‘মাল্যবান এক্সপ্রেস’
'মাল্যবান এক্সপ্রেস'-এ যদি ভ্রমণ করতে চান, তাহলে কোনো এক শীতের সন্ধ্যায় জরাজীর্ণ শ্যাওলা ধরা স্টেশনে একা বসে থাকতে হবে আপনাকে। হাড় হিম করা ঠান্ডার মাঝে স্টেশনের ভুতুড়ে বাতিগুলো যখন একে একে জ্বলে উঠে অন্ধকার আরও বাড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করবে, কাঁথা-কম্বলে জবুথবু হয়ে থাকা শীতের কাছে আত্মসমর্পণ করা অসহায় লাইনম্যান একটা লণ্ঠন হাতে নিয়ে সিগন্যাল দেওয়ার চিন্তাভাবনা করবে, তখনই আপনার পাশে এক বুড়ো লোক এসে বসবে। লোকটির চোখের সাদা অংশ হবে আশ্চর্যজনকভাবে হলুদ, থাকবে মাথায় বস্তাপচা বাসি একটা কানটুপি। পাশে বসে ফিসফিস করে কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণে আপনাকে জিজ্ঞাসা করবে, 'কবিতা আছে? নাকি কিনবেন একটা?'
বুঝে নিবেন 'মাল্যবান এক্সপ্রেসের' যাত্রী হতে যাচ্ছেন আপনি। জানা কথা, কবিতা আপনি কিনবেন না। তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে আগাগোড়া সেই লোককে মেপে জিজ্ঞাসা করবেন, 'কী কিনব?'
'কবিতা। কবিতা দরকার আপনার একটা।' লোকটার এই বাক্য শুনে চমৎকৃত হবেন।
'আপনার একটা কবিতা দরকার'—এই ধরনের কথা তো কখনো শোনেননি আগে। ভাত, মাছ, জামা, জুতো, টয়লেট দরকার হয় শুনেছেন। কিন্তু গল্প-কবিতা এসবও যে দরকার হয়, সেটা কি শুনেছেন? গল্প-কবিতা তো শখের জিনিস। জীবনে একটাও গল্প-কবিতা না পড়েও কত মানুষ তো দিব্যি দিন কাটিয়ে দিচ্ছে।
'কত টাকা?' কিনবেন না জেনেও দাম জানতে চাইবেন আপনি।
'পঞ্চাশ টাকা।' লোকটি তার সাপের মতো কিলবিল করা হাতের রগ দেখিয়ে উত্তর দিবে।
'বইয়ের দাম পঞ্চাশ টাকা?'
লোকটি পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে বলল, 'না, এই একটা কবিতা।'
একটা অট্টহাসি আটকিয়ে আর একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে তাকে জানিয়ে দিবেন লাগবে না।
লোকটির উচিত হবে কবিতা বিক্রির জন্যে অনুরোধ করার বা লেগে থাকার। কিন্তু আপনাকে অবাক করে দিয়ে শামুকের চেয়েও ধীরগতিতে উঠে চলে যাবে সে। ঠান্ডা তাড়ানোর অজুহাতে একটা সিগারেট ধরিয়ে এক মুখ ধোঁয়া ছাড়তেই দোদুল্যমান গতিতে এসে হাজির হবে 'মাল্যবান এক্সপ্রেস'। কবুতরের খোপের মতো টিকিট কাউন্টারে যাবেন টিকিটের জন্যে। ট্রেন আসার পরেই টিকিট কাটার নিয়ম এখানে।
'কত টাকা?' টিকিট হাতে নিয়ে কাউন্টারে জিজ্ঞাসা করলে আপনার প্রশ্ন শুনে লোকটা চোখ তুলে তাকাবে। মনে হবে অনেকদিন পর সে এই প্রশ্ন শুনেছে। 'টাকা লাগবে না।' এরপর সে তার সামনে রাখা ময়লা একটা ডায়েরি খুলে কী যেন দেখে জিজ্ঞাসা করবে 'আজ তো রমাপদ বাবু থাকার কথা। দেখা হইছিল?'
'কোন বাবু?'
