স্বাধীনতার অর্ধশতক
১৯৪১ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের একমাত্র ইংরেজি মুখপাত্র হিসেবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ 'ডন'প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর সম্পাদক আলতাফ হোসেনের নেতৃত্বে ডন এর সাংবাদিক ও লেখকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দিল্লি ছেড়ে করাচিতে বসতি স্থাপন করেন এবং সেখান থেকেই পত্রিকাটি প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৭১ এ অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে ঢাকার তথা তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ প্রকাশে ডন সততার পরিচয় দিয়েছে। ২৫ মার্চের পর ডনও আক্রান্ত হয় এবং হুমকির মুখোমুখি হয়ে সেন্সরশিপ মেনে নেয়। তারও আগে আক্রান্ত হয় উর্দু দৈনিক জঙ্গ। এর পেছনে পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল আকবরের সম্পৃক্ততার কথা সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তার ডায়েরিতে উল্লেখ করেছেন।
মার্চের একদিন ৬ মার্চ ১৯৭১ ডন-এ প্রকাশিত বাংলাদেশ ভিত্তিক সংবাদ Army withdrawn to baracks, East wing protest continues, firing in Tongi, Rajshahi. এই শিরোনামে সংবাদ ছিল এরকম:
৬ মার্চ ১৯৭১ সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। কর্তৃপক্ষের ঘোষণায় বলা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান শান্তিপূর্ণ অবস্থা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানানোর পর গত ২৪ ঘন্টায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির লক্ষণীয় উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ৪ মার্চ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে কারফিউ প্রত্যাহারের পর বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যকর ঘটনা ঘটেনি...
স্মরণ করা যেতে পারে বুধবার (৩ মার্চ) পল্টন ময়দানের জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান শহর থেকে অবিলম্বে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার ও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়েছেন। তখন থেকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন সংস্থা সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছিল।
এদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে ঢাকা শহরে এবং প্রদেশের সর্বত্র পরিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়েছে। আজ রাজধানী এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে টানা চতুর্থদিন এবং প্রদেশে তৃতীয় দিনের মতো হরতাল পালিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রধান ঘোষণা করেছেন আগামীকাল ৬ মার্চ-ও ১৯৭১ সারাদেশে হরতাল পালিত হবে।
আজ কর্মচারিদের বেতন প্রদানের জন্য অপরাহ্নে ব্যাংক ও অন্যান্য অফিস দু'ঘন্টার জন্য খোলা রাখা হয়েছিল। গতকাল শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছেন ব্যাংক ও অফিস বিকেল আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত এই উদ্দেশ্যে খোলা রাখতে হবে। তিনি কতিপয় যানবাহন ও প্রতিষ্ঠানকে হরতাল পালন থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন।
টঙ্গিতে গুলিবর্ষণ
আজ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টঙ্গির গুলিবর্ষণে আহতদের আরো দু'জনের মৃত্যু হলে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যায়। এর আগে ১ জন মৃত ও ১৫ জন আহত ব্যক্তিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। সেখানকার টেলিফোন শিল্প সংস্থায় বিক্ষোভকারী সৈনিকদের উপর নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তির সাথে সাথেই একজন মারা যায় অন্যজনের মৃত্যু ঘটে অপারেশনের পরপর।
