রেল এলো বাংলায়…
১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল ভারতবর্ষে প্রথম বাণিজ্যিক ট্রেন চালু হয়।১৪ টি বগিতে ৪০০ যাত্রী নিয়ে ৩ টা ৩৫ মিনিটে বোরিবন্দর (বর্তমান মুম্বাই) থেকে ছেড়ে যায় ট্রেনটি। হাজার হাজার প্রফুল্ল জনতার হর্ষধ্বনির মধ্যে ২১ বার তোপধ্বনি দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্বাগত জানিয়েছিল নতুন যুগের সুচনাকে। সেই ট্রেন টেনেছিল সিন্ধ সুলতান এবং শাহিদ নামের তিনটি লোকোমোটিভ। ২১ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে থানেতে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল সোয়া এক ঘন্টা। বেসরকারি ইংরেজ বিনিয়োগকারীদের দ্বারা গঠিত গ্রেট ইন্ডিয়া পেনিনসুল রেলওয়ে কোম্পানি ছিল এই রেল লাইনের নির্মাতা ও পরিচালনাকারী।
ব্রিটেনে বসে তখন জার্মান অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্ক্স লিখেছেন, Modern industry, resulting from the railway system, will dissolve the hereditary divisions of labor, upon which rest the Indian castes, those decisive impediments to Indian progress and Indian power.
একটা প্রযুক্তি পুরো একটা সমাজকে বদলে দেবে, কার্ল মার্ক্সের সেই ভবিষ্যদ্বাণী বিফলে যায়নি। বোরিবন্দর- থানে রেল লাইন চালুর এক বছর পর ১০ আগস্ট ১৮৫৪ তে শোভাবাজার থেকে প্রকাশিত 'সম্বাদ ভাস্বর' পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দেখে কলকাতার মানুষ চমকে যায়। কি ছিল বিজ্ঞাপনে?
ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের বিজ্ঞাপন:
'সমাচার দেওয়া যাইতেছে যে, বর্তমান ১৫ই আগস্ট (১৮৫৪) মঙ্গলবাসরে ও তৎপরে নিম্নলিখিত নির্দিষ্ট সময়ানুসারে হাবড়া ও হুগলী হইতে রেইলওএর গাড়ি-সকল ছাড়িবেক, বালী, শ্রীরামপুর ও চন্দননগর থামিবেক।
হাবড়া হইতে পূর্ব্বাহ্ণে ১০ ঘন্টা ৩০ মিনিট ও অপরাহ্ণে ৫ ঘন্টা ৩০ মিনিটের সময় ছাড়িবেক।
হুগলী হইতে পূর্ব্বাহ্ণে ৮ ঘন্টা ২৩ মিনিট ও অপরাহ্ণে ৩ ঘন্টা ৩৮ মিনিটের সময় ছাড়িবেক।
সেপ্টেম্বর মাসের ৭ম দিবসে ও তৎপরে হাবড়া হইতে পাণ্ডুয়া পর্যন্ত গাড়ি-সকল চলিবেক, পথিমধ্যাবস্থিত যাবতীয় আড্ডায় থামিবেক।
যে সকল গাড়ি প্রথম শ্রেণী গাড়ি বলিয়া ব্যবহারার্থ আছে তাহা অতি ত্বরায় রহিত হইয়া তৎপরিবর্ত্তে অত্যুৎকৃষ্ট প্রকার গাড়ি সকল হইবেক সেই সকল গাড়ি সম্প্রতি নির্ম্মাণ করা যাইতেছে।
যাঁহারা স্বল্প মূল্যে মাসিক অথবা বাৎসরিক টিকীট ক্রয় করিতে অভিলাষ করেন তাঁহারদিগকে জ্ঞাত করা যাইতেছে যে তাঁহারা যে কোন আড্ডায় তদ্বিষয়ক প্রার্থনা জানাইলে জৌল (অস্পষ্ট) সকল লিখনের দ্বারা পূর্ণ করিয়া মেনেজিং ডাইরেক্টর ও এজেন্ট অর্থাৎ কর্ম্মাধ্যক্ষ সাহেবের সমীপে প্রেরিত হইবেক।
রেইলওএ কর্ম্ম সম্বন্ধীয় সমারোহপূর্ব্বক যাত্রী সর্ব্বসাধারণের সুবিধা জন্য আগামি ১৮৫৫ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত স্থগিত রহিল তৎকালীন রাণীগঞ্জ অবধি পথ মুক্ত হইবেক ঐ পথ ১২২ মাইল, এতজ্জন্য যে সমস্ত নিয়ম নির্দ্ধারণ করা যাইতেছে তাহারা যথাযোগ্য অগ্রিম বিজ্ঞাপন দেওয়া যাইবেক।
R. Macdonald Stephenson,
Managing Director & Agent
২৯ থিয়েটার রোড, কলিকাতা
৭ আগস্ট ১৮৫৪'
