রোদের ঘ্রাণ আর বাতাসের রঙ
বিউটি পারলার-পাড়ার দোকান
কয়েক শতাব্দী ধরে ভারতে বিপুল সংখ্যক চীনা জাতির (হান বা ক্যান্টোনিজ) মানুষ বাস করেন। কলকাতার টেরিটিবাজার, টেংরা এলাকাগুলোতো চীনেপট্টি বলেই পরিচিত।ঢাকাতে চীনেপট্টি না থাকলেও আজিমপুরে চায়না বিল্ডিং আছে।শতাব্দী প্রাচীন অতিক্ষুদ্র চীনাগোষ্ঠী এখানে কলকাতার মতো জুতার ব্যবসা করেছেন কিনা জানি না তবে তারা চীনা রেস্তোরাঁ, চীনা লন্ড্রি আর বিউটি পারলারের ব্যবসা করেছেন। চীনাদের দেয়া লীফা (Li Hua) ড্রাই ওয়াশ লন্ড্রির কয়েকটা শাখা এখনো টিকে থাকলেও সেগুলোর মালিক আর চীনারা আছেন কিনা জানি না।
চীনা মেয়েদের দেয়া 'মেফেয়ার', 'হংকং', 'লী' আর 'লিলি' বিউটি পারলারগুলোর কথা অনেকের মনে থাকার কথা। বোধগম্য কারণে জীবনে কখনো কোন বিউটি পারলারের ভেতরে ঢোকার সুযোগ নাহলেও এটা মনে আছে যে বাঙালীদের মধ্যে জেরিনা আজগর প্রথম কাকরাইলের কোথায় যেন 'লিভিংডল' নামে বিউটি পারলার দিয়েছিলেন। তখন মেয়েদেরকে এমন সপ্তাহে সপ্তাহে বিউটি পারলারে যেতে দেখিনি। নিতান্ত বিয়ে বা বড় ধরনের অনুষ্ঠান থাকলে মেয়েরা পারলারে গিয়ে সেজে আসতেন।
তখন অবশ্য পারলারগুলো মূলত রূপচর্চ্চার জায়গা ছিল, এখনকার মতো শরীরের যত্ন নেবার জায়গা ছিল না। লিভিংডলের পর শান্তিনগরে 'গীতি'স', ধানমন্ডিতে 'বীথি'স', সিদ্ধেশ্বরীতে 'মধুপা' বিউটিপারলার খোলা হয়। সাজতে যাওয়া ছাড়া পারলারগুলোতে মেয়েরা চুল কাটাতে যেতেন—চায়নিজ কাট, বব্, ইউ-শেপ, থ্রিস্টেপস…স্ট্রেইট করা, কার্ল করা। চপস্টিকস চায়নিজ রেস্টুরেন্টের দোতলাতে ছিল 'ফেয়ারলেডি বিউটি পারলার'। চপস্টিকস উঠে যাবার পর ফেয়ারলেডি মগবাজার মোড়ের পূর্বদিকে টিউলিপ হেয়ারড্রেসারের কাছাকাছি চলে যায়। আরও পরে ফেয়ার লেডি পুরোপুরি উঠে যায়।
ঐ সময়ে অনেক পরিবারের মেয়েরা শখের বশে বাসায় উপটান বানাতেন। খুব হাতেগোনা কিছু দোকানে উপটান মিলতো। সিদ্ধেশ্বরীর 'নাজমা আন্টি'র বানানো উপটান বেশ জনপ্রিয় ছিল। নিউ এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যাল থেকে গাউছিয়ার দিকে যেতে, মানে উঠে যাওয়া মল্লিকা সিনেমা হলের রাস্তায় একটা দোকানে উপটানের সাথে মূলতানী মাটি, শ্বেতচন্দন ইত্যাদি রূপটানের নানা জিনিস পাওয়া যেতো। এখন বোধকরি মেয়েরা ঝামেলার বিষয়গুলো বিউটি পারলারের পেশাদারদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন তাই এসবের নাম নিয়ে বিশেষ আলোচনা শুনতে পাইনা।
কে যেন বলেছিলেন জাদুশিল্পী আজরা জ্যাবিন নাকি বিউটিশিয়ান জেরিনা আজগরের বোন।তথ্যের সত্যতা জানি না। জানার প্রয়োজনও নেই। তবে আজরা জ্যাবিন আমাদের সময়ের এক বিস্ময়। একজন নারী পেশাদার জাদুশিল্পী, যিনি পশ্চিমা পোশাক পরে ঘুরে বেড়ান, কারাতেতে ব্ল্যাক বেন্টধারী, গুণ্ডাদের দলকে একাই পিটিয়ে শায়েস্তা করেন, মোটর সাইকেল দাপিয়ে বেড়ান, জাপানী শিক্ষার্থী তাই জোইশিদা'র সাথে সম্পর্কের কথা গণমাধ্যমে অকপটে বলেন! এরসব কিছু আমাদের তখনকার চারপাশের মেয়েদের থেকে একেবারে ব্যতিক্রমী। বাংলা মোটরের কাছেএ-টুজেড নামে একটা অ্যাকুয়ারিয়ামের দোকান ছিল। লোকে বলতো সেটার মালিক নাকি আজরা জ্যাবিন তাই তার নাম 'এটুজেড'। এর সত্যতাও জানি না। তারও প্রয়োজন নেই। আমরা শুধু অপেক্ষায় থাকতাম কবে সবেধণ নীলমণি 'বিটিভি'তে আজরা জ্যাবিনের জাদু দেখানো হবে। জানি না তিনি কোথায় হারিয়ে গেলেন।
