সোনার দরে রহস্যময় কৌটো
No excellent soul is exempt from a mixture of madness – Aristotle
পৃথিবীর শিল্প ইতিহাসজুড়ে বিভিন্ন চিত্রশিল্পীর জীবনাচরণ ও শিল্পসৃষ্টি নিয়ে নানাবিধ বিতর্ক সৃষ্টি হয়ে আসছে। অনেকেই তাঁদের শিল্পকাজে সমাজের আধিপত্যশীল কাঠামোকে বিপর্যস্ত করার চেষ্টা করছেন এবং মানুষকে তার অভিজ্ঞতা, তার জীবনকে ভিন্নভাবে দেখতে উস্কে দিয়েছেন। সর্বোপরি, শিল্পীর ভূমিকা কি তাদের শিল্পকর্মের মাধ্যমে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা নয়? গত কয়েক শতাব্দীর শিল্পজগতের সবচেয়ে সাহসী পাগলাটে ক্ষ্যাপা তাছিরের শিল্পীদের তথা উস্কানিদাতাদের কার্যক্রম তো সে সাক্ষ্যই দেয়।
অনেক শিল্পীদের জীবনযাপনে যেমন নানা উদ্ভট, বেখাপ্পা আচরণ, স্বভাব দেখতে পাওয়া যায়, তেমনি এসব তাদের শিল্পচিন্তায় তথা শিল্পকর্মেও প্রতিফলিত হয়। কখনো কখনো সেসবকে আপাত ভারসাম্যহীন, নিয়মভাঙা, কুরুচিপূর্ণ, স্বেচ্ছাচারী ইত্যাদি বলে দাগিয়ে দেবার যেমন উদ্যোগ দেখা গেছে, তেমনি এসব ধারণ করেই কেউ কেউ ভবিষ্যৎ শিল্পদ্রষ্টার আসনে অভিষিক্ত হয়েছেন। এমনকি কালাতিক্রমেও সেসব সর্বদাই সরব থেকেছে শিল্পামোদিদের আলোচনায়, রাজনীতি, সমাজ, শিল্পবোধের নানা পাকেচক্রে।
কোনো কোনো শিল্পীর বৈসাদৃশ্য আচরণ, উপস্থাপন, বিষয়, উপকরণ রীতিমত মাইলফলক হয়ে আছে শিল্পের ইতিহাসে। সর্বোপরি একজন শিল্পী তাঁর ভাবনার, যাপনের জগতে হতে পারেন অন্য মানুষ বা তাঁর শিল্প সন্নিহিততার খুবই কাছাকাছি। শিল্পীদের পাগলামি, ক্ষ্যাপামি কত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত?
স্রেফ খেয়ালের বশে খুন করা থেকে শুরু করে পিতৃহত্যা, কিশোরী মেয়েদের সাথে যৌন সম্পর্ক, স্ত্রী-সন্তান ত্যাগ, নেশায় চুর হয়ে থাকা এবং চুরি করা জিনিসপত্র পর্যন্ত শিল্পের ইতিহাস নানা অপরাধ ও অপকর্মেরও সাক্ষী। তা ছাড়াও শিল্পীর পাগলামির তাছির থেকেও অনেক বিতর্কিত শিল্পকর্ম সৃষ্টি হয়েছে, যা শিল্পের ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনে সহায়ক হয়েছে।
বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ফ্রান্সিস বেকন কতিপয় অদ্ভুত অভ্যাসে অভ্যস্ত ছিলেন, সকালে উঠে এবং দিনে সকালের কয়েক ঘণ্টা ছবি আঁকতেন এবং মধ্যাহ্ন থেকে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত মদ্যপান, খাবার এবং সামাজিকতায় লিপ্ত হতেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি, 'আমি প্রায়শই হ্যাংওভারের সাথে কাজ করতে পছন্দ করি, কারণ আমার মনের শক্তিতে চিড় ধরলে আমি খুব স্পষ্টভাবে চিন্তা করতে পারি।'
কিন্তু যদিও সবাই জানেন যে বেকন অতৃপ্ত বা অসুখী ছিলেন এবং তাঁর অনিদ্রার সাথে লড়াইয়ের বিষয়টি খুব কমই উল্লেখিত হয়েছে যদিও। শিল্পী ঘুমের জন্য ওষুধের ওপর নির্ভর করতেন এবং তার অস্থিরতা নিরাময়ের জন্য একটি অস্বাভাবিক প্রচেষ্টা ছিল ক্লাসিক রান্নার বইগুলো বারবার পড়তেন, যাতে তিনি ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যান।
