সবুজ সমুদ্র কচ্ছপের দ্বীপ হুয়ান ভেনাডো
নিকারাগুয়ার নির্জন দ্বীপ হুয়ান ভেনাডো-তে আমি এসেছি সুহৃদ সিনিওর ডিগমারের প্ররোচনায়। দ্বীপটি বিরল প্রজাতির সবুজ সমুদ্র কচ্ছপ 'গ্রীন সি টার্টোল' এর প্রজনন ক্ষেত্র। আমাদের সহযাত্রী হয়ে এসেছে ক্রিসটেলা ও বিয়াংকা নামে দুই তরুণী মেরিন গাইড। মেয়ে দুটি জাতীয়তার নিরিখে নিকারাগুয়েনসে, তবে অভিবাসির সন্তান হিসাবে তারা বড় হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লেরিডায়। এরা ফি বছর গ্রীষ্মের ছুটিতে তাদের পিতৃপুরুষের দেশ নিকারাগুয়াতে আসে মেরিন গাইড হিসাবে পর্যটকদের কাছে তাদের পেশাদারি সেবা বিক্রয় করে একাডেমিক পড়াশুনার খরচ সংকুলান করতে। গেল দেড় দিন ধরে আমরা ক্যাম্প করে সময় কাটাচ্ছি হুয়ান ভেনাডো দ্বীপে। সমুদ্র পর্যবেক্ষণের ভেতর দিয়ে ক্রিসটেলা ও বিয়াংকার সাথে আমাদের গড়ে উঠছে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। ক্রিসটেলা গাইড হিসাবে দক্ষ, তবে সেন্টিমেন্টাল। বিয়াংকা একাডেমিক দিক থেকে খুবই শার্প, আচরণে সে হাসিখুশি ও সামাজিক।
বিকালে আমি একা একা একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। সন্ধ্যায় ফিরে আসি আমাদের ক্যাম্প-গ্রাউন্ডে। ছনের ছানির তলায় যে কাঠের প্ল্যাটফর্মে আমাদের স্লিপিংব্যাগ ও মশারি পাতা হয়েছে, তার কাছেই গ্রিলে রান্নাবান্নার আয়োজন চলছে। ডিগমার ও বিয়াংকা মাছ ধরতে গিয়ে লবস্টার পাকড়েছে মাত্র দুটি। তবে তারা একটি স্ন্যাপার মাছ ও তিনটি কাঁকড়া ধরে নিয়ে এসেছে। ডিগমার চারকোলের আঁচে এসব গ্রিল করছেন। বিয়াংকা সাজিয়ে রাখছে তরতিয়া রুটি,মাখন, ও স্যালাদের সব্জি। ক্রিসটেলা দিয়াশলাই স্ট্রাইক করে মোমবাতি জানালায়। সে আমার দিকে তাকিয়ে কী যেন এক ঘোরের ভেতর হাসে। চুলে রঙিন একটি সিল্কের স্কার্ফ জড়িয়েছে, তাই মেয়েটিকে বিয়ের কনের মতো লাজরক্তিম দেখায়।
আমিও ডিনার তৈরীতে হাত লাগাই। শশা কাটার জন্য বিয়াংকার কাছ থেকে ছুরি নিতে গেলে সে আমার কাছ ঘেষে কাঁধে অন্তরঙ্গভাবে হাত রেখে বলে,'ইজন্ট আ ফাইন ঈভিনিং?' আমি তার কব্জি ছুঁয়ে বলি,'ইনডিড আ কুল ঈভিনিং, এন্ড ইউ লুক চার্মিং।' আমার তারিফের প্রতিক্রিয়ায় অত্যন্ত সিডাকটিভভাবে হেসে, বিয়াংকা একটি লেবু নখে খুঁটে শোঁকার জন্য আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়। আমি স্যালাদে অলিভ ওয়েল ও লেবুর রস মেশাই। ডিগমার প্লেটে প্লেটে গ্রিল করা স্ন্যাপার মাছ, দাঁড়া ফাটানো কাঁকড়া ও লবস্টারের টুকরা রাখছেন। বিয়াংকা রুটিতে মাখন মাখাতে মাখাতে ফিসফিসিয়ে জানতে চায়,'হাউ আবাউট আ ওয়াক টুগেদার আর্লি ইন দ্যা মর্নিং, রাইট আফটার দ্যা সানরাইজ?' আমি তার মোমের আলোয় মায়াবী হয়ে ওঠা মুখের দিকে তাকিয়ে বলি,'দ্যাট উড বি আ লাভলি ট্রিট।' ডিগমার বিষয়টি খেয়াল করেন। তিনি প্লেটে প্লেটে আধপোঁড়া পেঁয়াজ ও রসুনের কোয়া রাখতে রাখতে তাঁর ঝোলা গোঁফের তলায় অর্থবোধক হাসি আড়াল করেন।
