ছাতি আর ছত্রধর—ইতিহাস, লোকশ্রুতি ও হাসিমশকরা
১.ছাতি মাথায় চলেছেন নাসিরুদ্দিন হোজ্জা। সাথে তার এক বন্ধু। ছাতি হোজ্জার। কওয়া নাই বলা নাই বৃষ্টি এলো ঝমঝমিয়ে। বেগতিক দেখে বন্ধু ছুটলেন। হোজ্জা তাকে থামালেন- বৃষ্টি আল্লাহর রহমত না? বন্ধু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। - তা হলে ভাগছ কেন? এবারে বললেন হোজ্জা। লা জবাব বন্ধু বেচারা। ভিজতে ভিজতে চললেন।
সব দিন সমান যায় না। ক'দিন পরের কথা। ছাতি বন্ধুর। তার সাথে চলেছেন হোজ্জা। আবারও বৃষ্টি এলো। এবারে আবাকাবা-পাগড়ি সামাল দিয়ে দৌড় দিলেন হোজ্জা। বন্ধু তাকে থামানোর চেষ্টা করলেন। -হোজ্জা করো কী? বৃষ্টি দেখে ভাগছ কেন? ও কি আল্লার রহমত নয়।
-ভাইরে সেই জন্যেই তো এই দৌড়। আল্লাহর রহমত যত পায়ের নিচে কম পড়ে ততই ভালো। তাই না?' না থেমেই হোজ্জার জবাব।
হ্যাঁ, ছাতিকে ঘিরে এমন রসাল গাল-গপ্প জানেন না তেমন মানুষ বিরল। ভিনদেশি রসিকতাকে আত্তীকরণের রাজা ছিলেন ভারতীয় লেখক তারাপদ। তারাপদের আদি বাড়ি বাংলাদেশের চমচমের দেশে। টাঙ্গাইল। ছাতি কিনেন আর হারান। জেরবার দশা। মহা মুশকিল। ছাতায় নাম লিখে কোনও ফয়দা হয় না। এমন যন্ত্রণার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিজের ছাতায় তারাপদ লিখে রাখলেন, এই ছাতা তারাপদের কাছ থেকে চুরি করা। নিজের ছাতাকে চুরির হাত থেকে বাঁচানোর মহাজনী পন্থাই ধরেছিলেন পরলোকগত কবি ও লেখক তারাপদ।
আমাদের অনেকের কাছেই ছাতির সাথে মিশে আছে মাইকেল মধুসূদন দত্ত। নাইনে তার কবিতা পড়তে হয়েছে। সেখানে রাবণের রাজসভার বর্ণনা দিতে যেয়ে বলা হয়েছে:
'…ধরে ছত্র ছত্রধর; আহা
হরকোপানলে কাম যেন রে না পুড়ি
দাঁড়ান সে সভাতলে ছত্রধর-রূপে!'
