“নিজেদের গৃহে নিজেই অতিথি” বনেচর গুজ্জর যাযাবর
হিমালয়ের বুকে বেঁচে আছে উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলের বিশাল বৈচিত্রময় এক ভাণ্ডার। অপূর্ব এই জীব-বৈচিত্রের পাশাপাশি হিমালয় শত শত বছর ধরে আশ্রয় দিয়েছে আদিবাসি বহু যাযাবর গোষ্ঠী। তাঁরা কখনো সমতলের জীবনে অভ্যস্ত নয়। সমতলে রাজা, রাজ্য পরিবর্তন হয়, পাহাড়ে তাঁদের জীবনে তার কোন প্রভাব পড়ে না। পাহাড়ের রীতিনীতিই তাদের আইন, শাসন।
সময়ের করাল থাবায় পরিবর্তন হয়েছে আবহাওয়ার, পরিবেশের। পাহাড়ের বুনো জীবনেও পড়েছে তার প্রভাব। পাহাড়ে বসবাসকারী আদিম যাযাবর গোষ্ঠীর মানুষ মুখোমুখি হচ্ছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের। কিন্তু তাঁরা প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, প্রকৃতির মতই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা পরিবেশ রক্ষায় অত্যন্ত জরুরী। সমস্যার মুখোমুখি এমনই এক গোষ্ঠী শিভালিক পাহাড়ে বসবাসরত যাযাবর গোষ্ঠী ভন গুজ্জর।
বৃষ্টিস্নাত সতেজ গাছপালায় ঘেরা এক কুড়েঘরের পাশেই একেবারে শুকিয়ে আসা একটা নদীতট। শাখামৃগের দল দোল খেয়ে খেয়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফিয়ে চলছে, দূর হতে ভেসে আসছে বুনোহাতির ডাক। আকাশে মেঘ, চারদিক গুমোট হয়ে আছে। ভ্যাপসা গরমের মধ্যে মাঝে মাঝে বাতাস বইছিল।
গ্রীষ্মের এমন এক বিকেলে একটা খাটিয়ায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে জুম্মুন ঠাণ্ডা বাতাস উপভোগ করছিলেন। তাঁর নাতিরা গবাদিপশু নিয়ে জঙ্গলের ভেতরে গেছে, ছেলেরা গেছে উত্তরকাশীর পাহাড়ের উপর। গরমের এই সময়টা তাঁরা পাহাড়ের উপরেই কাটায়। বিভিন্ন ঋতুতে পাহাড়ের ভিন্ন এলাকায় বসতি স্থাপন করা ভন গুজ্জরদের বংশ পরম্পরায় রীতি।
জুম্মনও তাঁর ছেলেদের সাথে পাহাড়ের উপর সাময়িক অভিবাসনে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু, বয়সের কারণে এতদূর হাঁটা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই বাহাত্তর বছর বয়স্ক জুম্মন একটা মাটির ঘরে থিতু হয়েছেন। জায়গাটা উত্তরখণ্ডের রাজধানী দেরাদুনের খুব কাছেই। এই এলাকা জুড়ে রয়েছে প্রায় ১২৭৯ বর্গ মাইলের কাছাকাছি এক বন।
শিভালিক পাহাড়ের পাদদেশের বনে ডেরা বেঁধেছে জুম্মানদের দল। বৃদ্ধ জুম্মন শিভালিকের বনে বনেই বড় হয়েছেন। এই পাহাড় আর বনই তার আশ্রয়। কিন্তু, সময় পাল্টে গেছে। এখন আর বনকে নিজের বাসস্থান বলতে তার দ্বিধা হয়।
ভন গুজ্জর হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত জম্মু-কাশ্মির, হিমাচাল প্রদেশ আর উত্তারখন্ডের পাহাড়ে পাহাড়ে বসবাসকারী এক যাযাবর গোষ্ঠী। পশুচারণই তাদের মূল জীবিকা। তারা মূলত সম্পূর্ণরূপে পাহাড়ের বুনো পরিবেশের উপরেই জীবনধারন করে এসেছে শত শত বছর ধরে। পশুর পাল নিয়ে একেক ঋতুতে পাহাড়ের একেক জায়গায় যেখানে তাদের এবং পশুদের জন্য জীবন সহজ- সেখানে অস্থায়ী বসতি স্থাপন করে।