ডিনারের পর পরই সিনিওর ডিগমার কাঠ জড়ো করে ক্যাম্পফায়ারের আগুন জানালেন। অরেঞ্জ জুসের সাথে পুদিনা পাতা ও লেবুর রসে হোয়াইট রামের ফোঁড়ন দিয়ে ক্রিসটেলা ড্রিংকস্ তৈরী করে। আমি আইপডে মোৎসার্টের 'সোনাটাস ফর টু পিয়ানোজ' বাজাই। ডিগমার ড্রিংকসে চুমুক দিয়েই পাইপে আবগারি ট্যবাকো পুরেন। তাতে দম দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে ক্রিসটেলা আঁধার গাঁঢ় হয়ে আসা আকাশের দিকে তাকায়। কয়েকটি নিশাচর পাখি ডানার পত পত শব্দ ছড়িয়ে উড়ে যায় নিচু হয়ে। ক্রিসটেলা নতমুখি হয়ে গ্লাসের তরলে নজর রাখলে তার চোখেমুখে ছড়ায় কেমন যেন সব হারানোর অভিব্যক্তি। সে আগুনের আভার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলে,' দিস ক্লাসিক্যাল কনসিয়ারর্ত হ্যাজ সাচ্ আ সুদিং এফেক্ট অন মি। কি বাজাচ্ছো তুমি?' আমি জনান্তিকে জবাব দেই,' ধ্রুপদী সঙ্গীতের এ আলেখ্যটি সোনাটাস ফর টু পিয়ানোস নামে পরিচিত। মোৎসার্ট এটি কম্পোজ করেন ১৭৮১ সালে।' খুব শার্পভাবে ঝাঁঝিয়ে ওঠে ক্রিসটেলা বলে,'আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড ইন মিউজিক্যাল হিস্ট্রি।' আমি এনোয়েড হই, কিন্তু মুখে কিছু বলি না। একটি তথ্য আমার করোটিতে ঘুরপাক করে। মিউজিক থেরাপি হিসাবে এ সোনাটার ব্যাপক প্রচলন আছে। শ্রোতার মনলোকে ধ্বনিপুঞ্জের প্রশান্তি ছড়িয়ে দেয়ার পজিটিভ পাওয়ার নিয়েও স্টাডি হয়েছে। ঠিক বুঝতে পারি না, ক্রিসটেলার এটিচিউড্ হঠাৎ করে হোস্টাইল হয়ে ওঠলো কেন?
বিয়াংকা নীরবে আমার কব্জি স্পর্শ করলে, আমি ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাই। আগুনের আঁচে রাঙা হয়ে ওঠা তার চোখমুখে ছড়াচ্ছে প্রশ্রয়। পাশেই ক্রিসটেলা বিষাদগ্রস্থ মুখে বসে আছে নিশ্চুপ। ডিগমার খুব ম্যাচিউর ভঙ্গিতে ক্রিসটেলার কাঁধে হাত রেখে বলেন,' গালর্, হোয়াই আর ইউ ফিলিং স্যাড? মনে হয়, কিছু একটা ঘটেছে তোমার জীবনে। আই অ্যাম অনেস্টলি স্যারি আবাউট ইট।' ক্রিসটেলা করতলে তার চোখ ঢেকে কান্না সামলায়। ডিগমারÑ কী ঘটছে তা ইশারায় বিয়াংকার কাছে জানতে চান। সে নিচুস্বরে বলে,' মাস তিনেক আগে আমরা দু'জন ইতালিয়ান পর্যটককে মেরিন গাইড হিসাবে সঙ্গ দিয়ে হুয়ান ভেনাডো দ্বীপে নিয়ে আসি, ক্যাম্প করে রাত কাটাই।। এদের একজন পিয়েতরোর সাথে ক্রিসটেলার সিরিয়াস বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। মানুষটির কিছু আচরণ ক্রিসটেলার পছন্দ হয়নি, তা নিয়ে বাঁধে দ্বন্ধ। এবং সম্পর্ক গাঢ় হয়ে ওঠার আগেই তা ভেঙ্গে যায়।' বিয়াংকাকে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে ক্রিসটেলা আলাপে যোগ দেয়,'পিয়েতরো ওয়াজ লাভলি এন্ড ওয়ান্ডারফুল। স্পিয়ার ফিসিংয়ে গিয়ে ব্লু মারলিন মাছটিকে বর্শাবিদ্ধ করলে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।' এ পর্যন্ত বলে ক্রিসটেলা ড্রিংকসের বাকিটুকু তার গ্লাসে ঢালতে গেলে বিয়াংকা বলে ওঠে,' ইউ নিড টু আন্ডারস্ট্যান্ড মারলিন মাছ শিকারে আইনি কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। তোমার ইমোশনের প্রতিও তো পিয়েতরো ছিলো খুব সেনসেটিভ। আমার সামনে সে তোমার কাছে বারবার এপোলজি চাইলো। তারপর তুমিও তো তার সাথে খুশিমনে মমোতোমবো আগ্নেয়গিরিতে ক্যাম্পিংয়ে গেলে.. ফিরে আসলে দারুণভাবে আপসেট হয়ে। হোয়াট একচুয়েলি হেপেন্ড দেয়ার?'