সালভাদর দালি নাকি তাঁর স্বপ্ন ও সম্মোহনীজগতে প্রবেশ সক্ষমতার জন্য একটি কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন, স্বপ্নঘোরে ঘুম আসতেই যাতে তা দালিলীকরণ করতে পারেন, সে জন্য একটি ধাতব পাত্রের ওপর চাবির গোছাসহ হাতটি রাখতেন এবং গভীর ঘুম আসার সাথে সাথেই হাত ফস্কে তা ধাতব পাত্রে পতিত হলেই হঠাৎ ঝনাৎ শব্দে জেগে উঠবেন এ উদ্দেশ্যে।
প্রায় এক যুগ আমেরিকান শিল্পী গ্রান্ট উডের বাসস্থান হয়ে উঠেছিল একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার লাশগুদামঘর। সেখানে কফিনের ঢাকনা দরজায় স্থাপন করে তাতে লিখে রেখেছিলেন নিজের হদিস। যেমন ভেতরে, শহরের বাইরে, স্নানরত, উৎসবরত ইত্যাদি।
এ তো গেল ব্যক্তিগত আচরণ, অভ্যাস বা যাপনের কথা। এর বাইরে আছে শিল্পীদের শিল্পকাজ নিয়ে সংক্ষোভ, বিক্ষোভ, রাগ, অভিমান, প্রত্যাখ্যান, অপমান, অপ্রাপ্তিজনিত মনোবৈকল্য। আবার এসব পরিপ্রেক্ষিত থেকেই উদ্ভূত পাগলপারা সৃষ্টিসুখের উল্লাসে ফেটে পড়া। নিতান্তই নির্মমতা থেকে উৎসারিত শিল্প প্রণোদনা যা নানা ঝঞ্ঝা পেরিয়ে ইতিহাসে সাফল্য হিসেবে দস্তখত রাখে।
১৮৬৩ সালে প্যারিসের স্যালন দ্বারা এডুয়ার্ড মানের বিখ্যাত পেইন্টিং, Le Dejeuner sur lÕHerbe, প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল এবং এটি বেশ কেলেঙ্কারি তৈরি করেছিল। সেই সময়ের সম্পূর্ণ পোশাক পরিহিত পুরুষদের দ্বারা পরিবেষ্টিত নগ্ন মহিলার অবাধ উপস্থিতি শিল্পজগত এবং জনসাধারণকে বিহ্বল করেছিল।
১৯ শতকে পূর্ণ নগ্ন চিত্রগুলো কতটা বিতর্কিত ছিল, তা যদি আমরা বিবেচনা করি, তাহলে কল্পনা করা অবিশ্বাস্য যে গুস্তাভ কোর্বে তাঁর সময়ের জন্য কতটা সাহসী এবং ব্যতিক্রম ছিলেন, যখন তিনি 'দ্য অরিজিন অফ দ্য ওয়ার্ল্ড' এঁকেছিলেন, একজন নারীর নিম্নাঙ্গের অত্যন্ত বাস্তবসম্মত চিত্রকর্ম, নগ্ন ঊরু, যোনি এবং ধড়। পেইন্টিংটি তাঁর সময়ের জন্য সম্পূর্ণ বৈপ্লবিক ছিল, কারণ কোর্বে নারীর যৌনাঙ্গ এবং নগ্ন শরীর চিত্রিত করতে 'জুম ইন' বা অনুপুঙ্খ'র কৌশল বেছে নিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে তার মুখ চিত্রিত করেননি।
তর্কাতীতভাবে বলা যায়, ২০ শতকের সবচেয়ে বিতর্কিত শিল্পকর্ম, 'ফাউন্টেন' হলো প্রথম 'রেডিমেড', এটা এমন একটি দৈনন্দিন ব্যবহার্য বস্তু, যা শিল্পী একটি শিল্পকর্মে পরিণত করতে সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯১৭ সালে, ডুসাম্প সোসাইটি অব ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্টিস্টের কাছে একটি ইউরিনাল জমা দেন। সোসাইটি তা প্রত্যাখ্যান করেছিল এই যুক্তিতে যে এটি একটি শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। ডুসাম্পের ফাউন্টেন অগণিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উস্কে দিয়েছে, যেমন 'কোন বস্তু শিল্প হিসেবে পরিগণিত হয়?' এবং 'শিল্প মূল্যায়ন এবং যোগ্যতা অর্জনে শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কী?' এগুলো এমন প্রশ্ন, যা বিংশ শতাব্দী থেকে আজ অবধি শিল্পের দিকনির্দেশনা তৈরি করতে সাহায্য করেছে।