আমাদের পরিচিত এক সুদর্শন এবং হাসিখুশি বৃদ্ধ ছাতি হাতে বের হলে এ লাইনগুলো আবৃত্তি করে শোনাতেন। স্কুলে বাংলা স্যারের বিশদ ব্যাখ্যার গুণে কবিতার এ অংশ অবোধ্য বা দুর্বোধ্য মনে হতো না। তারপর তিনি বলতেন, আমারে কী সভাতলের সেই ছত্রধরের মতো মনে হয়! জবাবের অপেক্ষা না করে হাসতে হাসতে ছাতি ঘুরাতে ঘুরাতে চলে যেতেন।
২. প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে ছাতা মাথায় নিঃশঙ্ক চিত্তে চলছি আজকাল আপনি আমি। পুরুষ। নারী। সবাই। কিন্তু পুরুষের জন্য ছাতি মাথায় প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে চলা মোটেও সহজ ছিল না ইংল্যান্ডে। মাত্র ৩০০ বছর আগে ছাতা ব্যবহার করে ব্যাপক ঠেলার মুখে পড়েন জোনাস হ্যানওয়ে। কিন্তু তারও আগে ফ্রান্সে ছাতা ব্যবহার হতো। এ চলকে নেহাৎ ইতর প্রথা বলে মনে করত রাজতন্ত্রের ছাতার ছায়ায় বেড়ে ওঠা ইংল্যান্ডের গণতান্ত্রিক মানুষরা। ফ্রান্স ঘুরে এসে হ্যানওয়ে একদিন ইংল্যান্ডের কুসংস্কারকে ঠেলে ছাতা মাথায় রাস্তায় নামেন। তৎকালীন ইংল্যান্ডে এক জাতের ঘোড়ার গাড়ি চলত। আমাদের টমটমের সাথে তার বেশ মিল ছিল। বৃষ্টি বা বরফের সময় সাধারণ মানুষের আশ্রয় হতো ওসব টমটম। পুরুষ যদি ছাতা ব্যবহার শুরু করে তবে ওই টমটমওলাদের আয়-রোজগারে লাল বাত্তি জ্বলবে। কাজেই ছাতি ফুলিয়ে ছাতা মাথায় জোনাস হ্যানওয়ের ওপর হামলা করল তারা। ইট-পাটকেল মারতে থাকে এ সব গাড়ির গাড়োয়ানকুল। আর সাথে অন্য লোকদেরও জড়ো করেনি তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। তিন তিনটি গাড়ি তাকে একবার চাপা দিতেও চেষ্টা করেছিল। ব্যাঙ চেপটা হওয়ার হাত থেকে সে যাত্রা খোশ বরাতের কারণে রক্ষা পান। কিন্তু 'ছাতি ফাটবে মাথা ভাঙ্গবে তবু খেলা ছেড়ে উঠব না' বলে গো ধরেছিলেন জোনাস হ্যানওয়ে। হামলার মুখেও ছাতি ছাড়েননি। ততদিনে ইংল্যান্ডের পুরুষকুল বুঝে গেছেন ছাতা ব্যবহারের সুবিধা ও উপকার। ইংল্যান্ডের পুরুষদের হাতে হাতে উঠে এসেছে ছাতা। কালে কালে ছাতা এবং হ্যানওয়ে সমার্থক হয়ে গেছে। ইংরেজিতে ছাতার আরেক নাম হ্যানওয়ে।
ছাতার সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় বৃষ্টির দিনে। অথচ ইতিহাস বলে, বৃষ্টি নয় রোদ ঠেকানোর কাজে ব্যবহারের জন্যেই মূলত ছাতা আবিষ্কার হয়েছিল। তেহরানে দেখেছি বৃষ্টি বা তুষার দিনে ছাতা ব্যবহার হচ্ছে। দেখেনি, না কখনোই দেখেনি, তীব্র গরমে রোদের জ্বালা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কেউ ছাতা ব্যবহার করছেন। তেহরানের অন্যতম সুন্দর এবং খ্যাতনামা নগর উদ্যান পার্কে মিল্লিতে ঢোকার পথে ছাতা মাথায় এক ব্যক্তির ভাস্কর্য আছে। ছাতা থেকে তিরতির করে পানি পড়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য ছাতা ব্যবহার হচ্ছে।