ক্রিসটেলার আচরণে আবার মিলাংকোলিক ভাব ফিরে আসে। চোখেমুখে ক্রোধ ছড়িয়ে সে বিয়াংকাকে বলে,' মমোতোমবোতে কী ঘটেছে তা তুমি খুব ভালো করেই জানো। ইয়েস, পিয়েতরো ওয়াজ ভেরি লাভিং, কিন্তু মমোতমবো আগ্নেয়গিরিতে পৌঁছেই সে হ্যাম রেডিও দিয়ে তার হ্যান্ডারদের কাছে আমার সম্পর্কে তথ্য ট্রান্সমিট করতে শুরু করে।' বিয়াংকা প্রতিবাদ জানিয়ে বলে,'লিসেন আই অ্যাম ইয়োর বেস্ট ফ্রেন্ড, আই অ্যাম টেলিং ইউ..অই ইনফরমেশন ট্রান্সমিটের বিষয়টা তোমার ¯্রফে কল্পনা, ইটস্ সিম্পলি অ্যান ইল্যুশন। পিয়েতরোর হবি হচ্ছে হ্যাম রেডিওতে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে কথা বলা। সে তোমার সম্পর্কে কোন তথ্য ট্রান্সমিট করেনি। আর কী ইবা সে ট্রান্সমিট করবে, নোবডি উড বি ইন্টারেস্টেড টু লার্ন এনিথিং আবাউট ইউ।' ক্রিসটেলা খেপে গিয়ে ঝরঝরিয়ে কেঁদে বলে,'ওহ্ মাই গড, মাই বেস্ট ফ্রেন্ড ইজ নো লংগার ট্রাস্টস্ মি।' বিয়াংকা প্রতিবাদ জানায়,'দ্যাটস্ নট ট্রু। আমি শুধু তোমার আজগুবি কল্পনা করার যে প্রবণতা আছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করছি। দ্যা কুল ইতলিয়ান গাই পিয়েতরো ইজ স্টিল ইন্টারেস্টেড ইন ইউ। এ নিয়ে সে আমাকেও টেলিফোন করেছে।' ক্রিসটেলা আবার রুখে ওঠে বলে,'ওহ্ লর্ড, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড এখন আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে কন্সপিরেসি করছে।' বলেই আকুল হয়ে কেঁদে ওঠলে, ডিগমার তার হাত ধরে বলেন,'অহ বেইবি, সামওয়ান রিয়েলি হার্ট ইউ সো ব্যাডলি..।'
ক্রিসটেলাকে সান্তনা দিতে দিতে সিনিওর ডিগমার তাকে নিয়ে দীর্ঘ ঘাস মাড়িয়ে চলে যান ঝোপের ওপাশে। এদিকে ক্যাম্পফায়ারের আগুনও নিভতে শুরু করে। বিয়াংকা অংগারের উত্তাপ হাতে মাখতে মাখতে বলে,'ক্রিসটেলাকে আমি খুবই ভালোবাসি। সেই আমার একমাত্র বন্ধু। কিন্তু, কিছুতেই সে কথা শুনবে না। তার উচিত রেগুলার স্কিজোফেনিয়ার মেডিসিনগুলো নেয়া। ওষুধ না নিলে তার মাথায় ভর করে রাজ্যের আজগুবি কল্পনা, একে-তাকে সে খামোকা সন্দেহ করতে শুরু করে।' আমি নীরবে শুনে যাই, কিন্তু কোন কথা বলি না। মেঘ ভেঙ্গে চুঁইয়ে পড়ছে জোছনা। দেখতে দেখতে মনে হয়, ক্রিস্টালে তৈরী অজস্র ওয়াইন গ্লাসের কাচে প্রতিফলিত হচ্ছে বিজুলি বাতির সোনালি আভা। আমি বিয়াংকাকে 'গ্রাসিয়াস বা থ্যাংকয়ু', বলে ওঠে পড়ি। সে আমার সাথে এসে স্লিপিংব্যাগের উপর মশারি খাটাতে সাহায্য করে। আমি তাকে 'গুড নাইট,' বললে সে 'সি ইউ', বলে চলে যায় তার স্লিপিংব্যাগের কাছে।
স্লিপিংব্যাগে ঢুকে আমি এপাশ ওপাশ করি। মশারির ভেতর জোছনা আঁকছে মসলিনের আলপনা। বাতাসে একটি বাঁশির মৃদু সেরেনাদ ভেসে এলে বেজায় কাকতালীয় লাগে। তবে অবাক হই না তেমন। বিকালে ক্রিসটেলার হাতে আমি একটি বাঁশি দেখেছি।