শেষমেশ রেল এলো বাংলায়। ১৮৫৪ সালের ১৫ ই আগস্ট হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত প্রথম বাণিজ্যিক ট্রেন যাত্রা করে। এই লাইনটি স্থাপন করেছিল বেসরকারি কোম্পানি ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি। মজার বিষয় সেদিন বিজ্ঞাপিত সময়ের দেড় ঘন্টা আগে ট্রেন ছেড়েছিল। কারণ এতো মানুষের ভিড় জমেছিল, এ ছাড়া আর উপায় ছিল না। সকাল সাড়ে আটটায় হাওড়া থেকে ছেড়ে দিয়ে সকাল ১০ টা ১ মিনিটে হুগলি পৌঁছায়। ট্রেনটিতে তিনটি শ্রেণি ছিল। প্রথম শ্রেণির ভাড়া ছিল ৩ টাকা দ্বিতীয় শ্রেণির ১ টাকা ২ আনা আর তৃতীয় শ্রেণির ৭ আনা।
বিজ্ঞাপন প্রকাশের দুই সপ্তাহ পর (২৭ আগস্ট ১৮৫৪) 'সম্বাদ ভাস্বর'-এ ছাপায় হয় ১৫ আগস্টের দিনের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ-
'আমাদিগের সম্পূর্ণ স্নেহ আছে'
লৌহবস্তু দিয়া বাস্পীয় শকট চলিতেছে। ইহাতে প্রতি দিবস হাবড়া শ্রীরামপুর ফরাসডাঙ্গা হুগলি এই চারিস্থানে লোকারণ্য হইতেছে লোকদের ভিড়ে টিকীট বিক্রয় গৃহে ক্রেতারা প্রবেশ করিতে পারেন না, যাঁহারা ঠেলাঠেলী করিয়া অতিকষ্টে অগ্রে যান তাঁহারাই টিকীট প্রাপ্ত হন। তদ্ভিন্ন প্রতি দিবস প্রতি আড্ডা হইতে দুই আড়াই শত লোক ফিরিয়া যাইতেছেন ইহাতে রেলরোড কোম্পানিদিগের লাভের হানিও হইতেছে, হাবড়া হইতে যাঁহারা হুগলি যাইবেন কিম্বা হুগলি হইতে যেসকল আরোহীরা কলিকাতায় আসিবেন তাঁহারা টিকীটের অধিক মূল্য দিবেন, কিন্তু সে সকল লোক বাহনী হয় না, হাবড়া হইতে যে সকল লোক শ্রীরামপুরে গমন করিবেন কিম্বা হুগলি হইতে যে সকল ব্যক্তি ফরাস ডাঙ্গায় আসিবেন তাঁহারাই অগ্রে টিকীট লইয়া যান অধিক মূল্যদাতাদিগের ফিরিয়া যাইতে হয় ইহাতে ঐ সকল ব্যক্তিরা দুঃখ পান এবং রেলওএ কোম্পানিদিগের পক্ষেও লাভের অনেক ব্যাঘাত হয়, আর বহু জনতা ইহাও হইতেছে নীচ শ্রেণীতে গমনীয় টিকীটে ক্রেতারা উচ্চশ্রেণীতে যাইতেছেন আমরা রেলরোড কোম্পানিদিগের লভ্যের উন্নতি দেখিয়া আহ্লাদিত হইয়াছি অতএব প্রার্থনা করি এই সকল গোল নিবৃত্তির কোন সদুপায় হয়, হুগলি হইতে কলিকাতা, কলিকাতা হইতে ফরাসডাঙ্গা অর্থাৎ দূর দূর গমনশীল ব্যক্তিগণ যাঁহারা অধিক মূল্য দিয়া টিকীট ক্রয় করিবেন অগ্রে বাহিরে তাঁহারদিগের বাহনী করা যায় তৎপরে তাঁহাদেরই অগ্রে টিকীট বিক্রয়ের ঘরে প্রবেশ করিতে পারেন অগ্রে তাঁহাদিগকে টিকীট বিক্রয় করিয়া যদি টিকীট থাকে তবে নিকট নিকট গমনাভিলাষী ব্যক্তিগণকে দিবেন ইহাতে রেলরোড কোম্পানিরাও লভ্যে বঞ্চিত হইবেন না এবং নিকট নিকট গমনেচ্ছু ব্যক্তিরাও অধিক দুঃখ পাইবেন না, এই ক্ষণে বাষ্পীয় শকটে গমনার্থে যত লোক উৎসাহিত হইয়াছেন তাঁহারদিগের গমনোপলক্ষে গাড়ি সকল প্রস্তুত হয় নাই অতএব তাঁহারদিগের সকলের গমনোপযুক্ত গাড়ি সকল শ্রীঘ্র প্রস্তুত হউক, যাঁহারা এই বিষয়ে লভ্য করিতে উৎসুক হইয়াছেন তাঁহারা অতি শীঘ্র অধিক গাড়ী প্রস্তুত করিলে দেখিতে পাইবেন প্রতিদিবস গাড়ি ভাড়ার টাকা রাখিবার স্থান পাইবেন না।
