৬ ঐতিহাসিকের চোখে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি

ইতিহাস মানেই তাতে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য জানা-অজানা ঘটনা। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসও ভিন্ন কিছু নয়। অন্ধকার আর আলোকিত অংশ মিলেমিশে থাকে প্রতিটি দেশের ইতিহাসজুড়ে। তবে নিজ দেশের রাজনীতিতে ঘটে যাওয়া ইতিহাসের কালো অধ্যায় বা অধিক চর্চিত নেতিবাচক ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা বলতে একটু কমই ভালোবাসে মানুষ। ব্যাপারটি ভিন্ন নয় ২৫০ বছরের ইতিহাসে ভরা আমেরিকার ক্ষেত্রেও।
প্রচুর রাজনৈতিক স্ক্যান্ডালের সাক্ষী আমেরিকা। তবে এই স্ক্যান্ডালগুলোর মধ্যে সেরা কোনগুলো? জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো ৬ ইতিহাসবিদকে। তাদের নির্বাচিত সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি:
এক্স ওয়াই জেড অ্যাফেয়ার (১৭৯৭-১৮০০)
১৭৯৭ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জন এডামস মার্কিন বাণিজ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে তিনজন মন্ত্রীকে ফ্রান্সে পাঠিয়েছিলেন। ফ্রান্স থেকে আগত তিনজন এজেন্ট তখন আমেরিকার কাছ থেকে ঘুষ চেয়ে বসে। পরবর্তীতে তাদের এই ঘুষ চাওয়ার ঘটনাটি প্রকাশ করে দেওয়া হয় এবং সেই তিনজন ফরাসি এজেন্টকে এক্স, ওয়াই ও জেড নামে উল্লেখ করা হয়। ঘটনাটি ফ্রান্স ও আমেরিকাকে যুদ্ধের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলো প্রায়। ১৮০০ সালে এক সম্মেলনে "মর্টেফতেঁ চুক্তি'র মাধ্যমে এই বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়। এসময় ফিলাডেলফিয়ার ডাক্তার জর্জ লোগান একজন আমেরিকান নাগরিক হিসেবে ফ্রেঞ্চ নেতাদের সাথে কথোপকথন চালান এবং তাদেরকে আমেরিকার বিরুদ্ধে কীভাবে কাজ করলে ভালো হবে সে সংক্রান্ত পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে এই তথ্য ফাঁস হয়ে যায় এবং দেশের কোন নাগরিক যেন অন্য দেশের স্বার্থে আমেরিকাকে ব্যবহার না করতে পারে তা নিশ্চিত করতে ১৭৯৯ সালে "লোগান অ্যাক্ট" প্রণয়ন করা হয়।
এই আইন অনুযায়ী, "যুক্তরাষ্ট্রের কোন নাগরিক, যেকোনো স্থানে থাকাকালীন সরাসরি বা অন্যকোনভাবে বিদেশী সরকার বা এজেন্টের সাথে শারীরিক বা অন্য কোন সম্বন্ধ স্থাপন করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজ করে, তাকে জরিমানা... অথবা জেল... অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।"
-হিদার কক্স রিচার্ডসন, ইতিহাসের অধ্যাপক, বোস্টন কলেজ। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: টু মেক মেন ফ্রি: আ হিস্ট্রি অফ দি রিপাবলিকান পার্টি।
এটন অ্যাফেয়ার (১৮২৯-১৮৩১)
অ্যান্ড্রু জ্যাকসন তখন ক্ষমতার প্রথম দুই বছর পার করছিলেন। সেসময় তার সেক্রেটারি অব ওয়ার পদে কাজ করছিলেন জন হেনরি এটন। শুধু কর্মী হিসেবে নয়, ভালো বন্ধু হিসেবেও গণ্য করতেন জুয়াকসন এটনকে। এটনের স্ত্রী মার্গারেট পেগি ও'নেইল ছিলেন পুবে এটনের মালিকানাধীন একটি বোর্ডিংহাউজ মালিকের মেয়ে। সবকিছু বেশ ভালোই চলছিলো। কিন্তু মাঝখানে ফাঁস হয়ে যায় মার্গারেটের একাধিক শারীরিক সঙ্গীর কথা। এর প্রভাব গিয়ে পড়ে জ্যাকসনের কেবিনেটেও।
সেসময় পুরো কেবিনেট দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একপক্ষ এটনকে সমর্থন করছিলো, আরেকপক্ষ বিরোধী। জ্যাকসন এটনকে সমর্থন করায় ধীরে ধীরে মানুষের মনে নেতিবাচক জায়গা করে নেন এবং ১৮৩১ সালে এটন-বিরোধী এক কেবিনেট সদস্যকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এই ঘটনার পর কেবিনেটের অনেকেই স্বেচ্ছায় পদ ছেড়ে দেন। জ্যাকসনের পুরো ক্যাবিনেট ভেঙ্গে যায় এই একটি কারণে।
-জোন বি. ফ্রিম্যান, ইতিহাস ও আমেরিকান স্টাডিসের অধ্যাপক, ইয়েল ইউনিভার্সিটি। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: অ্যাফেয়ার টু অনার: ন্যাশনাল পলিটিকস ইন দি নিউ রিপাবলিক
ক্রেডিট মোবিলিয়ার স্ক্যান্ডাল (১৮৭২)