রাতে ঘুম ভাঙ্গে হুট হুট শব্দে। মশারির তলায় হাঁটু মোড়ে বসে দেখি, ঝোপঝাড়ে মসলিনের রেণুর মতো লেগে আছে জোছনার ডিভাইন বিভা। আশপাশের গাছে বসে কয়েকটি প্যাঁচা ডেকে ডেকে চাঁদনী মাখা রাতের নির্জনতাকে করে তুলছে রহস্যময়। ক্যাম্পগ্রাউন্ডের ছোট্ট চাতালের প্রান্তিকে দুটি ছায়ামূর্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। শরীরের আবছা প্রোফাইল থেকে ডিগমার ও ক্রিসটেলাকে শনাক্ত করতে কোন অসুবিধা হয় না। আমি আবার শুয়ে পড়ি, কিন্তু ঘুম আসে না।
একটু বেলা করে ঘুম ভাঙ্গে। দেখি, ক্যাম্পফায়ারের আঙ্গারস্তূপের পাশে সুইমিং স্যুটের ওপর কোমরে বাটিকের র্যাপ জড়িয়ে বসে বিয়াংকা। আমাকে দেখতে পেয়েই সে থার্মস্ থেকে কফি ঢালতে ঢালতে বলে,' তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।' প্রাতঃরাশের বনরুটিতে সফ্ট চিজ মাখিয়ে আমি ডিগমার ও ক্রিসটেলার তলাশে এদিক-ওদিক তাকাই। বিয়াংকা ফিক করে হেসে বলে,'দে আর গন ।' কফিপানের পর আমিও ওঠে পড়ি। বিয়াংকা ডুবসাঁতারে জলতলে পর্যবেক্ষণের জন্য দুটি স্নোরকেল তুলে নেয়।
আমরা চলে আসি সংকীর্ণ খাড়ির কাছে। ভাটার তোড়ে নেমে যাচ্ছে প্রচুর জল। আর বেরিয়ে পড়ছে শ্বাসমূলের শিকড়বাকড়। বেলা হয়েছে, ডিম পাড়তে আসা কচ্ছপদের আজ দেখতে পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ভোরের ঝিরিঝিরি হাওয়ায় হাঁটতে ভালোই লাগে। আমরা চলে আসি খোলা বালুচরে। বিয়াংকা পা থেকে খুলে নেয় স্লিপার। আর কী যেন দেখতে পেয়ে অস্ফুটে চিৎকার করে ওঠে,' অহ্ গড, তুমি সত্যিই সৌভাগ্যবান!' আমি তার হাতের ইশারা লক্ষ্য করে দেখি -- বেশ দূরে বালুকাবেলায় ছোট ছোট পায়ের স্পষ্ট রেখাচিহ্ণ এঁকে টুকটুকিয়ে জলে ফিরে যাচ্ছে দুটি কচ্ছপ। বিয়াংকা -- ভোরবেলা কেবলমাত্র দুটি কচ্ছপ দেখা যে নিকারাগুয়ান সংস্কৃতিতে সৌভাগ্যের আলামত, তা আমাকে বুঝিয়ে বলে। তখন আমি তাকে খেয়াল করিয়ে দেই,'ইউ সাইটেড দ্যা সি-টার্টোল ফার্স্ট, তো সৌভাগ্যের কোন ব্যাপার থাকলে তা ঘটবে তোমার জীবনে।' চোখ কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে সে দীর্ঘশ্বাস চেপে বলে,'আমার জীবনে তাড়াতাড়ি সৌভাগ্য আসার কোন সম্ভাবনা দেখছি না।' 'হোয়াই ইজ দ্যাট, আনফরচুনেট কিছু ঘটেছে কী?' খুব ফ্র্যাংকলি সে জবাব দেয়,'ইয়েস, খুব ডিসএপোয়েন্টেড হয়েই আমি নিকারাগুয়াতে এসেছি। মেরিন বায়োলজি নিয়ে আমি বস্টন ইউনিভারসিটিতে মাস্টার্স করতে চেয়েছিলাম। এপ্লাই করে একসেপ্টেডও হয়েছিলাম। আই হ্যাভ আ ভেরী গুড একাডেমিক ট্র্যাক রেকর্ড। কিন্তু টিউশন ফি সেভেনটি ফাইভ থাউজেন্ড ডলার। দিস ইজ জাস্ট আ হিউজ কস্ট, আই সিম্পলি ক্যান্ট এফোর্ড।' আমি এবার জানতে চাই,'তোমার বাবার সাথে কথা বলেছো,উনি হেল্প করতে পারেন না?' জবাব দিতে গিয়ে বিয়াংকাকে ম্লান দেখায়। সে আকাশে উড়ে যাওয়া সিন্ধুসারসের চলমান ছায়ার দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়,'আমার বাবার মৃত্যু হয়েছে অনেক বছর আগে। নাউ আই হ্যাভ আ স্টেপ ড্যাড। আমার সৎপিতার কোন আগ্রহ নেই আমাকে ফাইনান্সসিয়ালি সাপোর্ট করার।'