রাজশাহীতে গুলিবর্ষণ
বুধবার ৩ মার্চ ১৯৭১ মিছিলের উপর গুলি চালানো হলে রাজশাহীতে একজনের মৃত্যু ঘটে এবং ৪ জন আহত হয়। জেলা প্রশাসনের একজন মুখপাত্র সংবাদ সংস্থা পিপিআইকে জানায় দুবার মালোপাড়া টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অফিসের সামনে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আর একবার ঘটেছে মেডিকেল কলেজের সামনে।
তিনি জানান এই ঘটনাগুলোর পর সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যা সাতটা থেকে ১১ ঘন্টার জন্য কারফিউ আরোপ করেছে। মাঝখানে তিনঘন্টা বিরতি দিয়ে গতকাল সকাল দশটা থেকে আজ সকাল সাতটা পর্যন্ত কারফিউ বহাল রাখা হয়েছে।
প্রাপ্ত রিপোর্ট অনুযায়ী আওয়ামী লীগ প্রধানের ডাকে ৩ মার্চ থেকে শান্তিপূর্ণভাবে পূর্ণ হরতাল পালিত হচ্ছে।
কারফিউ
গতকাল ৪ মার্চ ১৯৭১ বিকেল ৫টা থেকে আজ সকাল ১১টা পর্যন্ত জারি করা ২১ ঘন্টার কারফিউ কিছু সময়ের জন্য তুলে নেওয়া হয়। আজ সন্ধ্যা ৭টা থেকে পুনরায় কারফিউ ১০ ঘন্টা বলবৎ করা হয়েছে।
হরতাল
আকস্মিকভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রধানের ডাকে পালন করা হরতাল সব সরকারি ও বেসরকারি অফিস, স্বায়ত্ত্বশাসিত সংস্থা মিল কারখানা ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোর্ট-কাচারি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। ডাক্তার, সাংবাদিক, শান্তিরক্ষী, প্রমুখের গাড়ি ও হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া আর কোনো যানবাহন রাস্তায় নামেনি। ট্রেন স্টিমার লঞ্চ ও অভ্যন্তরীণ উড়োজাহাজ সার্ভিস ও হরতালের কারণে বন্ধ থাকে। আজকের ৫ মার্চ হরতালের বিশেষত্ব হচ্ছে কিছু ঔষধের দোকান হরতালের পুরো সময়টাতে খোলা ছিল। কর্মচারিদের বেতন দেবার জন্য বিকেলে সরকারি ও বেসরকারি অফিস দু'ঘন্টার জন্য খোলা রাখা ছিল। স্টেট ব্যাংক ও তফসিলভুক্ত অন্যান্য ব্যাংক বেতনের টাকা প্রদানের জন্য এবং রেশন ডিলারদের সুবিধা দেবার জন্য দু'ঘন্টা খোলা ছিল।
রেশন দোকান ও অন্যান্য খাদ্য সরবরাহকারীরা আড়াই থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত এই সময়টা ব্যাংকিং-এর কাজে লাগিয়েছে। আড়াইটায় ব্যাংক খোলার আগে থেকেই বহু সংখ্যক মানুষ ব্যাংকে লাইন দিয়েছে। সাড়ে চারটার সময় যখন পিপিআই প্রতিনিধি মতিঝিলে স্টেট ব্যাংকে টাকা উত্তোলনের জন্য, বিশেষ করে বেতনের টাকার জন্য কয়েক শত মানুষ লাইনে দাঁড়িয়েছিল। রেশন শপ ডিলার ও খাবার সরবরাহকারীরা সেখানেই ভিড় জমিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিরেক্টর এস ই কবিরকে দেখা গেল কাউন্টারে ব্যস্ত থেকে লেনদেন তত্ত্বাবধান করছেন। সর্বোচ্চ টাকা লেনদেনের একটি রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে স্টেট ব্যাংকে।
সভা-সমাবেশ
ঢাকা এবং প্রদেশের অন্যান্য শহরে অনেক মিছিল সমাবেশও সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুপুর দুটোয় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করে। গুটিকয় বাস রাস্তায় নেমে আসে, হরতালের সময় পার হবার পর কিছু সংখ্যক দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা হয়।
আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ বায়তুল মোকারম থেকে লাঠি মিছিল বের করে শহর প্রদক্ষিণ করে। বায়তুল মোকাররমে একটি সমাবেশের আয়োজনও করা হয়।
পূর্ব পাকিস্তান ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে এবং নিরস্ত্র জনগণকে হত্যা করার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সভা অনুষ্ঠান করে। তারাও মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামে।
ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) নিহতদের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা অনুষ্ঠান করে। জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম অব্যহত রাখার আহ্বান জানায়। হরতালের সময় পার হবার পরও জিন্নাহ অ্যাভিনিউ, বায়তুল মোকাররম, স্টেডিয়ামও নিউ মার্কেটের দোকান বন্ধ ছিল।
পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ড অধিবেশন স্থগিত করায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। তারাও মিছিল করে শহর প্রদক্ষিণ করে। খিলগাও ভূমি বিতরণ কমিটি বায়তুল মোকারমের সামনে একটি সমাবেশ করে।
দেশ থেকে অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে নারায়ণগঞ্জ শহরের গৃহবধু ও ছাত্রী শিক্ষকরা প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিল করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে আন্দোলনে যোগ দেওয়া মানুষের সাথে তারা একাত্মতা প্রকাশ করে।
অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদ জানায় পূর্ব পাকিস্তান সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতি। একটি সভায় তারা উল্লেখ করেন এতে ক্ষমতা হস্তান্তর বিঘ্নিত হবে। নিরস্ত্র জনগণের উপর গুলি চালানোর নিন্দা জানায় এবং শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে।
পূর্ব পাকিস্তান ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট জনগণের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে এবং সংবাদ প্রকাশে সম্প্রতি আরোপিত বিধিনিষেধের প্রতিবাদ করে আগামীকাল বিক্ষোভ প্রদর্শন করবে।
ইপিইউজের মহাসচিব কামাল লোহানী আগামীকাল ৩.০০টায় প্রেসক্লাবে সমবেত হবার জন্য সদস্যদের আহ্বান জানিয়েছেন। এখান থেকে মিছিল বের করা হবে এবং বায়তুল মোকাররমের সামনে গণজমায়েতে তারা অংশগ্রহণ করবে।
মুজিবের নির্দেশনামালা
১০ মার্চ ডন পত্রিকায় শেখ মুজিবুর রহমান নির্দেশিত এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ ঘোষিত নির্দেশমালা প্রকাশিত হয়। ৯ মার্চ অপরাহ্নে এই ঘোষণা দেওয়া হয়।
১. ব্যাংক: লেনদেনের জন্য সকাল ৯.০০টা থেকে দুপুর ১২.৩০টা পর্যন্ত এবং প্রশাসনিক কাজের জন্য ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। জমা, আন্ত-ব্যাংক ক্লিয়ারেন্স এবং নিম্নবর্ণিত বিষয়ে নগদ লেনদেনের জন্য খোলা রাখা হবে :
ক. পূর্ববর্তী সপ্তাহের মজুরি ও বেতন
খ. অনুর্ধ ১০০০ টাকা ব্যক্তিগত উত্তোলন
গ. পাটকলের কাঁচামাল ক্রয় ও চিনির কলের জন্য আখ ক্রয়ের অর্থ
২. স্টেট ব্যাংকের মাধ্যমে কিংবা অন্য কোনোভাবে দেশের বাইরে অর্থ পাঠানো যাবে না।
৩. অন্যান্য ব্যাংক অপরেশন চালু রাখার জন্য স্টেট ব্যাংক যতক্ষণ খোলা রাখা প্রয়োজন, ততক্ষণই রাখা হবে।
৪. ইপিওয়াপদা : বিদ্যুৎ সরবরাহের সাথে জড়িত অংশই কেবল খোলা থাকবে।
৫. ইপিএডিসি : সার সরবরাহ এবং পাওয়ার পাম্পের জন্য ডিজেল সরবরাহ ঠিক রাখতে যতটুকু অংশ খোলা রাখা দরকার ঠিক ততটুকুই।
৬. ব্রিক ফিল্ডের (ইটের ভাটা) জন্য কয়লা সরবরাহ, পাট বীজ, ধানবীজ সরবরাহের জন্য যথেষ্ট প্রয়োজন দফতর ততক্ষণ খোলা থাকবে।
৭. খাদ্য সরবরাহ অবাধ রাখা হবে।
৮. উপরে বর্ণিত বিষয় সমূহের সুবিধার্থে অ্যাকাউন্টেট জেনারেল অফিস খোলা থাকবে।
৯. সাইক্লোন দুর্গত এলাকায় ত্রাণ সামগ্রী পাঠানোর জন্য ব্যবহৃত গাড়ি চলবে।
১০. ডাক ও টেলিফোন অফিস খোলা থাকবে
১১. ইপিআরটিসি সারা বাংলাদেশে চলবে।
১২. পানি ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত থাকবে।
১৩. স্বাস্থ্য এবং পয়ঃনিষ্কাশনে সেবা অব্যহত থাকবে।
১৪. পুলিশ স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করবে। তবে প্রয়োজনে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্য নেবে।