রেলরোড বিষয়ে প্রথমাবধি আমরা অধিক পরিশ্রম করিয়াছি রোল রোড কর্ম্মাধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত আর এম স্টীফেনসন সাহেব এ বিষয়ের অনুষ্ঠান কালে পত্রদ্বারা আমারদিগকে তাঁহার বাসস্থলে লইয়ে গিয়াছিলেন এবং রেলরোড বিষয়ে সর্ব্বসাধারণের প্রবৃত্তি জানাইবার জন্য আমারদিগকে অনুরোধ করেন তাহাতে আমারদিগের সহিত তাঁহার যেসকল কথোপকথন হইয়াছিল তাহা সাহেবের স্মরণ থাকুক না থাকুক আমরা যাহা স্বীকার করিয়াছিলাম তদনুরূপ কর্ম্ম করিয়াছি সাহেবের রেলরোড কার্য্যের বিস্তারতা বিষয়ে ইংরাজী ভাষায় তাবদভিপ্রায় মুদ্রাঙ্কিত করিয়া আট শত পুস্তক আমারদিগের নিকট পাঠাইয়াছিলেন আমরা কলিকাতায় এবং জেলায় জেলায় ধনিলোকদিগের নিকট তাহা পাঠাইয়া এবং অনেক লিখিয়া সকলের চিত্তাকর্ষণ করিয়াছিলাম এই কারণ রেলরোডের বিষয়ে আমারদিগের সম্পূর্ষ স্নেহ আছে অতএব রেলরোড কর্ম্মচারী বিধানদিগকে লভ্যের বিষয়ে উপরে লিখিত পরামর্শ দিলাম তাঁহারা যেন ইহা স্মরণ রাখেন।
(১৩ মার্চ ১৯৪৯, দৈনিক যুগান্তর)
প্রথম দিনের ট্রেন যাত্রা নিয়ে কিছু মজার ঘটনা 'বেঙ্গল হরকরা' নামে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। রূপচাঁদ ঘোষ নামে এক ব্যবসায়ী স্টেশনে নেমে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, এত তাড়াতাড়ি সত্যিই হুগলি পৌঁছেছেন কি না। হুগলি স্টেশনে নেমে উনি জনে জনে জায়গার নাম জিজ্ঞেস করছিলেন। পণ্ডিত রাধালঙ্কার ব্যানার্জি নামে এক জ্যোতিষী পাঁজি-পুঁথি বিচার করে ট্রেনে উঠেছিলেন। হুগলিতে নেমে মন্ত্রপাঠ শুরু করে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, আগুনে গাড়িতে আয়ু কমে যাবে, এই অজুহাতে আর ট্রেনে ফেরেননি। মিস্টার জোন্স নামে এক সাহেবের ধারণা ছিল তাঁর ঘোড়ার গাড়ি ট্রেনের সঙ্গে ছুটতে পারে। লাইনের ধার দিয়ে ট্রেনের সঙ্গে পর পর তিনদিনের চেষ্টায় ক্রমাগত চাবুক মারতে মারতে ঘোড়াকে মেরেই ফেলেন তিনি।
সেসময় রেলকে নিয়ে বাংলায় কি আলোড়ন তৈরি হয়েছিল তা কালীপ্রসন্ন সিংহের 'হুতুম পেঁচার নকশা' পড়লে বোঝা যায়। সেখানে রেলওয়ে নামে একটি অধ্যায় আছে।
এবার একটু পেছন ফিরে দেখা যাক।
ইংল্যান্ডের নিউ ক্যাসেল কয়লা খনির এক শ্রমিক ভাবছিল, রেললাইনের উপর দিয়ে যে ট্রলিগুলোকে ঠেলে নিয়ে যেতে হয়, তা যদি যন্ত্র শক্তি দিয়ে করা যেত! তাহলেমানুষ ও ঘোড়ার কষ্ট অনেকটা লাঘব হয়। পরে সেই শ্রমিক খনির লিফটে কাজ করার সুযোগ পায়। ফলে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ খুলে যায়। তখন থেকে সে উঠে পড়ে লাগে এমন একটা যন্ত্র বানাবার কাজে। ১৮১৪ সালে আসে সাফল্য। কয়লার ট্রলিগুলোর মাথায় বাষ্প ইঞ্জিন লাগিয়ে দিব্যি একটা ট্রেন বানিয়ে ফেলল সেই। সেই শ্রমিকের নাম জর্জ স্টিফেনসন।
১৮১৯ সালে নিজ উদ্যোগে সান্ডারল্যান্ডে ৮ মাইল দীর্ঘ রেললাইন বসান তিনি। সে বছরই প্রথম মেশিন নির্ভর রেলওয়ে যাত্রা শুরু হয়। এটা মোটামুটি সাড়া ফেলে দেয় পুরো ইংল্যান্ডে। শিল্প উদ্যোক্তারা স্টিফেনসনের পেছনে টাকা ঢালতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
এদের অর্থায়নে ১৮২১ থেকে ২৫ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের স্টকটন থেকে ডার্লিংটন পর্যন্ত পৃথিবীর প্রথম বাণিজ্যিক রেললাইন স্থাপন করেন স্টিফেনসন। ১৮২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর স্টকসন থেকে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক ট্রেন ছাড়ে। এর পর অবশ্য ইংল্যান্ডে অনেকেই রেলের ইঞ্জিন তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। সফলও হয়েছেন। কিন্তু কে কতটুকু এগোলো বাজিয়ে দেখা দরকার। ইঞ্জিনের গতি ও শক্তি নিয়ে তাই একটা প্রতিযোগিতা ডাকা হলো। ১৮২৯ সালে সে প্রতিযোগিতায় দেখা যায় স্টিফেনসনের ইঞ্জিন 'রকেট' ৬ টন মাল নিয়ে ৩৬ মাইল বেগে ছুটতে সক্ষম। সে সময় এই বেগ ছিল অবিশ্বাস্য। দ্রুত স্টিফেনসনের নাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ব্রিটিশ সরকার তাকে লিভারপুল থেকেম্যাঞ্চেস্টার পর্যন্ত রেল লাইন বসানোর কাজ দেয়।