কী বলবো বুঝতে পারি না। আমাদের কিছু কিছু আকাঙ্ক্ষা দিগন্তের কাছাকাছি তুষারে ছাওয়া চূড়ার মতো, চাইলেও ওখানে আমরা আরোহন করতে পারি না। ইউনিভারসিটি অব ম্যাসাচুসেটসে উচ্চশিক্ষার বিপুল ব্যয় সংকুলানের জন্য আমাকে একবার যুদ্ধবিক্ষুদ্ধ কম্বোডিয়ায় কাজ করতে যেতে হয়েছিল। ওখানে উপার্জনের সাথে শরীরের সংক্রামিত হয়েছিলো ডেঙ্গু জ্বরের তীব্র প্রদাহ। আমি হাঁটতে হাঁটতে আমার অভিজ্ঞতাকে শেয়ার করি। শুনে বিয়াংকা ম্লান হেসে বলে,'আই অ্যাম ফলোয়িং দ্যা সেম স্ট্র্যাটেজি। মেরিন গাইড হিসাবে কাজ করে আমার হাতে আসছে বেশ কিছু টাকা। আমি তা সেভ করছি। অই টাকা জড়ো করে আমি ইউনিভারসিটিতে যেতে পরবো একদিন।'
ম্যানগ্রোভের ঝোপঝাড় পেরিয়ে সৈকতে এসে বিয়াংকা একটি স্নোরক্যাল তুলে দিলে -- আমি হেলমেটের মতো তা মাথায় পরে নেই। সে আমার হাতে একটি আন্ডারওয়াটার ক্যামেরা ধরিয়ে দিয়ে বলে,'আমি তোমাকে প্রবালের একটি দুর্দান্ত বাগানে নিয়ে যাচ্ছি, চাইলে তুমি ওখানে একটি দুটি ছবিও তুলতে পারো।' আমরা ব্যাকপ্যাক সৈকতে রেখে নেমে পড়ি জলে।
সমুদ্রের এ দিককার পরিসর অনেকটা লেগুনের মতো। তরঙ্গ নেই একেবারে। জলের সারফেসে পরিষ্কারভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে মেঘভাসা আকাশ। নোনাপানির তলায় বালুকায় মুখ গুঁজে পড়ে আছে কালচে-খয়েরি ছায়া-ছায়া রঙের পাথররাজি। তাদের আশপাশ দিয়ে আস্তে-ধীরে সাঁতার কাটছে হরেক রঙের মাছ। আমি স্নোরকেলের ফিতা এডজাস্ট করতে করতে চলে আসি বুকজলে। বিয়াংকা আমাকে ইশারা দিয়ে পানিতে শরীর ডুবায়। পানির সারফেসের ওপর ভেসে আছে স্নোরকেলের দীর্ঘ নল, যা তার মুখের সাথে সংযুক্ত। এতে ডুবসাঁতারে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে উপরের বাতাবরণ থেকে অনায়াসে সে টেনে নিতে পারছে নিঃশ্বাস। প্রঃশ্বাস ছাড়তেও কোন অসুবিধা হচ্ছে না। আমিও এবার পানিতে মাথা ডুবাই। জলতলে রীতিমতো ল্যান্ডস্কেপ করা নানা শেইপের প্রবাল। এগুলোর খাঁজ-খোঁজে হাল্কা স্রোতে দুলছে নানা আকৃতির মাছ।
একটি বড়সড় মীন কানকা নাড়তে নাড়তে কৌতূহলি চোখে আমার দিকে তাকায়। আমি পানি তলায় বিয়াংকার ভাসমান ছায়াকে অনুসরণ করে সামনে বাড়ি। সে সাঁতার কাটতে কাটতে বারবার ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে, মনে হয়, হাতের ইশারায় কী যেন দেখাতে চাচ্ছে। আমি প্রবালের বিস্তারিত রেখায় লেপ্টে থাকা মাছ ছাড়া আর বিশেষ কিছু দেখতে পাই না। ডান দিকের প্রকান্ড একটি ডুবা পাথরের তলা থেকে বলকে বলকে বেরোচ্ছে বুঁজকুড়ি কাটা ঘোলাজল। আমি চোরাস্রোতকে অতিক্রম করে এসে পড়ি নোনাজলে নিমগ্ন গুল্মের চত্তরে। খানিক দূরে, তীরের মতো জল কেটে সাঁতরে যায় লেজওয়ালা একটি শংকর মাছ। পর পর ভেসে আসে আরো কয়েকটি একই প্রজাতির মাছ। খুব কাছ থেকে আমি