১৫. বেসামরিক দফতর সমূহে বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকবে।
১৬. পূর্ববর্তী সপ্তাহে যে সকল বিষয়ে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে তা বজায় থাকবে।
২৪ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদনসমূহ ডন পত্রিকায় পাওয়া যাবে। এমনকি সম্পাদকীয়তেও দ্রুত সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং গণতান্ত্রিকভাবে বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতায় নির্বাচিত আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানানো হয়েছে।
কিন্তু ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানি পত্রিকার পক্ষে সত্য উচ্চারনের আর সুযোগও ছিল না। ইয়াহিয়া যে মুজিবকে পাকিস্তানের আগামী দিনের প্রধানমন্ত্রী বলে সম্বোধন করেছেন এ খবর যে সব পত্রিকা ফলাও করে ছেপেছিল, তাদের ছাপতে হচ্ছে তার বিশ্বাসঘাতকতার খবর।
ইয়াহিয়া বলেছেন মুজিব বিশ্বাসঘাতক: পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্রোহ, তীব্র লড়াই
নয়াদিল্লি, ২৬ মার্চ (রয়টার্স): পূর্ব পাকিস্তানের চারটি শহরের রাস্তায় পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হাজার হাজার গ্রামবাসী আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে, আজ রাতে এ খবর দিয়েছে প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া।
'অত্যন্ত বিশ্বস্ত'সূত্র উদ্ধৃত করে ভারতীয় সীমান্তে পাওয়া এজেন্সি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানিরা প্রাপ্য সব ধরনের অস্ত্র, বল্লম ইত্যাদি সৈন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। সূত্রমতে চট্টগ্রাম, ঢাকা, কুমিল্লা ও রংপুরে প্রবল যুদ্ধ চলছে। আজ দিনের প্রথম ভাগে জাতির উদ্দেশে দেওয়া বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়েছেন, তাঁর বিচ্ছিন্নতার আন্দোলনকে গুঁড়িয়ে দিতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে বলে এজেন্সি জানিয়েছে, লড়াই প্রায় জনযুদ্ধের সমতুল্য হয়ে উঠেছে। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দু'দিনে চীন হয়ে ১০০০ পশ্চিম পাকিস্তানি কমান্ডো পূর্ব পাকিস্তানে এসে অবতরণ করেছে।
প্রবল লড়াই চলছে
দু'দিন আগে পাকিস্তানি সৈন্যরা রংপুরে ২০ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে, সেখানে এখন প্রবল লড়াই চলছে। ভারতে শ্রুত একটি গোপন রেডিও প্রতিবেদনে জানা গেছে, শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন ঘোষণা করেছেন, দেশটির নাম হয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। তিনি নিজে আত্মগোপন করেছেন।
এই বেতারবার্তা পূর্ব পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চল থেকে প্রচারিত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এতে শত্রুবাহিনী সম্পূর্ণ পরাস্ত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে আহ্বান জানানো হয়েছে।
'স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার ভয়েস অব ইন্ডিপেনডেন্ট বাংলাদেশ জানিয়েছে, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, যশোর, বরিশাল ও খুলনায় বাংলাদেশ বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের ঘিরে ফেলেছে। বাংলাদেশ বাহিনীতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং পুলিশ সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন বলে বেতার সূত্র জানিয়েছে।
বেতার ঘোষণা করেছে শেখ মুজিব বাংলাদেশের একমাত্র নেতা, পশ্চিম পাকিস্তানি নির্মম একনায়কতন্ত্রের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তাঁর নির্দেশ অবশ্য প্রতিপালনীয়।'