আবিষ্কারের কথা ধরে প্রশ্নটি উঠবে ছাতা কে প্রথম আবিষ্কার করেন? ব্যাপারটা গ্যাঞ্জামের। কেউ বলেন মিশর, কেউ বলেন চীন ছাতা আবিষ্কার করেছে। প্রায় চার হাজার বছর আগের ইতিহাস বলছে, মিসর, গ্রিস ও চীনের চিত্রকর্মে ছাতার নিদর্শন রয়েছে। মিশরীয় চিত্রলিপিতে এবং সমাধি-মন্দিরে আঁকা ছবি থেকে বোঝা যায়, ২৫০০-২৪০০ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দের দিকে রাজা ও দেবতাদের ছায়াদানের জন্য ছাতা ব্যবহার করা হতো। আজকের দিনে ছাতার মতো সেগুলো গোলাকার ছিল না। বরং ছিল চারকোণা সমতল। বৃষ্টি ঠেকানো নয়, ছায়া দেওয়ার উদ্দেশ্যেই প্রথম ছাতা তৈরি করা হয়েছিল। এদিকে, তেল মাখানো বা মোম দেওয়া কাগজ দিয়ে ছাতাকে পানিরোধক করার কর্মটি প্রথম করেছিল চীন। সে সময় ছাতার কাঠামো হিসেবে ব্যবহার হতো বাঁশ বা মালবেরি গাছের বাকল।
ছাতার ইতিহাসের সাথে রাজকীয় বিষয়-আশয় জড়িত। অতীতে কেবল অভিজাত ব্যক্তিরাই ছাতা ব্যবহার করতে পারতেন। পরিব্রাজক মার্কো পোলার কাহিনি থেকে জানি, ১২৭৫ খ্রিষ্টাব্দে কুবলাই খানের দরবারে তিনি দেখেছেন সেনাপতির মাথার ওপর সম্মানসূচক ছাতা মেলে ধরা হয়েছে। রাজছত্রের ব্যবহার চীন থেকে রপ্ত করে জাপান ও কোরিয়া। জাপানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কেবল রাজাদেরই ছাতা ব্যবহারের অধিকার ছিল। একই চল ছিল কোরিয়াতেও। বরং সেখানে আরেক ধাপ এগিয়েছিল। ছাতাকে রাজকীয় প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হতো। প্রাচীন কোরিয়াতে রাজার ছবি আঁকা যেত না। রাজার উপস্থিতি বোঝাতে ঘোড়ার উপর রাজছত্রের ছায়া আঁকতেন শিল্পীরা।
৩. রাজছত্রের চল ছিল প্রাচীন আফ্রিকায়। দ্বাদশ শতকে আঁকা ছবি ও প্রাচীন পুস্তক থেকে জানা যায় ইথিওপিয়াতে রাজছত্র ব্যবহারের চল ছিল। ইবনে বতুতার রচনা থেকে জানা যায়, পূর্ব আফ্রিকায় রাজছত্র ব্যবহার হতো। রোদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাজারা ছাতা ব্যবহার করতেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। ইবনে বতুতা ১৪ শতকে পূর্ব আফ্রিকা সফর করেন।
আমাদের উপমহাদেশেও প্রাচীন কালে রাজছত্র ব্যবহার হতো। ৩০০ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দের বৌদ্ধদের প্রাচীন গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সে যুগে এই ভূমিতে ছাতা ব্যবহৃত হতো। ভারতীয় রাজারা ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে রাজছত্র ব্যবহার করতেন। অজন্তা গুহার দেয়াল-চিত্রে ছাতার ছবি