ডুসাম্পের ফাউন্টেনের বিরোধিতাকারী অনুভব করেছিলেন যে তাঁর এই শিল্পপদবাচ্যটি 'আসল শিল্প'কে সম্পূর্ণভাবে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, তারা ১৯৫৩ সালে আমেরিকান শিল্পী রবার্ট রসেনবার্গের দৃশ্যত অযৌক্তিক মুছে ফেলা ড্রইংয়ের পিছনে ও সমর্থন সমাবেশ করা কঠিন বলে মনে করেছিলেন। একটি ইরেজার দিয়ে ঘষে মুছে ফেলার মাধ্যমে রসেনবার্গ তাঁর বন্ধু, ডাচ-আমেরিকান বিমূর্ততাবাদী শিল্পী ভিইলেম ডি কুনিংয়ের একটি ড্রইংকে পরীক্ষার জন্য উৎসর্গ করতে রাজি করান। ফলাফল হলো একটি কাগজ স্ক্রাব করা কোনো স্পষ্ট ছবি ছাড়া, যা পর্যবেক্ষকদের চ্যালেঞ্জ করে সিদ্ধান্ত নিতে যে চিত্রবিহীন চিত্রটি আদৌ একটি শিল্পকর্ম কি না বা প্রদর্শনের আসল কাজটির অনুপস্থিতিতে ঘিরে থাকা খালি ফ্রেম একটি ভাস্কর্যধর্মী স্থানের সীমাহীন শৈল্পিক ক্ষতি।
শিল্পদুনিয়ায় একজনই পিএম ছিলেন, আছেন, থাকবেন। সাধারণ অভিধায় পিএম মানে প্রাইম মিনিস্টার বা প্রধানমন্ত্রী। এই পিএম তেমনটি আক্ষরিক অর্থে না হলেও এই অভিধায় শিল্পদুনিয়ায় অমর হয়ে রইলেন একজনই। এখানে পি মানে পিয়েরো, এম মানে মানজোনি। পিয়েরো মানজোনি।
মানববর্জ্যের অব্যবহৃত আধার যদি শিল্পজগত তার নিজের অধিকারে একটি শিল্পবস্তু হিসেবে গ্রহণ করতে পারে, তবে এটি সম্ভবত আশ্চর্যজনক নয় যে কোনো পর্যায়ে একজন শিল্পী নিজের মলমূত্র নিয়ে শৈল্পিক নিরীক্ষা করবেন এবং এটিকে একটি শিল্পকাজ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করবেন। ১৯৬১ সালে ইতালীয় অ্যাভান্ট-গার্দ শিল্পী পিয়েরো মানজোনি, যিনি এক বছর আগে শিল্পকাজ হিসেবে নিজের নিশ্বাসে ভরা একটি বেলুন উপস্থাপন করে পর্যবেক্ষকদের হতবাক করে দিয়েছিলেন, তিনি এমন এক শিল্পকর্ম উপস্থাপন করেছিলেন, যা ৯০টি টিনের কৌটোয় আবদ্ধ মোট ২৭০০ গ্রাম তাঁর নিজের মল! যার শিরোনাম ইতালিয়ান ভাষায় 'মেরদা দ্য আর্তিস্তা' ইংরেজিতে 'আর্টিস্ট শিট' বাংলায় 'শিল্পীর বিষ্ঠা'। মানজোনির উপস্থাপনার কৌটোয় 'প্রোডাক্ট সামারি' ইতালিয়ান, ইংরেজি, জার্মান ও ফরাসি ভাষায় উৎকীর্ণ ছিল।
জগতে শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম একজন, যাঁর সৃষ্টিকর্মের সামনে দাঁড়িয়ে আজও প্রায়শই দর্শকদের কেউ কেউ চিৎকার করে বলছেÑ'আমিও এমনটা করতে পারতাম।' মানজোনি নিজেও নিজের কাজটির অনুরূপ কিছু করে উঠতে পারত কি? মনে রাখা প্রয়োজন, গত শতাব্দীর ষাটের দশক তখন, আজ থেকে ষাট বছর আগে এমন প্রথাবিরোধী কাজ করা মোটেই তত সহজ ছিল না!