১৮৩০ সালে সফলভাবে শহর দুটির মধ্যে রেল যোগাযোগ চালু হয়। লিভারপুর এন্ড ম্যাঞ্চেস্টার (এল এন্ড এম) রেলওয়ে কোম্পানির সাফল্যে অন্যান্য বিনিয়োগকারীরা রেলওয়েতে বিনিয়োগে উৎসাহী হয়ে ওঠে।
তখন মাত্র শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। ইংল্যান্ডে একটি স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে। তাদের হাতে বেশ টাকা। তারা বিনিয়োগ করে আরো মুনফা পেতে চায়। কিন্তু হঠাৎ করে ইংল্যান্ডে ব্যবসা বাণিজ্যে একটা মন্দভাব দেখা দিল। ব্যাংকগুলোও তাদের সুদের হার কমিয়ে দিল সরকারের ইশারায়। সরকার চায় সরকারি বণ্ডে লোকে বেশি বিনিয়োগ করুক।
রেলের হুজুগ
১৭২০এর সাউথ সি কোম্পানির আর্থিক কেলেংকারির কারণে ব্রিটিশ সরকার জনসাধারণের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ নিষিদ্ধ করে দেয়। ৫ জনের বেশি বিনিয়োগকারী নিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়া যাবে না বলে আইন করে। কিন্তু ১৮২৫ সালে এই আইন তুলে নেয়া হয়।এতে নতুন গজিয়ে ওঠা মধ্যবিত্ত শ্রেণি বড়ো বড়ো ব্যবসায় স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে বিনিয়োগের সুযোগ পায়। সুযোগ পেয়েই দেখল সামনে সবচেয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রেলওয়ে খাতে। এল এন্ড এম কোম্পানিরও তখন প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। ৬ লক্ষ ৩৭ হাজার পাউন্ড। যারা বিনিয়োগ করল কিছুদিনের মধ্যে লাভের ভাগ পেতে লাগল।
এল এন্ড এম কোম্পানির সাফল্য অনুপ্রাণিত হয়ে অন্যরাও কোম্পানি গঠন করে পুজিঁবাজারে শেয়ার ছেড়ে দিল।শেয়ারের মূল্যের ১০% অগ্রিম দিয়ে অগ্রিম শেয়ার কিনতে হবে। বাকি ৯০% কোম্পানি কাজ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে চাওয়া মাত্র দিতে বাধ্য থাকার শর্তে শেয়ার দেয়া হত।
৪০-এর দশকে এসে আবার অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব দেখা দিল। ব্যাংকগুলো সুদের হার কমিয়ে দিল। জনগণ সরকারি বণ্ড থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। আর এই সময় রেল কোম্পানিগুলো শেয়ার বাজারে ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগল। মানুষ হুজুগের মধ্যে পড়ে ভিটামাটি বিক্রি করে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে লাগল। হু হু করে বাড়তে লাগল শেয়ারের দাম।
সবাই যে গড্ডাল প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল তা নয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এমপিদের মধ্যে কেউ কেউ রেলওয়ের পরিবেশ দূষণের কথা ভেবে এর বিরোধিতা করেছিলেন। এমনই একজন Mr. Creevy বলেছিলেন, ... Railway committee in support of this infernal nuisance- the loco-motive monster, carrying eighty tons of goods, and navigated by a tail of smoke and Sulphur, coming thro' every man's grounds between Manchester and Liverpool.রেল লাইন স্থাপনের উদ্যোগকে তিনি ইনফার্নাল নুইনসেন্স এবং রেল ইঞ্জিনকে লোকোমোটিভ মনস্টার বলেছিলেন।