আমেরিকার পুঁজিবাদের শিরায় উপশিরায় দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ার উদাহরণ ছিল ক্রেডিট মোবিলিয়ার স্ক্যান্ডাল। সেবার ক্রেডিট মোবিলিয়ার ইউনিয়ন প্যাসিফিক রেলরোড নির্মাণের কাজ পায় এবং সেজন্য প্রেসিডেন্টের গ্রান্ট প্রশাসনকে চড়া ঘুষ দিতে হয় তাদের। এই ঘুষ গ্রহীতাদের মধ্যে ছিলেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট, স্পিকার এবং কংগ্রেসের বাকি সদস্যরাও। রাষ্ট্রপতি সরাসরি এই কাজে যুক্ত ছিলেন না। তবে দায় এড়াতে পারেননি তিনিও। ১৮৭২ সালে সবার সামনে উঠে আসে এই দূর্নীতির কথা।
-মনিশা সিনহা, ইতিহাসের অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অফ কানিক্টেকাট। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: দি স্লেভ কজ: আ হিস্ট্রি অফ অ্যাবোলিশন।
টিপট ডোম (১৯২১-১৯২৩)
টিপট ডোম বলতে তখন ইয়োমিং-এ নেভির তেলের রিসার্ভগুলোকে বোঝানো হতো। দুর্নীতির বড় উদাহরণ হিসেবে প্রেসিডেন্ট ওয়ারেন জি হার্ডিং-এর সেক্রেটারির একটি ঘটনা হৈচৈ ফেলে দেয়, তিনি গোপনে তেলের রিজার্ভ ইজারা দেওয়ার বদলে একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানির কাছ থেকে হাজার হাজার ডলার লিবার্টি বন্ড গ্রহণ করেন। এই কাজের জন্য তিনিই প্রথম কোন কেবিনেট সেক্রেটারি যাকে জেলে যেতে হয়।
এই ঘটনা ওই সময় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, পুরো প্রশাসনের ভেতরটা পচে গেছে। এই ঘটনার সূত্র ধরেব্যাপক অনুসন্ধান চালানো হয় এবং দূর্নীতিসহ হার্ডিং-এর ব্যক্তিগত জীবনের নেতিবাচক ঘটনাও বেরিয়ে আসে। ফলে মানসিক চাপে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে অফিসেই মৃত্যুবরণ করেন হার্ডিং।
-ডগলাস ব্রিঙ্কলে, প্রেসিডেন্টশিয়াল হিস্টোরিয়ান। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: আমেরিকান মুনশট: জস এফ. কেনেডি অ্যান্ড দি গ্রেট স্পেস রেস
ওয়াটারগেট (১৯৭২-১৯৭৪)
একটা অডিও টেপ সেবার প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে কংগ্রেসের সদস্য- সবার জীবনকে নাড়িয়ে দেয়। সেই টেপে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে আরো অনেকের সাথে ওয়াশিংটনে অবস্থিত ওয়াটেরগেট কমপ্লেক্সের ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটি অফিসে গোপনে প্রবেম করে তথ্য সংগ্রহের ঘটনাতে চাপা দেওয়া নিয়ে আলোচনা করতে শোনা যায়। টেপটি প্রকাশিত হওয়ার পরপর অভিশংসনের মুখে পড়েন নিক্সন, পড়ে আন্দোলনে পদ থেকে সরে দাঁড়ান। নিক্সনকে প্রেসিডেন্ট ফোর্ড ক্ষমা করায় রেহাই পার। তবে এ কেলেঙ্কারিতে হোয়াট হাউজের উকিল থেকে শুরু করে এটর্নি জেনারেল, চিফ অব স্টাফসহ অনেকেরই জেল হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তথ্য যোগাড় করতে পরিচালিত এই ঘটনাটি প্রেসিডেন্টের একার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। আর ইচ্ছে করলেই যে নিজের কাজে একজন ক্ষমতাধর মানুষ দেশের সবগুলো পক্ষকে নিযুক্ত করতে পারেন, তাও অন্যায়ভাবে, সেটা এই ঘটনা দিয়েই পরিষ্কারভাবে বোঝা সম্ভব!
-বারবারা এ. পেরি, প্রেসিডেন্টশিয়াল হিস্টোরিয়ান, ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়া মিলার সেন্টার।
ইরান-কন্ট্রা (১৯৮৬-১৯৮৯)
আমেরিকার রিগান প্রশাসন তখন ইসরাইলের মাধ্যমে ইরানকে গোপনে অস্ত্র বিক্রি করছিলো। আমেরিকা থেকে কেনা এই অস্ত্র কন্ট্রা বিদ্রোহীরা ব্যবহার করছিলো নিকারাগুয়ার সোশ্যালিস্ট স্যানদিনিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে। এতে করে বেশ কয়েকটি আইন ভেঙ্গেছিল প্রশাসন। কোন দলকে অর্থসাহায্য দেওয়ার সে সর্বোচ্চ সীমা, সেটা ভাঙ্গা হয়েছিলো। ইরানের কাছে অস্ত্র না বেচা এবং জিম্মি মুক্ত করতে টাকা না প্রদানের পক্ষে ফেডারেল সরকারের যে আইন দুটোই অমান্য করা হয়েছিলো। এই পুরো চুক্তিটিই চলছিলো আমেরিকান জিম্মি মুক্তির বিনিময়ে। হিজবুল্লাহ এই আমেরিকানকে ১৯৮০ সালে অপহরণ করেছিলো। এ অনিয়মের কথা জানাজানি হলে একে একে এই ঘটনার সাথে যুক্তদের নাম এবং সঙ্গে তাদের অন্যান্য অনৈতিক কর্মকান্ডের কথাও সামনে চলে আসে।
উচ্চ পর্যায়ের সরকারি এমন কাজ যে নিয়মের বাইরেও হতে পারে এবং তা এতো সহজে গোপন করা যায় তা জানানোর জন্য ইরান-কন্ট্রা স্ক্যান্ডাল যথেষ্ট ছিল!
-জুলিয়ান ই. জিলাইজার, অধ্যাপক ইতিহাস ও পাবলিক অ্যাফেয়ারস, প্রিন্সটন ইউনির্ভাসিটি