নিরামিষী মুসলিম এই গোষ্ঠি ডেরায় বাস করে। ডেরা হচ্ছে জঙ্গলের মধ্যে তিন-চারটি ঘরের গুচ্ছ। ঘরগুলো মাটি আর খড়ের তৈরি যা সাধারণত কোন নদীর পাশে গড়ে ওঠে। নদীর পানিই তাদের সকল কাজে ব্যবহৃত হয়। বিদ্যুতহীন এই সব গৃহে থাকে না কোন ভারি আসবাবপত্র। অস্থায়ী বাসস্থান তৈরি করে এবং তা আবার ভেঙে অন্য কোথাও বসত গড়ে ওঠে। ভ্যান গুজ্জর এভাবে বিভিন্ন ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় যাযাবর জীবন গড়ে তোলে।
কিছু কিছু ডেরা হয় স্থায়ী। সাধারণত গোষ্ঠীর বৃদ্ধ ব্যক্তিরা এসব ডেরায় বাস করেন। কারণ তাদের পক্ষে পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে চলাচল কষ্টদায়ক। জুম্মন এখন যেটাতে বাস করছেন সেটা সেরকম একটা স্থায়ী ডেরা। তিনি এখন সেখানে বসে একটা খবরের কাগজ দিয়ে বাতাস করছেন।
জুম্মন সঠিক জানেন না কীভাবে, কখন থেকে তার পূর্বপুরুষেরা বনের মধ্যে বসবাস শুরু করেছিল। যদিও অনেকে বলেন গুজ্জরদের পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন রাজস্থান থেকে, যা ৫৭০ খ্রীষ্টাব্দে গুরজারা রাজ্য নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু জুম্মনের মত অনেকে বিশ্বাস করেন তাদের পূর্বপুরুষরা প্রায় ১৫০০ বছর আগে কাশ্মীর থেকে এসেছিলেন।
জুম্মন হতাশ সুরে বলেন, 'আমাদের কাছে আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, আমাদের ভাষা গোজরা—যা ডংরী ভাষার অপভ্রংশ তাদের কোন গ্রহণযোগ্য ইতিহাস নেই।'
জুম্মনের পাশে বসে থাকা তাঁর বোন বলেন,'আমাদের গল্প, আমাদের ঐতিহ্য মুখে মুখে চলে আসছে এক পরম্পরা থেকে আরেক পরম্পরায়।' তাঁর গায়ে মেরুন রঙের সালোয়ার-কামিজ আর মাথা থেকে কপাল পর্যন্ত কালো ওড়না। অদ্ভুত গভীর সুন্দর সবুজ চোখ, তাঁর সমস্ত অবয়ব, পরিচ্ছদ বন-গোত্রের অন্যান্য নারীদের মত, যার সাথে কাশ্মীরি নারীদের অনেক মিল।
পাহাড়ের বনে বনে বাস করা এই গুজ্জর গোষ্ঠীর নেই কোনো নিশ্চিত ভবিষ্যৎ। তাদের ইতিহাসের রহস্যের জট যেমন সহজে খুলছে না, তেমনি অনেকেই তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত। পঁয়ত্রিশ বছর বয়স্ক মোহাম্মদ আলীম- যিনি তাঁর ভাই মীর হামজা (৪৫) এবং ইউসুফ(৫০) এর সাথে একত্রে বাস করেন, আক্ষেপ করে বলেন,'গত এক দশক ধরে পাহাড়ের সাথে মূল ভূমির সংযোগটা বেশ ভালো ভাবে গড়ে উঠেছে। কিন্তু স্বাস্থ্য, পরিবহন ব্যবস্থাসহ অন্যান্য জরুরী ব্যাপারগুলো আমাদের নাগালের বাইরে।'
এই ভাইয়েরা তাদের দশ সদস্যের পরিবারের খাবার যোগাতে মাত্র তিনটা মহিষের উপর নির্ভর করে। পাশাপাশি দৈনিক ৩০০ টাকার বিনিময়ে কাছের এক শহরে শ্রমিকেরও কাজ করে। শিভালিক পাহাড়ের পাদদেশে সঙ নদীর পাড়ে অবস্থিত গুজ্জরদের ছোট ছোট কুড়েগুলোয় গৃহস্থালির কাজ করেন তাদের স্ত্রী'রা।