তখন ব্রিটিশ পত্রিকাগুলো রেল নিয়ে নিয়মিত কার্টুন প্রকাশ করত। এরকম একটি কার্টুন দেখা যাচ্ছে: রেলযাত্রীকে ট্রেনে ওঠার আগে হাড়ভাঙার ডাক্তারের দালাল চিকিৎসকের ঠিকানা দিচ্ছে। ট্রেনে যেহেতু দুর্ঘটনা ঘটবেই, ঠিকানাটা নিয়ে রাখলে ভালো।
বিরোধিতারও মূল্য আছে। রেলকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া বিশৃঙ্খলার রাশ টেনে ধরতে ১৮৪০ সালে ব্রিটিশ সরকার রেল লাইন স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করে পার্লামেন্টে। এই আইনে রেললাইন স্থাপন দেখভালের দায়িত্ব বোর্ড অফ ট্রেডকে দেয়া হয়। এ আইনের প্রধান বিষয়বস্তুগুলো ছিল-
-
বোর্ড অফ ট্রেডের অনুমতি ব্যতীত রেল লাইন স্থাপন নিষিদ্ধ;
-
বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন দাখিল;
-
বোর্ড অফ ট্রেড রেলওয়ে ইন্সপেক্টর নিয়োগ;
-
কোন রেল কর্মচারীর মদ্যপান নিষিদ্ধ;
-
রেল কোম্পানি আইন বোর্ড অফ ট্রেড কর্তৃক অনুমোদন দান;
-
রেললাইন স্থাপনে বাধা দূরিকরণ।
এদিকে ব্রিটিশ সরকার সারা ব্রিটেনে রেল লাইন প্রসারের স্বার্থে কোম্পানিগুলোকে প্রশ্রয় দিতে লাগল। বলা হল রেল কোম্পানি স্থাপনের জন্য পার্লামেন্টে বিল পাস করতে হবে কোম্পানিগুলোকে। নইলে ভূমি দেয়া হবে না। কোম্পানিগুলো পার্লামেন্টে গেলেই তাদের অনুমতি দিয়ে দেয়া হলো। দেখাও হলো না কোম্পানিগুলোর কেমন সামর্থ্য আছে। তাদের প্রস্তাবগুলো কতটা বাস্তবসম্মত। লোকজন ইচ্ছামত কোম্পানি গঠন করে বিল পাস করিয়ে নিতে লাগল। এই সময় আড়াই শ টির মতো রেল কোম্পানির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল।
একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ১৮৩৬-৩৭ সালে ৩৫ মিলিয়ন পাউন্ডের ১৫০০ মাইল রেল লাইন স্থাপনের প্রস্তাব পাস করে পার্লামেন্ট। ১৮৫-৪৭ সেটা গিয়ে দাঁড়ায় ১৭০ মিলিয়ন পাউন্ডে। এক বছরেই ৩৩০ টি রেলওয়ে এক্ট পাস হয়।
কোম্পানিগুলো জনসাধারণকে ভুলভাল বুঝিয়ে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে লাগল। যে শেয়ার ১০ টাকা দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, কয়েকদিন পর বলা হল তৈরির ব্যয় বেড়ে গেছে, আরো ১০ টাকা দিতে হবে। লোকজন হাসি মুখে দিল। কিছুদিনের মধ্যে প্রকৃত চিত্র প্রস্ফুটিত হতে লাগল। যেভাবে সোনার খনির মতো করে টাকা আসবে ভেবেছিল তা হলো না। বেশির ভাগ ছোট ছোট কোম্পানি সরকারি অনুমতি নিয়ে কোন কাজেই গেল না। ফলে বিনিয়োগকারীদের অর্থ জলে গেল।
এদিকে ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে দিল। সরকারও বাড়াল বন্ডের মুনফা। হুট করে বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিল রেল কোম্পানিগুলোর দিক থেকে। এই উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে রেলকে নিয়ে লন্ডনে যে উন্মাদনা শুরু হয় তা ইতিহাসে রেল ম্যানিয়া নামে পরিচিত।
দুর্ভাগ্য বাঙ্গালীর
ততদিনে অবশ্য ভারতে রেল এসে গেছে। তবে বাণিজ্যিকভাবে রেল লাইন বসানো শুরু হয়নি। মাদ্রাজে স্বল্প দূরত্বের দুটো রেললাইন বানানো হয়েছিল বাঁধের পাথর আর রাস্তার গ্রানাইট আনার জন্য। ব্রিটিশ সরকারের আইনের আলোকে ১৮৪৪ সালে ভারতের গভর্নর-জেনারেল লর্ড হেনরি হার্ডিঞ্জ বেসরকারি সংস্থাগুলিকে ভারতে রেলপথ স্থাপন করার অনুমতি দেন। কিন্তু এতে যে ব্রিটিশ বিনিয়োগকারীরা খুব একটা আকৃষ্ট হচ্ছিল তা কিন্তু না। এদিকে সরকারের সেই সামর্থ্য নেই বিশাল ভারতে রেল নেটওয়ার্ক স্থাপন করার। ভারতের রেল খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৯ সালে গ্যারান্টি সিস্টেম চালু করে। এর মূল বিষয় বস্তু ছিল-