আইসক্রীম পারলার স্নোহোয়াইটের পাশের মাধবীলতায় ভরা গেটের বাসাটিতে গড়ে উঠেছিল আরেক নতুন জিনিস ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল 'ইউনিভার্সাল টিউটোরিয়াল'। কাছাকাছি সময়ে অ্যাসেমব্লিজ অব গড চার্চের পাশে হয়েছিল 'এজি চার্চ স্কুল'।স্কুল দুটো এখনো আছে, তবে ইউনিভার্সাল টিউটোরিয়াল সোহাগ কমিউনিটি সেন্টারের পাশে চলে এসেছে। এখন অবশ্য কোটি মানুষের স্মৃতিধন্য সোহাগ কমিউনিটি সেন্টারটি আর নেই। সেখানে বহুতল বাণিজ্যিক আর আবাসিক ভবন নির্মিত হচ্ছে। যেমন, রাস্তার আরেক মাথার 'কুইন্সগার্ডেন' কমিউনিটি সেন্টারটা ভেঙে অনেক বছর আগে বহুতল বাড়ি উঠে গেছে। সেক্রেড হার্ট স্কুল আর টুইট টিউটোরিয়াল হলো তো এই সেদিন! জিংহ্যাম চেক শার্ট যে কোন স্কুলের ইউনিফর্ম হয় সেটা ইউনিভার্সাল টিউটোরিয়াল ছাড়া আর কোথাও দেখিনি।
ইসমাইল লেনে ঢোকার মুখে একটা মাংসের দোকান ছিল। তাদের মাংস ছিল উন্নতমানের আর ব্যবহার ছিল নিম্ন মানের। এদের মাংসের সুনাম ছিল সেন্ট্রাল রোডের পুরনো মাংসের দোকানটার বা টিপু সুলতান রোডের বাদশাহের মাংসের মতো। যেদিন সকালে লম্বা, ঢোলা গাউন পরা মিসেস 'এম' মাংসের দোকানটাতে ঢুকতেন সেদিন অন্য ক্রেতারা দোকানের কর্মচারীদের মনোযোগ পেতেন না। মিসেস 'এম' বিপুল পরিমাণে মাংস কিনতেন—সারলোইন, টেন্ডারলোইন, টি-বোনস্টেক, আইস্টেক, বোন-ইন, বোনলেস। মোটামুটি সাপের খেলা দেখার মতো লোক জড়ো হয়ে যেতো দোকান কর্মচারীদের মাংস কাটার সার্কাস দেখার জন্য।
কথিত আছে পাড়ার সব ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মানুষ মিসেস 'এম'-এর সরাসরি পরিবারের সদস্য না হলেও তাঁর আত্মীয়স্বজন ছিলেন। ঐ দোকানে পাত্তা না পেলে লোকে রাস্তার উলটো দিকে দিলু রোডের ঢোকার মুখের মসজিদের নিচের মাংসের দোকানে যেতেন। সেখানে দুই ভাই উঁচু কাঠের গুড়িতে সাঁই সাঁই করে চাপাতি চালিয়ে কাটতেন করলি, সীনা, চুস্, ক্ষীরি, নলি…কাচ্চি কাট, তেহারী কাট, চায়নিজ কাট, রেজালা কাট, কিমা, চাপ…। ছুটির দিনগুলোতে বা শবে বরাত আর ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দোকান দুটোতে গরুর মাংস কিনতে আগ্রহী ক্রেতাদের ভীড়ে গলিতে রিকশা চলাচল বন্ধ হবার উপক্রম হতো।
সুপার শপ সংস্কৃতি বাজারে আসার আগে লোকে বাজারে গিয়ে এক বা একাধিক দোকান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতেন। ছোটখাটো প্রয়োজনে পাড়ার দোকান থেকেই কিনতেন। অনেকেই পাড়ার দোকানে মাস-বাকিতে জিনিস কিনতেন। সেসব দোকানে লাল রঙের সালু কাপড়ে বাঁধাই করা মোটাখাতা থাকতো। সেসব খাতায় বিভিন্ন জনের নামে তারিখ দিয়ে বাকির হিসাব লিখে রাখা হতো। পাড়ার দোকানদাররা অবশ্য বাকিতে বিক্রি করতে অনাগ্রহী ছিলেন।তারা দোকানে শক্ত, স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ভেতর কাগজে লেখা ঝুলিয়ে রাখতেন—
"নগদ বিক্রি পেটে ভাত
বাকি বিক্রি কপালে হাত"
অথবা
"যদি চান ভালোবাসা
না করিবেন বাকির আশা
লাভের আশায় বাকি দেয়া বড় কষ্ট