গুজ্জরদের ডেরা থেকে পনের কিলোমিটার দূরে শিভালিক বনের একেবারে প্রান্তে অবস্থিত মোহান্দ গ্রামে ভন গুজ্জরদের জন্য বিশেষ স্কুল আছে। সেখানে গুজ্জরদের সন্তানরা শিক্ষা গ্রহণ করে। দ্রব্যসামগ্রী প্রস্তুতকারী এক কোম্পানি এবং একটি এনজিও'র সম্মিলিত চেষ্টায় স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয় কারিকুলামের সাথে গুজ্জরদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, তাদের প্রচলিত গল্প ইত্যাদি সম্পর্কে স্কুলে শিক্ষা প্রদান করা হয়। এছাড়াও, পশুপালন ও পশু দুগ্ধের বাজারজাত, বিপণন ইত্যাদি সম্পর্কেও শেখানো হয়।
মোহাম্মদ আলীমের সন্তানেরা স্কুলে গেলেও তাঁর ভাইয়ের সন্তানেরা স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। স্কুলবাস যেহেতু বনের দিকে আসা বন্ধ করে দিয়েছে তাদের পক্ষে যাতায়াতে খরচ বহন করা সম্ভব হচ্ছিল না। ছেলেরা এখন বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়, কখনো কখনো বাবাদের সাহায্য করে। কন্যা সন্তানরা মায়ের কাজে সাহায্য করে, সেলাই করে, পুতির তৈরি গহনা বানায়, ঐতিহ্যবাহী এমব্রয়ডারি করা টুপি সেলাই করে, যা সাধারাণত কোন উৎসবে পরা হয়।
বংশ পরম্পরায় গুজ্জর গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে এক নিবিড় সম্পর্কে জড়িত, যা ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে চলেছে। গুজ্জররা যেহেতু প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পাহাড়ি বনভূমিতে বসবাস করে আসছে; তাই এই বনের সাথে, পাহাড়ের সাথে তাঁদের যে আত্মিক সম্পর্ক- তা খুবই অর্থপূর্ণ এবং জরুরী। বনের বাস্তুসংস্থান এবং টোপগ্রাফি বা ভূসংস্থান সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানা এই মানুষগুলোর। নুন্যতম এবং নিরামিষ জীবন ব্যবস্থা তাদের শিখিয়েছে, যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকুই ভূমি থেকে, প্রকৃতি থেকে নিতে, এর বেশি নয়।
পঁয়ষট্টি বছর বয়স্ক লিয়াকত প্রকৃতি এবং পরিবেশের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করেন। তিনি বলেন,'অনেক সময় বানর আমাদের রান্নাঘরে ঢুকে খাবার নিয়ে পালিয়ে যায়। আমরা তাঁদের কিছু বলি না, কারণ আমরা তাদের বাসস্থান দখল করেছি বিনিময়ে তারা কিছু খাবার নিয়ে গেছে।'
লিয়াকত-সহ গোষ্ঠীর অনেক বয়স্ক সদস্য মনে করেন অবস্থা পরিবর্তন হচ্ছে, পরিবেশ পাল্টে যাচ্ছে। 'নদীগুলো শুকিয়ে আসছে, দেরাদুন আর মোহান্দের মধ্যেকার সংযোগ সড়ক শেষ করে দিয়েছে এখানকার পরিবেশ। অসংখ্য গাছ মরছে আর গরম শুধু বাড়ছেই। আমরা বিদ্যুৎ ছাড়াও বাঁচতে পারি, কিন্তু পানির খোঁজে আমাদের মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়।'