আছে। খ্রিষ্টীয় নবম শতকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজছত্রের প্রচলন ঘটতে থাকে। সে সময় কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং জাভার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ রাজছত্র ব্যবহার শুরু করেন। মরক্কোয় বহু শতাব্দী ধরে শাসক ও তার স্বজনরা কেবল ছাতা ব্যবহারের অনুমতি পেতেন। মোগল দরবারে রাজছত্র ব্যবহারের চল থাকবেই সে কথা বুঝতে আমাদের কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
১৮৮৭ সালে প্রিন্স অফ ওয়েলস ভারত সফর করেন। সে সময় সারাক্ষণই তার মাথার ওপর ধরা ছিল বিশাল এক ছাতা। রোদ-তাপ থেকে রক্ষার জন্য এ ছাতা ব্যবহার করা হয়নি। ভারতীয় জনগণের মনে ছাতার সাথে সার্বভৌমত্বের সম্পর্কর বিষয় ছাপ ফেলার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়। ঐতিহাসিক এরিয়েল বিউজোট বলেন, ছাতাবিহীন প্রিন্স এডওয়ার্ড কেবল 'গুরুত্বহীন পশ্চিমা ভ্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত হতেন, ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ সম্রাট বলে তাকে মনে হোতো না।'
বার্মার প্রাচীন রাজধানী আভা'এর রাজাকে সম্বোধন করা হতো, "শ্বেতহস্তী রাজ এবং চব্বিশ ছাতার প্রভু।" ছাতা ব্যবহার করে ত্রয়োদশ শতাব্দীর একজন রাজা তার উত্তরসূরি বেছে নিয়েছিলেন। তিনি তার পাঁচ ছেলেকে বৃত্তাকারে দাঁড় করিয়ে মাঝখানে একটি ছাতা ফেলার ব্যবস্থা করেন। তারপর প্রার্থনা করেন তার পছন্দসই সন্তানের দিকে যেন পড়ে ছাতাটা। এ ভাবে রাজা হলেন রাজপুত্র ওকসানা। তাঁকে সম্বোধন করার সময় বলা হতো, মহান রাজা যিনি ছাতার দৌলতে সিংহাসন লাভ করেছেন!' ছাতা শুধু ছায়া দেয় না। বৃষ্টি ঠেকায় না। সিংহাসনও দিতে পারে। তবে এমন ঘটনা আর কোথাও ঘটেছে কিনা জানা নেই।
প্রাচীন মিশরে ছাতা রাজাদের কেবল সুরক্ষা দেয়নি। শুধুমাত্র সূর্যতাপ থেকে রক্ষা করেনি বরং রাজার উপর প্রসারিত স্বর্গের খিলানকেও বোঝাতো ছাতা। রাজার ঐশ্বরিক মর্যাদাকে প্রকাশ করতো। রাজার ছাতার নীচের "ছায়া"রও প্রতীকী অর্থ ছিল। তবে এ নিয়ে ইতিহাসের পণ্ডিতদের মধ্যে জমজমাট তর্কাতর্কি আছে। কেউ মনে করেন ছাতার ছায়া রাজার সুরক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে। অন্যদিকে আরেক ইতিহাসবেত্তা মনে করেন, এটি কেবল রাজার ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে না শুধুমাত্র মানবকুলের ওপর রাজার ক্ষমতার প্রতীক নয়। বরং সূর্যের উপরেও রাজক্ষমতার প্রতীক হয়েছে এটি। অন্যদিকে রাজা শুধুমাত্র তার ছাতার ছায়া কারও উপর বিস্তার করে তাকে দাসে পরিণত করতে পারে। বা পারে তাকে হত্যাও করতে।