বাকিতে বন্ধুত্ব নষ্ট"
দোকানদারের ভালোবাসা পেতে লোকজনের বিশেষ আগ্রহ না থাকায় কেউ কেউ লিখে রাখতেন—
"আজ নগদ, কাল বাকি"
লোকজন আগামীকালের আশায় বসে না থেকে আজ থেকেই বাকি দেবার জন্য দোকানদারকে চাপাচাপি করতেন। ফলে পাড়ায় টিকে থাকার জন্য দোকানদারের বাকি দেয়া ছাড়া উপায় থাকতো না। মাঝে মাঝে দেশে দুঃসময় আসতো, তখন অনেক লোক কাজ হারাতেন। ফলে তারা পাড়ার দোকানের বাকি শুধতে পারতেন না। একদিন রাতে আঁধারে বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে সপরিবারে কোন এক অজানায় চলে যেতেন। আমরা ঘুম থেকে উঠে শুনতাম রয়েলদের পরিবার বা শাহীনাদের পরিবার কোথায় যেন চলে গেছে। এতে পাড়ার দোকানদার বিপদে পড়তেন। বকেয়া আদায় করতে না পেরে অনেক দোকান লোকসান গুনে বন্ধ হয়ে যেতো। আমরা বলতাম, মজিদের দোকানে লাল বাতি জ্বলেছে। দোকান বন্ধ
হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ছাড়া আর কোথাও আমরা 'লালবাতি' শব্দটা ব্যবহার করতাম না। কেন, কে জানে!
দিলু রোডে ঢোকার মুখে বাঁদিকে কয়েকটা দোকান ছিল। তার মধ্যে নারমিন আর সুফিয়া নামের দুটো মুদি দোকান ছিল। আর ছিল শাপলা মার্কেটের শুভেচ্ছা বিপণী। এই দোকানগুলোতে কাঁচাবাজারের জিনিস ছাড়া দুনিয়ার যেখানে হেন জিনিস নেই পাওয়া যেতো না—মোটামুটি এখনকার সুপার শপের মিনি ভার্সান। এসব দোকানে আবার হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা ছিল। সকালে গৃহকর্তা বাজারের লিস্ট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, রিপন, মালগুলো বাসায় পাঠিয়ে দিও তো। নারমিনের রিপন লিস্ট মিলিয়ে সদাইপত্র ব্যাগে ভরে একজন দোকান কর্মচারীকে দিয়ে ক্রেতার বাসায় পাঠিয়ে দিতেন।সন্ধ্যায় ক্রেতা বাসায় ফেরার মুখে বিল পরিশোধ করে যেতেন। দেশের বাড়ি একই জেলায় হওয়ায় রিপন আবার আমাদের একটু বাড়তি খাতির করতেন।
লক্ষ্মীপূজা শেষ হবার এক সপ্তাহ পরেও দোকানে গেলে ফ্রিজ খুলে লাড্ডুর বাক্স বের করে দিতে দিতে বলতেন, পূজা সেই কবে শেষ তাও আপনাদের বাসার কেউ দোকানে আসে না তাই ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখেছি।ভবন ভেঙে ফেলায় নারমিন দিলুরোডের অনেকটা ভেতরে চলে গেছে আর সুফিয়া নাই হয়ে গেছে। একইভাবে শাপলা মার্কেট ভেঙে ফেলায় শুভেচ্ছা বিপণী নাই হয়ে গেছে। শাপলার উলটো দিকে ছিল 'রাণুকা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর'—ঐ সময়ের ঢাকার হাতে গোনা কয়েকটা ডিপার্টমেন্ট স্টোরের একটা।
কথা বলার উপলক্ষ তৈরি করার জন্য নাইয়ারকে পথে থামিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা, স্যান্ডউইচ বানানোর জন্য চীজ কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারো?
অবাক চোখে তাকিয়ে নাইয়ার বিজ্ঞাপনের মতো করে বলেছিল, কেন, রাণুকা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে!
যেখানে রাণুকা ছিল এখন সেখানে বা তার কাছাকাছি জায়গায় সুপারশপ 'মীনাবাজার' হয়েছে। অর্থনীতির অবধারিত নিয়মে বৃহৎ পুঁজির আবির্ভাবে ব্যক্তি উদ্যোগ এভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কালের অমোঘ স্রোতে যেমন নাইয়ারের অবাক চোখে তাকানো কোথায় হারিয়ে গেছে।