নিজের 'শিল্পসত্তার আড়ালে শিল্প লুকানো'র চেষ্টা ছিল মানজোনির? বোধ করি নিজ সত্তাকে একদিকে যেমন আড়াল করতে চাইতেন, অন্যদিকে আরও বেশিমাত্রায় সত্তা আবির্ভূত হতো তাঁর শিল্প সারাংশে। তিনি মল পর্যন্ত বিক্রি করেছিলেন বেলুন বন্দি করে।
হোয়াট অ্যাবাউট বিষ্ঠা? এর উত্তরে হয়তো যে কেউই বলবে, 'প্রত্যেকেই তা ত্যাগ করে থাকে।' কিন্তু যখন শিল্পকর্মের শিরোনাম 'শিল্পীর বিষ্ঠা' আর তার সামনে যথার্থ দর্শক দাঁড়াবে, তখন তার মনে হতে বাধ্য যে এমন সৃষ্টি কেবল মানজোনির পক্ষেই করা সম্ভব, অন্য কারও পক্ষে নয়।
কেন এর এত মূল্য? কারণ হিসেবে বলা যায়, এটা এমন শিল্প, যা শিল্পকে অন্যভাবে সংজ্ঞায়িত করতে সক্ষম হয়েছিল। মাত্র ২৯ বছরের তারুণ্যে অবিশ্বাস্য মৃত্যুযাত্রা হয়েছিল তাঁর। কিন্তু তিনি একটি দুর্দান্ত শিল্পচিন্তার উত্তরাধিকার রেখে যেতে পেরেছেন। তাঁর শিল্পচেতনা যে শিল্পধারণা জন্ম দিয়েছে, সেসব ধারণাগত শিল্পান্দোলনের জন্য প্রবাদপ্রতিম সৃষ্টি। তাঁর মৃত্যুর পর ৪৫টির মতো 'বিষ্ঠা কৌটো' সংগ্রাহকের কাছে পৌঁছেছে।
'বলবার কিছু নেই: শুধুমাত্র থাকতে হবে, শুধুমাত্র বাঁচতে হবে।'
আংশিকভাবে এটি ছিল শিল্পজগতের একটি মূর্খতাপূর্ণ নির্বোধ প্রবণতার প্রতি মানজোনির পক্ষ থেকে স্রেফ কৌতুক–যেখানে আক্ষরিক অর্থে অভিজাতরা তাদের যা কিছু বলা হবে তাই কিনবে এবং প্রদর্শন করবে, এমনকি বিষ্ঠাও। ২০০২ সালে ব্রিটিশ জনসাধারণের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে উঠেছিল, যখন টেট মিউজিয়াম জাতির সামনে প্রদর্শনের জন্য ৩০ গ্রাম ওজনের মানজোনির বিষ্ঠার একটি কৌটো কিনেছিল ২২,৩০০ পাউন্ড খরচ করে! সে সময় ডেইলি মেইল পত্রিকার সম্পাদকীয়তে এই ঘটনাকে শিল্পীর ফাঁদে পড়ে যাওয়ার জন্য গ্যালারিটিকে 'অযৌক্তিক আলাভোলা' বলে অভিহিত করেছিল এবং সাথে এ-ও যোগ করেছিল যে, এটি 'কোনো পাবলিক লাইব্রেরির লেখকের টয়লেট পেপার একসাথে করে বানানো একটি বই কেনার' অনুরূপ।
কার্ল আন্দ্রের ইটের ভাস্কর্যের সাথে তুলনা করলে, মানজোনির বিষ্ঠার শিল্পের কৌটো সম্ভবত টেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত ক্রয়। কিন্তু ম্যানজোনির কাজের মধ্যে চোখে পড়ার এর চেয়ে আরও বেশি কিছু ছিল।