কালিদাস তার শকুন্তলায় ছাতাকে ব্যবহার করেছেন রাজার সার্বভৌমত্ব ও কল্যাণকামিতা প্রসঙ্গে। চীনে ছাতা মহাজগতের প্রতীক হয়ে এসেছে। পোপের শোভাযাত্রায় ছাতা অনিবার্য ভাবেই থাকছে সেই অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে। ব্রিটিশ রাজার অভিষেক অনুষ্ঠানে ছাতাকে দেখা যাবে।
চীনে প্রাচীন কালে ছাতা ব্যবহারের প্রমাণ আছে। ২৫ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দের যুদ্ধবাজ ওয়াং কুয়াং'এর সমাধিতে বন্ধ করা যায় এমন ছাতা পাওয়া গেছে। অষ্টাদশ শতকে ব্রিটিশ ছাতা-নির্মাতারা এমন এক প্রযুক্তি বের করতে যেয়ে হিমসিম খেয়েছেন। এদিকে মিং রাজবংশের মধ্যে( ১৩৬৮ থেকে ১৬৫৫) সমাজে শ্রেণি-ভিত্তিক ছাতা ব্যবহারের শিষ্টাচার মেনে চলা হতো। গভর্নর-জেনারেল বহন করতেন দুটি বড় লাল রেশমের ছাতা। এরপর সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী নানা প্রকারের ছাতা ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হতো। তবে আম জনতা কোনও ভাবেই কাপড় বা রেশম আবৃত ছাতা ব্যবহারের অনুমোদন পেতেন না। শক্ত কাগজ দিয়ে বানানো ছাতা ব্যবহার করেই তাদেরকে খুশি থাকতে হতো।
জাপানেও ছাতা ব্যবহারের জটিল অনুশাসন ছিল। মর্যাদার ভিত্তিতে ছাতার ধরণ নির্বাচিত হতো। সপ্তদশ শতক পর্যন্ত এ অনুশাসন সূর্যোদয়ের দেশটিকে কার্যকর ছিল। সে সময় নগরবাসী ধনীরা বৃষ্টি ঠেকাতে ওয়াগাসা'র ব্যবহার শুরু করেন। কাগজ এবং কাঠের তৈরি ছাতিকে ওয়াগাসা বলা হয়। ধীরে ধীরে ছাতা ব্যবহারের কঠোর অনুশাসন ফিকে হয়ে যায়। ছাতি নিয়ে সামাজিক অনুশাসনকে বাতিল করায় ওয়াগাসা'র ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু কালে কালে ওয়াগাসা'কেও বাতিল হতে হলো। উনিশ শতকের শেষ দিকে পশ্চিমী ছাতা আসতে শুরু করে পূর্বের এ দেশটিতে। ওয়াগাসা'র ব্যবহারও সে সাথে কমতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত এটি বিলীয়মান শিল্পের কাতারে যেয়ে ঠেকে।
৪. তবে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ব্রিটেনের ছাতা ছিল বেশ বড়। ওজনও ছিল গড়ে প্রায় ৪-৫ কেজি। লোহার শিক নয় সে যুগে ছাতা তৈরিতে ব্যবহার হতো কাঠের খণ্ড বা তিমি মাছের কাঁটা। অভিজাত নারীরা প্যারিস থেকে রেশম ও দামি ঝালর বসানো লেসের ছাতা আনাতেন।