মাছগুলোর মুখ দেখতে পাই। কালো ফোটা-ফোটা এ মাছের মুখ পাখির মতো। শংকর মাছের এ প্রজাতির সাথে আমার আগে কখনো মোলাকাত হয়নি। এদের সাঁতারের ভঙ্গি অনেকটা বড়সড় চিলের ফ্লাই করার মতো। ভার-ভারিক্কি চালে ভেসে ভেসে আসে দুটি সবুজাভ সি-টার্টোল। তারা জলতলের গুল্ম চিবাতে চিবাতে পরষ্পরের দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যে -- মনে হয়, পাথরের বড়সড় একটি সোপান পেলে, ওখানে বসে জিরাতে জিরাতে বলে নেবে দুদন্ড কথাবার্তা। এতো কাছ থেকে প্রৌঢ়ত্ব অতিক্রম করা সমুদ্র-কচ্ছপদের আমি আর কখনো দেখতে পাইনি। ভাবি, এদের ছবি তুলে নেবো। কাছিম দুটি যেন আমার অভিসন্ধি বুঝতে পেরে লুকিয়ে পড়ে ফোয়ারার মতো মস্ত একটি প্রবালের আবডালে। আর তখনই জলতল আন্দোলিত হয়ে ওঠে দারুণভাবে। গোটা পঞ্চাশেক রূপালি মাছ ভেসে আসে এক সাথে। তাদের রূপালি দেহের পেছনে ছন্দায়িতভাবে নড়াচড়া করছে সোনালি লেজ।
বিয়াংকার ইশারায় আমি গলাজলে দাঁড়িয়ে মাথা তুলি। সে-ও ভেসে ওঠেছে, জানতে চায় -- আমি রক বিউটি মাছগুলো দেখতে পেয়েছি কী? সে বর্ণাঢ্য মাছটির বর্ণনা করলে, আমি জানতে চাই, সোনালি লেজ নেড়ে দল বেঁধে ভেসে যাওয়া মাছগুলো কী? সে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলে,'দে আর আ বা অব ইয়োলো টেইল স্ন্যাপার ফিস। দে টেইস্ট গুড, বাট টোটালি স্টুপিড।' মাথা থেকে স্নোরকেলের হেলমেট সরিয়ে সে ভেজা চুলে আংগুল চালিয়ে রাবার ব্যান্ডে গিঁট দেয়। তাতে বিকিনি-টপ ছাপিয়ে ওঠে তার নোনাজলে সিক্ত স্তন যুগল। মাথায় স্নোরকেল চাপাতে চাপাতে সে জানতে চায়,'ওয়ানা গো ডাউন আন্ডার ওয়াটার এগেইন?' আমি রেসপন্স করি,'অহ্ ইয়েস, শো মি নাউ সাম ইনটিলিজেন্ট ফিস।' সে আমার দিকে জল ছিটিয়ে দিয়ে বলে,'কাম অন, লেটস্ চেইজ দ্যা রক বিউটি?' জলতলে আবার সাঁতার কাটতে কাটতে দেখি, আমাদের সামনে দিয়ে রীতিমতো মার্চ করতে করতে আগুয়ান হচ্ছে ইয়োলো টেইল স্ন্যাপারদের বিশাল একটি স্কুল। তাদের ভেতর দিয়ে তোড়ে-জোড়ে ফ্লাই করছে শংকর মাছগুলো। স্ন্যাপারদের চলমান স্কুলের মাঝ বরাবার ভেসে থেকে ট্র্যাফিক পুলিশ যে রকম হাত তুলে নিয়ন্ত্রণ করে যানবাহনের গতিপথ, তেজি কয়েকটি শংকর বেজায় লম্বা লেজ নেড়ে যেন দিগনির্দেশনা দিচ্ছে।
আমরা এবার এসে পড়ি জলজ গুল্মে ছায়াচ্ছন্ন পরিসরে। পানিতে ত্রিশংকু হয়ে ভেসে থেকে রীতিমতো পা নাড়িয়ে ড্যান্স করছে কয়েক শত চকচকে লাল চিংড়ি। একটি অক্টোপাস এদের উৎপাতে বিরক্ত হয়ে, ডজন খানেক হাত-পা দিয়ে ডুবাপাথরের শরীর থেকে শ্যাওলা সরিয়ে জল ঘোলা করতে করতে সরে যায় অন্ধকার এক কোণে। তখনই আমি রক বিউটি মাছগুলোকে স্পট করি। একটি দুটি নয়, রীতিমতো পাঁচটি রক বিউটি তাদের কুচকুচে কালো শরীরে রঙের তীব্র সোনালি আভা ছড়িয়ে খামোকা কানকা নাড়ছে। এদের কাছাকাছি নীল রঙের লেজে হলুদ ছোপ আঁকা একটি এ্যাঞ্জেল ফিস লাজুক ভঙ্গিতে আড় চোখে তাকায়। কী যেন আমার পায়ে সুড়সুড়ি দিলে আমি ভুস করে ভেসে ওঠি।