বলা হয় যে কাজটি একটি বিদ্রুপাত্মক মন্তব্যের বিস্তৃত প্রতিক্রিয়া! মন্তব্যটি তাঁর বাবার, যিনি একটি টিনের কৌটো কারখানার মালিক ছিলেন, কথিত যে একবার রেগে গিয়ে ছেলের শিল্পকাজকে নাকি মলমূত্রের সাথে তুলনা করেছিলেন! আশ্চর্যের যে, সেই ছেলের একটি বিষ্ঠা কৌটো নিলামে বিক্রি হয়েছিল দুই লক্ষ পঁচাত্তর হাজার ইউরো বা দুই লক্ষ পঁয়তাল্লিশ হাজার পাউন্ডে!
তিনি ডুসাম্পিয়ান ধারণার সাথে খেলছিলেন, যেমন একটি বস্তু কেবল কোনো একটি গ্যালারিতে প্রদর্শিত হওয়ার কারণেই শিল্পকর্ম হয়ে উঠতে পারে। তাঁর আত্মপ্রকাশ ছিল রাজার মতো। এমনকি তাঁর অত্যন্ত বিদ্রুপাত্মক ব্যাখ্যায়, মানজোনির টিনজাত মলমূত্র আক্ষরিক অর্থেই ছিল আত্মপ্রকাশের চূড়ান্ত উদাহরণ।
একটি কাজে তাঁকে বেশ কয়েকটি বেলুন ফোটাতে দেখা গেছে, যা সময়ের সাথে সাথে অনিবার্যভাবে চুপসে গেছে এবং বেলুনের অবশিষ্টাংশ তিনি একজন সাধুর সমাহিতের মতো প্রদর্শন করেছেন। মানজোনি সম্ভবত সমসাময়িক শিল্পের উত্তপ্ত বাতাস এবং শূন্যতারও পরামর্শ দিয়েছিলেন। অন্য একটি অনুষ্ঠানে, তিনি মানুষকে 'জীবন্ত শিল্পকর্ম' মনোনীত করেছিলেন কেবল তার স্বাক্ষর করার অভিনয়ের মাধ্যমে, যেমন একজন চিত্রশিল্পী তার ক্যানভাসে স্বাক্ষর করেন।
জনৈক শিল্প পর্যবেক্ষক মানজোনিকে সাম্প্রতিক শতাব্দীর অন্যতম সাহসী চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রকাশ করেছেন। যেমন তাঁর স্বদেশি আলবার্তো বুররি, যিনি তাঁর ক্যানভাস আগুন দিয়ে পুড়িয়েছিলেন এবং লুসিও ফুন্তানা, যিনি তাঁর চিত্রপট ছুরি দিয়ে ফুঁড়ে দিয়েছিলেন।
তাঁর বিষ্ঠার কৌটোটি প্রদর্শনীর কক্ষে মাঝখানে রাখা হয়েছিল। একজন সমালোচক বলেছিলেন, আমি অবশ্যই বলতে পারি যে শিল্প ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কাজগুলোর মধ্যে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়, অথচ তিনি ৩০ গ্রাম খাঁটি সোনা নিয়ে মানজোনির কাছে এসেছিলেন এবং তাঁকে বলেছিলেন: 'আসুন বিনিময় করা যাক।'