বিশ্বের প্রথম ছাতার দোকানের নাম জেমস স্মিথ অ্যান্ড সন্স। ১৮৩০ সালে এটি চালু হয়। দোকানটি ৫৩ নিউ অক্সফোর্ড স্ট্রিটে রয়েছে। আজও তা চালু আছে। এ দিকে ১৮৫২ সালে স্যামুয়েল ফক্স ইস্পাতের সরু শিক দিয়ে ছাতা তৈরি করেন। সে ছাতা রানি ভিক্টোরিয়ার জন্য তৈরি করেছিলেন। ভিক্টোরিয়ার জামানায় ছাতা খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এমনকি রণাঙ্গনেও ছাতা বয়ে নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ ছিল। নেপোলিয়নের সঙ্গে এক যুদ্ধের পর রণক্ষেত্র জুড়ে পড়ে ছিল তলোয়ার, সৈন্যদের ব্যবহৃত থলি আর ছাতা। যুদ্ধক্ষেত্রে ইংরেজদের ছাতার ব্যবহারে বিনোদিত হয়েছে ফরাসিরা। এক ফরাসি সেনা কর্মকর্তা লিখেছেন, বৃষ্টি হচ্ছিল এবং অশ্বারোহী ইংরেজ সেনা কর্মকর্তাদের প্রত্যেকের হাতেই ছিল ছাতা। যা বেশ হাস্যকর মনে হচ্ছিল। তারপর তার ছাতা বন্ধ করে ঘোড়ার জিনের সাথে ঝুলিয়ে রাখলেন। তলোয়ার বের করলেন। আর হামলা শুরু করলেন।
৫. বাংলাদেশে অতীতে আম জনতা ছাতা ব্যবহারের অধিকার রাখতেন না। বৃষ্টি-বাদলার দিতে তাদের ভরসা হতো মাথলা, টোকা বা কচুর পাতা। গ্রামের বিত্ত ও ক্ষমতাবানরাই কেবল ছাতি ব্যবহার করতে পারতেন। অন্যদিকে জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে ছাতা মাথায় যেতে পারতেন না সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে হিন্দু জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে ছাতি মাথায় যাওয়া মুসলমান প্রজাদের জন্য কঠোর ভাবে নিষেধ ছিল।
পরবর্তীতে ছাতার ব্যবহার বাড়লে ঘটকের বগল তলে সর্ব সময়ই ছাতা শোভা পেত। ছাতা বহন করতেন টোলের পণ্ডিত এবং মাদরাসার শিক্ষক। কিংবা স্কুলের হেড মাওলানা। সে সময় লোহার শিক, কালো কাপড় আর বাঁশ বা কাঠের ডান্ডাওলা হতো ছাতি। কাপড় ছিঁড়ে গেলে, ডাণ্ডা ভেঙ্গে গেলে বা শিক নষ্ট হলে ছাতা বাতিল হতো না। মেরামত চলত। গোটা কাপড় বদলে দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। আর কম খরচে কাজ সারতে চাইলে পট্টি লাগান হতো। সুতরাং ছাতি দেখেই মালিকের আর্থিক অবস্থা ঠাহর করা যেত। ছাতা মেরামতকারীরা আসতেন বর্ষার আগেভাগে। সাধারণ ভাবে তাদেরকে অনেকেই ঠাট্টা করে ছাতি ইঞ্জিনিয়ার বলতেন। ১৯৯০'এর দশকের গোড়ার দিকে মগবাজার থেকে নয়াটোলাগামী সড়কটির রেলগেটের আশেপাশে ছাতি মেরামতকারীদের নিয়মিত বসতে দেখেছি। ইদানীং কালে ঢাকায় ছাতা ইঞ্জিনিয়ারদের দেখেনি।
ছাতা কেবল বৃষ্টি থেকে রক্ষা করে না। বা রোদে ছায়া যোগায় না। বরং মাথার ওপর ছাদ হয়ে বিরাজ করে। ছাতাকে ছাদের সাথে তুলনা করাটা নতুন কিছু নয়। ১০০০ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দের চীনা লোককাহিনীতে এ কথারই প্রতিধ্বনি পাওয়া যাবে। সে কালে লাও-পান নামের এক তুখোড় কাঠমিস্ত্রি ছিল। কাঠের ঘর বানানোয় তার সমকক্ষ দূরের কথা ধারে কাছেও কেউ ছিল না। একবার তার স্ত্রী বলল, হ্যাঁ তুমি যে ঘর বানাও তার তুলনা নেই। তবে তোমার ঘর তো নড়াচড়া করতে পারে না। আর আমি যে ঘর বানাই তা মানুষ ইচ্ছা করলেই সাথে নিয়ে ঘুরতে পারবে। এ কথা বলে সেই নারী তুলে ধরল তার তৈরি করা ছাতি।