দেখি, কাছেই জলহস্তির পৃথুল দেহের মতো ভেসে আছে প্রকান্ড একটি রক। ডুব-সাঁতারে আমার শরীরে জমেছে কিছুটা ক্লান্তি। তাই, পেল্লায় রকটির ওপর ওঠে পা ঝুলিয়ে বসি। জলতলে দেখা মাছ ও প্রবালের দারুণ সব ইমেজ আমার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে দেয়। আমি ঊর্মিসংকুল ফেনার সবুজাভ শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে নির্ভারবোধ করি। আশ্চর্য্য এ অনভূতিটি অভাবিতপূর্ব, এতে আছে এক ধরনের আবেশ। ভুস করে ভেসে ওঠে বিয়াংকা। সে শরীর ঘষটে রকে ওঠে পড়ে জানতে চায়, আর ইউ নট ইন্টারেস্টেড ইন স্কুবা ডাইভিং?' আমি নেতিবাচকভাবে মাথা হেলিয়ে জবাব দেই,'নট রিয়েলি, স্কুবা ডাইভিংয়ের নিয়ম-কানুন অনেক, এ সব শেখার মতো আমার মনযোগ নেই।' যেন আমার সাথে তর্কে করছে এমন ভঙ্গিতে সে আবার বলে,'জলতলের গভীরে এমন বিষয়-আশয় আছে, স্কুবা ডাইভিং না করলে তুমি কখনো এসব দৃশ্য দেখতে পাব না। ইউ উড মিস আ হৌল লট অব আন্ডার ওয়াটার সিনস্, সিনিওর।' আমি প্রতিক্রিয়া জানাই,'আই অ্যাম হেপি ইউথ হোয়াট আই হ্যাভ বিন সিয়িং, স্নোরক্যাল আমি পছন্দ করি, এতে ঝামেলা কম, এন্ড দিস ইজ জাস্ট ফাইন ইউথ মি।'
বিয়াংকা স্লাইড করে রক থেকে জলে নেমে বলে,'তোমাকে কিছু ইউনিক শেপের প্রবাল ও তার আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকা কয়েকটি প্যারোট ফিস দেখাতে চাই। দ্যাটস্ ইট, দিস ইজ গোয়িং টু বি মাই গিফ্ট টু ইউ ।' আমি তাকে 'থ্যাংকয়ু' বলতে বলতে মাথায় স্নোরকেলের হেলমেটটি পরে নেই। আমরা ডুবসাঁতারে ভেসে যাই বেশ খানিকটা সময়। প্রবালের কিছু ফর্মেশনকে গাছপালায় নিবিড় বাগিচার মতো মনে হয়। খুব সাবধানে ফ্লিপার নেড়ে ভাসছে বিয়াংকা। আমি তাজ্জব হয়ে দেখতে পাই -- প্রবালপুঞ্জের লীলাবৈচিত্র। কোন কোন প্রবালের আকার-আকৃতিকে যাদুঘরে সাজিয়ে রাখা ভিনটেজ আর্ট অবজেক্টের মতো দেখায়। অনেকগুলো তাজা ফুলের সমবায়ে তৈরী সাজির মতো দেখতে বিশাল একটি প্রবালের মাঝখানকার ছিদ্র থেকে উঁকি দেয় আজানা একটি কুঁতকুঁতে চোখের মীন। আমি তন্ময় হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তখন আরো কিছু প্রবালে তৈরী দেয়ালের ওপাশ থেকে ড্রামাটিকভাবে বেরিয়ে আসে গোটা পাঁচেক রঙচঙে প্যারোট ফিস। তাদের মে নৃত্যরতা কালারফুল কসটিউম পরা ড্যান্সারদের মতো বর্ণাঢ্য দেখায়। ক্যামেরা বাওছাও করার আগেই প্যারোট ফিসগুলো আবার ভেসে পর্দার ওপারে চলে গেলে, আমি খাজুল হয়ে তীরে ফেরার জন্য উল্টাদিকে সাঁতার কাটি। বুকজলে আসতেই দেখি, মনমরা গোছের একটি প্যরোট ফিস বালুকায় চুপচাপ ভেসে আকাশ-পাতাল ভাবছে। আমি তাকে খুব কাছকাছি থেকে স্টাডি করি। মাছটির সবুজাভ-নীল অবয়বে লালচে রঙের ছোট ছোট ডোরা কাটা দাগ। কানকার কাছের বেগুনি রঙও ছড়াচ্ছে এক ধরনের সফ্ট আভা। ঘাঁই মেরে সে অতঃপর পালিয়ে গেলে আমি তার ভিজ্যুয়েল ইমেজ স্মৃতিতে ধারন করে ভেসে ওঠি।