'রমাপদ বাবু। কবিতা বেচে।'
'হ্যাঁ দেখা হইছে।'
'ঠিক আছে যান।'
পাগল নাকি এই স্টেশনের মানুষজন? টাকা ছাড়া টিকিট। বাহ! ভালোই তো। ঠিক এইসব ভাবতে ভাবতে ট্রেনে উঠে পড়বেন আপনি। ট্রেনের ভেতরের পরিবেশটা হবে প্রচণ্ড শীতল এবং প্রচণ্ড নির্বিকার।
আপনার টিকিটের সিট নাম্বার মিলিয়ে বসার পর খেয়াল করবেন, পাশের সিটের যাত্রী বানরটুপি পরে চোখমুখ ঢেকে ফেলেছে। দেখতে দেখতে বাকি সিটগুলো ভর্তি হয়ে যাবে। এরপর ধীরে ধীরে দুলে দুলে ট্রেন চলতে আরম্ভ করবে। কান পাতলেই শুনবেন পাশের লোকটা একটা কাগজ দেখে কী যেন বিড়বিড় করছে।
'এই যে দাদা জানালাটা বন্ধ করেন, বাতাস ঢুকতেছে।' পাশের যাত্রীকে বললে সে প্রথমবার আপনার দিকে তাকাবে। বানরটুপির ভেতর থেকে তার কুতকুতে চোখ দিয়ে আপনাকে মেপে দেখবে যেন। কিন্তু জানালাটা বন্ধ করবে না।
খানিক বাদেই ট্রেনের ভেতরে কয়েকটা লাইট জ্বলে উঠে কামরাগুলোর আলো-আঁধারির খেলা বাড়িয়ে দিবে। এই প্রথম খেয়াল করবেন ট্রেনের দেয়ালে কিছু লাইন লেখা রয়েছে। কয়েকটা লাইন কবিতা বলে মনে হবে আপনার।
'যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের; মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা
এই জেনে।'
'তবুও পেঁচা জাগে;
গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহুর্তের ভিক্ষা মাগে।
আরেকটি প্রভাতের ইশারায় অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে'
'একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাবো
আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।'
'কয়েকটি আদিম সর্পিণী সহোদরার মতো
এই যে ট্রামের লাইন ছড়িয়ে আছে
পায়ের তলে, সমস্ত শরীরের রক্তেএদের
বিষাক্ত স্পর্শ অনুভব করে হাঁটছি আমি।'
হঠাৎ আশেপাশের সবার মধ্যে কেমন একটা চাঞ্চল্য অনুভব করবেন। এরপরই দেখবেন ভোজবাজির মতো কোথা থেকে ফস করে চার-পাঁচজন লোক এসে হাজির হয়েছে।
'কবিতা বের করেন সবাই!' ষণ্ডামার্কা একজন ঘোষণা করতেই সবাই পকেট, ব্যাগ থেকে কাগজ বের করতে শুরু করবে।
'দাদা, কবিতা মানে?' পাশের লোককে জিজ্ঞাসা করবেন।
'টিকিট এর কথা কইতেছে!' নির্বিকার থাকবে লোকটি।
'কিন্তু কবিতা বলতেছে কেন?'
'নতুন নাকি আপনে? কবিতা আনেন নাই?'
আপনার নিশ্চুপ প্রশ্নবোধকসহ চেহারা দেখে লোকটা তার বানরটুপি খুলে মানুষ হবে। এরপর ব্যাখ্যা করা শুরু করবে, 'এইখানে টিকিট লাগে শুধু সিট নাম্বার দেইখা মিলাই বসবার জন্যে। আর টাকার বদলে লাগে কবিতা। নতুন কবিতা দেখাইতে হয়। নিজে লিইখ্যা আনতে পারলে ভালো, না হইলে স্টেশনে অনেকেই বেচে, ওদের থেকে কিনতে হয়। পুরান কবিতা হইলে হবে না আবার। ধাক্কা মাইরা ট্রেন থেইকা ফালাই দিবে।' প্রথমে লোকটা ঠাট্টা ফাইজলামি করছে বলে মনে হবে আপনার। কিন্তু এরই মধ্যে দেখবেন একজন কবিতা বের করে পড়তে শুরু করেছে,
'কোজাগরি চাঁদ আজ সওদা করতে বের হয়েছে,
সাথে নেই পয়সা'
'কিন্তু আমার তো কবিতা নাই।' একের পর এক যাত্রীর কবিতা পড়ার দৃশ্য দেখে পাশের লোকটাকে ফিসফিস করে বলবেন। নিজের অজান্তে কখন ফিসফিস করা শুরু করেছেন খেয়ালই করে উঠতে পারবেন না। কী হচ্ছে বা কী হতে যাচ্ছে, সেসব ঠিকঠাক বুঝে ওঠার একটা ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাবেন প্রতিনিয়ত।
'ক্যান? স্টেশনে কেউ কবিতা বেচতে যায় নাই আপনার কাছে? আজ তো রমাপদ বাবু ছিল।'
'গেছিল। আমি তো জানতাম না।'
'না জানলে আর কী!' লোকটা বিরাট একটা হাই তুলবে।
এর মধ্যেই পর্দায় আবির্ভাব ঘটবে নতুন একজনের। গোলগাল বেটে, ধুতি ও পাঞ্জাবি পরা সুবোধ চেহারার এক লোক। দেখবেন বাকিরা তাকে সম্ভ্রমে রাস্তা ছেড়ে দিচ্ছে। কেউ যখন কবিতা পাঠ শুনবে, লোকটি কেমন যেন আনমনা হয়ে যাবে। এক মহিলা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলবে, 'পড়বার পারি না।' লোকটা এক পলক দেখে কাগজ ফেরত দিবে। তার জহুরির চোখে যেন নিমিষেই ধরা পড়ে যাচ্ছে নতুন ও পুরাতন কবিতার পার্থক্য।
'উনি কে?' পাশের যাত্রীকে শুধাবেন।
'কবি সাহেব।'
'নাম কী?'