পরিবেশের বিপর্যয়ের দরুন এইসব যাযাবর গোষ্ঠীর মানুষ এখন আর প্রকৃতির উপর নির্ভর করে থাকতে পারে না। মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে কেউ সাইকেল বা মোটর সাইকেলে করে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে সবচেয়ে কাছের গ্রাম মোহান্দ থেকে সবার জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করে আনে। তাদের অনেকের কাছে রয়েছে যোগাযোগের জন্য মোবাইল ফোন, যদিও বনের মধ্যে এর নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না বললেই চলে।
গুজ্জররা যদিও তাঁদের প্রতিদিনের জীবনে যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হচ্ছে সে ব্যাপারে জানে, কিন্তু এর বাইরেও আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা তাদের নজর এড়িয়ে ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে। এটা শুধু তাঁদের বনের জীবনকেই প্রভাবিত করছে না, সেটা তাদের পরিচয়কেও প্রশ্নের মুখোমুখি করে দিয়েছে।
তারা এখন প্রায়শ' হয়রানীর শিকার হচ্ছে। যে বনে তাঁদের চৌদ্দ পুরুষের বাস, যে বন তাঁদের মায়ের মত, যে বন সম্পর্কে তাঁদের চেয়ে বেশি কেউ জানে না- সেই বনে বাস করতে তাঁদের দিতে হয় ঘুষ। বনভূমি নষ্ট করার জন্য দায়ী করা হয় তাঁদের। লিয়াকত আক্ষেপ করে বলেন,'তাঁরা বলেন, পশুদের বনের ঘাস খাইয়ে আমরা বনের গাছ ধ্বংস করেছি, এটা পুরো মিথ্যা কথা।' লিয়াকতের এই আক্ষেপের মধ্য দিয়েই ফুটে উঠে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত, নুন্যতম জীবন-চাহিদার মানুষ গুজ্জরদের অসহায়ত্বের চিত্র।
একই রকম আকুতি ফুটে উঠে জুম্মনের ভাষাতেও,'ভন গুজ্জররা ভূমি থেকে খুব সামান্য কিছু নেয়। এই বন আমাদের বাড়ি।' জুম্মন পশু চরানোর জন্য ঘুষ দিতে রাজি না হওয়ায় এক বনরক্ষীর হাতে মার খেয়েছিল। যদিও শিভালিকের বনরক্ষা প্রধান এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন,'ভন গুজ্জররা এই বনে শত বছর ধরে বাস করে আসছেন। এই বনভূমিতে তাঁদের অধিকার সম্পর্কে আমরা সচেতন। তাছাড়া গুজ্জররা আইনের প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গাছকাটা এবং পশুচারণের কিছু কঠোর আইন আছে, সেগুলো না মানলে তাদের জরিমানা করা হয়।'
অন্যদিকে গুজ্জরদের অভিযোগ তাদের ১০০০ রুপি জরিমানা করা হয়, শুধুমাত্র কেন তারা খুব সকালে পশুদের চারণের জন্য নিয়ে যায় এই অভিযোগে। 'আমি কখনই এই বনভূমি ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না, কিন্তু পরিস্থিতি এমন হলে অন্য কোথাও যেতে আপত্তি করবো না,' দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে জুম্মন কথাগুলো বলেন। আরো অনেকের কণ্ঠে এমন আবেগময় স্বর শুনতে পাওয়া যায়। তারা চায় বনবিভাগ তাঁদের কিছু জমি দিক, যাতে তারা তাদের গ্রাম তৈরি করে বাস করতে পারে যেমনটি তাঁদের প্রতিবেশীদের দেয়া হয়েছে।