ছাতির ইতিহাস নিয়ে চমৎকার একটি পুস্তক মেরিয়ন র্যাঙ্কাইনের ব্রোলিওলজি। বইয়ের একটি পর্বে ছাতিকে 'এ হ্যাট ইউথ এ হ্যান্ডেল' বা 'ঠাণ্ডাওলা টুপি' বলা হয়েছে। এ লেখার অনেক তথ্য ও বই থেকে কুড়ানো হয়েছে সে কথা হয়ত না বললেও চলবে। ছাতিকে ইংরেজিতে ব্রোলিও বলা হয় সে কথা জানেন বোদ্ধা পাঠক।
৬. ছাতির সাথে ছোটকাল খুব সুখের হয়নি। ক্লাস সিক্সের কথা। কিনে দেওয়া হলো ছাতি। কিন্তু বৃষ্টির আর দেখা নেই। তারপর এলো সেই বর্ষণ। ছাতি নিয়ে গেলাম স্কুলে। ফিরলাম খালি হাতে। ছাতা আনতে ভুলে গেছি। বাসায় এসে মনে হলো। স্কুলটি বেশি দূরে ছিল না। ছুটলাম। ক্লাসের সম্ভব অসম্ভব সব জায়গায় খুঁজলাম। নেই। হয়ত করুণ মুখ দেখেই কয়েক দিন বাদে আবার কিনে দেওয়া হলো ছাতা। তাতে সাদা অক্ষরে নাম লেখা। এবারও একই ঘটনা ঘটল। ব্যাস। ছাতা আর আমাদের কিনে দেওয়া হয়নি।
ছোট বেলায় দেখতাম বৃষ্টির সময় ছাতার শিকের ফাঁকে কায়দা করে বইখাতা রাখা যেত। অনেককে করতে দেখেছি। ও ভাবে বইখাতা নেওয়ার মধ্যে একটা 'ভাব' ছিল। সে ভাব দেখানোর ইচ্ছা হতো। কিন্তু নিজে সুবিধা করতে পারিনি। নিজের ছাতিই রক্ষা করতে পারেনি। ওটা আর অভ্যাস করব কিভাবে? বাসায় বড়দের ছাতা ধার নিয়ে কয়েকবার চেষ্টা যে করিনি তা তা নয়। প্রতিবার নিজ প্রতিভা বিকাশের আগেই কড়া ধমক। তারপর থেমে যাওয়া। বড়রা মোটেও প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দেননি। তাদের কথা হলো, এতে শিক নষ্ট হয়ে যাবে। বৃষ্টির দিন ওভাবে বইখাতা না নিতে পারার দুঃখ আজও আছে! ঘরে ছাতিও আছে। বইখাতাও আছে। দুঃখবোধও আছে। ইচ্ছাটা নেই। নেই স্কুলও।
ছাতি নিয়ে অনেক চটুকির একটি বেশ মনে ধরেছিল। অনেকেই জানেন, তাও আবার বলছি।
এক সুন্দরী মেয়ে বৃষ্টির মধ্যে ছাতা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো। ঠিক তার পাঁশেই একটা লোক বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে যাচ্ছিলো। তখন মেয়েটি বলল-মেয়ে : আপনি চাইলে আমার ছাতার নিচে আসতে পারেন। লোক : না, বোন। আমি এমনি ঠিক আছি। মেয়ে : কেন? সমস্যা কি? লোক : না মানে, পেছনে আমার স্ত্রী আসছে।
আজকাল বিয়েতেও ছাতি পৌঁছে গেছে। ঘটককে ছাতি দেওয়ার কথা শুনেছি। সে সুবাদে অন্তত দুটি ছাতি আমাদের পাওয়া উচিত ছিল। আমিই আমার বিয়ের সফল ঘটকালি করেছি কিনা! আমার সাথে এ কাজে সহযোগিতা করেছেন এক নারী। মানে সেই আমার গিন্নি। সত্যি কথা হলো আমি করেছি সহঘটকালি। ঘটকালির মূল কাজটা তারই করা। কিন্তু আমাকে বা তাকেও কেউ আজ পর্যন্ত ছাতি দেননি! কপাল!
