
আমরা বেশি কিছু বুঝতে পারিনি। কিন্তু তার পাশে একটা কালো পিস্তল পড়ে থাকতে দেখে বুঝলাম তিনি কী বলছিলেন। শিশু যেমন হঠাৎ ভয়ংকর কোনো দৈত্য দেখে ভয়ে দৌড়াবে-পালাবে, আমি তেমন দৌড় দিলাম পাহাড়ের দিকে। পালিয়ে গেলাম সেই বাড়ি থেকে।
যেই মুহূর্তে আমি বাড়ি থেকে দূরে গেলাম, তখনই যেন শৈশব থেকেও দূরে সরে এলাম। বুঝলাম আমাদের জীবন আর আনন্দময় সহজ কোনো জীবন নয়। এখন আমাদের নীরব হয়ে বাঁচতে হবে। জীবনের এই মুহূর্তে এসে শুধু সবার মাথায় একটি করে গুলিই একমাত্র সমাধান হতে পারে। তাই এখন বুঝদারের মতো আচরণ করতে হবে। খুব ক্ষুধার্ত হলেও আর খাবার চাওয়া যাবে না। বাবা যখন তার সমস্যার কথা বলবে, তখন কোনো কথা বলা যাবে না। বাবা যখন বলবেন, পাহাড়ের দিকে চলে যাও আর দুপুরের আগে ফিরবে না, তখন মাথা ঝুঁকে চলে যেতে হবে। আমরা ফিরে আসি সন্ধ্যায়, যখন আমাদের তাঁবুগুলো অন্ধকার হয়ে পড়ে। বাবা এখনো অসুস্থ আর মা তার পাশে বসা। বিড়ালের মতো অন্ধকারে আমাদের চোখগুলো জ্বলজ্বল করে। আর ঠোঁটগুলো আঠা দিয়ে লাগানো, যা কখনোই আর খুলবে না। দীর্ঘ রোগা-ভোগার কারণে শীর্ণ ঠোঁটগুলো স্থায়ীভাবে বিবর্ণ হয়ে গেছে।
আমরা এখানে স্তূপাকারে বসবাস করছি যেমন আমাদের শৈশব ছেড়ে বহু দূরে, তেমনি আমাদের কমলার দেশে থেকেও অনেক দূরে। এক কৃষক আমাদের বলেছিল, যে হাত কমলার গাছে পানি ঢেলে যত্ন নিয়ে পরিচর্যা করে, সেই হাত বদলে গেলে কমলার রংও বিবর্ণ হয়ে যায়। বাবা এখন অসুস্থ হয়ে শয্যাগত আর মায়ের চোখের অশ্রু আজও শুকায়নি।
বহিষ্কৃত মানুষের মতো খুব পা টিপে টিপে আমি ঘরে ঢুকি। বাবার দিকে তাকাতেই দেখলাম এখনো রাগী চোখেই আমাকে দেখছেন। তখনই চোখে পড়ল ছোট টেবিলের ওপর সেই পিস্তল আর একটি কমলা। শুকনা কুঁচকানো এক কমলা।
কুয়েত, ১৯৫৮ [আরবি থেকে অনুবাদ]