প্রতিবেশী বলতে গুজ্জর গোষ্ঠীরই আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু যারা বিশ কিলোমিটার দীর্ঘ দেরাদুন, মোহান্তের সংযোগ সড়কের অপর প্রান্তে অবস্থিত বনে স্থায়ী আবাস গড়ে তুলেছে। শিভালিক বনের ঐ রেঞ্জগুলো রাজাজী জাতীয় উদ্যানের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেই এলাকায় বসবাসকারী প্রায় সকল গুজ্জর স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত গ্রামে বসবাস শুরু করেছে সেই ২০০৫ সাল থেকে।
রাজাজী জাতীয় উদ্যান প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই গুজ্জরদের উচ্ছেদের হুমকিটা শুরু হয়। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় রাজাজী প্রতিষ্ঠার যে নোটিশ দেয়া হয়েছিল তাতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় গুজ্জরদের।
এতে বলা হয়, 'রাষ্ট্র শংকিত কারণ অবিবেচকের মত ব্যবহারের কারণে বন উজাড় হচ্ছে। তাই রাষ্ট্র চায় বন, সেখানে বাস করা বন্যপ্রাণি এবং পরিবেশ রক্ষা করতে। যতদিন পর্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে ১৯৭২ সালের বন্য প্রাণি সংরক্ষণ আইনের ৩৫ তম ধারা অনুযায়ী ভন গুজ্জররা তাদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে যেতে পারবে না, বা নতুন এলাকায় বসতি বসতি স্থাপন করতে চাইলে আইন অনুযায়ী আগে অনুমতি নিতে হবে।'
২০০৬ সালে সরকার এফআরএ বা "রিকগনিশন অব ফরেস্ট এক্ট" আইন পাস করে বনের অধিবাসীদের সমতলে বসবাসের অধিকার নিশ্চিত করে। সাথে ছোট ছোট বন তাদের পশুপালনের জন্য ব্যবহারের অনুমতি দেয়। তাদের উন্নয়ন এবং পুনর্বাসন অধিকার ও বন পরিচালনা অধিকারও নিশ্চিত করে।
নিজেদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকায় এফআরএ বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইনের বিরুদ্ধে কদাচিৎ আবেদন করে। জুহা ফাতিমা জুনাইদি ভন গুজ্জরদের হয়ে আইনি লড়াই করা একজন আইনজীবী। জুহা ফাতিমা দাবি করেন, এফআরএ একটি শক্তিশালি আইন যা দ্বারা চারনভুমির উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
তার মতে, সংবিধানের কোন আইনই জোর করে কাউকে বিতাড়িত করার অনুমতি দেয় না। এমনকি যদি কোন বসতি "মারাত্মক হুমকির মুখোমুখি বন্যপ্রাণির বাসস্থান"ও হয় তাহলেও তাদের পুনরায় বসতি স্থাপন না করে উচ্ছেদ করা যাবে না। আইনের সাথে এর কোন বিরোধ নেই, বরং সঠিকভাবে আইনের প্রয়োগ না হওয়াটাই এর মূল সমস্যা।
বনের বাস্তুসংস্থান সম্পর্কে গুজ্জররা বিশেষ ভাবে দক্ষ। বহু বছর ধরে বনের সাথে তাদের সুন্দর সহাবস্থান। বনভূমি বৃদ্ধির যে ধারা, জীববৈচিত্রের নাজুক স্থান সমূহ নির্দিষ্ট করা এবং বন্যপ্রাণির প্রকৃতি সম্পর্কে গুজ্জরদের যে গভীর জ্ঞান তা "সম্প্রদায় সংরক্ষণ"এর জন্য জরুরী হতে পারে- এটা এফআরএ আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা।