মানজোনি একবার বলেছিলেন: 'দেখুন, শিল্পের চারপাশে আপনারা দুর্দান্ত ভক্ত,' তিনি এতটা ভুল ছিলেন না। ১৯৬১ সালে যখন কিংবদন্তি শিল্পী পিয়েরো মানজোনি তাঁর মলকে শিল্পের কাজ হিসেবে বিক্রি করার জন্য কৌটোয় রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে খাঁটি সোনার ওজনের সংগতির ভিত্তিতে এর মূল্য নির্ধারিত হবে। স্পষ্টতই, মানজোনির এই ডুসাম্পিয়ান উদ্যোগটি দ্রুতই বিশ্বজুড়ে শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সংগ্রাহক এবং সাধারণ উৎসাহীদের মাঝে ব্যাপক বিতর্ক এবং মারমুখী সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। আমি মনে করি এবং স্পষ্ট ও দৃঢ়ভাবে বলতে পারি যে জ্যামের বয়ামে বিষ্ঠা অবশ্যই শিল্প নয়। এভাবেই নানা আলোচনা সমালোচনায় শিল্পীর বিষ্ঠার কৌটো সবচেয়ে খ্যাত হয়ে ওঠে।
তাঁর এক সহশিল্পীর বর্ণনায় এখানে একটি ঘটনা বর্ণনা করা যাক, যা তাঁর মিলানের স্টুডিওতে ঘটেছিল। মানজোনি একদিন অনেক তরুণ শিল্পী এবং শিল্পপ্রেমীদের ডেকে পাঠালেন, শুধু তা-ই নয়, অনেক সাংবাদিককেও। সবাই তাঁর স্টুডিওতে। তিনি তরুণ শিল্পী ও উৎসাহীদের গাড়ির দুটি চাকা দেখালেন। তিনি বললেন: 'এই দুটি চাকার একটির দাম ১,০০০,০০০ লিরা, অন্যটির কয়েক লিরা মাত্র, কেন?' দুই চাকার মধ্যে পার্থক্য কী?
তৎক্ষণাৎ উপস্থিত সকলেই চাকা ঘুরিয়েফিরিয়ে, ওজন পরখ করে ইত্যাদি নানা উপায়ে তদন্ত সাপেক্ষে এর গোমর ফাঁস করার চেষ্টা করে। এভাবে বেশ কিছু সময় কেটে গেল এবং তারা বাস্তবিক অর্থে কোনো পার্থক্যই খুঁজে পেল না। এমনকি উপস্থিত সাংবাদিকেরা চাকার পার্থক্য অনুসন্ধান করতে শুরু করলেও তেমন কিছুই ফল হয়নি!
অবশেষে, তারা যখন রীতিমতো ক্লান্ত, তখন তারা মানজোনিকে জানায়, 'মায়েস্ত্রো, আমরা কোনো পার্থক্যই খুঁজে পাচ্ছি না, আমাদের কাছে চাকাগুলো অভিন্ন মনে হচ্ছে, কাজেই আমরা হাল ছেড়ে দিচ্ছি।'
মানজোনি উত্তর দিয়েছিলেন, 'খুবই সহজ, দুটি চাকার মধ্যে কেবল খরচের পার্থক্য, একজন শিল্পী হিসেবে আমি নিজের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে ১,০০০,০০০ লিরার চাকাটি স্ফীত করেছি।'
উপস্থিত সকলে হতবাক, অবিশ্বাস্য এমন মনোভঙ্গিতে সবাই নিশ্বাস ছাড়ে!