ডাঙ্গায় ওঠে তোয়ালেতে গা মোছে, গতরে টিশার্ট গলিয়ে ব্যাকপ্যাকের সাইড পকেট থেকে বের করি জেড পাথরে মাছের আকৃতিতে তৈরী একটি লকেট, যা চেনে ঝুলিয়ে গলায় পরা যায়। বিয়াংকা তা দেখতে পেয়েই বলে,'দিস ইজ ভেরী প্রিটি এন্ড কুল।' সে লকেটটি হাতে নিয়ে পাথরের মসৃণতা পরখ করতে করতে বলে,'ইজ দিস আ রিয়েল জেড?' আমি জবাব দেই,'ইয়েস ইট ইজ। অনেক বছর আগে আমি চীন দেশের কুমিংয়ে ঘোরাঘুরির সময় জেড পাথরের ছোট্ট মাছটি খরিদ করি। আমি লকেটটি তেমন একটা ইউজ করি না। তবে মনে মনে খুঁজছি -- কারো এটি পছন্দ হলে গিফ্ট হিসাবে তা দিয়ে দেবো।' সে কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করে পাথরটি তুলে তাতে রোদের মৃদু ঠিকরানো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। আমি এবার সিদ্ধান্তে এসে বলি,'আই হ্যাভ আ সুপার ফাইন আন্ডার ওয়াটার এক্সিপিরিয়েন্স টু-ডে, আজকের দিনে জেড পাথরের সামান্য এ টুকরাটি তোমাকে দিতে পারলে আমার খুব ভালো লাগবে। উড ইউ লাইক টু হ্যাভ ইট।' সে লকেটটি আমার হাতে ফিরিয়ে দিতে দিতে চোখমুখে দুষ্টুমি ফুটিয়ে তুলে বলে,'ইয়েস, আই উইল একসেপ্ট দিস লিটিল স্টোন-ফিস অনলি ইফ ইউ..।' সে বাক্যটি শেষ না করলে আমি অধৈর্য হয়ে জানতে চাই,' হোয়াট অনলি ইফ..?' সে ফিক করে হেসে,' দেখছো না আমার শরীর থেকে কী রকম জল ঝরছে। যদি তুমি আমাকে এখন ড্রাই হতে একটু সাহায্য করো,' বলে সে আমার দিকে বাড়িয়ে দেয় একটি ভাঁজ করা তোয়ালে। 'নট অ্যাট অল আ বিগ চ্যালেঞ্জ', বলে আমি তার শরীর মুছিয়ে দেই। তারপর সে নিজেই লকেটটি পরে নিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেয়। আমি চুমো খেতে খেতে তার বাদামি ত্বকের মসৃণতা উপভোগ করি।
গায়ে-গতরে বালুকণা ও ঝরাপাতা মেখে একটু দেরি করেই আমরা ক্যাম্পগ্রাউন্ডে ফিরি। দেখি -- সিনিওর ডিগমার স্লিপিংব্যাগ, কুলার ইত্যাদি ক্যারি করে বোটের দিকে যাচ্ছেন। আমাদের বোটে উঠতে তিনি তাড়া দেন। ভাটির স্রোতে জল নেমে যাওয়ার আগে তিনি নৌকা ভাসাতে চান। মিনিট দশেকের ভেতর আমরা মাল-সামান গুছিয়ে চলে আসি বোটে। প্যান্টের পায়া গুটিয়ে জলকাদা ভেঙ্গে বোটে উঠতে গিয়ে দেখি, ওখানে আগে থেকেই চুপচাপ বসে আছে ক্রিসটেলা। তার চুলে গোঁজা ফুলটি আগুনের শিখার মতো ছড়াচ্ছে হলদে-লাল রঙের উজ্জ্বলতা। কুশন বিছিয়ে আমি জুত হয়ে সিটে বসি। ক্রিসটেলার সাথে চোখাচুখি হয়। সে লাজুক মুখে কনেবউটির মতো হাসে। তাতে তার গালের টোলে ছড়িয়ে পড়ে কমনীয় প্রসন্নতা। কিন্তু আমাদের মাঝে আজ আর কোন কথা হয় না। বোটম্যান নায়ের ইঞ্জিন চালু করে। জল কেটে কেটে বার-দরিয়ার দিকে যেতে যেতে আমি হুয়ান ভেনাডো দ্বীপের দিকে ফিরে তাকাই। বালুচর থেকে দ্রুত নেমে যাচ্ছে জল। একটি শুভ্র সারস নোনাজলে তার প্রতিবিম্ব ভাসিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেজায় নিমগ্ন হয়ে।