ভারতীয় সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে কমপক্ষে ১০ হাজার সৈন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসে পৌঁছেছে, এখন সেখানে সৈন্যসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০ হাজার; অল ইন্ডিয়া রেডিও আজ রাতে জানিয়েছে, কারফিউ সতত্ত্বেও ঢাকায় প্রচণ্ড লড়াই হয়েছে।
প্রেস ট্রাস্ট আরও জানাচ্ছে, আজ রাতে শেখ মুজিবের অনুগত বাহিনী চট্টগ্রাম রেডিও স্টেশন দখল করে নিয়েছে। কলকাতায় প্রাপ্ত সংবাদ সংস্থার 'অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য'প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তীব্র লড়াইয়ের পর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সেনাবাহিনী পিছু হটেছে। ভারতের সরকারি মুখপাত্র জানিয়েছেন, পূর্ব পাকিস্তানে ১৩৪০ মাইল সীমান্তজুড়ে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীকে সতর্ক রাখা হয়েছে।
এই সংকট নিয়ে ভারতীয় মন্ত্রিসভা আগামীকাল বৈঠকে বসবে। (ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন: ২৬ মার্চ)
২৬ ঘন্টার ঢাকা নাটক
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন ঢাকার নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নেয়, ইউপিআইর প্রতিনিধি রবার্ট কেয়লর তখন ঢাকায়। তারই রচনা প্রত্যক্ষদর্শীর ডায়েরি। আরও বিদেশি সংবাদদাতাদের সঙ্গে তার অবস্থানও ঢাকা হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল:
রাত ১১টা, বৃহস্পতিবার ২৫ মার্চ আমি হোটেলের লবিতে নেমে আসি। আমার হাতে একটি বার্তা, জনগণের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর ব্যবহার অব্যাহত রাখার 'ভয়াবহ পরিণতি'সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বক্তব্য অবলম্বন করেই আমার বার্তা।
আমি একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে টেলিগ্রাফ অফিসে গিয়ে বার্তাটি প্রেরণের পরিকল্পনা করছি, আমি দেখলাম লবিতে অনেকের জটলা, যুদ্ধসাজে সজ্জিত সৈন্যরা এসেছে, হেলমেট মাথায়, হাতে খোলা অস্ত্র। হোটেলের কর্মচারীরা একটি ব্ল্যাকবোর্ড বসিয়ে তাতে নোটিশ লিখেছে,'অনুগ্রহ করে বাইরে যাবেন না,' একেবারে দরজার সামনে চক দিয়ে লেখা। শনিবার হরতাল পালনের জন্য শেখের আহ্বান সংবলিত বিবৃতিটি কেউ একজন ব্ল্যাকবোর্ডের উপর সেঁটে দিয়েছে। অন্য সংবাদদাতারা জানালেন, তারা যখন বাইরে যেতে চেষ্টা করেছেন সৈন্যরা তাদের বাধা দিয়ে ভেতরে ঢোকার নির্দেশ দিয়েছে। এই সৈন্যদের নেতা বলে দিয়েছে, যে বাইরে যেতে চেষ্টা করবে তাকে গুলি করা হবে।
রাত ১১.৪৫
কী যে ঘটছে সবাই তা বের করার চেষ্টা করছে। একটি তত্ত্ব হচ্ছে, এই গার্ডরা হোটেলে অবস্থানরত পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোর প্রতিরক্ষার চেষ্টা করছে, ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানে ঘৃণিত ব্যক্তি। হোটেলের সর্বোচ্চ তলায় তিনি অবস্থান করছেন। অন্য একটি তত্ত্ব হচ্ছে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে যাচ্ছে, সে জন্যই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অন্য কোনো জেনারেলের স্বার্থে হার্ডলাইনে যাননি।
সময় যতটা গড়াতে থাকে ততটাই অভ্যুত্থানের মতোই মনে হয়। সন্ধ্যার পর সৈন্যদের গাড়ির বহর দু'বার হোটেলের সামনে দিয়ে অতিক্রম করতে দেখা গেছে। প্রেসিডেন্টের মূল সহযোগীদের একজনের ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করলাম, উদ্দেশ্য একটি গুজব চাউর হয়েছে: প্রেসিডেন্ট এর মধ্যেই ঢাকা থেকে চলে গেছেন, এর যথার্থতা যাচাই করা। কেউ-একজন ফোন ধরল কিন্তু কথা বলল না। আমি স্থানীয় একটি সংবাদ সংস্থায় ফোন করি এবং কী ঘটছে এ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা আছে কি-না জানতে চাই। তারাও বলতে পারছে না। অফিস ছেড়ে বেরও হতে পারছে না।