গুজ্জররা কিন্তু এই অধিকারগুলো দাবি করতে পারে না। কারণ সরকার তাঁদের উপজাতি গোষ্ঠীর মর্যাদাই প্রদান করে না; যার দ্বারা তারা তাদের সংস্কৃতি, জীবনধারা, রাজনৈতিক অধিকার, সংরক্ষিত আসনে উচ্চশিক্ষা এবং চাকুরির অধিকার রক্ষা করতে পারে। উপজাতি সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ে তাদের স্বীকৃতির জন্য কিছু নির্দিষ্ট মানদন্ড রেখেছে। কিন্তু, সংবিধানে সেগুলো পরিষ্কার নয়। এ কারণেই সমস্ত সিদ্ধান্তেই আসে আইনের দীর্ঘসূত্রিতা।
তাদের নিয়ে কাজ করেন এমন একটি এনজিও'র প্রধান আবদাস কুশাল বলেন, ভন গুজ্জর অন্যান্য বনে বাস করা গোষ্ঠীর মত এফআরএ আইন অনুযায়ী সংরক্ষিত সুবিধা নিতে পারে, কিন্তু সেটা সহজে নয়। তাদেরকে তিন পুরুষ ধরে বা দীর্ঘ পঁচাত্তর বছর বনে বাস করার প্রমাণ দেখাতে হবে। নির্ভরযোগ্য প্রমাণ যোগাড় করা তাদের জন্য কঠিন ব্যাপার। যদিও কোন গোষ্ঠীর সবচেয়ে বয়স্ক সদস্যের সাক্ষ্য এক্ষেত্রে গ্রহণ করার নিয়ম আছে, কিন্তু আইনের যে ফাঁকফোকর তা কিছু বন বিভাগের অসৎ কর্মকর্তাকে অশিক্ষিত এবং নিরীহ গুজ্জরদের উপর সুযোগ নিতে সহায়তা করে।
'আমরা আমাদের বনের জীবন খুব মনে করি,' বলছিলেন বন ছেড়ে স্থায়ী ভাবে সমতলের গ্রামে বাস করা এক গুজ্জর। যখন শিভালিক পাহাড়ে বসবাসরত গুজ্জররা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করছে- তখন রাজাজী সংরক্ষিত বনে অন্য একটি দলের সদস্যরা অনেক আগেই স্থায়ী হয়েছে। প্রায় ৫১২ টি পরিবার পাথরি গ্রামে এবং ৮৭৮ টি পরিবার হরিদুয়ারের গান্ধিখাটা গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। এই ভন গুজ্জর সদস্যরা চিরদিনের জন্য বন এবং বনের জীবন ছেড়ে দিয়েছে।
গান্ধিখাটার 'গুজ্জর বস্তি' শত শত ঘন সন্নিবিসিত কুঁড়েঘরে বাস করে রাজাজী বনের ভন গুজ্জররা। এই মাটির ঘরগুলো তাঁদের বনের মধ্যে যে মাটির ঘর ছিল তাঁদের মতই শুধু পার্থক্য হল এই ঘরগুলোতে বিদ্যুৎ আছে। সেখানে অবশ্য বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, মসজিদ এমনকি একটা প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রও রয়েছে। পুনর্বাসিত এই পরিবারগুলোকে যাতায়াতের জন্য পরিবার প্রতি মাসে ৩০০০ করে টাকা দেয়া হয়। সাথে চাষবাসের জন্য দুই একর করে জমি। এদের মধ্যে অনেকেই চাষবাসের সাথে পুর্ব পুরুষের পশুপালন পেশাও ধরে রেখেছে।
'বনের জীবনটা খুব মনে পড়ে, সেখানকার মুক্ত হাওয়া, ঠাণ্ডা আবহাওয়া, চুপচাপ নিরিবিলি জীবনটা অনেক বেশি মনে পড়ে,' মন খারাপ করে কথাগুলো বলেন মোহাম্মদ আলম যিনি তাঁর পরিবার সহ ছয় বছর আগে এই বস্তিতে বাস শুরু করেছেন, 'এখানে অবশ্য খাবার পানিটা সহজে মেলে, চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে আর বাচ্চাগুলো পড়াশুনা করতে পারছে।'
মোহাম্মদ আলমের সাথে একমত মোহাম্মদ আমির- যিনি পনের বছর আগে গান্ধিখাটায় এসেছিলেন। তিনি স্বস্তির সাথে বলেন, 'আমাদের এখন একটা নিশ্চিত জীবন হয়েছে। নীল রঙের বড় কুড়েঘরটার সামনে তাঁর পরিবারের পাশে বসে কথাগুলো বলছিলেন পঁয়ত্রিশ বছর বয়স্ক মোহাম্মদ আমির। তাঁর বোন রেশমা এক কোনায় একটা সেলাই মেশিন চালাচ্ছিলেন। তিনি একটা দর্জির দোকান চালান। বাসার ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে ফিরেই স্মার্টফোনে গেম খেলছে।