তিনি ১৯৬০ সালে সেদ্ধ ডিমের একটি সিরিজ উপস্থাপন করেছিলেন, যার প্রতিটিতে তাঁর আঙুলের ছাপ দিয়ে 'স্বাক্ষরিত', ডিমগুলো উপস্থিত দর্শকদের খেতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সম্ভবত মার্সেল ডুসাম্পের প্যারিস এয়ারের ৫০ সিসি রেডিমেড অ্যাম্পুল দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, তিনি 'আর্টিস্টস ব্রেথ' বা 'শিল্পীর দম' শিরোনামে বেলুনগুলো ফুলিয়েছিলেন এবং বিক্রি করেছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি ইতালীয় লেখক উমবার্তো একো এবং বেলজিয়ান শিল্পী মার্সেল ব্রুডথায়ার্সসহ একদল দর্শকের শরীরে স্বাক্ষর করেছিলেন, যেন প্রত্যেকেই তাঁর শিল্প, কাজ!
আলবিজলা মারিনার পেস্কেত্তো গ্যালারিতে Galleria Pescetto di Albisola Marina, ১২ আগস্ট, ১৯৬১ সালে একটি প্রদর্শনী উপলক্ষে, পিয়েরো মানজোনি প্রথমবারের মতো জনসাধারণের সামনে 'আর্টিস্টস শিটের' কৌটো উপস্থাপন করেন, যাতে লেখা ছিল 'নেট কনটেন্ট ৩০ গ্রাম, প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত, উৎপাদিত এবং ১৯৬১ সালের মে মাসে টিনজাত করা।' উল্লেখ্য যে ৯০টি কৌটোর জন্য শিল্পী কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যবিনিময়ের দিনের সোনার তাৎক্ষণিক মূল্যের সাথে সংগতিপূর্ণ। এই বিতর্কিত শিল্পকর্মের বাজারমূল্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে শেষ নিলামে শিল্পীর বিষ্ঠার একেকটি কৌটোর মূল্য পৌঁছেছে ১২৫,০০০ ইউরোতে! গড়ে তাদের মূল্য ৭৫,০০০ ইউরো।
পিয়েরো মানজোনি তাঁর মিলান স্টুডিওতে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, ২৯ বছর বয়সে, ১৯৬৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে। তবে নানাবিধ অদ্ভুততার চেয়ে সম্ভবত আরও বেশি ছিল তাঁর শিল্পকর্মে প্রখর মেধা, সাহস ও বিচিত্র উদ্ভাবনের চিহ্ন, কিন্তু তা সত্ত্বেও সেসব ছিল যুগপৎ আজব এবং বিস্ময়কর!
মার্সেল ডুসাম্প ১৯১৭ সালে টয়লেট সরঞ্জাম মানে মূত্রাধার উপস্থাপন করে শিল্পদুনিয়ায় তোলপাড় করে দিয়েছিলেন। তার ৪৪ বছর পর আবারও টয়লেট-সংক্রান্ত মানে এবারে বিষ্ঠা এল শিল্পশালায়! তা-ও আবার সোনার দরে!
কিছুসংখ্যক শিল্পবোদ্ধা এসব শিল্পপ্রয়াসকে চমকপ্রদ বলে সমালোচনা করলেও কারও কারও মতে তা কেবল কৌশলী, মনোযোগ আকর্ষক বলে বিবেচিত।
শিল্পদুনিয়া কবেই-বা ভেবেছিল প্রদর্শনশালায় চলে আসবে মূত্রাধার ও মল? যখন এল তা নিয়ে সমালোচনা, প্রত্যাখানের পর্ব ছাড়িয়ে শিল্প ইতিহাসে স্বতন্ত্র শিল্পদৃষ্টিভঙ্গি ও মহিমা নিয়ে তাদের অবস্থান পোক্ত করে নেয়।