-
৯৯ বছরের জন্য বিনামূল্যে ভূমি দেয়া হবে।
-
প্রত্যেক বিনিয়োগকারী কোম্পানিকে সাড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ লাভের নিশ্চয়তা দেয়া হবে। ২২ সেন্টকে ১ রুপি হিসেবে ধরে এই লাভ ক্ষতির হিসাব করা হবে।
-
৫ শতাংশের উপরে যে লাভ হবে তা সরকারের সঙ্গে ভাগ বাটোয়ারা হবে।
-
রেল লাইন নির্মাণ তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকবে।
-
২৫ বছর পর রেললাইন সরকার গ্রহণ করে নেয়ার ক্ষমতা রাখবে।
-
৬ মাসের নোটিশে রেল লাইন সরকারের কাছে ফেরত দিতে পারবে কোম্পানিগুলো। তখন সরকার কোম্পানিগুলোকে তাদের বিনিয়োগ ফিরিয়ে দেবে।
ইংল্যান্ডের রেল ম্যানিয়ার মাঝে ১৮৪২ সালের জানুয়ারিতে এক বাঙ্গালী উদ্যোক্তা ইংল্যান্ডে পা রাখেন। বাষ্পীয় শকটের অত্যাশ্চর্য কর্মকাণ্ড দেখে তিনি বিমোহিত হয়ে যান। বুঝতে পারলেন ভবিষ্যত ভারতের ভাগ্য লেখা আছে এই যন্ত্রটির সঙ্গে। সেই বাঙ্গালী হলে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ। জাহাজ, বীমা, ব্যাংক, নীল ব্যবসার বদৌলত তার হাতে তখন প্রচুর অর্থ। ১৮৪৩ এ দেশে ফিরে তিনি গঠন করেন গ্রেট ওয়েস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি। তাতে সব দেশী ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ। যেমন- রামরতন রায়, নরসিংহচন্দ্র রায়, ব্রিজনাথ ধর এবং পার্সি ব্যবসায়ী রুস্তমজি কাওয়াসজি। পরে তা তিনি লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত করান।
এদিকে জর্জ স্টিফেনসন রেল লাইন পাতার কাজ করে রীতিমতো ধনী হয়ে যান। শুধু তাই নয় ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ ধনীদের তালিকায় ঠাঁই করে নেন। তার পরিবারের লোকজনও নেমে পড়ে ব্যবসায়। তার ভাতিজা রোনাল্ড ম্যাকডোনাল্ড স্টিফেনসন কলকাতায় রেল লাইন পাতার জন্য ১৮৪৫ সালের ১ জুন একটি কোম্পানি গঠন করেন। নাম ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি। কোম্পানিটির প্রাথমিক মূলধন ছিল ৪০ লক্ষ পাউন্ড। ১৩ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হন স্টিফেনসন। কোম্পানির পক্ষ স্টিফেনসন ভারত সফরে আসেন। রেল লাইন স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই করে যান।
যেহেতু ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানিতে কেবল ব্রিটিশ বিনিয়োগকারী তাই ভারত শাসনকারী প্রতিষ্ঠান ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানি তাদের প্রতিই ঝুঁকল। স্টিফেনসন ইংল্যান্ডে গিয়ে কোম্পানিকে রিপোর্ট দেন ভারতে রেল লাইন পাতলে প্রচুর মুনফা আসবে।
ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের পক্ষে তিনি প্রস্তাব দেন প্রথম পর্যায়ে বর্ধমানের কয়লা খনি এলাকার মধ্য দিয়ে কলকাতা থেকে বেনারসের মির্জাপুর পর্যন্ত রেল লাইন পাতার। পরবর্তীতে সুযোগ ও সুবিধা মত তা দিল্লি পর্যন্ত বিস্তৃত করা যাবে।