'নাম জানি না।'
এর মধ্যে একজনের কাগজ দেখে কবির মুখে একটা হাসি ফুটে উঠবে। সেই হাসি দেখে মনে হবে দুষ্টুমি করতে গিয়ে কোনো বাচ্চা যেন ধরা পড়েছে।
'ধরা পড়ছে!' আপনার পাশের লোক ফিসফিস করবে।
'কিসের ধরা?' আপনিও ফিসফিস করবেন।
'পুরান কবিতা চালাইতে গেছিল।'
'চুনিলাল!' কবির ডাক শুনে পাকানো শরীরের এক লোক এগিয়ে আসবে।
টেনে ধাক্কা দিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দিবে ওই লোককে।
এই দৃশ্য দেখে আপনার মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডাও না গরম না—এ রকম নাতিশীতোষ্ণ একটা স্রোত বয়ে যাবে। নিজের বিপদটা খুব কাছ থেকে দেখতে শুরু করবেন আপনি।
এভাবেই কবিতা পড়তে পড়তে, শুনতে শুনতে অনন্তকাল পর যেন হঠাৎ দেখবেন আপনার সামনে এসে দলটা হাজির হয়েছে। কবিকে সামনাসামনি দেখে চেনা চেনা লাগবে আপনার। তার শান্ত, করুণ, ক্লান্ত মুখ দেখে মনে হবে তিনি হাজার বছর ধরে যেন পথ হেঁটে আসছে পৃথিবীর পথে।
আপনি দাঁড়িয়ে হড়বড় করে বলতে শুরু করবেন, 'দেখুন আমি এখানে নতুন। আপনাদের নিয়ম জানতাম না।'
'কেউ যায়নি আপনার কাছে কবিতা নিয়ে?' জলদগম্ভীরস্বরে কবির জিজ্ঞাসা।
'গিয়েছিল। কিন্তু আমি...'
'কবিতা কেনার প্রয়োজন বোধ করেননি।'
'না মানে...'
'কবিতার দরকার নেই চলতে-ফিরতে?' কবি বলে যাবে, 'সকলেই কবি না, কেউ কেউ কবি। সকলের কবিতা তো আর কিনতে বলা হয় না আপনাদের। মাঝে মাঝেই কবিতা সৃষ্টি করার সময় আসে জীবনে, কবিতা কেনার সময় হয় জীবনে। মাল্যবান এক্সপ্রেসে চড়তে গেলে...' তারপরেই কী যেন মনে পড়ে যাবে কবির। চুনিলালকে ইশারা করবে।
'চমৎকার! ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার!' এই বলে চুনিলাল হাসতে হাসতে এগিয়ে যাবে আপনার দিকে। সাথে আর একজনকে নিয়ে টেনেহিঁচড়ে ট্রেনের দরজায় নিয়ে যাবে।
আপনি চিৎকার করতে করতে বলবেন, 'ট্রেনে কাটা পড়ব,দয়া করুন আমাকে।'
'কবিও তো ট্রামে কাটা পড়েছিল। কেউ তো দয়া করেনি।' পেছন থেকে কে যেন বলে উঠবে। প্রচণ্ড শব্দের মধ্যে শূন্যে ভেসে পড়বেন আপনি।
এরপর আর কিছু মনে থাকবে না আপনার। হাসপাতালের এক বিছানায় ঘুম ভাঙবে। মাথায় আর হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে। চোখ মেলে দেখবেন এক নার্সের ম্লান মুখ।
'কোথায় আমি?' ফিসফিস করে জানতে চাইবেন।
'শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে।'
পাশের সিটে তাকালে দেখতে পাবেন, একেও ট্রেন থেকে ফেলা হয়েছিল। সেই নার্স আপনাকে জানাবে এক অদ্ভুত তথ্য। মাল্যবান এক্সপ্রেস থেকে যাদের ফেলা হয়, তারা কেউ মারা যায় না। সামান্য আহত হয়। তাদের প্রায় সকলেরই চিকিৎসা হয় এই হাসপাতালে। কে বা কারা সেই সব আহত রোগীদের বয়ে নিয়ে আসে, কেউ জানে না। একটু সুস্থ হলেই বাড়ি চলে যেতে পারবেন আপনি। সুস্থ হয়ে এই পুরো ঘটনাটা বিশ্বাস হতে চাইবে না আপনার। তারপরেও এরপর থেকে যখনই টেন ভ্রমণ করতে যাবেন, সাথে একটা কবিতা রাখতে শুরু করবেন আপনি। আর সাথে কবিতা না থাকলেও সব সময় সতর্কচিত্তে কান পেতে রাখবেন কারও প্রশ্নের জন্যে, 'কবিতা আছে? নাকি কিনবেন একটা?'
সাথে সাথেই বুঝে নিবেন 'মাল্যবান এক্সপ্রেসের' যাত্রী হতে যাচ্ছেন আপনি।