এরাই গুজ্জরদের প্রথম বংশধর যারা বনের বাইরে বড় হচ্ছে। এই পরিবর্তনটা আসছে সংস্কৃতির একটা বড় অবলুপ্তির মাধ্যমে। ঐতিহ্যবাহী পোশাক, নিজস্ব তৈরি গহনা আর গ্রীষ্মকালীন অভিবাসনের যে সংস্কৃতি শত শত বছর ধরে চালু ছিল গুজ্জরদের মাঝে, এরা তা থেকে অনেক দূরে।
এই যে পুনর্বাসিত গোষ্ঠী তারা সর্বদা এক আতংকের মধ্যে থাকে, তাদের কখন আবার উচ্ছেদ করা হয়। কেননা তাদের কাছে নেই কোন লিখিত দলিল। তারা কোনো ব্যাংক থেকে লোন নিতে পারে না বা অন্য কোন কাজেও পিছিয়ে থাকে, কারণ তাঁদের নেই কোন ঠিকানা।
কমল সিং, হরিদুয়ার বন বিভাগের এক কর্মকর্তা যিনি গান্ধিখাটা পুনর্বাসন কেন্দ্রের দায়িত্বে আছেন বলেন, 'আমাদের কাছে এমন প্রমাণ আছে যে অনেকেই একশ টাকার স্ট্যাম্পে সই করে তাদের জমি লিজ দিয়েছে এবং বনে ফিরে গেছে। এই ধরনের সমস্যাগুলো আটকানোর জন্যই আমরা তাদের বাড়ি নাম্বার দেই, কিন্তু কাগজ দেই না।'
অনেক ভন গুজ্জর যারা পুনর্বাসিত হয়েছে তাঁরা এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে 'অপর্যাপ্ত পুনর্বাসন প্রকল্প' বলে মনে করেন, কারণ এতে শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তি জমির মালিকানা পেয়েছেন।
'যখন পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চলছিল তখন প্রকল্পের কিছু অফিসার সার্ভে করতে আমাদের ঘরে আসেন। যারা সেদিন উপস্থিত ছিল- শুধু তাদের নামই তালিকাভুক্ত হয়। যারা দূরে ছিল তাঁরা সবাই তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়,' এভাবেই ঘটনা বর্ণনা করেন একজন বয়স্ক গুজ্জর রুস্তম মালিক।
'ভূমিহীন কারা, যদিও এটা বের করা কষ্টকর তারপরও প্রত্যেক পরিবারে অন্তত একজনকে জমি দেয়া হোক,' বলছিলেন ষাট বছর বয়স্ক আমির হামজা।
শিভালিক পাহাড়ের গুজ্জররা যখন তাঁদের নিজ গৃহে বাস করতে ভীত তখন পাথরি ও গান্ধিখাটার গুজ্জররা নিজেদের ভিটে কোথায় তার ঠিকানা খুঁজছে। আইন যদিও তাদের পক্ষে, তথাপি গোত্রের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ আইনের অকার্যকর প্রয়োগের সাথে সরকারের উদাসীনতায় হতাশ।
বিভিন্ন অলাভজনক সংগঠন, ইউনিয়ন যারা তাদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছেন- তারা মনে করে এসব এলাকায় গোষ্ঠীবদ্ধ সংহতি প্রয়োজন, সাথে তাদের অধিকার সম্পর্কে নিজেদের মধ্যে সচেতনতা।
কিন্তু নিজেদের পরিচয়ের সাথে সাথে ভন গুজ্জরদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হুমকির মুখে। আর এই ঐতিহ্য রক্ষা করার কাজটা খুব একটা আনন্দময় কিছু নয় গুজ্জরদের জন্য। যেভাবে গান্ধিখাটার হুসান বিবির মুখে শোনা যায়,'আমরা একটা নিশ্চিত জীবনের জন্য প্রার্থনা করি, অনিশ্চিত, গৃহহীন জীবন যেখানে আমরা মেহমানের মত, আর চাই না।'
- সূত্র: আল জাজিরা