রানিগঞ্জের কয়লা খনির কয়লা পরিবহনের বিশাল ব্যবসা ছিল ঠাকুর পরিবারের। তাই দ্বারকানাথ পরিকল্পনা করলেন রানিগঞ্জ, রাজমহল, হাওড়ার মধ্যে রেল লাইন পাতার৷ দ্বারকানাথ ১৮৪৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে সে প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু দ্বারকানাথের প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায় ভারতীয় বলে। শেষ চেষ্টা হিসেবে তিনি স্টিফেনসনের সঙ্গে যৌথ ব্যবসা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্টিফেনসন রাজি হলো না। এই বছরই আগস্ট মাসে দ্বারকানাথ দেহত্যাগ করেন।
নতুন ফেয়ারি টেলস
১৮৪৭ সালে গ্রেট ওয়াস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি স্টিফেনসনের ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে যায়।
এর মধ্যে বলে নেই, রেলওয়েকে নিয়ে ফটকাবাজি ইংল্যান্ডের মতো কলকাতাতেও হয়েছিল। ১৮৩০সালে ইংল্যান্ডে যাত্রিবাহী ট্রেন চলা শুরু হওয়ার পরে পরেই কলকাতা থেকে ভগবানগোলা পর্যন্ত ট্রেন রেলপথ নির্মাণের জন্য আগ্রহ দেখিয়ে 'সেন্ট্রাল বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি' নামে এক বই ছাপিয়ে একদল লোক অর্থ সংগ্রহে নেমে পড়ে।১৫ লক্ষ টাকা তারা তুলেছিলে। অবশ্য অর্থ ও উদ্যোক্তা কাউকে আর পরে খুঁজে পাওয়া যায় নি।
কিন্তু বাঙ্গালীর রেল ভাগ্য ভালো ছিল না। ইংল্যান্ড থেকে আসা ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির রেলের কামরা বোঝাই জাহাজ এইচএমএস গুডউইন গঙ্গাসাগরের কাছকাছি এলাকায় ডুবে যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের লোকজন বুঝতে পারলেন এভাবে জাহাজে করে রেলের কামারা আনা যাবে না। অগত্যা 'মেসার্স স্টুয়ার্ড অ্যান্ড কোম্পানি' এবং 'মেসার্স সেটন অ্যান্ড কোম্পানি' নামের দুটো ঘোড়ার গাড়ির কোচ তৈরির কোম্পানিকে রেলের কামরা তৈরির আদেশ দেয়া হয়। এ দুটো কোম্পানির যেহেতু পূর্বের অভিজ্ঞতা ছিল না, তাই তারা রেলের কামরা তৈরিতে বেশ সময় নিয়ে নেয়।
এদিকে যে জাহাজটি রেল ইঞ্জিন নিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিল সেটা পথ ভুলে অস্ট্রেলিয়া চলে যায়। পরে ইঞ্জিনটি ডেকাগ্রি নামের একটি জাহাজে করে কলকাতা আসে। সেই ইঞ্জিনটির নাম ছিল ফেয়ারি কুইন।
এ এই ফেয়ারি কুইনই বাংলার মাটিতে নতুন ফেয়ারি টেলসের জন্ম দিল। এই ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির উদ্যোগে ১৮৫৪ সালের ১৫ আগস্ট হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত (৩৭ কিমি অথবা ২৩ মাইল) যাত্রীবাহী ট্রেন চালু শুরু হয়।
পূর্ববঙ্গে রেলওয়ে
১৮৫৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি এই রেল লাইনটি রানীগঞ্জ পর্যন্ত বর্ধিত হয়। কিন্তু এর আগেই মেজর গ্রেট হেড নামের এক ব্রিটিশ প্রকৌশলী কলকাতা থেকে যশোর, ফরিদপুর হয়ে ঢাকা পর্যন্ত রেল লাইন স্থাপনের জরিপ করেন। সেই জরিপের ফলাফল তিনি সরকারের কাছে জমা দেন।
এদিকে দেখা গেল মেজর গ্রেটের প্রস্তাবিত রুটে লাইন স্থাপন করলে পথে ১৪ টি বড়ো নদী পড়বে। এর মধ্যে একটির প্রস্থ প্রায় আড়াই মাইল। ১৮৫৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্যোগে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৮৫৭ সালেল ২৫ আগস্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্ট Eastern Bengal Railway Act 1857 (20 & 21 Vict. c.159) আইন পাস করে। যার ভিত্তিতে কোম্পানিটি পূর্ববঙ্গে রেল লাইন স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে ১ মিলিয়ন পাউন্ডের ৫০ হাজারটি শেয়ার লন্ডনের শেয়ার বাজারে ছাড়ে। ইঞ্জিনিয়ার পার্ডনকে প্রস্তাবিত রেললাইনের নকশা ও ব্যয় চূড়ান্তকরণের দায়িত্ব দেয়া হয়।