বিষ্ঠার কথা শুনে কিংবা প্রক্ষালনকক্ষে কৌটো হাতে দাঁড়ানো মানজোনির ছবি দেখে যদি উল্টে আসা বা বিবমিষার উদ্রেক হয় দর্শকের মধ্যে, তবে তার মূল রহস্য এই কৌটোতে বিষ্ঠা থাকার তথ্য! না-ও তো থাকতে পারে! সত্যিই তাতে বিষ্ঠা আছে কী নেই, তার সত্যতা কী? প্রক্ষালনকক্ষে নিঃসরিত বিষ্ঠা টিনজাত করার প্রক্রিয়াটা তো ধারাবাহিক ডকুমেনশন করা নেই! এসব কেউ প্রত্যক্ষ করতে উৎসাহ প্রকাশ করেছেন কি? অথবা বলা যায়, কেই-বা এসব প্রত্যক্ষ করতে যাবেন! এখানেই মানজোনির ধারণাগত শিল্পপ্রয়াসের জিত।
জল্পনা রয়েছে যে লেখকের মৃত্যুর ৩০ বছর পরে তাঁর বন্ধু আগোস্তিনো বোনালুমি প্রকাশ করেছিলেন যে কৌটোতে কেবল প্লাস্টার রয়েছে। তবে, দাবিটি সত্য কি না, তার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য কৌটোগুলোর কোনোটিই খোলা হয়নি। শিল্প? বাস্তব কৌতুক? মানজোনির কাছে সব একই ছিল। তিনি এটা করতেন, কারণ, তিনি জানতেন যে তিনি পারবেন। এমন সাহসী কাজ নিয়ে সমালোচকদের মোকাবিলা করে তাঁর উপহাস একটি নতুন মানদ- স্থাপন করেছে। তার কাজগুলো এখন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘরে প্রদর্শিত হয় এবং কৌটোগুলোর মূল্য ২৫০ হাজার ইউরোরও বেশি।
এটা যে সম্ভব হয়েছে, তা মানজোনি যদি দেখতে পারতেন, লোকেরা কীভাবে তাঁর কাজের প্রশংসা করে, তাহলে তিনি হেসে ফেলতেন। তিনি একটি বিষয় প্রমাণ করেছেন, মানুষের কাছে শিল্পের নামে যেকোনো কিছুই বিক্রয় করা সম্ভব, এমনকি তা যদি মলমূত্রও হয়!
মানজোনি তাঁর কাজের স্বীকৃতির পাশাপাশি অপমানও পেয়েছেন বিস্তর! যাই হোক, তার অকাল মৃত্যুর মাত্র দুই বছর পরে, তার শিল্পকর্মকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম অপ্রতিরোধ্য শিল্প-উপহার হিসেবে গ্রহণীয় করে তুলবার ক্ষেত্রে হয়তো নিখুঁত অজুহাত তৈরি করেছিল, যা আভান্ট-গার্ড শিল্পীদের অহংকেন্দ্রিকতার একটি অমূল্য প্রমাণ হয়ে উঠেছে।
মার্সেল ডুসাম্পের দাদাবাদ, সালভাদর দালির পরাবাস্তববাদ, সেই সাথে জর্জেস ব্যাটেইলে এবং দালির কাজ দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণে, তিনি তাঁর বর্জ্য বা বর্জ্য বলে যাকে মহত করে উপস্থাপন করেছেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। শিল্পজগত যে 'হিংস্র খরচ' প্রদর্শনের আরেকটি উপায়, তা মানজোনির এই কাণ্ডের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়।
শেষবিচারে যা আসলে শিল্প হয়ে ওঠে না, সেটাই কি শিল্পবিষ্ঠা? আবার পুঁজির দাসত্বের যুগে বিষ্ঠাও যে পণ্য, ভোক্তাবাদী সমাজকে এর চেয়ে নির্মম কটাক্ষের মধ্যে শিল্পী মানজোনি ছাড়া আর কে এতটা অসহায়ভাবে দাঁড় করিয়ে দিতে পেরেছেন?
মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা যেমন রহস্যপূর্ণ একটি বিষয়, তেমন রহস্যপূর্ণ তার সৃষ্টিশীলতাও। মনোবিজ্ঞানীরা বিষয় দুটিকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করলেও তা থেকে উদ্ভূত কিছু দর্শনগত সমস্যার কোনো সমাধান পাননি। সৃষ্টিশীল মানুষের প্রকৃতি এমনই এক ধাঁধা যে নানা উপায়ে তাকে সমাধান করার চেষ্টা করা হলেও শেষ পর্যন্ত উত্তর পাওয়া প্রায় অসম্ভব।