হ্যাঁ আমি বলছিলাম বিয়ের ছাতির কথা। ইন্টারনেটে আহসান হাবিবের একটা লেখা পড়লাম কদিন আগেই। তবে তালাশ করে সেটা বের করতে পেরেছি। লেখাটার 'ছত্রাংশ' তুলে দিচ্ছি।
''এক বিয়ের দাওয়াতে আমাকেও যেতে হলো। গিয়ে দেখি অতিথিরা সব এসে পৌঁছায়নি, তবে চারিদিকে শুধু ছাতি ছাতি আর ছাতি। কালো ছাতি, সাদা ছাতি, ছাতিতে ছাতিময়। আমার তখন বিখ্যাত রম্যলেখক তারাপদ রায়ের অনবদ্য ছাতা গল্পটা মনে পড়লো (প্রয়াত এই কবি ও রম্য লেখকের সন্মানে এই লেখার নামও ছাতা)। সেই সঙ্গে ছাতা নিয়ে যত জোক সব যেন এক সঙ্গে আমার মস্তিষ্কের নিউট্রাল নেটওয়ার্কে রাশিয়ান মিসাইলের মত হামলা করতে শুরু করল। বরং ছাতা বিষয়ক একটা জোক শুরুতেই শেয়ার করি…
এক লোক শুধু ছাতা হারায়। যথারীতি আবারও ছাতা হারালো একদিন। এক ধর্মীয় আলোচনায় গিয়ে আলোচনা শুনতে শুনতে তার হঠাৎ মনে পড়লো, সে যথারীতি আজও ছাতা হারিয়েছে। সে মনে করার চেষ্টা করতে লাগল ছাতাটা ঠিক কোথায় হারিয়েছে। ওদিকে ধর্মীয় আলোচক তখন বলতে শুরু করেছে, 'তোমরা নীতিভ্রষ্ট হইয়া কখনও পর-নারীর সাথে ব্যাভিচার করিও না...' তখনই তার মনে পড়ল সে ছাতাটা ঠিক কোথায় ফেলে এসেছে!
যা হোক বিয়ের ছাতায় ফিরে আসি। এত ছাতা কেন? ছাতার কারণে বর-বউ কাউকেই দেখার উপায় নেই। হঠাৎ টের পেলাম এতো ছাতার রহস্য। বিয়ের ছবি তোলা হচ্ছে। বর-কনেকে ঘিরে এইসব ছোট-বড় ছাতা, কোনো কোনো ছাতা আবার নাসার মহাজাগতিক অ্যান্টেনার মতো। আমি বর-কনেকে দেখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। ছাতা আর ক্যামেরাম্যানের ভীড়ে তাদের দেখার কোনো বুদ্ধি নেই। অ্যারেঞ্জমেন্টও এমনভাবে করা হয়েছে, অতিথিরা সব বসে থাকবে আর বর কনেকে দেখবে বসে বসে, সে উপায় নেই।'
খোন্দকার রওশন আলী ছিলেন রাজবাড়ীর (সে-সময়ের ফরিদপুরের) পাংশা উপজেলার প্রথম মুসলিম স্নাতক। মেধাবী ও বৃত্তিপ্রাপ্ত কীর্তিমান এই ছাত্র শিক্ষাজীবন শেষ করে নিজ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে যোগ দিয়েছিলেন। চার দশক ধরে শিক্ষকতা করেন। শিক্ষক হিশেবে তাঁর সাফল্যে অনেকেরই ঈর্ষার উদ্রেক করবে। ছাতা নিয়ে ঘটনাটি তারই জীবনের। বৃষ্টির দিন ডাক বাংলাতে জরুরি সভা। সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই ছাতা নিয়ে গেলেন তিনি। নতুন ছাতা। আগের দিন বেড়াল তাড়াতে যেয়ে ছাতার কাঠের হাতলের খানিকটা ভেঙ্গে গেছে। ওটা তার পকেটে ছিল। সভা শেষে আলাপ করছিলেন কারো সাথে। সে সময় নজরে তাঁর নজরে এলো, তারই ছাত্র এবং সহকর্মী ভুলে হোক বা যে কোনও কারণে হোক তার সেই ছাতা হাতে চলছে। খোন্দকার রওশন আলী হাঁক দিলেন, লোকমান এই যে ছাতিটার ভাঙ্গা অংশ আমার কাছে ওটাও নিয়ে যাও। তারপর লোকমান বেচারার অবস্থাটা ভাবুন!