এর মধ্যে ভারতবর্ষে শুরু হয় সিপাহী বিদ্রোহ। সে কারণে কিছুটা থমকে যায় এর কার্যক্রম। সিপাহী বিদ্রোহ শেষ হলে কলকাতা-কুষ্টিয়া রেললাইন বসানোর কাজটি চূড়ান্ত করা হয়। রেল কোম্পানি রেল লাইন স্থাপনের জন্য দরপত্র আহ্বান করে। মেসার্স ব্রেসী ও পেক্স এ্যান্ড ওয়াইটেস কাজটি পায়। ১৮৫৮ সালের ১ নভেম্বর নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা কলকাতা আসেন। শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। ১৮৬২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে রানাঘাট এবং ১৫ নভেম্বর রানাঘাট থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল শুরু হয়। নদীবিধৌত পূর্ববঙ্গের নরম মাটি বাষ্পীয় শকটের সদম্ভ পদভারে প্রকম্পিত হতে লাগল। দূর্গা-অপুরা অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল নতুন যুগের এই বার্তাবাহকের দিকে। দুর্ভিক্ষ পীড়িত বাংলায় খাদ্য নিরাপত্তা অনেকটা সুসংহত। অন্যদিকে আরো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল ব্রিটিশ শাসনের নিগড়।
১৮৭১ সালে এই রেললাইন গোয়ালন্দ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ঢাকা-ময়মনসিংহ স্টেট রেলওয়ে কর্তৃক ১৮৮৪ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের কাজ শেষ হয়ে গেলে পূর্ব বঙ্গের সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগের নতুন যুগের সুচনা হয়। রাতের ট্রেনে কলকাতা থেকে যাত্রা করে ভোরে গোয়ালন্দ ঘাট। তারপর স্টিমারে পদ্মা পার হয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্রেন ধরে দুপুরের মধ্যে ঢাকা। তিন দিনের পথ ১৭ ঘন্টায় নেমে এলো। ১৮৯৯ সালে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ রেললাইনটি জগন্নাথগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
আসামের চা মালিকদের চাপে ১৮৯২ সালে ব্রিটিশ সরকার আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি গঠন করে। এই কোম্পানি শুরু করে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে আসামের চা বাগানগুলোর রেললাইন স্থাপনের কাজ। এ কোম্পানির উদ্যোগে ১৮৯৫ সালের ১ জুলাই, প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ চট্টগ্রাম–কুমিল্লা এবং ৬০. ৫৪ কিলোমিটার দীর্ঘ লাকসাম–চাঁদপুর মিটারগেজ সেকশন দুটি চালু হয়। পরের বছর কুমিল্লা-আখাউড়া ও আখাউড়া-করিমগঞ্জ সেকশন চালু হয়। যা পরবর্তীতে (১৯০৩) আসামের তিনসুকিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
এভাবে পূর্ববঙ্গে স্নায়ুতন্ত্রের মতো রেল যোগাযোগ প্রসারিত হতে থাকে।
তথ্যঋণ:
-
সাবেক কলকাতার ইতিকথা, জলধর মল্লিক
-
পূর্ব বাংলার রেলওয়ের ইতিহাস ১৮৬২-১৯৪৭, দিনাক সোহানী কবীর
-
সম্বাদ ভাস্বর-এর পুরনো সংখ্যা
-
দৈনিক যুগান্তর (কলকাতা)
-
The Railway Regulation Act 1840 (3 & 4 Vict c 97)
-
The Creevey Papers: A Selection from the Correspondence and Diaries of the ..., By Thomas Creevey
-
The Future Results of British Rule inIndia, Karl Marx
-
উইকিপিডিয়া
-
বাংলাপিডিয়া
-
eisamay